হ্যাঁচ্চো!
উফ, এই তো ঠিক বেরোনোর মুখে তোমার শুরু হল।
আমি কি ইচ্ছে করে দিলাম নাকি! হাঁচি আসলে কী করব?
ভাল্লাগে না ধুর! নাকটা টিপে ধরতে পারো না?
আচ্ছা এত কুসংস্কার কেন তোমার? হাঁচি দেওয়া যাবে না, বিড়াল রাস্তা কাটা যাবে না, ডাকা যাবে না পেছন থেকে… একের পর এক! পারা যায় না।
পারতে হবেও না। আমার বিশ্বাস আমায় নিয়ে থাকতে দাও। তোমায় ভাবতে হবে না।
কথা বলাই মুশকিল।
বলোই বা কতটুকু? সারাদিন তো কাজ, কাজ আর কাজ!
কাজ না করলে খাব কী ম্যাডাম?
ঢং!
তো এবার হয়েছে বেরোব এখন? না আরও টাইম পাস করতে হবে হাঁচি দেওয়ার অপরাধে।
এসো এবার। দুগ্গা দুগ্গা!
হাসতে হাসতে অফিসের উদ্দেশে রওনা দেয় মলয়, আটশো বর্গফুট এই ফ্ল্যাট-বাড়িতে দোলন এখন একেবারে একা।
পাঁচতলা এই বিল্ডিং-এ আলো বাতাস খুবই কম ঢোকে। গুমোট লাগে দোলনের। জানলা-দরজাগুলো খুলে সামান্য আলো ঢোকানোর চেষ্টা করে সে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রেলিং-এ হাত দিয়ে নীচে ছড়িয়ে থাকা শহরটা দেখার চেষ্টা করে। পাঁচ বছর হয়ে গেল সে এই বিরাট শহরের বাসিন্দা অথচ আজও একে নিজের বলে ভাবতে পারল না। সব যেন কেমন প্রাণহীন! ছোট্ট একটুকরো বারান্দায় বেশ কয়েকটা ফুল গাছ লাগিয়েছে দোলন। এই বারান্দাটাই তাকে বাড়ির স্মৃতিকে মনে করায়। সামান্য হলেও এই প্রাণহীন শহরে এক চিলতে নিজের গ্রাম গড়ে তুলেছে দোলন।
মলয় দোলনকে স্পেস দেয়। থাকতে দেয় নিজের মতো করে। দোলনের ভালো লাগে খুব। তবু কেন জানি না, কিছুতেই বুঝতে পারে না, এই পাঁচবছরে শহরটার মতো মলয়কেও তেমন করে আপন ভাবতে পারল না দোলন।
॥ ২ ॥
কী চ্যাটার্জী? তিনদিন তো ছুটি পেলে, তা বউদিকে নিয়ে কোথাও যাওয়া-টাওয়ার প্ল্যান করলে নাকি?
টেবিলে পড়ে থাকা ফাইলগুলো ডেসপ্যাচ করার আগে আরও একবার চোখ বুলিয়ে দেখছিল মলয়। কাল শুক্রবার, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একজন মারা যাওয়ায় হঠাৎ একটা ছুটি পাওয়া গিয়েছে, তারপর শনি-রবি। ইচ্ছে করলেই কাছে-পিঠে কোথাও ঘুরে আসা যায়। ফাইল থেকে মুখ তোলে মলয়। তারপর হেসে বলে নাহ, যাওয়া হবে না দাদা।
আরে ঘুরে এসো। মন্দারমণি, শঙ্করপুর অথবা ডায়মন্ড হারবারও যেতে পারো! যাওনি তো বউদিকে নিয়ে কোথাও।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মলয়। মুখে বলে হবে না গো বোসদা। অন্য কাজ আছে।
অভিজ্ঞ বোসবাবু আর কথা বাড়ান না, মলয়ের কাঁধে হাত দিয়ে আলতো চাপ দেন শুধু।
বোসবাবু চলে গেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মলয়। দোলনের কথা মনে পড়ে তার। মনে মনে ভাবে যাওয়া তো যেতই কিন্তু দোলন কিছুতেই রাজি হবে না। কিছু না কিছু বাহানা বানাবেই। পাঁচবছর বিয়ে হয়েছে তাদের, কিন্তু দোলনকে আজও চিনতে পারে না মলয়। কী চায় মেয়েটা? আদৌ কি কিছু চায়? সারাদিন বাড়িতে বসে বসে মলয়ের ফেরার অপেক্ষায় রান্নাবান্না করে, ঘর পরিষ্কার করে, পুজো করে আর তার সংসার সামলায়। কিন্তু কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে চায় না। প্রথম প্রথম খুব জোর করত মলয়। মনের মতো করে সাজাতে চাইত দোলনকে। শেষ পর্যন্ত সে হেরেই গেল।
গ্রামের মেয়ে দোলন। এক ঘটক মলয়ের মাকে ছবিটা দিয়ে গিয়েছিল। এক ঝলক দেখেই পছন্দ হয়ে যায় তার। অমন টানা টানা চোখ, টিকোলো নাক, দুধে আলতা গায়ের রং মলয়ের না করার কোনও কারণ ছিল না। বিয়ের পর পরই কলকাতায় নিয়ে আসে মলয় দোলনকে। আর তখনই মলয় টের পায় দোলন যত সুন্দরী তার চাইতেও বড়ো কথা সে অসম্ভব কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ঘরকুনো, আনস্মার্ট একটা মেয়ে।
তবু ভালো মানুষ মলয় সবটা মেনে নিয়েছিল। বিয়ের পর পর দু’একটা পার্টিতেও নিয়ে গিয়েছিল প্রায় জোর করেই। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্যদের কাছে হাসির পাত্র হয়েছে সে। যদিও এসব কিছুই দোলনকে বুঝতে দেয়নি কোনওদিন মলয়। শুধু ওদের দূরত্ব বেড়েছে ক্রমে ক্রমে। সব আছে কিন্তু কী একটা যেন নেই! হয়তো দোলনও তা টের পায় কিংবা পায় না, কে জানে!
একবার দিঘাও বেড়াতে গিয়েছিল তারা। মলয় অবাক হয়ে দেখেছিল বাড়ির পুরো ঠাকুর ঘরটাই তুলে এনেছে দোলন হোটেলের রুমে। মুহূর্তে একসঙ্গে সমুদ্রস্নানের আমেজ মাটিতে মিশে গিয়েছিল তার। ব্যস! সেই শেষ! আর কোথাও যাওয়ার কথা বলেনি কোনওদিন। দোলনও যেতে চায়নি।
॥ ৩ ॥
বৃহস্পতিবারের পুজো সারতে সারতে আজ বেশ বেলা হয়ে গেল দোলনের। সকাল থেকে না খাওয়া কাপড় ছেড়ে রান্নার আয়োজনে লেগে পড়ে দোলন। মলয় দুপুরে আসে না। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়। তবু রোজ নানা রকম রান্না করে দোলন। টেবিলে সাজিয়ে রাখে। আজ শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। ডাল আর চাল মিশিয়ে তার মধ্যে দুটো খোসা ছাড়ানো আলু দিয়ে দেয়। অবশ্য না খেলেও হয়। এমনি কতদিন সে উপোস করে থাকে।
দোলন আভেনে কুকারটা বসিয়ে বাইরের ঘরে সোফায় গিয়ে বসে। মাথার দুপাশের রগটা দপদপ করে ওঠে। ঘাড়েও প্রচন্ড চাপ। মলয়কে কি একটা ফোন করবে? ভাবতে ভাবতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দোলন।
অফিস ছুটি হলে বাসস্ট্যান্ড-এ এসে দাঁড়ায় মলয়। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যখন তখন ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। এত সুন্দর ওয়েদার, একটু লাল জলে গলা ভেজালে বেশ হতো। কিন্তু বাড়িতে দোলন গোপালের আসন পেতেছে, সেসব ঢোকানো বারণ। মনে মনে বিরক্ত হয় মলয়। সত্যি দোলন তার ভালোমানুষির বড়ো বেশি সুযোগ নিচ্ছে না তো? অন্য কেউ হলে! দোলনের উপর রাগ বাড়তেই বন্ধু অনিরূদ্ধকে ফোন করে মলয়। তারপর উলটো দিকের বাসে চড়ে চলে যায় ওদের পুরোনো ঠেকে, বন্ধ করে দেয় মোবাইলের সুইচ।
রাত বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি। মলয়ের বেশ নেশা হয়েছে আজ। তার মধ্যেই টের পায় আজ বাড়াবাড়িটা বেশিই হয়ে গেল বোধহয়। বন্ধু অনিরূদ্ধকে বলে, আমায় বাড়ি দিয়ে আসবি রে, বড্ড দেরি হয়ে গেল। দোলন ভয় পাবে।
অনিরূদ্ধর কয়েক পেগেও সমস্যা হয় না। সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জানলার কাচে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে আছে মলয়। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। হঠাৎই সাংঘাতিক ভাবে গাড়িটা পাশ কাটায় অনিরূদ্ধ। মলয় চমকে উঠে বলে, কী হল রে?
আরে একটা কালো বিড়াল! এমনিতেই বৃষ্টি, ভালো দেখা যাচ্ছে না।
মলয় চিন্তিত গলায় বলে, মারলি নাকি?
অনিরূদ্ধ স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই সহজ ভাবে বলে, নাহ, মরেনি ব্যাটা একটুর জন্য। রাস্তাটা পেরিয়ে গেল।
মলয় উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, সেকি? রাস্তা কাটল নাকি? থামলি না কেন?
অনিরূদ্ধ মলয়ের ছোটোবেলার বন্ধু। তার জীবনের কথা সে জানে সবটাই। অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকায় সে, কিরে তুইও কি দোলনের মতো…।
থতমত খেয়ে যায় মলয়। তাড়াতাড়ি বলে, আরে না রে, ওই বললাম আর কী!
কিন্তু সারা রাস্তা মনটা খচখচ করতেই থাকে তার।
॥ ৪ ॥
কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরও যখন ওপাশ থেকে দোলন দরজা খোলে না, তখন ডুপ্লিকেট চাবিটা বের করে মলয় ব্যাগ থেকে। ঘর অন্ধকার, দোলন কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছে? গা ছমছম করে ওঠে! নেশাটাও অনেকটাই কেটে গেছে এতক্ষণে। আলো জ্বালিয়ে দোলনকে ডাকতে গিয়ে চোখে পড়ে সোফার উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে দোলন। মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বেরিয়ে শুকিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ছুটে গিয়ে দোলনের মাথাটা কোলে তুলে নেয় মলয়। ততক্ষণে দোলনের শরীর বরফের চাইতেও ঠান্ডা হয়ে গেছে।
মলয় দিশেহারা হয়ে পড়ে। সকালেই তো সুস্থ ছিল মেয়েটা! হঠাৎ কী এমন হল যে… পাগলের মতো দোলনের নাম ধরে ডাকতে থাকে মলয়।
না, আর কোনওদিন সাড়া দেয়নি দোলন। পাঁচবছরের দাম্পত্যের মায়া এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে সে চলে গিয়েছে অনেক দূরে। মলয় বুঝতে পারে, দোলনের কাছাকাছি পাশাপাশি থেকেছে কিন্তু ওর মনের হদিশ পায়নি কোনওদিন। পাওয়ার চেষ্টাও করেনি। এমনকী মেয়েটা নিজের যত্ন নিত কিনা তাও জানে না মলয়। নির্ঝঞ্ঝাট ভালো মানুষ বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করত মলয়। আজ তা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে দোলন নামে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েটা।
দিন পেরিয়ে যায় মলয় টের পায় দোলন ছেড়ে গেলেও তাকে দিয়ে গিয়েছে তার যাবতীয় বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা।
এমবিএ পাশ করা ঝকঝকে ছেলেটা আজকাল গোপালকে খাইয়ে অফিস যায়। পেছন থেকে কেউ ডাকলে দুমিনিট দাঁড়ায় আর বেরোবার মুখে হাঁচি এলে নাক টিপে ধরে, ঠিক যেমন করে ধরতে বলত দোলন।
দোলনের রেখে যাওয়া কুসংস্কার ছোঁয়াচে রোগের মতো সংক্রমিত হয় মলয়ের মনে। মলয় জানে এই রোগ থেকে সে আর আজীবন মুক্তি পাবে না।