কনক এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি-তে পিএইচডি-র ছাত্রী। ওর বিষয় হিন্দি। ড. অমনের আন্ডারে রিসার্চ করছিল সে। ড. অমন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময়, ইউনিভার্সিটি-তে উনি যে ঘরে বসতেন, সেখানকার চাবিটা কনককে দিয়ে যান যাতে সে, প্রয়োজনীয় বইগুলো নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে আর-একজন প্রফেসারও দুমাসের ছুটি নেওয়াতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কনককে ওই পদে অস্থায়ীরূপে বহাল করে।
ইউনিভার্সিটি-তে কনক কোনও দিন রঙিন পোশাকে আসত না। সাদা শাড়ি ব্লাউজ ওর প্রায় ড্রেস কোড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কনকের গায়ের রং একটু চাপা হলেও নাক চোখ খুব শার্প এবং সবসময় হাসিমুখ। সামনে এসে দাঁড়ালে বা পাশ দিয়ে গেলে উপেক্ষার অবকাশ থাকে না। চোখ তুলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে এতটাই আকষর্ণীয় ওর চেহারা এবং ব্যক্তিত্ব। এছাড়া স্বভাব এবং কথার মিষ্টতা সহজেই মুগ্ধ করত অপরিচিতদেরও।
কনকের প্রথম ক্লাস পড়ল মাস্টার্স-এর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ক্লাসের আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল কনক। বুকের মধ্যে কিছুটা দুরুদুরু ভাব নিয়ে কনক ক্লাসে প্রবেশ করল। প্রথমেই শিক্ষার্থীদের নিজের পরিচয় দিতে উদ্যত হল,
– তোমাদের যিনি এতদিন পড়িয়েছেন তিনি ছুটিতে থাকায় আমিই এই দুই মাস তোমাদের ক্লাস নেব। আমাকে তোমাদের বন্ধু মনে করো। আমি সবরকম ভাবে তোমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করব। আমি হয়তো তোমাদের কাছেও কিছু শিখতে পারব, যা কিনা আমার রিসার্চে সাহায্য করবে।
এরপর কনক ক্লাসে সকলের পরিচয় জিজ্ঞেস করল। সকলেই নিজের নিজের নাম ও পরিচয় দিল। একটি ছেলে বিশেষ করে কনকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছেলেটির নাম নবীন। জানতে পারল, সে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবা নেই, মা গৃহিণী। বাবার পেনশনের টাকায় মা-ছেলের সংসার চলে।
কনক লক্ষ্য করল, নবীন ছেলেটি বুদ্ধিদীপ্ত, স্টুডিয়াস এবং অত্যন্ত সপ্রতিভ। আবার সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টাতেও যোগ দিচ্ছে আর মুখে হাসি লেগেই আছে। একটা পেপার খারাপ হয়ে যাওয়াতে, গত বছর ড্রপ করে নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করছে নিজেকে।
এক সপ্তাহ ক্লাস নেওয়া হয়ে গেছে কনকের। সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। ক্লাস শেষ করে দুপুরে যখন কনক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে বেরোল, তখনও বৃষ্টি হচ্ছে তবে সকালের থেকে বেগ অনেক কম। গেটের বাইরে এসে রিকশার অপেক্ষা করতে লাগল। সাধারণত অটোতেই বাড়ি ফিরত কনক। অটো ওকে মেন রোডে নামিয়ে দিত। সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে গলির ভিতর কনকের বাড়ি। আজ রিকশা করে বাড়ির সামনেই নামবে ঠিক করেছিল, যাতে বৃষ্টিতে অতটা হাঁটতে না হয়।
হঠাৎ-ই চোখ পড়ল নবীন নিজের স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে নবীনও কনককে দেখেছে। কনকের সামনে এসে স্কুটি দাঁড় করাল। স্কুটি থেকে নেমে এসে নবীন জিজ্ঞেস করল,
– আপনি কোথায় যাবেন ম্যাডাম? চলুন আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিচ্ছি।
-না না ঠিক আছে, আমি রিকশা করে চলে যাব।
-যা বৃষ্টি সকাল থেকে, সহজে রিকশা পাবেন না। বরং আমাকে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিন।
নবীনের কথায় কনকও হেসে ফেলে। স্কুটিতে বসতে বসতে নবীনের উদ্দেশ্যে বলে,
-ঠিক আছে চলো। আমাকে বাজারে নামিয়ে দিও। কত টাকা দিতে হবে?
-আপনার যা ইচ্ছে তাই দেবেন। এমনিতে আমি ওই রাস্তা দিয়ে যাই। আপনি আমার স্কুটিতে বসেছেন, সেটাই আমি আমার ভাড়া ভেবে নিলাম।
বাজারে পেঁছোতেই কনক বলল,
-ব্যস, আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। পাশের গলিতেই আমার বাড়ি।
নবীন স্কুটার না থামিয়ে বলল,
– না চলুন আপনাকে বাড়ির সামনেই নামিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টিতে আর আপনাকে হাঁটতে হবে না, বলে নবীন স্কুটার নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়ল।
খানিক দূর যেতেই একটা বাড়ির সামনে কনক স্কুটার থামাতে বলতেই, নবীন স্কুটিটা দাঁড় করিয়ে দিল।
-এটাই আমার বাড়ি। অনেক ধন্যবাদ নবীন, বলে কনক হাত নেড়ে বিদায় পর্ব সেরে স্কুটার থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। নবীন কিছু বলা বা ভাবার অবসরটুকু পেল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় নবীন কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল। নবীন বাড়ি অবধি পেঁছে দিল, তাই ভদ্রতার খাতিরে অন্তত বাড়ির ভিতরে আসার নিমন্ত্রণটুকু আশা করেছিল সে। কিন্তু শুধু ধন্যবাদটুকু জানিয়ে কনকের ভিতরে চলে যাওয়াটাকে, নবীন মনে মনে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না।
পরের দিন কনকের আবার ক্লাস ছিল। ক্লাসে ঢুকেই বলল,
– গতকাল আমি তোমাদের সুরদাসের লেখায় সৌন্দর্য-বর্ণনা সম্পর্কে বলছিলাম। আশা করি তোমরা সকলে পুরোটা বুঝতে পেরেছ। কারও যদি কিছু জানার থাকে তবে জিজ্ঞেস করতে পারো।
নবীন উঠে দাঁড়াল,
– ম্যাম, আমি এই লাইনটার মানে ঠিক বুঝতে পারছি না। অদ্ভুত এক অনুপম বাগ, জুগল কমল পর গজভর ক্রীড়ত, তাপর সিংহ করত অনুরাগ…
-এটার মানে আর যারা যারা বুঝতে পারোনি তারা হাত তোলো, কনক বলল।
সারা ক্লাসে কেউ হাত তুলল না। কনক বলল, আমি জানি এটা সকলেই স্নাতক স্তরে পড়ে এসেছ। শুধু নবীন তুমি একমাত্র ছাত্র, যে মানেটা জানে না। তুমি ড. অমনের ঘরে আমার সাথে দেখা কোরো, আমি বুঝিয়ে দেব। ক্লাসে সবার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
ক্লাস শেষ হতে নবীন কনকের সঙ্গে বেরিয়ে ড. অমনের ঘরে এসে দাঁড়াল। কনক হাতে বই-খাতাগুলো টেবিলের উপর রেখে ইশারায় নবীনকে চেয়ারে বসতে বলল। গেলাসে রাখা জলটা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে কনক একটা নিঃশ্বাস ফেলে নবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ক্লাসেই তোমাকে বলে দিতে পারতাম কিন্তু অন্য ছেলেমেয়েরা মানেটা যখন জানে, তখন তোমাকে আলাদা করে ডেকে বোঝানোই ভালো। তোমার একা বুঝতে কোনও সমস্যা নেই তো?
-না ম্যাডাম, বরং একা পড়লে মানেটা বেশি সহজে ভালো করে বুঝতে পারব।
-আচ্ছা, সত্যি বলো তো মানেটা তুমি বুঝতে পারোনি?
-ম্যাডাম, স্যারের কাছে আমরা এটা পড়েছি ঠিকই কিন্তু স্যার এটাও বলেছিলেন বর্তমান যুগে এর মানে অন্যও হতে পারে, নবীন বলে।
-তার মানে, তুমি আমার মুখ থেকে শুনতে চাও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটার অন্য কী মানে হতে পারে?
-ম্যাডাম, আপনার যদি এটা খারাপ মনে হয় তাহলে আপনি ছেড়ে দিন।
-না সেরকম কিছু না। আমি তোমাকে মানেটা বলছি। আজকাল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পুরুষ কবিদের কবিতার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে। নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করার জন্য তার আঙ্গিক শোভা বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে কবিরা বর্ণন করে থাকেন। আজকাল সিনেমায়, সিনেমার গানে, বিজ্ঞাপনে মেয়েদের নগ্নতাকে প্রকট করা হচ্ছে। নবীন, তুমি এই মানেটাই আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলে তাই না?
নবীন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এরপর পরপর এক সপ্তাহ ক্লাস নিল কনক। নবীনের সঙ্গে বিশেষ কোনও কথাবার্তা হল না। সেদিন কনক ক্লাস শেষ করে দুপুরে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরোতে যাবে, দেখল আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গেটের কাছে এসে রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়াতেই নবীন এসে স্কুটি নিয়ে সামনে দাঁড়াল।
-চলুন, আমি বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিচ্ছি।
কনক আজ কথা বাড়াল না, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। বাড়ির সামনে কনককে ছেড়ে দিয়ে নবীন চলে যেতে উদ্যত হতেই কনক বলল, ভিতরে এসে বসো নবীন। চা খেয়ে তারপর যেও।
নবীন একটু ইতস্তত করে কনকের পিছনে পিছনে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল। কনক ওকে বসার ঘরে বসিয়ে চা করতে ভিতরে চলে গেল। বৃষ্টিতে নবীনেরও ভিতরটা ধূমায়িত চা পান করার জন্য আনচান করছিল। একটু পরে ট্রে-তে দুকাপ চা আর কিছু বিস্কুট সাজিয়ে কনক ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। টেবিলের উপর ট্রে-টা নামিয়ে বসতে বসতে কনক বলল, সেদিন তোমাকে ভিতরে বসার জন্য বলতে পারিনি কারণ মা বাড়িতে ছিলেন না।
কনকের মা পাশের ঘরে বসে সেলাই করছিলেন। সেলাই শেষ করে বাইরের ঘরে যখন এলেন ততক্ষণে নবীন বেরোবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। কনকের মা-কে দেখে প্রণাম করে, কনককে বিদায় জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল নবীন।
নবীন চলে যেতেই মা জিজ্ঞেস করলেন,
– ছেলেটি বেশ ভালো, তোর ওকে পছন্দ কনক?
-মা তুমি যে কী বলো! ও আমার স্টুডেন্ট।
-আজকালকার ছেলেমেয়েরা সারা জীবন ধরে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। তাহলে বিয়ে কবে করবি?
কিছুদিন পরের ঘটনা। কনক মায়ের সঙ্গে একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিল। নবীনও হঠাৎই তার মায়ের সঙ্গে ওই একই রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকল। কনক ওদের দেখতে পেয়ে নিজেদের টেবিলে বসার জন্য ওদের আমন্ত্রণ জানাল। একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কনক জানাল, পরের সপ্তাহে ওর ইউনিভার্সিটির ক্লাস নেওয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং ওর রিসার্চও শেষের মুখে।
দুটো পরিবারই গল্পে মেতে ওঠে। নবীনের মা জানান, কনকের পড়ানো নবীনের সবথেকে ভালো লাগে কারণ এত ভালো ভাবে ক্লাসে কেউই বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বোঝান না। সুতরাং কনক ছেড়ে দিলে নবীনের প্রথম কিছুদিন একটু অসুবিধাই হবে।
কনকের মা-ও নবীন-কে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতে অনুরোধ করলেন। নবীনের
মা-কে বললেন
– দিদি আপনার ছেলেটি বড়ো ভালো। ওকে মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি আসতে বলবেন। এখন তো কনককে বাড়িতেই পাবে। রিসার্চ-ও প্রায় শেষ করে এনেছে কনক।
দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। কনকও পেপার জমা দিয়ে এখন বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। একদিন নবীন বাজারের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কী ভেবে কনকদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরায়।
কনক বাড়িতে একাই ছিল। নবীনকে দেখে খুশি হল,
-আরে নবীন তুমি! ভেতরে এসো। আজ কী মনে করে এদিকে?
-সত্যি বলব না মিথ্যা?
-আমি সত্যিটা শুনতেই ভালোবাসি নবীন।
-তাহলে সত্যিই বলছি। আপনার কথা আমার সব সময় মনে হয়। মনে হয় ছুটে চলে আসি এখানে। আপনার ব্যক্তিত্বই যে এরকম।
-বাঃ, সুন্দর কথা বলতে পারো তো, মৃদু হাসে কনক।
-না ম্যাম, আপনাকে এতদিন দেখেই তবে এই সিদ্ধান্তে এসেছি।
-কী এমন দেখেছ আমার মধ্যে? জিজ্ঞেস না করে পারে না কনক।
আপনাকে সব সময় সাদা শাড়ি পরতে দেখি। সাদা পোশাকে আপনাকে বড়ো নিষ্পাপ দেখায়। এছাড়া আভিজাত্যের অভাব নেই আপনার মধ্যে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে৷ নবীনের কথা শেষ হতে না হতেই কনকের মা ফিরে আসেন। একসঙ্গে বসে তিনজনে চা খেয়ে গল্পগুজব করতে থাকে। একটু পরে নবীন কাজ আছে বলে চলে যায়।
কয়েক মাস কেটেও যায়। কনক এখন ড. কনক। নবীনও সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে এমএ পাশ করেছে। কনক নবীনকে অভিনন্দন জানাতে ওর বাড়ি গিয়ে পেঁছোয়। নবীনকে আশাহত দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে নবীন বলে,
– ম্যাম, আমি ভেবেছিলাম প্রথম বিভাগ নিয়ে পাশ করতে পারব। সেজন্যই গত বছর ড্রপ দিয়েছিলাম।
কনক ওকে সান্ত্বনা দেয়,
-সাহিত্যে ফার্স্ট ক্লাস আনা খুবই কঠিন। তাছাড়া এ বছর কেউই ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। তোমার কষ্ট পাওয়ার কোনও কারণ নেই কারণ সেকেন্ড ক্লাসে ইউনিভার্সিটি-তে তোমার নামই সবথেকে উপরে। চলো মিষ্টি মুখ করো, বলে সঙ্গে আনা মিষ্টির বাক্স থেকে একটা মিষ্টি তুলে কনক জোর করে নবীনের মুখে গুঁজে দেয়।
হঠাৎ-ই নবীন কনকের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে ওঠে,
-কনক, আমার সারা হৃদয় জুড়ে শুধু আপনি বসে আছেন। জেগে, ঘুমিয়ে শুধু আপনাকেই আমি চোখের সামনে দেখি। পড়াশোনাতেও মন বসাতে পারি না…
কথার মাঝেই নবীনকে থামিয়ে দেয় কনক।
-থামো থামো, এসব কী বলছ নবীন? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
-না ম্যাম, আমাকে বলতে দিন। নয়তো আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। আপনার চিন্তায় যখন ডুবে যাই তখন বাইরের জগতের হুঁশ হারিয়ে ফেলি আমি।
-পাগলের মতো কথা বোলো না নবীন। যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছ। এটা ভুলো না যে, তুমি আমার ছাত্র ছিলে।
বাড়ি ফিরে নবীনের কথাই বারবার মনে পড়তে লাগল কনকের। নিজের মনকে বোঝাল কনক, ও নিজে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই সঠিক। কনক, নবীন দুজনেই চাকরির সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এরপর।
কনক নিজের শহরেই সরকারি সংস্থায় ভাষা বিভাগে ভালো চাকরির সুযোগ পেয়ে গেল। নবীন অবশ্য চাকরির সুযোগ পেল অন্য শহরে। যাওয়ার আগে নবীন কনকের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইলে, কনক রাজি হল দেখা করতে।
তারা একটা পার্কে গিয়ে দেখা করল। নবীন আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল সেখানে। কনক আসতেই ওকে ইশারায় পার্কের বেঞ্চে বসতে অনুরোধ জানাল। কনক বসে একটু শ্বাস নিয়ে বলল, -নবীন তাহলে তোমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হচ্ছে। ওখানে যাওয়ার পরেও কিন্তু যোগাযোগ রেখো।
-ম্যাম, দূরে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আপনাকে আমার প্রতি মুহূর্তে মনে পড়বে। আমি জানি না, আপনি আমাকে মনে রাখবেন কিনা।
কনকের হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নেয় নবীন,
– কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় আমি জানি না। কিন্তু এটুকু জানি আপনাকে ছেড়ে এতদূর চলে যেতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। এক নিঃশ্বাসে নবীন বলে।
নবীনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় কনক। মনে মনে একটু অধৈর্য হয়ে ওঠে সে। একটু রাগত ভঙ্গিতেই বলে,
– কী পাগলামি করছ নবীন। পাবলিক প্লেসে রয়েছি আমরা। সুতরাং আমার এবং তোমার নিজের সম্মানের কিছুটা খেয়াল তো রাখো। তুমি তো অন্য শহরে চলে যাবে কিন্তু আমাকে তো এখানে থাকতে হবে। সবকিছু বুঝেও কেন শুধু শুধু এক তরফা প্রেমে পাগল হচ্ছো? আমাদের দুজনের মধ্যে যে-ব্যবধান সেটা বোঝার চেষ্টা করো।
-কীসের ব্যবধান? বয়সেই যা আমি আপনার থেকে ছোটো, তাও এক-দুবছরের বেশি হবে না।
-নবীন, কখনও কখনও একটা ছোটো সিদ্ধান্ত নিতেও সারা জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। চলো ওঠো, বাড়ি যাও, কথাগুলো বলতে গিয়ে কনকেরও গলা ভিজে আসে। কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখে সে। কিছু আদর্শ মেনে চলে কনক সেটা লঙ্ঘন করার দুঃসাহস কনক নিজেও করে না।
নবীন চলে গেল অন্য শহরে। ফোনে মাঝেমধ্যে ওদের কথা হতো। কনকেরও মনে পড়ত নবীনের কথা। এদিকে মায়ের পীড়াপীড়িতে কনক বিয়ের জন্য মাকে হ্যাঁ বলে দিল।
কনকের বিয়ে হয়ে গেল। নবীন কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কনকের বিয়ে অ্যাটেন্ড করল। এই প্রথম নবীনকে বিদায় জানাতে গিয়ে কনকের চোখ জলে ভরে এল।
কনকের স্বামী একটি বড়ো কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কর্মরত। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই কন্যাসন্তানের মা হল কনক। প্রথমে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। দু-বছর পর কনকের স্বামী চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় চলে গেল নতুন চাকরি নিয়ে৷ ঠিক হল ওখানে সেটল করে কনক আর মেয়েকে নিয়ে যাবে।
আমেরিকায় গিয়ে ফোনেই কথাবার্তা হতো কনকের সঙ্গে। কিন্তু ধীরে ধীরে ফোন আসাও কমতে লাগল। তারপর একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। খবরাখবর করতে কনক যখন ফোন করল স্বামীকে, জানতে পারল নাম্বারটার আর কোনও অস্তিত্বই নেই।স্বামীর একমাত্র দাদা, মানে কনকের ভাশুর ভাইয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই বলে জানিয়ে দিলেন৷ চিন্তিত হয়ে স্বামীর অত্যন্ত কাছের এক বন্ধুকে ফোন করল কনক এবং যা শুনল তাতে পায়ের নীচের মাটি সরে গেল তার।
বন্ধুটি জানাল,
– বউদি, কথাটা আমার একেবারেই বলার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল সুগতর একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মেয়েটির বাবা ভারতীয় হলেও মেয়েটির জন্ম-কম্ম সবই আমেরিকাতেই। বেশ কিছুদিন ধরে ওরা একসঙ্গেই থাকছে। সুগত গ্রিন কার্ডও পেয়ে গেছে। সুতরাং ভারতবর্ষে ফিরে আসার চান্সেস নেই বললেই চলে।
নবীন এবং কনকের মধ্যেও যোগাযোগ ছিল ঠিকই কিন্তু কনক নিজের স্বামীর ব্যাপারে নবীনকে এবং ওর মাকে কিছুই জানায়নি। একদিন কনক মেয়েকে সঙ্গে করে নবীনের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ওখানে তার স্বামীর কথা উঠতেই কনক সবকিছু খুলে বলল। নবীনের মা সব শুনে খুবই দুঃখিত হলেন। কনক উঠব উঠব করাতে বললেন,
-আর একটু বসো কনক। আজ নবীন বাড়ি আসছে। একটু পরেই এসে পড়বে। তোমাদের তাহলে দেখাও হয়ে যাবে।
নবীন নিজের বাড়িতে কনককে দেখবে আশা করেনি। কনক আর ওর মেয়েকে দেখে খুব খুশি হল। কনক আগের থেকে অনেকটাই রোগা হয়ে গেছে। আবার আগের মতো ওর পরনে সাদা শাড়ি-ব্লাউজ। নবীন কনকের মেয়েকে কাঁধে তুলে নিল, তারপর মৃদু হাসি হেসে বলল,
-আপনার মেয়ে তো দেখছি আপনার থেকেও সুন্দরী।
কনকের মুখে একটা মেকি হাসি লেগে ছিল। নবীনের মা নবীনকে কনকের স্বামীর কথা খুলে বললেন। নবীন কোনও কথা বলল না। কথাবার্তা চলতে লাগল। হঠাৎ-ই কনক প্রসঙ্গ তুলল,
-মাসিমা, এবার নবীনের একটা বিয়ে দিন।
মা নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এই ছেলে বিয়ে করলে তো। তুমিই ওকে বোঝাও কনক।
-মা, আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি আজও কারও অপেক্ষায় রয়েছি।
-কার অপেক্ষায় নবীন?
-কনকের।
-এ অসম্ভব। তুমি কেন বুঝতে চাইছ না নবীন, বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে কনক।
-আরে আপনি কাঁদছেন কেন? আমি কি কিছু ভুল বলে ফেলেছি, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে নবীন।
নবীনের হাত চেপে ধরে কনক বলে,
-না নবীন, তোমার চিন্তায় কোনও পাপ নেই। তুমি সবসময় আমার ভালোই চেয়েছ। কিন্তু আমরা যা ভাবি সবসময় যে সেটা হবেই, তা তো হয় না। আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমাদের দুজনের মধ্যে যে-ব্যবধান আছে, সেটা লঙ্ঘন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
-আমি তো কোনও ব্যবধান দেখি না। আপনি কোন ব্যবধানের কথা বলছেন?
-একটা হলে তবে না বলব।
-আমি আপনার সঙ্গে একমত নই, নবীন বলে।
-তাহলে শোনো। আমাদের মধ্যে বয়সের তফাত, সেটা তুমিও স্বীকার করো। দ্বিতীয়ত আমি বিবাহবিচ্ছিন্না, তৃতীয়ত একটি সন্তানের মা। চতুর্থ হচ্ছে আমার মেয়ের জন্য সৎ বাবার উপস্থিতি আমি মানতে পারব না। আর সবথেকে শেষে, তোমার আমার মধ্যে গুরু-শিষ্যর সম্পর্ক ছিল একসময়। সেজন্যই সম্ভবত আজও তুমি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করো। সম্পর্কের এই সম্মানের জায়গাটা আমি কোনও দিনও ভাঙতে পারব না।
-এর অর্থ আমি কী ধরব? আপনি দ্বিতীয়বার আর কখনও বিয়ে করবেন না?
-না, জোরের সঙ্গে বলে কনক।
নবীন দীর্ঘনিঃশ্বাস নেয়। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কনকের দিকে। তারপর বলে,
-আপনার মধ্যে অদম্য সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। ভাগ্য নিশ্চয়ই আপনার সহায় হবে। চুপ করে যায় নবীন। নিরাশায় ডুবে যাওয়া ভেঙে পড়া সৈনিকের মতো মনে হয় ওকে। মাথা নীচু করে বসে থাকে সে।
কনক বলে ওঠে,
-তুমি কি সত্যি মন থেকে আমাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা রাখো?
-এটা নিয়ে আপনার মনে এখনও সন্দেহ আছে?
-না, সন্দেহ নেই নবীন। আমি বলছি কারণ আমি চাই আমার আর মায়ের কথা শুনে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও। একটা সম্পর্ক তখনই সত্যি হয়ে ওঠে, যখন সেটা মানুষের মনের গভীরে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। হৃদয়ে গভীরতা দিয়ে ভালোবাসাকে উপলব্ধি করার নামই হল প্রেম। প্রেম দুটো মানুষকে মনের মাধ্যমে বেঁধে রাখে। দুঃখ কোরো না। শরীরী প্রেম এ জীবনে সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বাস করো মন থেকে আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই থাকব।
নবীন কনকের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখের জল হাতের উপর পড়ে সিক্ত করে তোলে। মনের পীড়া অশ্রুরূপে বেরিয়ে আসতে চায় দুজনেরই চোখ দিয়ে৷
নবীন বলে,
-আপনাকেও একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। জীবনের যে-কোনও মোড়ে এসে যখনই আমার প্রয়োজন মনে করবেন, অবশ্যই আমাকে জানাবেন। তবেই আমি বুঝব একই সুতোয় আজও আমাদের মন বাঁধা আছে।
নবীনের মা এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন। একটা কথাও বলেননি। চুপ করে শুধু ওদের দুজনের কথা শুনছিলেন। কথা শেষ হলে কনককে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– কনক মনে রেখো এটা তোমারও বাড়ি। যেদিন মা হিসেবে আমাকে তোমার দরকার হবে আমাকে জানাতে দ্বিধা কোরো না।
-নিশ্চয়ই মাসিমা, বলে নবীনদের বাড়ি থেকে কনক মেয়েকে কোলে করে বেরিয়ে আসে। আর সে নবীনকে দুর্বল করে দিতে চায় না তার চোখের সামনে থেকে৷