দিন গুনছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর। নিশ্চিত ছিলাম ভালো নম্বর নিয়ে পাস করব। ভালো কলেজে ভর্তির জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।মাঝেমাঝে গ্রামের বাড়ি থেকে ঠাকুমা আমাদের এখানে এয়ে থাকতেন৷ তখন আমার বাড়িতে সকলেই ঠাকুমার কথামতোই চলত। অন্য কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া খুব বেশি করা হতো না।

আমার কলেজ যাওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই ঠাকুমা একদিন বাবাকে ডেকে বললেন,

-আর কত পড়াবি মেয়েকে? এর পর ভালো পাত্র পাওয়াই তো মুশকিল হয়ে যাবে। আর যদি পাওয়াও যায় মোটা পণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবি তো দিতে, ভেবে দেখিস।

-মা, তোমার নাতনি যখন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন পণ দেওয়ার কোনও দরকারই পড়বে না।

-মেয়েরা যতই পড়াশোনা করুক খোকা, আমাদের সমাজে পণ ছাড়া বিয়ে কখনও শুনিনি।

-তুমি চিন্তা কোরো না মা। তোমার নাতনি আরও পড়াশোনা করতে চায়। ওকে তুমি আশীর্বাদ করো ও যেন অনেক বড়ো হতে পারে। আর যদি স্কলারশিপ পেয়ে যায় তাহলে ওর পড়াশোনার পেছনেও আমাদের খরচ করতে হবে না।

-ঠিক আছে, তোদের যদি মনে হয় মুনমুনের বেশি পড়াশোনা করা উচিত, তাহলে পড়া। কিন্তু একটা কথা তোদের শুনতেই হবে, কলেজে ওকে শাড়ি পরে যেতে হবে। স্কুলের মতো স্কার্ট-ব্লাউজ বা

সালোয়ার-কামিজ পরে ওকে আমি কলেজ যেতে দেব না।

-ঠিক আছে ঠাম্মা, জিন্স, স্কার্ট এগুলো না হয় পরব না কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরলে কী দোষ? ওটাতেও তো পুরো শরীর ঢাকা থাকে, মুনমুন ঠাম্মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

-না, কলেজ যেতে হলে শাড়ি পরেই যেতে হবে।

আমার রেজাল্ট বেরোল। ভালো নম্বর থাকলেও একটুর জন্য স্কলারশিপটা মিস করলাম। ভালো কলেজেও ভর্তি হয়ে গেলাম ৷ তার কয়েকদিন পর ঠাকুমা গ্রামে ফিরে গেল৷ আমিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে হাঁফ ছাড়লাম৷

কলেজে পুরোদস্তুর ক্লাস শুরু হওয়ার পরেও আমার ইতিহাসের একটা বই দোকানে কিছুতেই পাওয়া গেল না। তার ফলে আমাকে এবং আমার সহপাঠীদেরও লাইব্রেরির ভরসায় থাকতে হচ্ছিল। বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে যখনই যেতাম, কেউ না কেউ বইটা নিয়ে পড়ছে দেখতাম কারণ আমাদের লাইব্রেরির বই বাড়িতে ইস্যু করা হতো না।

একদিন লাইব্রেরি গিয়ে দেখি যথারীতি একজন আমার আগেই বইটা নিয়ে গেছে। বিফল মনোরথ হয়ে চেয়ার নিয়ে বসতে যাব, দেখি বইটা আমার পাশের চেয়ারে বসা ছেলেটির ডেস্ক-এর উপর রাখা এবং ছেলেটির দৃষ্টি অন্য একটি বইয়ের পাতায় আটকে। আমি একটু সাহস জুগিয়ে ছেলেটির সামনে গিয়ে সরাসরি বললাম,

-এক্সকিউজ মি, আপনি কি ওই বইটা পড়ছেন? যদি এখন না পড়েন তাহলে আমাকে বইটা কিছুক্ষণের জন্য দিন প্লিজ। আমি কিছু নোটস নিয়ে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব।

বইটা আমার টেবিলে রাখতে রাখতেই ছেলেটি উত্তর দিল,

-শিওর, আপনি বইটা নিতে পারেন। হিস্ট্রি আমার সাবজেক্ট নয়। আমার এক বন্ধুর জন্য ওটা ইস্যু করিয়েছি। ও যতক্ষণ না আসছে আপনি বইটা রাখতে পারেন।

থ্যাংকস বলে বইটা নিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে আসি।

আধঘন্টা পরেই আর একটি ছেলে এসে পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,

-প্রসূন, আমার বইটা ইস্যু করিয়েছিস?

-পুলক, আয় বস,বই নিয়ে রেখেছি, পাশের ছেলেটি বলে ওঠে।

-তুই আসিসনি বলে ওনাকে বইটা দিয়েছি। উনি নোটস বানিয়ে কিছুক্ষণে ফেরত দিয়ে দেবেন। ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রসূন নামের ছেলেটি।

আমি নোটস লেখা বন্ধ করে পুলক নামের ছেলেটির দিকে বইটা এগিয়ে দিতেই প্রসূন বলে উঠল, -আরে না না। আপনি নোটস লেখা শেষ করে নিন। কী বলিস পুলক?

আমি অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। পাঁচ মিনিট পরেই আমি প্রসূনকে বইটা ফেরত দিয়ে দিই।

প্রসূন বলে,

-আপনি তো আমার সেকশনে পড়েন না? আপনার নাম জিজ্ঞাসা করতে পারি?

-আমার নাম মুনমুন।

আমি উঠে দাঁড়াই যাওয়ার জন্য, তখনই প্রসূন আবার বলে ওঠে,

-আমার মনে হয় আপনার নোটস নেওয়া এখনও শেষ হয়নি। আপনি এক কাজ করুন, আমাকে পেজ নম্বরটা বলে দিন। আমি আপনাকে ওই পাতাগুলো দিয়ে দিতে পারব।

আমি একটু বিরক্ত হই। রূঢ় ভাবেই জিজ্ঞাসা করি,

-আপনি কি বই থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে আমাকে দেবেন?

-আমাকে দেখে কি এরকম বাজে ছেলে বলে মনে হয়?

-না না, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। সরি! কিন্তু আপনি আমাকে পাতাগুলো কীভাবে দেবেন?

-আপনি নিজের মোবাইল নম্বরটা আগে দিন। দেখবেন এক সেকেন্ডে কাজটা হয়ে গেছে।

ফোন নম্বর দিতে আমাকে ইতস্তত করতে দেখে পুলক বলে ছেলেটি এবার বলে,

-মুনমুন আমি বুঝতে পারছি, একটা অচেনা ছেলেকে কোনও মেয়ের ফোন নম্বর দিতে চাইবে না। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন প্রসূন খুব ভালো ছেলে। ও পেজগুলোর ছবি মোবাইলে তুলে আপনার ফোনে বা মেইল-এ পাঠিয়ে দিতে পারবে। ক্লাসের অন্য মেয়েদেরকেও এই ভাবে ছবি তুলে পাঠিয়েছে। এতে ওর কোনও মতলব বা উদ্দেশ্য নেই।

আমি তত্ক্ষণাৎ নোটবুক থেকে পাতা ছিঁড়ে আমার নম্বর লিখে প্রসূনকে ধরিয়ে দিই। প্রসূন বলে,

-আপনি যদি বলেন প্রিন্ট আউট বার করেও দিতে পারব।

-না না, অত কষ্ট করতে হবে না। আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেই হবে, বলে মুনমুন লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

ওই দিনই একটু রাত করে হোয়াটস-অ্যাপে আমার দরকারের পেজগুলোর সব পেয়ে যাই প্রসূনের কাছ থেকে। ওকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট করে দিই। প্রসূনের উপর একটা আলগা ভালোলাগা মনের কোণায় উঁকি দিয়ে যায়।

এর পর বেশ কিছুদিন প্রসূন বা পুলক কারও সঙ্গে আমার দেখা হল না। আমাদের সেকশনও আলাদা ছিল। পুলকের স্কুটারেই প্রসূন কলেজ আসা-যাওয়া করত আর আমি যাতায়াত করতাম অটোতে।

সেদিন আমার ইতিহাসের পরীক্ষা ছিল কলেজে। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি। কোনওরকমে কলেজ পৌঁছোলাম রিকশা করে, অর্ধেক ভিজতে ভিজতে। প্রসূন সাহায্য করাতে পরীক্ষা খুবই ভালো হল। কলেজের গেটে যখন পৌঁছোলাম তখনও বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। রিকশা স্ট্যান্ডে একটাও রিকশা নেই, হয়তো বৃষ্টির জন্য।

ধীরে ধীরে বড়ো রাস্তার দিকে এগোলাম, যদি একটা রিকশা পাওয়া যায় এই ভাবতে ভাবতে। বড়ো রাস্তাতেও জল চারদিক থইথই করছে। শাড়িটা বাঁচাতে পায়ের থেকে একটু উপরে তুলে নিয়েছিলাম। হঠাৎ-ই মনে হল আমার পিছনে পিছনে কেউ আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না। পাশ দিয়ে মোটারবাইকে দুটি ছেলে যেতে যেতে আমার দিকে ক’টা নোংরা উক্তি ছুড়ে দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে শাড়িটা ছেড়ে দিলাম। ওই অসতর্ক মুহূর্তে কোনও ভাবে শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে রাস্তায় পড়তে যাব পেছন থেকে সবল দুটো বাহু আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখলাম প্রসূন।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-আপনি আজ হেঁটে কোথায় যাচ্ছেন? আপনার বন্ধু পুলক আজ আসেনি?

-না আজ ও আমার সঙ্গে আসেনি।

আমি প্রসূনকে ইতিহাসে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। ও আমার সঙ্গে বড়ো রাস্তা অবধি এল। ওখানেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। প্রসূনও বাড়ির রাস্তা ধরল যদিও তখনও পর্যন্ত আমি প্রসূন কোথায় থাকে জানার আগ্রহ বা চেষ্টা কিছুই প্রকাশ করিনি।

একদিন কলেজে প্রসূনের সঙ্গে লাইব্রেরিতে দেখা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম,

– কেমন আছেন?

-খুব একটা ভালো নেই। তুমি কেমন আছ? সরি আপনি কেমন আছেন? একটু বিব্রত লাগল প্রসূনকে।

ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম,

– ইটস পারফেক্টলি ওকে। আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন।

-তাহলে তোমাকেও তুমি বলতে হবে যখন আমার সঙ্গে কথা বলবে। বন্ধুত্ব রাখতে গেলে আপনি বলা চলবে না। কি রাজি? প্রসূনের কথা শুনে আমি হেসে ফেলি।

প্রসূনকে যত দেখতাম ততই ওকে ভালো লাগত। অদ্ভুত ছেলে। ওকে কোনওদিন উদাস হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখিনি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকত। মুহূর্তের মধ্যে অপরিচিত কাউকেও আপন করে নিতে পারত। সকলের মুখে ওর প্রশংসাই শুনতাম। কলেজের ছেলেমেয়েরাও ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য নিজেরাই এগিয়ে এসে কথা বলত। ওর প্রতি ওর বন্ধুদের শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা আমার মনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করল। ওর প্রতি একটা অলিখিত ভালোবাসার আকর্ষণ ধীরে ধীরে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল।

আমাদের মেলামেশার গণ্ডি লাইব্রেরি ছাড়িয়ে ক্যান্টিন, ক্যান্টিনের সীমা অতিক্রম করে সিনেমা হল পর্যন্ত পৌঁছোলেও সবসময় তৃতীয় কেউ সঙ্গে থাকতই। কখনও পুলক, কখনও অন্য কোনও ছেলে বা কখনও কখনও কলেজের অন্য মেয়েরাও।

প্রোপোজ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার, ভালোবাসার একটা শব্দ প্রসূনের মুখ থেকে শোনার জন্য আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করে মরতাম। অন্য মেয়েদের সঙ্গে ওকে একলা কথা বলতে দেখেও ঈর্ষায় পুড়ে যেতাম। দু-তিনদিন একসঙ্গে কলেজ ছুটি থাকলে কাউকে কিছু না বলে কোথায় উধাও হয়ে যেত প্রসূন। কলেজের কেউ ওর সন্ধান দিতে পারত না।

 

সময় কারও জন্যই থেমে থাকে না। আমি গ্র্যাজুয়েশন পাস করে যাই। প্রসূনও পিসিএস কমপ্লিট করতে সফল হয়। এই আনন্দে হোটেলে আমাদের ট্রিট দেয় প্রসূন। আমি, পুলক আর প্রসূন। আমরা কেউ-ই ড্রিংক করতাম না তাই স্ন্যাকস নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। স্টেজে একটা অর্কেস্ট্রার দল হিন্দি ছবির গানের সঙ্গে সুরের মূর্ছনা তুলে একটা রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করে তুলেছিল- ফলে নিজেকে আমার খুব হালকা বোধ হচ্ছিল।

প্রসূনের সঙ্গে যা আমি কোনওদিন করিনি, সেটাই হঠাৎ করে বসলাম। আমার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,

-আচ্ছা প্রসূন, তুমি কাউকে ভালোবাসো? কে তোমার সেই ভালোবাসার পাত্রী?

হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে উঠল প্রসূন। বলল,

-আমার কথা ছাড়ো, তুমি কবে বিয়ে করছ বলো? বিয়েতে আমাকে ডাকতে ভুলো না কিন্তু।

প্রসূনের উত্তর শুনে আমি একটু দমে গেলাম। আমার মন বলছিল ভালো চাকরি পেয়ে প্রসূন নিশ্চই আমার সঙ্গে নতুন সংসার পাতার কথা ভাবছে।

সেদিনের দেখাই আমাদের শেষ দেখা। এরপর আর ওর সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। অন্য বন্ধুদের কাছে শুনলাম রাজ্য সরকারের অধীনে প্রসূন বড়ো চাকরি করছে। অন্য কোনও শহরে ওর পোস্টিং। আমার মা-বাবাও আমার জন্য পাত্রর খোঁজ চালাচ্ছিলেন। পুলক একই শহরে থাকাতে মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে দেখা হতো।

একদিন একসঙ্গে কফি খেতে খেতে পুলককে প্রসূনের কথা জিজ্ঞেস করলাম। পুলক বলল,

– মুনমুন তুমি প্রসূনকে দেখে মনে করো যে ও খুব আনন্দে রয়েছে। শুধু তুমি কেন সকলেই তাই মনে করে ওর মুখের হাসি দেখে। কিন্তু আসলে ও খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। নিজের কষ্ট ও কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। আমি ওর এত বন্ধু, আমাকেও ওর নিজের সম্পর্কে কিছুই কখনও বলেনি। কিন্তু হঠাৎ-ই কয়েকদিন আগে আমি ওর সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারি।

-কেন এমন কী কথা যা প্রসূন কাউকে বলতে পারেনি, উদগ্রীব হয়ে উঠি আমি।

একটু চুপ করে থাকল পুলক, তারপরেই বলতে লাগল,

-কয়েকদিন আগে প্রসূন ওর গ্রামে হঠাৎই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আমি যেদিন ওর গ্রামে গিয়ে পৌঁছোই, দেখি একটা জরুরি কাজের জন্য ওকে শহরে চলে যেতে হয়েছে। ওর বাড়িতে তখন শুধু ওর বৃদ্ধা মা আর পাঁচ বছরের মেয়ে ছিল।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,

-মেয়ে!

-হ্যাঁ

-প্রসূনের মেয়ে ওর মায়ের কাছেই থাকে৷ শুনলাম ক্লাস টুয়েলভ-এ পড়তেই প্রসূনের বিয়ে হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের শরীরও ভেঙে পড়ে। মায়ের দেখাশোনার জন্য ভরসা করতে পারবে এমন কেউই বাড়িতে ছিল না। গ্রামের সকলের পরামর্শে ওর মা ওই বয়সেই প্রসূনের বিয়ে দিয়ে দেন। দুবছর পর মেয়ের জন্ম। সবই ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে প্রসূনের বউ সব ছেড়ে এমনকী কোলের শিশুটিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে যায়।

-কিন্তু কেন? আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করি।

একটু থেমে পুলক আবার বলা শুরু করে,

-প্রসূনের মা বললেন, মেয়েটির নাকি গ্রামে থাকা একেবারে অপছন্দের ছিল। শহরে থাকতে চাইত। প্রসূন বলেছিল, শহরে যতদিন না ওর চাকরি হচ্ছে ততদিন ওকে গ্রামেই থাকতে হবে। কিন্তু প্রসূনের কথা মেনে নিতে মেয়েটি মোটেই রাজি ছিল না। তাই মেয়েকেও ছেড়ে দিয়ে ও চলে যায়। মেয়েটি নাকি আবার বিয়ে করে ফেলেছে। কয়েকদিন পর প্রসূন, মা আর মেয়েকে শহরে নিজের কাছে নিয়ে চলে যাবে।

আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে খালি বলছিলাম, এত বড়ো একটা ঘটনা প্রসূন কী করে চেপে রাখতে পারল!

 

সময়টা বর্ষাকাল। পুলকের সঙ্গে আবার পাঁচ-ছদিন কথা হয়নি। তিনদিন ধরে ক্রমাগত অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। খবরে জানতে পারলাম রাজ্যের অবস্থা ভযংকর। বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জল ক্রমাগত বাড়তে থাকার কারণে বাঁধের লকগেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে বহু গ্রাম জলের তলায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুলকের ফোন এল। জানাল, প্রসূনদের গ্রাম জলে ডুবে গেছে। উদ্ধারকারীরা প্রসূনের মা-কে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু মেয়েকে উদ্ধার করে বন্যাত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু ও খুবই অসুস্থ। পুলক কিছুক্ষণ পরেই ওই শিবিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

আমি কোনও কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম,

– পুলক আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

ও একটু ইতস্তত করে বলল,

– কিন্তু ওখানে তো তোমার খুব কষ্ট হবে।

-না, কোনও কষ্ট হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে যেতে না চাইলে পরিষ্কার বলে দাও। আমি একাই চলে যেতে পারব।

-ঠিক আছে, তৈরি থেকো আমি আসছি।

বাড়িতে বন্ধুর মেয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে বাবাকে রাজি করালাম পুলকের সঙ্গে আমাকে যেতে দিতে। পুলকের সঙ্গে প্রসূনের গ্রামে পৌঁছোলাম। দুদিনের আগে প্রসূন কিছুতেই এসে পৌঁছোতে পারবে না কারণ বন্যার জন্য শহরের থেকে গাড়ি সব বন্ধ আর তাছাড়াও দায়িত্ব অন্য কাউকে না সঁপে অফিস থেকে বেরোনো মুশকিল। পুলক ওকে জানিয়ে দিয়েছিল আমরা দুজন ওর মেয়ের কাছে যাচ্ছি।

ত্রাণশিবিরে প্রথমবার প্রসূনের মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। নাম জিজ্ঞেস করাতে ছোট্ট উত্তর পেলাম, মিনি। মিনি কলেরায় ভুগছিল। কোলে তুলে আদর করতেই আমার গলাটা জড়িয়ে ধরল। চোখদুটো যেন কীসের আশায় চকচক করে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তুমি কি আমার মা?

আমি চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছে মিনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,

– আমি তোমার মা নই, মায়ের মতো।

পুলক মোবাইলে আমাদের কয়েকটা ছবি তুলল। শিবিরের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পথ্যের ব্যবস্থা করলাম। একদিনেই মিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। দুদিন পর প্রসূনও এসে পেঁছোল। তবে ও জেনে গিয়েছিল পুলক আর আমার তত্ত্বাবধানে মিনি আগের থেকে অনেক ভালো আছে।

প্রসূনকে দেখেই মিনি দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রসূনকে দেখে মনে হচ্ছিল মেয়েকে আর কোনওদিন ও নিজের থেকে আলাদা হতে দেবে না। মিনিও বাবাকে গায়ের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল, রুদ্ধ গলায় বলল,

– এত দেরি করে কেন এলে বাবা। আমি যদি ভগবানের কাছে চলে যেতাম?

দুচোখে জল নিয়ে প্রসূন মিনির মুখ চেপে ধরল,

– মিনি এরকম বলে না,মা রে তোকে ছাড়া তোর বাবাও যে বাঁচত না। শুধু তোকে দেখার জন্যই পুলককাকু আর মুনমুন মাসি এতদূর ছুটে এসেছে।

আমরা চারজন তিনদিন ওখানে কাটালাম। এর মধ্যে জলও নেমে গেল, পরিস্থিতি আগের থেকে বেশ কিছুটা শুধরোল। পুলক বলল,

-এখন মিনির শরীর অনেকটা ভালো, আমাকে এবার ফিরতে হবে।

আমিও কপট রাগ দেখিয়ে পুলককে বললাম,

-আচ্ছা স্বার্থপর মানুষ। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ, এখন আমাকে ফেলে দিয়ে পালাবার ধান্দা আঁটছ?

-মুনমুন, আমি তোমাকে এখানে আসতে বলিনি। তুমি নিজের ইচ্ছেতে এখানে এসেছ।

-ঠিক আছে তুমি চলে যাও। আমি একাই ফিরতে পারব।

-আরে রেগে যাচ্ছ কেন? আমি ভাবলাম তুমি আরও কটা দিন এখানে কাটিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়তো? পুলক জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল আমার দিকে।

আমি একবার প্রসূনের দিকে তাকালাম। ও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। হঠাৎই চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। চোখের ভাষায় এমন কিছু ছিল না যার জন্য আমি আরও কটাদিন গ্রামে থেকে যেতে পারি। নিজের উপরেই রাগ হল। শুধু শুধু কীসের আশা করে আমি বারবার ঠকে যাই, নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। হতাশা গ্রাস করল আমাকে। গলায় জোর দিয়ে বললাম,

– না এখন আর এখানে আমার কী কাজ? আমি তোমার সঙ্গেই ফিরে যাব।

 

পুলকের সঙ্গে আমি ফিরে এলাম। পুলকের মুখেই শুনলাম, গ্রামের জমি বাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে প্রসূন মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে গেছে।

একদিন হঠাৎ প্রসূনের কাছ থেকে একটা ভিডিও ক্লিপিং এবং মেসেজ পেলাম ফোনে। ভিডিও ক্লিপিং-টা পুলক নিজের মোবাইলে তুলেছিল যখন গ্রামে মিনিকে দেখতে গিয়েছিলাম, আর ওকে বোঝাচ্ছিলাম আমি ওর মায়ের মতো। মেসেজটাতে লেখা ছিল,

– মিনি তোমাকে খুব মনে করে। মায়ের মতো থেকে ওর মা হয়ে উঠতে পারবে না? আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। তোমার বাড়িতেও আমি কথা বলে রেখেছি, আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না।

এতদিন ধরে প্রসূনের মুখ থেকে আমি এটাই শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। ধীরে ধীরে সত্যি নিরাশ হয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ আশার একটা আলো দেখতে পেলাম। এই কথাটা বলার জন্যেও প্রসূন মিনির সাহায্য কেন নিল? নিজেও তো বলতে পারত? আমার খালি এটাই মনে হচ্ছিল কিন্তু তাও ভিতরে ভিতরে আমি খুব সুখ অনুভব করছিলাম। যেভাবেই হোক না কেন, প্রস্তাবটা প্রসূনের কাছ থেকেই এসেছে।

আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম না, সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট করলাম।

– এই দিনটার জন্য আমি কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...