মধ্যাহ্নে রেস্তোরাঁর দোতলায় বসে চিকেন ড্রাই-ফ্রাই-এর স্বাদ আস্বাদন করতে করতে সুন্দরী তিস্তাকে দেখার অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। এই সুযোগ করে দিল আমাদের সফরপথের গাড়িচালক স্যামুয়েল লেপচা। বেলা বারোটায় বাগডোগরা বিমানবন্দরের বাইরে এসে গাড়িতে উঠে খিদে পাওয়ার কথা জানাতেই, সেবক রোড-এ অবস্থিত ‘অভিনয়’ রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল স্যামুয়েল। তাই, পথে চা-পান করলেও, ভালো খাবারের জন্য একটু অপেক্ষা করতেই হল।

পাহাড়ি জল পেটে সহ্য নাও হতে পারে, এই ভেবে নামি ব্র্যান্ডের কয়েকটা পাঁচ লিটারের জলের জার কিনে গাড়িতে তুললাম। তারপর চললাম পূর্ব সিকিমে আমাদের প্রথম গন্তব্য ইয়াকতেন-এর উদ্দেশে।

তিস্তার ফিগার এখন স্লিম। কারণ, শীতে তার জলভার কমে গেছে। এহেন বহমান তিস্তাকে পাশে রেখে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। তিস্তা বাজার, লাভার্স পয়েন্ট ছাড়িয়ে গ্যাংটকগামী পথে কিছুটা চলার পর তিস্তাকে আর পাশে পাওয়া গেল না, রানিপুল থেকে গাড়ি ঢুকল অন্য পথে।

সিকিমের অন্য পর্যটন পথের মতো এ পথে (ইয়াকতেন-এর) গাড়ির ততটা চাপ নেই। তাই সর্পিল পাহাড়ি পথের ডানদিকে পাহাড় আর বাম দিকে শাল-সেগুন প্রভৃতি বৃহৎ বৃক্ষের ঘন জঙ্গল ভেদ করে যখন আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে, তখন নির্জনতার এক অদ্ভূত রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছিল। এভাবেই ১০৮ কিলোমিটার পথে (রানিপুল থেকে) দুপুর-বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামল সফর পথে।

সন্ধে সাতটা। গাড়ি থামালাম পাখিয়ং বাজারে। পূর্ব সিকিমের পর্যটনকে যাঁরা আরও উন্নত করতে চান, সেই দুই প্রধান উদ্যোক্তা নারায়ণ প্রধান এবং হূষিকেশ গুরুং-এর আমন্ত্রণে কিছুক্ষণের জন্য গেলাম ‘অ্যালপাইন হোম স্টে’-তে চা-পান করতে। প্রায় ১০৪ বছরের প্রাচীন বাড়িটিকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। জমিদার আমলের আসবাব আর গৃহস্থালিতে সমৃদ্ধ এই হোম স্টে, সত্যিই মন কেড়ে নিল, কিন্তু থাকা হল না সফর তালিকায় না থাকার জন্য। তবে জেনে নিলাম, এখানে মোট কুড়িজন একসঙ্গে থাকতে পারবেন। থাকা-খাওয়া বাবদ প্রতিদিন মাথাপিছু খরচ করতে হবে ৮00 টাকা।

পাখিয়ং-এ তিরিশ মিনিট চা-পানের বিরতির পর আবার গাড়িতে উঠলাম। দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঠিক রাত আটটার সময় পৌঁছোলাম ইয়াকতেন ‘অর্কিড হোম স্টে’-তে।

স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী হোম-স্টে-তে আমাদের বরণ করা হল দই-চাল-দানাশস্য আর পাহাড়ি ফুল দিয়ে। বরণ-পর্ব শেষ হওয়ার পর, থাকার ঘরে পৌঁছোনোর জন্য প্রায় তিরিশ ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হল। কারণ এখানে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে হোম-স্টে। বরাদ্দ পেল্লাই সাইজ-এর ঘরে রয়েছে, বড়ো খাটে সুন্দর বিছানা, বসার জন্য বড়ো সোফা, ঘরে হিটার, গিজার, কফি-মেকার সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী। শীতকে উপভোগ্য করার জন্য এসবের ব্যবস্থা রয়েছে দেখে স্বস্তি পেলাম।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে রাত-পোশাকে বাইরে এলাম। আকাশের আধফালি চাঁদের আবছা আলোয় তখন চারিদিকে এক মায়াবি পরিবেশ। তারই মধ্যে বনফায়ার আর বারবিকিউ-র ব্যবস্থা করেছেন অর্কিড হোম স্টে-র সর্বময় কর্তা জ্ঞান বাহাদুর সুব্বা। বসার জায়গা করে দিয়ে জ্ঞানু (ডাক নাম) আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন ফারমেন্টেড মিলেট তরল। বাঁশের পাত্র এবং বাঁশের স্ট্র সহযোগে ‘টুংবা’ নামের এই বিশেষ পানীয়, প্রবল শীতে (৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) খুব কাজে লাগল। শরীর গরম হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। এরপর আমাদের বিনোদনের জন্য সুব্বা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা শুরু করল সিকিমিজ লোকগান আর লোকনৃত্য। নিংমা, ডোমা শেরপা, মনিতা সুব্বা, ইশনিয়া সুব্বা নাচল নীতেন ছেত্রীর গানের সঙ্গে। প্রথম রাতেই মনটা বেশ ভরে গেল আনন্দে। রাতে জ্ঞান বাহাদুরের স্ত্রী বাসন্তীর হাতে গড়া রুটি, ডাল, আলুভাজা আর চিকেন কারির স্বাদ নিয়ে ঘরে ঢুকলাম পরের দিনের আলোয় প্রকৃতিকে দেখার কৌতূহল নিয়ে।

প্রসঙ্গত নারায়ণ প্রধান জানিয়েছিলেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে ইয়াকতেন থেকে ভোরবেলা কাঞ্চনজঙঘা দর্শন করা যায়। সেই লোভে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে বিছানা ছাড়লাম ভোরবেলা। দরজা খুলে চোখ মেলতেই দেখি কাঞ্চনজঙঘার রূপের আলোর বিচ্ছুরণ। আহা কী অপরূপ রূপ, কী মহিমা! ক্যামেরা বের করে দু’দশটা ছবি তুলতে-তুলতেই আবার ঝাপসা হয়ে গেল কাঞ্চনজঙঘা। তখন চোখ ফেরালাম ইয়াকতেনের অর্কিড হোম স্টে-র চারপাশে। চোখে পড়ল অর্কিড-এর বহুবর্ণ ফুলের বাগিচা, কিউই, স্কোয়াশ আর শাকসবজির খেত। ফুলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ঘুরে বেড়াতেও দেখা গেল। আর দেখা হল মধু চাষের প্রক্রিয়া। ফুলের বাগানে বসানো রয়েছে মৌচাক তৈরির বাক্স।

মকাই আটার রুটি, জিরে-আলু ভাজা, ছানার ডালনা, আর দেশি মুরগির ডিম সিদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। স্নানে যাওয়ার আগে জ্ঞানুর কাছ থেকে জেনে নিলাম ‘ইয়াকতেন’ নামের মাহাত্ম্য। জ্ঞানু জানালেন, সিকিমিজ ল্যাংগুয়েজ-এ ইয়াকতেন বলতে বোঝায় ‘ওয়েলকাম টু মাই নিউ হোম’।

আগের সন্ধেয় পাখিয়ং-কে জাস্ট ছুঁয়ে এসেছিলাম, আজ দ্বিতীয় দিনে ভালো করে আলাপ-পরিচয় হবে। সেইমতো বেলা ন’টার সময় বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড স্যামুয়েল প্রথমে নিয়ে গেল ইয়াকতেন থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের পাখিয়ং এয়ারপোর্ট ভিউ পয়েন্ট-এ। একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে, পাহাড়ি ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখলাম নবনির্মিত পাখিয়ং বিমানবন্দরকে। পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ছোট্ট রানওয়ে। জানা গেল, চলতি বছরের শেষের দিকে নাকি এখান থকে ওঠানামা করবে বিমান। তবে পঞ্চাশ থেকে ষাট সিটারের যাত্রী বহনকারী বিমান-ই শুধু ওঠানামা করবে বলে জানা গেছে। এও জানা গেছে, কলকাতা থেকে বাগডোগরা পর্যন্ত যা ভাড়া, মোটামুটি সেইরকম অর্থ ব্যয় করলেই পর্যটকরা পৌঁছে যেতে পারবেন পূর্ব সিকিমের এই (পাখিয়ং) বিমানবন্দরে। তারপর এখান থেকে গ্যাংটক কিংবা অন্যত্র খুব কম সময়ের মধ্যে গাড়ি করে পৌঁছানো যাবে।

বায়ুপথে আরামে যাতায়াত করা যাবে এই আনন্দে মনটা যখন বিভোর, তখন স্যামুয়েল জানাল, আজ সে দেখাবে পাখিয়ং-এর দুটি নতুন জায়গা– পাসতাংগা আর আচ্ছাম লিংজে।

পাখিয়ং এয়ারপোর্ট থেকে পাথুরে পথে গাড়ি এগোতে থাকল পাসতাংগার দিকে। রাস্তার দুদিকে দেখা গেল ফুলঝাড়ু তৈরির অসংখ্য গাছ, ফসলের খেত, ঝাউবন, বাঁশগাছ আর টকটকে লাল পাতাবাহার গাছ। এরপর একটা জায়গায় গাড়ি থামাতেই হল ছবি তোলার জন্য। অসংখ্য কানের ঝুমকো দুলকে একসঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলে যে সৗন্দর্য প্রকাশিত হবে, তেমনই কমলারঙা একাধিক ফুলের গাছের সারি চোখ জুড়িয়ে দিল। স্থানীয় একটি মেয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জানাল, এটা সোসতানি ফুলের গাছ। পবিত্র এই ফুল দিয়ে দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করা যায় বলে অঞ্চলের অধিবাসীদের বিশ্বাস। পাখিয়ং-এর পাসতাংগার দামলাখা অঞ্চলে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই ফুল ফুটতে দেখা যায়।

ফুলের ছবি তুলে গাড়ি একটু এগোতেই স্যামুয়েল দেখাল সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। এই স্কুলেই নাকি একসময় লেখাপড়া করতেন ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া।

পাসতাংগার ছাঙে মনাস্ট্রি দেখার আগে, স্যামুয়েল গাড়ি থামিয়ে আলাপ করাল পল করন রাই-এর সঙ্গে। জানা গেল, ইনি রাই সম্প্রদায়ের অভিজাত পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্য। কথা বলে বুঝলাম, সত্যি জ্ঞানী এবং সম্ভ্রান্ত মানুষ। বিনয়ী স্বভাবের এই মানুষটি আমাদের ভ্রমণকে সার্থক করতে অনেকটাই সাহায্য করলেন স্বেচ্ছায়। প্রথমে তিনি তাঁর অভিজাত ‘রাই হাউস’-এ নিয়ে গিয়ে মকাই চুরা (ভুট্টার তৈরি) আর ‘টুংবা’ দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। অতিথিকে আপ্যায়ন করার ওটাই নাকি স্থানীয় রীতি।

যাইহোক, তারপর পল রাই দেখালেন তাঁর নানা প্রজাতির কুকুর, বেড়াল, খরগোশ প্রভৃতির ছোট্ট চিড়িয়াখানা। দেখালেন বইয়ের সংগ্রহ। সংগীত প্রেমীদের জন্য গিটার ছাড়াও তিনি রেখেছেন নানারকম মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট। এসব দেখানোর পর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ির অনতিদূরের রংরং ঝরনা দেখাতে। বিশাল না হলেও মন্দ নয় সেই ঝরনা। ‘এপিকা গার্ডেন’-এর প্যারাগ্লাইডিং-ও রোমাঞ্চিত করল আমাদের। মিস্টার পল দূর থেকে দেখালেন দেওরালি জনপদ।

এরপর পাহাড়ি জঙ্গলে কিছুটা ট্রেক করে (১৫ মিনিট) পৌঁছোলাম একটা উঁচু জায়গায়। পাসিংটেল (ভুটিয়ারা বলে পাথরের স্তুপ) নামে পরিচিত ওই উঁচু পাহাড়ে রয়েছে ছোটো ছোটো তিনটে জলাধার– বালাখোলা, একচেন খোলা আর সেলেলে। স্থানীয় লেপচারা বলে, ডুঙ্গেল খাড়ুকা। একসময় নাকি এখানে বাস করত ডুঙ্গেল পরিবার। চাষাবাদের জন্য তারাই নাকি এইসব জলাধার তৈরি করেছিল। সে যাইহোক, মিস্টার পল জানালেন, এখান থেকেও নাকি কাঞ্চনজঙঘা এবং পান্ডিম দেখা যায় ভোরবেলা।

পল রাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এরপর আমরা চললাম পাখিয়ং-এর আচ্ছাম লিংজের লিম্ব গ্রামে। স্যামুয়েল আলাপ করাল বিক্রম সুব্বার সঙ্গে। পুলিসের চাকরি ছেড়ে ইনি এখন ব্যস্ত পর্যটনে। এরজন্য তাঁর স্ত্রী তাঁকে ‘পাগল’ বললেও, তিনি পর্যটকদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন হাসিমুখে।

সিকিম পর্যটন দফতরের প্রেরণায় গড়ে ওঠা ‘ইয়াকচেরি হোম স্টে’-কে জনপ্রিয় করে তোলার দায়িত্ব পালন করছেন এই প্রাক্তন পুলিশকর্মী। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করছেন মন বাহাদুর সুব্বা। ছিমছাম হোম স্টে দেখানোর পর স্লঁরা তাঁদের নিজের হাতে তৈরি ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্কিড ফার্ম’ এবং ‘মেডিটেশন সেন্টার’ দেখালেন। এসব দেখে তাঁদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হল। আরও কিছু দেখার আবদার করতে ওঁরা নিয়ে গেলেন ‘ওহো প্যারাগ্লাইডিং পয়েন্ট’-এ। মিনিট পনেরো হেঁটে ওই পয়েন্ট-এ পৌঁছোলাম। তবে প্যারাগ্লাইডিং (২০৫০ টাকা) করার সময় না পেলেও, ফুলে ভরা পাহাড়ি অঞ্চলটির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। ওহো থেকে আরও পনেরো মিনিট পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছোলাম সারমসা গার্ডেন-এ। সেই বাগানের রূপ পাগল করার মতো। এক এক করে সমস্ত ফুল চেনালেন বিক্রম। করোনেশন, জারবেরা, গোলাপি আরু, বালটিক গ্লোসিয়ার, পাইন ক্লাস, মুন ভেনাস, জুনিপার, ছুজেন, রাম্বও মাস্টার পিস, কারমিট, নোবিলি, বলবো ফাইলাম, বারবেটা প্রভৃতি আরও কত কি ফুল, সব নাম আর মনে নেই। এসব দেখার পর মন বাহাদুরের স্ত্রী আমাদের ভাত, ডাল, রাই শাক আর ডিমের কারি খাওয়ালেন মধ্যাহ্নে। এরই ফাঁকে বিক্রমের ধামসা বাজানোর প্রতিভার কথা জানতে পেরেছিলাম, তাই সে সুযোগও হাতছাড়া করলাম না। পাখিয়ং-এর লিম্বু গ্রাম-কে বিদায় জানানোর আগে, বিক্রম মাতালেন ধামসা বাজিয়ে। সেদিনের মতো আবার আমরা ভ্রমণ পিপাসুরা সন্ধের মধ্যে ফিরলাম ইয়াকতেন-এর অর্কিড হোম স্টে-তে।

তৃতীয় দিন সকালে প্রাতরাশ সেরে আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম ইয়াকতেন-এর পাহাড়ি জঙ্গলে। নিঃশব্দে নানা জাতের পাখির ছবি তুলতে তুলতে শুনলাম তাদের কলকাকলি। মধ্যাহ্ন ভোজের পর আমরা ইয়াকতেন ছাড়লাম। এবার আমাদের গন্তব্য ২৫ কিলোমিটার দূরের চোচেনফেরি। এই সফর পথে পড়ে পারাখার জঙ্গল। দেখলাম শাল, সেগুনে ভরা সেই জঙ্গলের মধ্যে এক প্রাচীন মন্দির– মাংখিম। স্থানীয় দেব-দেবী পূজিত হন সেখানে।

পড়ন্ত বিকেলে আমরা পৌঁছোলাম ‘চোচেনফেরি ইকো-হাট হোম স্টে’-তে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম দারুণ ল্যান্ডস্কেপ। ধাপচাষের জমির ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি লেক। জানলাম, এই চোচেন লেক বর্ষাকাল ছাড়া শুকনো থাকে বাকি সময়। আলু, মটর, গম, ভুট্টা, রাই, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকোলি প্রভৃতি চাষের জমির মাঝ-বরাবর, সরু নুড়ি-মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে পৌঁছোলাম গন্তব্যে। দেখলাম, কিশোর-কিশোরীদের আর্চারির (তিরছোঁড়া) ট্রেনিং। বেশ উৎসাহের সঙ্গে শিখছে ওরা।

সন্ধে নামতেই বনফায়ারের ব্যবস্থা করলেন বসন্ত গুরুং এবং কিরণ ভুশাল। লেপচা আর ভুটিয়া ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখাল তাদের লোকনৃত্য। রাই শাকের পকোড়া, চিলি চিকেন আর রডোডেনড্রন ফুল থেকে তৈরি বিশেষ পানীয় সহযোগে রাতটা বেশ জমে গেল। পরের দিন সকালে লুচি আর আলুর দম খেয়ে আমরা দেখলাম স্থানীয় এথনিক ভিলেজ। প্রায় একশো বছরের পুরোনো বাড়িগুলি মাটি, কাঠ আর টিনের চালে ছাওয়া। ধান, গম, ছোলা, সরষে, অড়হড় চাষ আর গবাদি পশু নিয়েই ওদের জীবন ও জীবিকা।

এই চোচেনফেরির অবস্থান ঠিক জুলুক কিংবা সিল্ক রুটের নীচে। এখান থেকে পাঁচ-ছয় ঘন্টা ট্রেক করে পৌঁছে যাওয়া যায় ছাংগু লেক-এ। এই ট্রেকিং পয়েন্টকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় খেদি ট্রেকিং পয়েন্ট। এই ট্রেকিংয়ের শুরুতেই আমরা দেখলাম চোচেন গুম্ফা। বেশ প্রাচীন এই গুম্ফার ভেতরে রয়েছে অসাধারণ সব তৈলচিত্র, যা পৌরাণিক কাহিনির পরিচয় বহন করছে। রয়েছে শিঙা এবং সানাই।

খুব ইচ্ছে থাকলেও পুরোটা ট্রেক করতে পারিনি। তাই হয়তো অনেক কিছুর দর্শন থেকে বঞ্চিত হলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পাহাড় থেকে নেমে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলল লোসিংমাছং-এর উদ্দেশে।

চোচেনফেরি থেকে চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর ঝুলন্ত রোলেপ সেতু পেরিয়ে গাড়ি থামাল স্যামুয়েল। দেখলাম, পাহাড়ি ঝরনার জলে পুষ্ট রংপো খোলা। নানা আকৃতির পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলা এই নদী, তার একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে জঙ্গল– সব মিলে সে এক নয়নাভিরাম পরিবেশ। তবে এখানেই শেষ নয়, খানিক হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে স্যামুয়েল আমাদের প্রায় দু’শো মিটার নীচে নামিয়ে নিয়ে দেখাল এক রোমাঞ্চকর হিডেন ফলস। গুহার মতো একটি জায়গায় ঝরঝর করে পড়ছে জল। অদ্ভূত এই ঝরনার ওপরে সেতু দিয়ে গাড়ি গেলেও, ঝরনা দেখা যায় না। বুদ্ধা নামের এই হিডেন ফলস দেখতে হলে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে নীচে নামতেই হবে।

প্রয় ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মধ্যাহ্নে পৌঁছোলাম লোসিংমাছং-এর রিভার ভ্যালি রিসর্ট-এ। নামে ‘রিসর্ট’ শব্দটি থাকলেও, এটা আসলে একটা হোম স্টে। এর সামনে দিয়েও বয়ে চলেছে রংপো খোলা। ট্রাউট এবং আসালা মাছে সমৃদ্ধ এই নদী। শুনেছি দারুণ স্বাদের সেই মাছ। তাই রিভার ভ্যালি রিসর্ট-এর কর্তা মিলন সুব্বাকে অনুরোধ করে মধ্যাহ্নভোজ হল ওই দুই সুস্বাদু মাছের ঝোল আর ভাত দিয়ে। বিকেলে ঘুরলাম রংপো নদীর পাড় ধরে। জল-জঙ্গল আর পাহাড়ি পরিবেশে শুধু মাছ, ফুল, পাখি আর প্রজাপতির সান্নিধ্যে মনটা রঙিন হয়ে উঠল।

রংপো-খোলার কলকল শব্দে আচ্ছন্ন ছিলাম সারা রাত। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল পাখির কুজনে। সেই কুজনে মিষ্টতা থাকলেও, সফর শেষের মনখারাপি যেন বিদায়ের বিরহী সুর মনে হল। সকাল দশটায় বাড়ি ফেরার জন্য যখন গাড়িতে উঠলাম, তখনও মনে হল কে যেন অলক্ষ্যে হাত ধরে আরও ক’টা দিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করছে। কিন্তু ছুটি শেষ, সফরও শেষ। ফিরতি পথে শুধু স্মৃতিটুকুই সম্বল! আর সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনের দিকে ১২০ কিলোমিটার পথ (লোসিংমাছং থেকে) পাড়ি দিলাম।

জরুরি তথ্য

কীভাবে যাবেন – শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে নিউজলপাইগুড়িগামী পদাতিক এক্সপ্রেস, দার্জিলিং মেল, কাঞ্চনজঙঘা এক্সপ্রেস কিংবা শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে নামুন এনজেপি স্টেশনে। অথবা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বায়ুপথে চলে যান বাগডোগরা। এরপর এনজেপি কিংবা বাগডোগরা থেকে এইট সিটার সুমো কিংবা স্করপিও ভাড়া করে ইয়াকতেন পৌঁছোতে খরচ পড়বে ৩০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকার মধ্যে। দু’হাজার টাকায় ছোটো গাড়িও পাওয়া যাবে। ইয়াকতেন থেকে সারাদিন ঘোরার জন্য খরচ করতে হবে মাথাপিছু ৫০০ টাকা।

কী খাবেন – অর্গানিক ফুড ছাড়াও অর্ডার দিলে মাছ, মাংস, ডিম সবই পাওয়া যাবে।

কোথায় থাকবেন – প্রত্যেক লোকেশনে একাধিক হোম স্টে আছে। তবে সরকারি সহযোগিতায় গড়ে ওঠা হোম স্টেগুলিতে (অ্যালপাইন, অর্কিড, ইয়াকচেরি, রিভার ভ্যালি প্রভৃতি হোম স্টে) থাকা এবং খাওয়া বাবদ খরচ পড়বে মাথাপিছু ১৫০০ টাকা।

যোগাযোগ-০৩৫৯২-২৫৭৬০০/৯৮৩২০৬৫৬১৭/৮৩৪৮৮১৩৮৪৫

Email : yaaktenvillagehomestay@gmail.com

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...