ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘ওয়েল বিগান ইজ হাফ ডান’। অতএব, শুরুটা ভালো হওয়া চাই। ভিত সুন্দর এবং মজবুত হলে তবেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। শিশুরা কাঁচা বাঁশ কিংবা নরম মাটির মতো। তাই নরম থাকা অবস্থায় তাকে ইচ্ছে মতো সুন্দর রূপ দেওয়া যায়। আর শিশুকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার শিল্পী বা কারিগর কিন্তু শিশুর মা-বাবা। শুধু ভালো স্কুল-এ ভর্তি, ভালো লেখাপড়া কিংবা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালেই শিশুর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব নয়। শিশুকে সহবতও শেখাতে হবে। যাতে তার ব্যবহারে ভদ্রতা, নম্রতা এসব বজায় থাকে। যেন সে মিশুকে এবং দয়ালু হয়, স্বার্থপর না হয়, অন্যকে সাহায্য করে, সহানুভূতি দেখায়। কারণ, শিশুরাই সমাজ এবং দশের ভবিষ্যৎ। মনে রাখবেন, সহবত শেখানো এবং দেখানো, দুটি বিশেষ গুণ। এই গুণ-কে ছোটো থেকে লালন করতে পারলে নিজের এবং অন্যের সবার-ই মঙ্গল। মা-বাবা যদি তাদের সন্তানকে ছোটো থেকে সহবত না শেখান, তাহলে যে কী কী হতে পারে, তেমন-ই কিছু ঘটনার উল্লেখ করছি এখানে।
বিয়ের পাকা দেখা চলছে। মেয়ের বাড়ির লোকেরা উপস্থিত ছেলের বাড়িতে। টেবিলে জল, মিষ্টি, চা প্রভৃতি দেওয়া হয়েছে অতিথিদের। এমন সময় ওই বাড়ির একটি বাচ্চা ছেলে নিজের ছোট্টো সাইকেলে চড়ে এ-ঘর, ও-ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে বাড়ির কেউ থামাচ্ছেও না। অতএব, বিপর্যয় ঘটার-ই ছিল! বাচ্চাটি সাইকেলে চড়ে জোরে এসে ধাক্বা মারল টেবিলে। মুহূর্তের মধ্যেই চা, মিষ্টি, জল সমস্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কাচের বাসনপত্র ভেঙে একাকার। অনেকের গায়ে গরম চা পড়ে সে এক করুণ পরিস্থিতি। ‘বাচ্চা ছেলে কী আর করা যাবে’ বলে হাসিমুখে তাৎক্ষণিক ভালো প্রতিক্রিয়া দিলেও, পরে মেয়ের বাড়ির লোকেরা সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। অতিথিদের সামনে কী সহবত দেখাবে বাচ্চা, তা যে বাড়িতে শেখানো হয় না, সেই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়ে সুখী হবে না, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ির লোকেরা। কার্যত, বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে যায়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, তাকে যে ঠিক মতো সহবত শেখানো হয়নি, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল একটি ঘটনায়। প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে তাঁর ছেলে রিন্টু ছাড়াও কয়েকজনকে পড়াতেন এক শিক্ষক। একবার পড়ুয়া এবং শিক্ষককে পায়েস খেতে দিয়েছেন রিন্টুর মা। আর রিন্টুকে বলেছেন পড়া শেষ হলে খেতে দেবেন। এ কথা শুনে রিন্টু হঠাৎ উঠে চলে গেল। খানিক বাদে আবার পড়ার ঘরে ঢুকল হাসতে হাসতে। এর ঠিক এক মিনিট বাদে রিন্টুর মা ভেজা কাকের মতো হয়ে ঢুকলেন পড়ার ঘরে এবং রুটি গড়ার বেলনা দিয়ে রিন্টুকে পেটাতে থাকলেন শিক্ষকের সামনেই। কী হয়েছে শিক্ষক জানতে চাইলে রিন্টুর মা জানালেন, পড়া শেষ হলে খেতে দেব বলায়, গায়ে এক বোতল জল ঢেলে দিয়ে এসেছে। গড়া রুটি, পায়েস সব নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, শীতকালে ফ্রিজে রাখা কনকনে ঠান্ডা জল মাথায় ঢাললে কী কষ্ট হতে পারে, তা বেশ টের পেয়েছিলেন রিন্টুর মা।
বাড়িতে আসা অতিথিদের মুখোমুখি বসে খাচ্ছিল পিঙ্কু। হঠাৎ সজোরে হাঁচি দিল নাকের সামনে হাত না রেখে। ব্যস! নাকের সর্দি গিয়ে পড়ল অতিথির গায়ে এবং খাবারে। খাওয়া পণ্ড হল অতিথির।
এমন আরও অনেক অপ্রিয় ঘটনার খবর আসতে থাকে কানে। কেউ হয়তো হাত দিয়ে মুখ না ঢেকে জোরে জোরে হাই তুলছে, কেউ শব্দ করে খাবার চিবোচ্ছে, বড়োরা যখন কথা বলছে তখন হঠাৎ-ই তাদের মাঝে লাফ দিয়ে পড়ছে, কেউ এলোপাথাড়ি ঢিল ছুঁড়ছে, কেউ অন্য কোনও বাচ্চার খেলনাপত্র কেড়ে নিচ্ছে, কেউ ধারালো কিছু দিয়ে অন্যকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, অন্যের চুল ধরে টানছে, মারছে, জামা-প্যান্ট-এ কালির দাগ কেটে দিচ্ছে। যে-কোনও ডে-কেয়ার বা ক্রেশ-এর এটি পরিচিত দৃশ্য। অর্থাৎ শিশুরা হাজারো অন্যায় করছে সঠিক গাইড-এর অভাবে।
অবশ্য এর ঠিক উলটো ছবিও দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে।
নিয়ম-নীতি, উচিত-অনুচিত এসব জেনে-বুঝে কাজ করে অনেকে। হাত না ধুয়ে খাবার খেলে যে অসুখ হতে পারে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ছোটো থেকেই শেখাতে হবে। খাবার টেবিল-এ কী সহবত দেখাতে হবে, তাও অত্যন্ত জরুরি বিষয়। হাঁচি, কাশির পর কিংবা বড়োদের গায়ে পা লাগলে যে ‘সরি’ বলতে হবে, এটা বাচ্চাদের অবশ্যই শেখাতে হবে। আস্তে কথা বলা, অন্যের কথার মাঝে কথা না বলা ইত্যাদি শেখানোও আবশ্যক। কেউ কিছু দিলে মা-বাবার অনুমতি নিয়ে খাওয়া, অনুমতি নিয়ে কোথাও কিংবা কারওর সঙ্গে যাওয়ার অভ্যাসও গড়ে তোলাতে হবে। যত্রতত্র ময়লা না ফেলে ওয়েস্টবিন-এ ময়লা ফেলা, যেখানে খুশি মলমূত্র ত্যাগ না করে শৗচালয়ে ত্যাগ করাও শেখাতে হবে ছোটো থেকেই। অনুমতি না নিয়ে কারও ঘরে ঢোকা যে উচিত নয়, তাও যেন শৈশবেই শিখে রাখে বাচ্চারা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ছেলে বাচ্চাদের ছোটো থেকেই শেখাতে হবে, মেয়েদের সম্মান করতে।
নিজের বাড়ির পাশাপাশি রাস্তায়, উৎসব-অনুষ্ঠানে, অন্যের বাড়িতে, শিক্ষাক্ষেত্রেও কী-কী সহবত দেখাতে হবে, তাও ছোটো থেকেই শেখাতে হবে। বাম দিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটা, রেড সিগনাল দেখে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়া, অন্যকে ধাক্বা না দিয়ে চলা প্রভৃতি শেখানোও যেমন জরুরি, তেমনই উৎসব অনুষ্ঠানে খাওয়ার জন্য হ্যাংলামো না করে সবার সঙ্গে বসে ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া, ভিড়ের মধ্যে লাফালাফি না করে বড়োদের হাত ধরে থাকা, ফুলের গাছে কিংবা সাজানো কোনও কিছুতে অযথা হাত না দেওয়া প্রভৃতি নিয়ম-নীতিগুলি বুঝিয়ে দিতে হবে বাচ্চাদের। শিক্ষাক্ষেত্রে সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করা, অকারণে অন্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে মিথ্যে নালিশ না করা, অন্যের ব্যাগ থেকে কোনও জিনিস তুলে না নেওয়া, অন্যের খাবার জোর করে না খাওয়া, ঝগড়া না করা, লেখাপড়ায় মনযোগ দেওয়া প্রভৃতি শেখানো অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষক-শিক্ষিকার কথা ঠিকমতো শোনা, পরীক্ষার সময় অন্যের খাতা দেখে কিংবা বই দেখে যাতে না লেখে, লিখলে কী শাস্তি হতে পারে তা বন্ধুর মতো বুঝিয়ে দিতে হবে ছোটো থেকেই।
বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া-মারামারি-গালমন্দ না করা, অন্যদের এসব করতে না দেওয়ার সহবত দেখাতে হবে মা-বাবাকে। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বাচ্চাদের সামনে ধূমপান, মদ্যপান করা, স্বামী-স্ত্রী-র শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া প্রভৃতি থেকেও স্ট্রিক্টলি বিরত থাকতে হবে। আর যদি দেখেন বাচ্চা কোনও ভাবে সহবত শিখছে না, কথা না শুনে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে একরোখা স্বভাবের হয়ে উঠছে, তাহলে ভাববেন সমস্যার শিকড় লুকিয়ে আছে গভীরে। আর নিজেরা যদি সমস্যার সমাধানে অসফল হন বারংবার, তাহলে আর দেরি না করে কোনও ভালো মনোবিদ কিংবা মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে কাউন্সেলিং করাবেন অবশ্যই। নয়তো এর ফল ভুগতে হবে আপনাদের এবং দেশ-বিদেশের সুস্থ নাগরিক সমাজকে।