হিসাবের খাতা দেখে চমকে উঠল সুজয়। এত বেশি খরচ! মাত্র এক মাসে যদি এত খরচ হয়, তাহলে তো রাজাও ভিখারি হয়ে যাবে। বিড়বিড় করতে করতে সুজয় হাত দিয়ে নিজের কপাল চাপড়াল।

গত এক-দু’মাস ধরে সুজয় লক্ষ্য করছে যে, যখন-তখন এটিএম থেকে টাকা তুলে নিয়ে আসছে নন্দিতা। আবার যখন এটিএম থেকে টাকা তুলে আনার সময় পাচ্ছে না, তখন সুজয়ের থেকে টাকা চেয়ে নিচ্ছে সে।

কিছুদিন আগে এই খরচের বিষযটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি সুজয়। কারণ, তখন সে ভাবত, নতুন বিয়ে সদ্য সংসার সামলাচ্ছে নন্দিতা, তাই হয়তো খরচে লাগাম টানতে পারছে না। তবে মজার বিষয় হল এই যে, সুজয়ের নিজেরও সংসার খরচের কোনও জ্ঞান ছিল না। কারণ, তাদের যৌথ পরিবারের বেশিরভাগ সংসার খরচ সামলাতেন সুজয়ের মা এবং বাবা। আর বেশি কিছু না জানার কারণে, সুজয়ও বিয়ের প্রথম দিকে তেমন কিছু বলত না নন্দিতাকে। কিন্তু লাগামছাড়া খরচ হতেই সুজয় দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। এখন ওর মনে প্রশ্ন, এত টাকা কোথায় খরচ করছে নন্দিতা?

কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে সুজয় এবং নন্দিতার। কানপুর বদলি হওয়ার পর প্রথম দুমাস তো খরচ মোটামুটি ঠিকই চলছিল। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে খরচ অনেক বেড়েছে বলে মনে হয়েছে সুজয়ের। তাই সে এ ব্যাপারে নন্দিতাকে সতর্কও করেছিল কিন্তু নন্দিতা খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি সুজয়ের কথায়। ফলে, এই বিষয়ে সুজয়ের চিন্তা বাড়ছিল। ব্যবসায়ীর মেয়ে, টাকার অভাব নেই। বাঁধাধরা আয়ের সংসারে কীভাবে ভেবেচিন্তে খরচ করতে হয়, তা নন্দিতা কতটা বুঝবে, এই নিয়ে বিয়ে আগে থেকেই দুঃশ্চিন্তায় ছিল সুজয়।

এখন খরচের কথা ভেবে খুব রাগ হল সুজয়ের। সে এ বিষযে কড়া ভাবে সতর্ক করার জন্য বেশ রাগত স্বরেই ডাক দিল নন্দিতাকে।

সুজয়ের ওরকম গম্ভীর স্বর আগে কখনও শোনেনি নন্দিতা। তাই সে ঘাবড়ে গেল। রান্নার কাজ ছেড়ে বাইরে এল।

নন্দিতার ওইরকম ঘাবড়ে যাওয়া মুখ সুজয়ও আগে কখনও দেখেনি। এই প্রথম এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নন্দিতার মুখে ফুটে উঠতে দেখে, রাগের আগুন অনেকটাই নিভে গেল। নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে, ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে খুব ইচ্ছে হল তার কিন্তু খরচে লাগাম টানতে হবে এই তাগিদে নিজেকে সামলে নিল সুজয়। তারপর কোনও রকমে বলল, নন্দিতা, হিসাবের এই খাতাটা দেখো। খরচ কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছ না তুমি? গত মাসেও তোমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম আমি।

লজ্জাবনত হয়ে নন্দিতা উত্তর দিল, খরচ তো আমি নিয়ন্ত্রণেই রেখেছি। শাড়িও কিনছি না, মেক-আপ সামগ্রীও না, বিউটিপার্লার-এও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। যা খরচ করছি তা তো সংসারের প্রযোজনীয় সামগ্রী কিনতেই।

নন্দিতার উত্তরের পর খরচ নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে কথা হয়তো আরও এগোত কিন্তু হঠাত্ সুজয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করার পর সুজয় জানতে পারল, সহকর্মী সৌরভ তার জন্য হাউজিং-এর বাইরের গেট-এর সামনে অপেক্ষা করছে।

 

কলকাতা থেকে একই সঙ্গে কানপুরে ট্রান্সফার হয়েছে সুজয় এবং সৌরভ। দুজনে খুব ভালো বন্ধু। তাই, একই হাউজিং-এই কোয়ার্টার নিয়েছে দুজনে। অনেক সময় ওরা দুজনে একসঙ্গে অফিসে যায়। আজও তাই গেল।

এরই মধ্যে সুজয়ের বউ নন্দিতা এবং সৌরভের বউ শুভ্রার মধ্যেও একরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কখনও ওরা ডিনারও একসঙ্গে করে। যে-কোনও একজনের কোয়ার্টার-এ জড়ো হয়ে নন্দিতা এবং শুভ্রা দুজনে মিলে পছন্দের খাবার রান্না করে সবাই মিলে হইহুল্লোড় করে খায়।

কয়েক মাস আগে, একদিন সকালে নন্দিতার সঙ্গে দেখা করতে এল শুভ্রা। তাকে খুব চিন্তিত লাগছিল। সে বলল, আমার বাড়িতে একটুও চিনি নেই। বাচ্চাটার দুধে একটু চিনি লাগবে। সামনের মুদি দোকানটাও আজ বন্ধ। কিছুটা চিনি দাও, আমি কিনে এনে ফেরত দিয়ে দেব।

নন্দিতা হেসে ফেলল, আরে তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? এমন তো আমারও হতে পারে। সুজয়ও তো কিছু জিনিস আনতে ভুলে যেতে পারে। দাঁড়াও, দিচ্ছি।

চিনি হাতে নিয়ে শুভ্রা আবার জানাল, সন্ধেবেলা ফেরত দিয়ে যাব।

এক কৌটো চিনি ফেরত দেওয়াটা কি খুব জরুরি? আমাদের বন্ধুত্বটা কি এমনই ঠুনকো? কপট রাগ দেখায় নন্দিতা।

আচ্ছা ঠিক আছে ফেরত দেব না, হল তো? বলেই বল্ধুত্বপূর্ণ হাসি হাসল শুভ্রা।

এরপর থেকে সংকোচ কেটে গিয়েছ্লি শুভ্রার। যখন যা ফুরিয়ে যেত, নির্দ্বিধায় এসে নন্দিতার থেকে চেয়ে নিয়ে যেত। আর অজুহাত হিসাবে, বর সৌরভের সংসারের প্রতি উদাসীনতার কাহিনি শুনিয়ে যেত।

প্রথম দিকে সুজয় ও সৌরভ দুজনেই নিজেদের স্কুটার নিয়ে অফিসে যেত। এরপর খরচ বাঁচানোর জন্য দুজনে একটা স্কুটারে অফিস যাওয়া শুরু করল। একদিন সুজয়ের স্কুটার তো পরের দিন সৌরভের স্কুটারে অফিস যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল।

কখন সন্ধে নেমেছে বুঝতে পারেনি নন্দিতা। সুজয়ের স্কুটারের শব্দে বাইরে এল সে। দেখল, স্কুটারের পিছনে একটা পাঁচ লিটারের রিফাইন্ড তেলের জার নিয়ে বসে আছে সৌরভ। সুজয় স্কুটার থামাতেই সৌরভ স্কুটার থেকে নেমে বলল, এই নিন বউদি আপনার রান্নার রসদ ৷ এই বলে তেলভর্তি জার-টা নন্দিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।

ওদিকে সুজয়ের মাথা থেকে তখনও সংসারের অতিরিক্ত খরচের বিষযটা মুছে যায়নি। তাই সে নন্দিতাকে পাশে বসিয়ে হিসাবের খাতার প্রতিটা পাতা আবার দেখতে শুরু করে। কিছুক্ষণ দেখার পর, প্রত্যেকটি জিনিস কেন এত বেশি খরচ হচ্ছে জানতে চায় সুজয়।

নন্দিতা, গত মাসে পাঁচ কেজি চিনি কিনেছ। এত চিনি কোথায় খরচ করলে? দুজন তো মাত্র লোক আমরা। প্রতি মাসে খুব বেশি হলে দু-আড়াই কিলোগ্রামের বেশি চিনি খরচ হওয়ার কথা নয়!

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে খুঁজে পায় না নন্দিতা।

সুজয় আবার বলতে থাকে, ডিটারজেন্ট পাউডারও ডবল এসেছে দেখছি। ৫০০ গ্রাম ডিটারজেন্ট-এ দুজনের জামকাপড় কাচা হয়ে যাওয়া উচিত। তা নয়, মাসে ১ কিলোগ্রাম খরচ হয়েছে দেখছি।

এবার আর চুপ থাকতে পারল না নন্দিতা। আস্তে আস্তে বলল, সৌরভ মুদিমশলা কেনার সময় পায়নি, তাই শুভ্রা এসে কিছু জিনিস ধার নিয়ে গেছে। বলেছে খুব তাড়াতাড়ি ফেরত দেবে।

সে না হয় বুঝলাম কিন্তু ২০ দিনে গ্যাস সিলিন্ডার ফুরোল কী করে? আমাদের তো তিনমাস চলে যায়।

সৌরভ গ্যাস বুক করারও সময় পায়নি। শুভ্রা তাই এসে আমাদের এখানে রান্না করে নিয়ে যায়।

নন্দিতার কথা শুনে সুজয় খুব রেগে যায় এবার। প্রায় চিত্কার করে বলতে থাকে, সৌরভের সময় না থাকলে শুভ্রা গ্যাস সিলিন্ডার বুক করে নিতে পারত, না পারলে আমাকে বললে আমি বুক করে দিতাম।

একটু থেমে সুজয় আবার বলতে শুরু করল, আর এত সবজি কীভাবে খরচ হল?

সবজিও যে শুভ্রা নিয়েছে, একথা আর নিজের মুখে বলতে পারল না নন্দিতা। এরপর নন্দিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুজয় হিসাবের খাতা বন্ধ করে রাখল। আর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নন্দিতা বলল, তুমি-ই বা কী লোক, অফিস থেকে এসেই হিসাবের খাতা নিয়ে বসে পড়লে! চা-খেয়ে একটু তো বিশ্রাম নেবে…

বিষয়টা তা নয় নন্দিতা। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-এ আর সামান্য ১০ হাজার টাকা পড়ে আছে। ফ্রিজ-এর জন্য ৫ হাজার টাকার কিস্তি মেটালাম। এদিকে সৌরভ বলল, ওর হাতে একদম টাকা নেই৷ ছেলের স্কুলের ফিজ দেওয়ার জন্য আড়াই হাজার টাকা ধার নিল আমার থেকে। আমার মাথায় ঢুকছে না, এসব কী ঘটছে! বলেই ওখান থেকে উঠে অন্য ঘরে চলে গেল সুজয়।

 

দিনটা ছিল রবিবার। হঠাত্ একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এল সুজয়ের। কীসের শব্দ বোঝার জন্য ছাদে গেল সে। ছাদে গিয়ে দেখল, দুটো লোক ডিশ বসাচ্ছে পাশের ছাদে। আর ওদের পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে সৌরভ। এই দৃশ্য দেখে, নীচে নেমে এল সুজয়।

ঘরে ঢুকে নন্দিতাকে সুজয় জানাল, দুদিন আগেই ছেলের স্কুলের ফিজ দিতে পারছিল না সৌরভ, আজ কী করে ডিশ বসাচ্ছে?

বিষযটা তখনকার মতো সামাল দেওয়ার জন্য নন্দিতা সুজয়কে বলে, আরে ওদের কেবললাইন খুব ডিসটার্ব করছিল, টিভি ঠিকমতো চলছিল না। শুভ্রার বাড়িতে একা একা সময় কাটানোই দায়৷ তাই হয়তো ডিশ বসাচ্ছে।

সে ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে অন্যের কাছে টাকা ধার নিয়ে? রাগত স্বরে প্রশ্ন সুজয়ের।

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে নন্দিতা বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাগ করবে না তো?

বলো, কী বলতে চাও।

সৌরভ-শুভ্রার সঙ্গে এত ঘরোযা সম্পর্ক, তাই তোমাকে এতদিন কিছু বলিনি। এই যে তুমি প্রায়ই বলছ না যে, খরচ এত বাড়ছে কেন? তাহলে শোনো, শুভ্রা যা যা জিনিসপত্র ফেরত দেবে বলে নিয়ে গেছে, তা আজ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি।

মানে? আর কী কী নিয়েছে শুভ্রা?

সবজি, দুধ, চা, চিনি, রিফাইন্ড তেল আরও অনেক কিছু। রান্না করেও নিয়ে যায় আমাদের বাড়ি থেকে।

এ যে নিয়মিত চলছে, এ কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?

আসলে আমি বিষযটাকে খুব হালকা ভাবে নিয়েছিলাম এতদিন। তাছাড়া, সৌরভ তোমার সহকর্মী, বন্ধু…

ঠিক আছে, সতর্ক থেকো এবার থেকে।

কিন্তু কীভাবে?

আবার কিছু চাইতে এলে একটা কিছু অজুহাত দিয়ে না করে দিও। এমন ভাবে বলবে যেন খারাপ না ভাবে।

আমি তো ঠিকমতো অজুহাত দিতেও পারি না।

যাইহোক একটা কিছু বলে দিও। যেমন দুধ কেটে গেছে, চিনি শেষ হয়ে গেছে এমনই একটা কিছু।

এই পর্যন্ত বলে অন্য ঘরে চলে গেল সুজয়। এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার৷

 

পরের দিন সকালে শুভ্রা আবার নন্দিতাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর বলতে শুরু করে, আরে এভাবে দরজা খুলে রেখেছ কেন?

কথার কোনও উত্তর নন্দিতার থেকে না পেয়ে আবার শুভ্রা বলতে থাকে, আরে কী বলব আর, আজ আমার কপালটাই খারাপ। দুধ গরম করতে বসিয়ে স্নান করতে গিয়েছিলাম, এসে দেখি সব দুধ উপচে পড়ে গেছে। একটু দুধ দাও, বাচ্চাকে খাওয়াব।

দুধ কেটে গেছে গো– সুজয়ের শেখানো এই অজুহাত দেওয়ার আগেই নন্দিতা দেখে অবাক হল যে, ফ্রিজ খুলে, এক প্যাকেট দুধ বের করে নিয়েছে শুভ্রা৷ বলল, নিলাম একটা প্যাকেট, সন্ধেবেলা সৌরভ আনলে ফেরত দিয়ে যাব।

নন্দিতা কিছু বলার আগেই দুধের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল শুভ্রা।

এক ঘন্টা বাদে আবার ডোরবেল বাজল। নন্দিতা দরজা খুলে দেখল, শুভ্রা দাঁড়িয়ে এরপর নন্দিতাকে সরিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গিয়ে জানতে চাইল, আজ কী রান্না করছ?

নন্দিতা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর মুখ থেকে তাই বেরিয়ে গেল, উচ্ছে ভাজছি।

শুভ্রা বাহ্ বলার পর আরও ঘাবড়ে গেল নন্দিতা। এবার তো মনে হচ্ছে উচ্ছে ভাজাও চাইবে!

না, তা চাইল না শুভ্রা। বরং বলল, তাহলে তো আজ আলু আর লাগছে না কোনও সবজিতে। দাও চারটে আলু। আমার ঘরে আজ আলু ফুরিয়েছে।

নন্দিতার কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সুজয়ের দেওয়া টোটকা কাজে লাগাতে না পেরে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার।

সন্ধেবেলা নন্দিতার মুখ থেকে পুরো ঘটনার বিবরণ শুনে, সুজয়ও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না সুজয়ও।

 

আবার এক রবিবার এসে গেল। সুজয় দেখল, ওর অন্য এক সহকর্মীও ওদের পাশের কোয়ার্টারে মালপত্র নিয়ে ঢুকল। অপূর্ব নামের ওই সহকর্মীর সঙ্গে ওর বউকেও দেখা গেল।

অপূর্বর অনুরোধে সুজয় ও সৌরভ দুজনেই জিনিসপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে ঘরে ঢোকাতে সাহায্য করল।

জিনিসপত্র ঢোকানো শেষ করে সৌরভ নিজের ঘরে চলে গেল। সুজয় থেকে গেল অপূর্বর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আর আড্ডার মধ্যেই ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণও করে এল।

রাতে খাবার খেতে খেতে কথায় কথায় সুজয়কে অপূর্ব বলল, জানিস সুজয়, এই সৌরভটা তো দেখছি অদ্ভুত মানুষ! সিলিন্ডারে গ্যাস ফুরিয়েছে বলে দুপুরে আমাদের বাড়ি থেকে ইন্ডাকশন কুকারটা নিয়ে গেল, এখনও ফেরত দিল না।

তোদের ইন্ডাকশন কুকার আছে সৌরভ জানল কী করে? প্রশ্ন সুজয়ের।

জিনিসপত্র নামানোর সময় তো সৌরভও ছিল সঙ্গে, দেখেছে তখনই। জানায় অপূর্ব।

এই কথা শোনার পর সুজয় এবং নন্দিতা পরস্পরের দিকে তাকায়। নন্দিতা কিছু বলতে চায়। ওর ইচ্ছে হয় সৌরভ ও শুভ্রার মুখোশটা অপূর্বদের সামনে খুলে দিতে। কিন্তু সুজয় ইশারায় বারণ করে কিছু বলতে।

অপূর্ব এবং ওর স্ত্রী কুহেলী, সুজয়ের বাড়িতে ডিনার সেরে নিজেদের কোয়ার্টারে চলে যায়। কিন্তু সৌরভ-শুভ্রার অন্যায় আবদারের বিষয়টা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে সুজয়ের। সে ভাবতে থাকে, সবার থেকে জিনিস নিয়ে ফেরত না দেওয়া তো এক রকমের চিটিংবাজিই। দিনের পর দিন এ তো সহ্য করা যায় না। এ তো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সে ওদের অসভ্যতা বন্ধ করার পথ খুঁজতে থাকে কিন্তু পায় না। তখন সে এর কিছু একটা উপায় বের করতে অনুরোধ করে নন্দিতাকে।

সুজয়কে বিচলিত হতে দেখে নন্দিতা বলে, আমরা আর কিছু দিতে পারব না বলে সরাসরি জানিয়ে দেব।

না, তা ঠিক হবে না। সম্পর্ক নষ্ট হবে।

আচ্ছা, দেওয়া জিনিসগুলো যদি ফেরত চাই, তাহলে বেশ জব্দ হবে কিন্তু।

তা করা যেতে পারে কিন্তু বুঝে যাবে বিষয়টা।

তাহলে তো কোয়ার্টার চেঞ্জ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কোয়ার্টার বদলানো খুব সহজ কাজ নয় নন্দিতা। তাছাড়া, সেখানেও তো এমনই কেউ কপালদোষে জুটে যেতে পারে। তাহলে তখন কি আবার কোয়ার্টার চেঞ্জ করব নাকি? না, না, কোয়ার্টার চেঞ্জ করা কোনও সলিউশন হতে পারে না।

সমাধানসূত্র সে রাতে আর বের করতে পারল না ওরা।

পরের দিন সুজয় অফিস চলে যায়। শুভ্রা যথারীতি এসে পেঁয়াজ, চিনি এবং কাপড় কাচার সাবান নিয়ে যায় নন্দিতার থেকে। একথা ফোন করে সুজয়কে জানায় নন্দিতা।

 

অফিসে লাঞ্চ টাইম। অনেকে একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করছে। সৌরভের উদ্দেশ্যে সুজয় হঠাত্ বলল, শোন সৌরভ, আজ তোর বাড়িতে পেঁয়াজ, চিনি, ডিটারজেন্ট পাউডার ফুরিয়েছে। বাড়ি ফেরার সময় কিনে নিয়ে যেতে ভুলবি না।

তুই কী করে জানলি?

আরে বন্ধু, তুই তো বাড়ির সব জিনিস কিনতে ভুলে যাস, আর বেচারা ম্যাডাম শুভ্রা এর-ওর থেকে ধারবাকি নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তাই, নন্দিতাকে আমি বলে এসেছিলাম সৌরভের বাড়িতে যা যা থাকবে না, আমাকে জানাতে। একটু আগে নন্দিতা জানিয়েছে, আজ শুভ্রা ম্যাডাম পেঁয়াজ, চিনি আর ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে গেছেন আমাদের বাড়ি থেকে।

সুজয়ের কথা শুনে বেশ রেগে যায় সৌরভ। সবার সামনে এভাবে অপমানিত হবে ভাবতে পারেনি। তাই সামাল দেওয়ার জন্য সৌরভ বলে যে, আরে এটা নিতান্তই মেয়েলি বিষয়৷ তাছাড়া ফলাও করে বলার মতো কী আর এমন নিয়েছে!বন্ধু-প্রতিবেশীদের মধ্যে এটুকু আদানপ্রদান তো চলতেই থাকে। কিন্তু তাই বলে ঢাক পেটানোর মতো কিছু হয়নি।

সৌরভের কথা শেষ হতে না-হতেই অপূর্ব এসে বলে, আরে তোর গ্যাস সিলিন্ডার

এল? আমার ইন্ডাকশন কুকারটাও তো ফেরত দিলি না।

এমন দু’মুখো আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না সৌরভ। তাই আর কথা বাড়াল না।

এরই মধ্যে ওদের এক অন্য সহকর্মী বিপিন একটা টিফিনবক্স থেকে এক চামচ পটলের তরকারি তুলে নিয়ে মুখে ভরে বলল, বাহ্, দারুণ তো। এটা কার বাড়ির?

আমার বাড়ির, বেশ জোর দিয়ে বলল সৌরভ।

এটাও সুজয়ের বাড়ির নয় তো? নিজের বাড়ির বলে চালিয়ে দিচ্ছিস… বলেই হো হো করে হেসে উঠল বিপিন।

খবরদার, ভুলভাল মন্তব্য কোরো না বিপিন। আজ আমার বাড়িতে পটল রান্না করেছিল বউ। রাগত স্বরে উত্তর দেয় সৌরভ।

কাউন্টারে বিপিন জানায়, আসলে রোজই তো সুজয়ের বাড়ির খাবার আসে, তাই আজও ভাবলাম…

কথা আরও এগোতে, সৌরভ রেগে টিফিনবক্স নিয়ে উঠে চলে গেল।

সন্ধেবেলা সুজয়ের স্কুটারের পিছনে বসে বাড়ি ফিরছিল সৌরভ। বাজার আসতেই স্কুটার থামিয়ে সুজয়, সৌরভের উদ্দেশ্যে বলে, যা, যেসব জিনিস বাড়িতে নেই, কিনে নে সব। আমার খুব খারাপ লাগে, শুভ্রা ম্যাডামের জন্য। বেচারা চেয়েচিন্তে সংসার চালান।

সুজয়ের কথা শোনার পর, এক হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো বাধ্য হয়ে সব জিনিসপত্র কিনতে থাকে সৌরভ।

এক মুদি দোকানি তো বলে বসল, ক্যায়া বাত হ্যায় সাহাব, ইতনা দিন বাদ!

সৌরভকে আরও খোঁচা দিতে, মান্ডি-মার্কেটের দোকানির উদ্দেশ্যে সুজয় বলে, ম্যায় হি লে জাতা হুঁ সব কুছ, লেকিন কলসে ইয়ে আয়েগা, চিন্তা মত কিজিয়ে৷

কথা শেষ করার পর, সুজয় বেশ কিছু জিনিসপত্র আলাদা প্যাক করতে বলে দোকানদারকে। আর সৌরভের উদ্দেশ্যে বলে, শোন, কিছু জিনিস আমি বাড়ি নিয়ে যাব। টাকা তুই দিবি। কারণ, ধার-করা জিনিস শুভ্রা ম্যাডাম নিজের হাতে ফেরত দিতে এলে আমার খারাপ লাগবে। তাই, আগে থেকেই আমি এসব নিয়ে চলে যাচ্ছি। কেউ জানতে পারবে না।

সবকিছু দেশেশুনেও কিচ্ছু বলার ছিল না সৌরভের। তাই, সে চুপচাপ দোকানদারকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে সব জিনিসপত্র পিঠে তুলে, সুজয়ের স্কুটারের পিছনের সিটে এসে বসে।

সৌরভকে স্কুটার থেকে ওর কোয়ার্টার-এর সামনে দিয়ে নিজের কোয়ার্টার-এ আসে সুজয়। সৌরভের থেকে নেওয়া জিনিসপত্র স্কুটার থেকে নামিয়ে নন্দিতার হাতে দেয় সে।

জিনিসপত্র রাখতে রাখতে নন্দিতা জিজ্ঞেস করল সুজয়কে, শুভ্রা যা নিয়ে যাবে, রোজই কি তোমাকে ফোন করে জানাতে হবে?

কাল থেকে আর ফোন করার প্রয়োজন হবে না বলে মনে হয়।

মানে?

আজ এমন মুশকিলে ফেলেছি সৌরভকে, সারা জীবন মনে রাখবে। সব জিনিস ওর টাকায় কিনেছি। শুধু তাই নয়, আরও দুহাজার টাকা গচ্চা যাবে ওর। আমার স্কুটারেই এতদিন যাতায়াত করেছে। কথা ছিল, এক-এক দিন এক-একজন স্কুটার নিয়ে অফিস যাব। তা না করে, এতদিন নিজের স্কুটার খারাপ বলে বাহানা দিয়ে আমার স্কুটার ব্যবহার করেছে। কাল আর সে বাহানাও দিতে পারবে না। মেকানিক পাঠিয়ে স্কুটার সারাই করিয়ে দিয়েছি। বাড়িতে ঢুকলেই মেরামতের বিল পেয়ে যাবে। এতক্ষণে বিল পেয়েও গেছে হয়তো। বলেই হো হো করে হাসতে থাকে সুজয়।

নন্দিতা সুজয়ের কথা শুনে হতবাক হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলে, তুমি সত্যি জিনিয়াস! হাসতে হাসতে সুজয়ের গায়ে ঢলে পড়ে নন্দিতা। ওদের আনন্দ আর হাসিতে মুখরিত হয় সন্ধের পরিবেশ। মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদটাও যেন মিটিমিটি হাসছে তখন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...