ছোটোবেলায় শুনেছিলাম রামেশ্বরমের সমুদ্রপাড় থেকে ধনুষ্কোটির সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে পাকপ্রণালী পার হয়ে এককালে যাওয়া যেত ভারত থেকে সিংহলে। সেই রাস্তার পুনর্নির্মাণ হয়নি, সড়কপথে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ আর বাস্তাবায়িত হয়নি। তাই আকাশপথেই কলকাতা থেকে পৌঁছেছি কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে। তারপর একদিন কলম্বো সফর করে চলেছি অনুরাধাপুরের পথে। দূরত্ব প্রায় ২০৬ কিমি। প্যাকেজ ট্যুর হলেও আমরা পাঁচজন নিজস্ব একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছি। লম্বা পথ, একবার শুধু কার্তিক মন্দিরে নেমে দর্শন করে আবার এগিয়ে চলেছি। পথে সে রকম দর্শনীয় কিছু নেই– ফাঁকা মাঠ, মাঝে মাঝে চাষের খেত, গাছপালা, গ্রাম, আধাশহর। সঙ্গে আনা শ্রীলংকা সম্পর্কিত তথ্য পুস্তকগুলিতে মনোযোগ দিই।

শ্রীলংকার ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময় দেশে ভগবান বুদ্ধের পদার্পণ ঘটে আর এই ঘটনাই দেশের সভ্যতা প্রসারের ভিত্তি। কথিত আছে আরও আগে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজকুমার বিজয়, শ্রীলংকায় আসেন আর এই দ্বীপের প্রথম রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন সিংহলী জাতিকে। প্রথম সিংহলী রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এই অনুরাধাপুরের কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুরাধাপুরের ধবংসাবশেষ দক্ষিণ এশিয়ার এক এমনই আকর্ষণ যা স্মৃতিকে অনেক প্রাচীন সভ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

অনুরাধাপুরের এই বিশাল চত্বর জুড়ে পুরাতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যশিল্পের অতুলনীয় সমষ্টি। কখনও দেখা যাবে স্তূপ (দাগোবা), বিশাল আকৃতির ইটের স্থাপত্য, প্রাচীন পুষ্করিণী বা ভগ্ন মন্দির যা কয়েক হাজার বছর আগে অনুরাধাপুরে শ্রীলংকার রাজাদের শাসনের সময় নির্মিত। আজকের দিনেও তার অনেকগুলি যেন জীবন্ত! কখনও পবিত্র বা ধার্মিক স্থান হিসাবে মানুষের সমাগম হচ্ছে। মন্দিরে পূজা বা নানা উৎসবে মানুষের মনে স্পন্দন জাগাচ্ছে।

পান্ডুকাভায়ার রাজত্বকালে অনুরাধাপুর, সিংহলের প্রথম রাজধানী হয়। সেটা ৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব। কিন্তু দেবনামপিয়া টিসার রাজত্বকালে  বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার সিংহলে শুরু এবং সামাজিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধারণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই অনুরাধাপুর সমৃদ্ধির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের হাতে তার পতন হয়। এই ঘটনা হাজার বছরের মধ্যে বার বার ঘটেছে। কিন্তু ডুটুগেমুনু তার গুপ্ত আশ্রয়স্থল থেকে একদল সৈন্য জোগাড় করে তাদের সাহায্যে আবার অনুরাধাপুর পুনরুদ্ধার করেন। ডুটুগেমুনু তার রাজত্বকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নির্মাণ করেন, যা আজকের দিনেও বর্তমান। এর পরবর্তীকালের গুরুত্বপূর্ণ রাজাদের মধ্যে রয়েছেন ভালাগাম্বা যিনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের আক্রমণে সিংহাসন হারান কিন্তু আবার তা পুনরুদ্ধার করেন। অনুরাধাপুরে শেষ মহান রাজা ছিলেন মহাসেনা যার আমলে জিতবনরামা দাগোবা বা স্তূপ নির্মিত হয়। এছাড়া পুষ্করিণী ও একটি ক্যানেল কাটানোর তিনি ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ক্রমাগত দক্ষিণ ভারতীয় আক্রমণের ফলে রাজধানী, দেশের আরও অভ্যন্তরে পোলোনারুয়ায় স্থানান্তরিত হয় এবং অবশেষে ক্যান্ডিতে স্থাপিত হয়। এই অনুরাধাপুর, পোলোনারুয়া, ক্যান্ডি স্থানগুলি পরস্পরের সঙ্গে সরলরেখায় যুক্ত করলে যে ত্রিভুজ তৈরি হবে তাকে সাংস্কৃতিক ত্রিভুজ বলে আখ্যা দিয়েছে ইউনেস্কো। শ্রীলংকা ছোটো দেশ হলেও এখানে রয়েছে সাত-সাতটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

এই সব হেরিটেজ সাইটে যেমন জীবন্ত মানুষ তথা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অস্ফুট ধর্মীয় উচ্চারণ ধবনি শোনা যায় তেমনই প্রাচীন ইটের মন্দির, পাথরের মূর্তি, বিশাল স্তূপগুলির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য আধুনিক মানুষকে মুগ্ধ করে, মনে স্পন্দন জাগায়। এই হেরিটেজ সাইটগুলির মাধ্যমে ফিরে যাই সেই প্রাচীন যুগে যেখানে পরপর ছায়াছবির মতো ফুটে ওঠে কালক্রমে একের পর এক দৃশ্যাবলী– বৌদ্ধ ধর্মের শুভ সূচনা, যার অনুপ্রেরণায় রাজাদের নির্মিত নানা বিস্ময়কর নির্মাণকল্প, রাজসভায় নানা চক্রান্ত, বারবার বিদেশি শত্রুর আক্রমণ এবং অবশেষে ইউরোপীয়দের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন।

ইতিমধ্যে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি। রাস্তার ধারে এক মহিলা ডাব বিক্রেতাকে দেখে তৃষ্ণাটা আরও বেড়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে অনেকেই ডাবের জল পানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডাবের দাম অবশ্য কম নয়, ডাব প্রতি সত্তর রুপি।

অবশেষে পৌঁছোলাম অনুরাধাপুরে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন অনুরাধাপুরের সমৃদ্ধির ঐতিহাসিক নিদর্শন। ভারতের বাইরে এই সিংহলেই মৌর্যসম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু করেন।  তবে আংশিক দেখার টিকিট আলাদা মূল্যেও পাওয়া যায়। এছাড়া এ ধরনের ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণে একজন অভিজ্ঞ গাইডেরও প্রয়োজন। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ও টুর গাইড হেমন্ত অবশ্য তৎপরতার সঙ্গে জোগাড় করে আনল ফিল্মস্টার মার্কা চেহারার এক গাইড নাম তার জগৎ। গেট দিয়ে ঢুকে বিশাল চত্বরের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি বোধিবৃক্ষের দিকে। যেতে যেতে নজরে আসে জাপানি অর্থ সাহায্যে নির্মিত এক লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম। সালে উদ্ঘাটিত এই মিউজিয়ামের দরজা কিন্তু বন্ধ ছিল।

আর একটু এগিয়েই ফুল বিক্রেতারা বসে আছে। সবাই পথ্বফুল বিক্রি করছে। বোধিবৃক্ষের তলায় এই পথ্বফুল উৎসর্গ করার জন্যই বোধহয় অনেকে কেনাকাটা করছে। আমাদের গাইড জগৎ বলতে শুরু করে– দর্শনার্থীরা যেদিকে যাচ্ছে ওই বৃক্ষটিই হল বোধিবৃক্ষ বা শ্রীমহাবোধি। গৌতম বুদ্ধ যে-গাছের নীচে ধ্যানমগ্ন হয়ে মহানির্বাণ লাভ করেন, পিতার নির্দেশে সেই ‘বো’ বৃক্ষের একটি চারা সংগ্রহ করে সিংহলে নিয়ে এসেছিলেন সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা। অশোকের পুত্র মহেন্দ্র অনুরাধাপুরের রাজা দেবানামপিয়াতি সসাকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করে এই চারাটি উপহার দেন। তারপর এই পবিত্র বৃক্ষটি মহাসমারোহে রোপন করা হয়। তারপর অনুরাধাপুর একাধারে হয়ে ওঠে রাজধানী-শহর ও বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান। অনেক বৌদ্ধস্তূপ, মনাস্ট্রি, জল সরবরাহের জন্য পুষ্করিণী ইত্যাদি নিয়ে সমৃদ্ধ হয় এই শহর।

এরপর বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণে অনুরাধাপুরের পতন হয়। পেলোনারুয়ায় নতুন রাজধানী স্থাপন হয় আর অনুরাধাপুর ঢেকে যায় গভীর জঙ্গলে। ঊনিশ শতকে ইংরেজ আমলে জঙ্গল পরিষ্কার করে অনুরাধাপুরে ঐতিহাসিক শহরের সন্ধান মেলে। এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যশালী স্থানের মর্যাদা পেয়েছে।

 

আমরা বোধিবৃক্ষের কাছে পৌঁছে গেছি। এবার এগোতে হলে জুতো খুলতে হবে। গাইড মহাশয় অনুরোধ করলেন যে যারা জুতো দেখভাল করছে তাদের যেন অন্তত ২০ টাকা মাথাপিছু টিপ্স দেওয়া হয়। বোধিবৃক্ষ বেশ বড়ো একদিকে হেলে পড়েছে। এই গাছের ডালগুলি এখন সোনার পাতে মোড়া ঠেকার সাহায্যে রক্ষা করা হচ্ছে। গাছের চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে, একেবারে কাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। এই বোধিবৃক্ষই এখন বিশ্বের সব চেয়ে প্রাচীন বৃক্ষ বলে পরিগণিত হয়।

গাছের পাটাতনে উঠতে সিঁড়ি রয়েছে তা খুবই প্রাচীন তবে গাছকে ঘিরে যে সোনালি রেলিং রয়েছে তা আধুনিক কালের। এই রেলিংগুলি পুণ্যার্থীরা রঙিন কাপড় ও প্রার্থনা পতাকা দিয়ে সাজিয়ে দেয়। তারপর বোধিবৃক্ষের নীচে পূজা নিবেদন করে। এখানে এপ্রিল ও ডিসেম্বর মাসের পূর্ণিমাতে পুণ্যার্থীদের সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। বৃক্ষের পাদমূলে ছোটো মন্দির, সেখানে রয়েছে ছোটো ছোটো বুদ্ধমূর্তি। বোধিবৃক্ষের পিছনে একটি সাদা রং-এর মন্দির সদৃশ স্থাপত্য তার ভিতরে নানা রং-এ রঞ্জিত কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি। মার্বেল পাথরের মেঝেতে বসে ভক্তরা বুদ্ধকে অন্তরের ভক্তি প্রণাম নিবেদন করছেন। সামনে নানা রং-এর পথ্বফুল বুদ্ধের চরণে নিবেদন করা হচ্ছে।

মন্দিরের দেয়াল বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার ছবিতে সজ্জিত। বোধিবৃক্ষ ও সংলগ্ন অঞ্চলটি অনুরাধাপুরের হূদয় বলা চলে। এখানে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। দলে দলে মানুষ সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে এখানে প্রণাম নিবেদনের জন্য একত্রিত হয়। নানা ধরনের পশরা নিয়ে বিক্রেতারা হাজির। বিক্রি হচ্ছে ফল-ফুল, হালকা খাবার, খেলনা ঠিক যেন মেলার পরিবেশ।

 

বোধিবৃক্ষ অঞ্চল ছেড়ে পাদুকা উদ্ধার পর্ব (অর্থাৎ টিপ্স দিয়ে জুতো নিয়ে) শেষ করে ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। কয়েকটি একই প্রজাতির সুন্দর দেখতে পাখি ঘাসের মধ্যে থেকে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। ছবি তুলতে কোনও অসুবিধাই হল না। গাইড পাখির নামটা জানালেও পরে ভুলে গেছি। একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম সারি সারি পাথর নির্মিত বড়ো বড়ো স্তম্ভ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জগৎ জানাল এটাই ব্রাজেন প্যালেস। এখানে ১ছঙ্মঙ্মটি পাথরের স্তম্ভ আছে। এর মাথায় ব্রোঞ্জের ছাদ ছিল বলেই নামকরণ ব্রাজেন প্যালেস। এই স্তম্ভগুলি ছাড়া সেকালের প্রসিদ্ধ নয়তলা বিশিষ্ট অট্টালিকার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানেই বাসস্থান ছিল এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তাদের সহচরদের। সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র তার সিংহল সফরে এই রাজপ্রাসাদেই বসবাস করতেন। এই রাজপ্রসাদটি প্রথমে নির্মাণ করেন রাজা ডুটুজেমুনু দু-হাজার বছরেরও আগে। কালের গ্রাসে তা বার বার ধবংসের দিকে এগিয়ে গেলেও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে কমেছে তার জাঁকজমক। বর্তমানে তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা এই প্রাসাদ।

এবার গাড়িতে করে এগোতে থাকি গাইডের নির্দেশে। বাঁদিকে পড়ল একটি বিরাট প্রাকৃতিক জলাশয়– নাম তার অনুরাধাপুর লেক। লেকের ধারে গাছপালা বিক্ষিপ্ত ভাবে বেড়ে উঠেছে সৗন্দর্যায়নের প্রচেষ্টা সেরকম ভাবে চোখে পড়ল না। কয়েকটি ছবি তুলে আবার এগিয়ে চলি। গাড়ি থামে থুপারামা স্তূপের সামনে। চারপাশে গাছপালা ঘেরা সাদা রং-এর এক অতি সুন্দর স্তূপ। চারধারে চারটি গেট, স্তূপ ঘিরে রয়েছে সবুজ লন ও ফুলের বাগান। থুপারামা স্তূপটি (দাগোবা) শ্রীলংকার তো বটেই পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন স্তূপ বলে স্বীকৃত।

আরও তথ্য জোগাল জগৎ– খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রাজা দেবনামপিয়া এটি নির্মাণ করেন। অনেকের মতে বুদ্ধের দেহের একটি অস্থি এখানে সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে ঘন্টার আকৃতির এই স্তূপ তার এই বর্তমান আকৃতি লাভ করে। তার আগে এটি ধানের গোলার আকৃতি ছিল। স্তূপটি এক কেন্দ্র বিশিষ্ট চারটি বৃত্তে পিলার দিয়ে ঘেরা। ঐতিহাসিকরা পিলারের উপস্থিতি নির্ধারণ করলেও বর্তমানে মাত্র ৪রটি উপস্থিত আছে। ঐতিহাসিকরা এই স্তূপের মাথায় কাঠের কৌণিক একটি ছাদও কল্পনা করেন কিন্তু কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ তার স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি।

যুপারামা স্তূপের পরই অভয়গিরি স্তূপ। অভয়গিরির অর্থ হল গিরির অভয় অর্থাৎ পাহাড়ের সুরক্ষা। তাঁর লেখনী থেকে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা যায়। বার বার এই স্তূপ নির্মিত হয় এবং সবশেষে তার উচ্চতা দাঁড়ায় ৭৫ মিটার। পশ্চিম দ্বারপ্রান্তে রয়েছে একটি হাতি গাছ টেনে আনার মূর্তি। উত্তর দিকের দ্বারপ্রান্তে যে পদচিহ্ন রয়েছে, সেটি বুদ্ধের পদচিহ্ন বলে কথিত। পূর্ব দিকের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে মুনস্টোন। রাজা ওয়ালাগাম্বারা নির্মিত এই স্তূপের নাম অনেক, অভয়গিরি ছাড়াও উত্তরা মহাচেতা, অপহাইয়াগরা, ভাগিরিনাকা, বায়াগির্যা প্রভৃতি।

সেই প্রাচীন কাল থেকে এই স্তূপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানকার শাসকেরা যেমন গজবাহু, মিত্তসেনা, কাসাপা ৪, পরাক্রমবাহু প্রভৃতি। বর্তমান কালের এই স্তূপের রূপ ও পূর্বের রূপের বিশাল ছবি স্তূপের কাছেই শোভা পাচ্ছে।

অভয়গিরি স্তূপের উত্তর পশ্চিম দিকে নবম শতকের আমলের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য নির্মিত বাসস্থানের ভগ্নস্তূপের সামনে আমরা উপস্থিত হয়েছি। এর খ্যাতি এখানে মুনস্টোনের উপস্থিতির কারণে। চারদিকে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে এই ভগ্নস্তূপ। প্রবেশ পথের কাছে রাস্তার ধারে স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান রয়েছে কয়েকটি। দু-চারজন টুরিস্টের দেখা পাওয়া গেল তবে সবাই বিদেশি। ভিক্ষুদের এই আশ্রম পিবিভেনা প্রাসাদ অথবা আরামা নামেও পরিচিত। সামনে একটি প্রধান বাসগৃহ। চারকোণে ছোটো আকারের বাসস্থান। এখানে জলের ও স্নানঘরের ব্যবস্থাও ছিল। সিঁড়ির মুখেই এক আশ্চর্য সুন্দর মুনস্টোন। মুনস্টোন হল অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের টুকরো যার গায়ে অর্ধবৃত্তাকারে কারুকার্য করা রয়েছে। সেকালের ভাস্কর্যশিল্পের গৗরবের স্বাক্ষর বহন করছে এই নিদর্শন অর্ধচন্দ্রাকৃতি চন্দ্রকান্ত মণি। এক একটি সারিতে এক এক রকমের নকশা– অধিকাংশই ফুল লতা-পাতা ও জীবজন্তুর। এই পাথরটির ব্যাস প্রায় ৯ ফুট এবং সমালোচকদের মতে এই সব কারুকার্যের জীবনযাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে এক অন্তর্নিহিত অর্থও রয়েছে। অভয়গিরি স্তূপের ঠিক দক্ষিণে অভয়গিরি মিউজিয়াম। খোলা থাকে সকাল ১০ থেকে  বিকেল ৫টা পর্যন্ত। চিন দেশের অর্থানুকুল্যে নির্মিত এই মিউজিয়াম।

পঞ্চম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিউয়েন-এর ভ্রমণের স্মারক হিসাবে এই নির্মাণ। ফা-হিয়েন তাঁর ভ্রমণকালে এই অভয়গিরি মনাস্ট্রিতে কিছুদিন বসবাস করেন এবং কিছু পুঁথির অনুবাদের কাজও করেন যা তিনি কাজের শেষে চিন দেশে নিয়ে যান। এই মিউজিয়ামে রাখা আছে বিভিন্ন সাইটে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক প্লেট, অলংকার, বাসনপত্র, ভাস্কর্যের নমুনা। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ও লম্বা সফরের ধকলে আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সেটা বোধহয় বুঝতে পেরে গাইড উৎসাহ দেয়, আরও অনেক কিছু দেখার আছে। অনুরাধাপুর দর্শন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে না। মুনস্টোন তো দেখলেন এবার দেখুন গার্ডস্টোন। একটি প্রাঙ্গণে অনেকগুলি খাড়া খাড়া পাথরের স্তম্ভ দেখিয়ে বললেন, ‘এ গুলো হল গার্ডস্টোন মন্দিরের চারধারে সব সময় নির্মাণ করা হয়। মন্দির রক্ষার জন্য এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপর দেখা হল ‘রত্নপ্রাসাদ’। নামেই রত্নপ্রাসাদ এখন এই গার্ডস্টোন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।

মুনস্টোন, গার্ডস্টোন দর্শন শেষে অভয়গিরি স্তূপের পূর্বদিকে খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি গাইডের নির্দেশে। জগৎ জানাল, আমরা শ্রীলংকার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাচ্ছি। খুবই আড়ম্বরপূর্ণ একটি মূর্তি দেখব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু খুবই সাধারণ পরিবেশে এক অসাধারণ মূর্তি দেখলাম। চতুর্থ শতকে নির্মিত ধ্যানরত বুদ্ধের এই পাথরের মূর্তি সত্যিই অনন্য। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ব্রিটিশ আমলে যখন কারাগারে অন্তরিন থাকতেন, তখন এই বুদ্ধমূর্তির ছবি সামনে রেখে মনের শান্তি ফিরে পেতেন।

 

আবার গাড়িতে ওঠা, তবে এবারও বেশি পথ নয়, তিন চার মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যের সামনে। নাম তার কুট্টাম পাকুনা যার অর্থ জমজ পুষ্করিণী এই পুকুর দুটি অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীতে সমৃদ্ধ। এখানে যেন সুকুমার শিল্পকলা ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন, সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত এই জোড়া পুষ্করিণী সম্ভবত অভয়গিরির বৗদ্ধ ভিক্ষুদের স্নানের জন্য নির্মিত হয়েছিল। নামে জমজ হলেও দক্ষিণ দিকের পুষ্করিণীটি অপেক্ষাকৃত বড়ো (র্ব২ ফুট দৈর্ঘ্য)। আর অন্যটি ৯১ ফুট লম্বা। আয়তক্ষেত্রকার পুষ্করিণী দুটির ঘাট সুন্দর ভাবে বাঁধানো এখনও প্রায় অটুট রয়েছে। বড়ো পুকুরটিতে জলের প্রবেশপথ একটি মকরমুখী গহ্বর দিয়ে তারপর মাটির তলার পাইপের মাধ্যমে ছোটো পুকুরে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে পুকুরে সঞ্চিত জলের রং সবুজ। পুকুরের ঘাটে অল্পক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পরের গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম।

পাশেই যেটা দর্শনীয় সেটা হল পাথরে নির্মিত ৩ মিটার লম্বা এক পাত্রবিশেষ। এই পাত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ভাত রান্না করে রাখা হতো। প্রায় ৫০০ ভিক্ষুর খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা। ফিরে আসি আবার পুরাতত্ত্ব স্থলের কাছেই যেখানে রয়েছে ইটের বিশাল স্তূপ জেতবন বিহার। এই স্তূপ বর্তমানে ৭০ মিটার উঁচু। তবে নির্মাণকালে এটি ১০০ মিটার উচ্চতা ছুঁয়ে যায়। তখন এটি ছিল পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম সৌধ, ইজিপ্টের পিরামিডের পরেই ছিল এর স্থান। জেতবন বিহার থেকে গাড়িতে ফিরে এলাম পার্কিং লটে তারপর সামান্য হেঁটে রুবানওয়ালি স্তূপের সামনে। এই স্তূপ নির্মিত হয়েছিল দুশো খ্রিষ্টপূর্বে। অর্ধগোলাকৃতি শুভ্র এই স্তূপের অন্দরে মার্বেল পাথরের মেঝে, সামনে তিনটি বুদ্ধমূর্তি। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ভগ্নদশায় পরিণত হয়। ইংরেজ আমলে এই স্তূপ পুনর্নির্মিত হয়। রাজা ডুটুজেমুনুর রাজত্বকালে এই স্তূপ নির্মিত হয়, যদিও জীবনকালে এই স্থাপত্য সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। শত্রুর আক্রমণে বিধবস্ত হলেও বর্তমানে এই স্তূপের উচ্চতা ৫৫ মিটার। স্তূপটির পূর্বের চেহারা ছিল জলের বুদ্বুদের মতো। কিন্তু বর্তমানে পরিমার্জনের পরে সে রূপ আর নেই। এই রুবানওয়ালি স্তূপের চারপাশে সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে ধবংসস্তূপের চিহ্ন পাথরের ভাঙা পিলার, আর পুকুর বা জলাশয়ের চিহ্নও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

এবার আমরা আজকের শেষ দ্রষ্টব্য অনুরাধাপুর পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার সামনে। ব্রিটিশ যুগের প্রশাসনিক ভবনকে এখন সংগ্রহশালা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এই মিউজিয়াম দর্শনের সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা। ঘড়ির কাঁটা এখন ৫টা ছাড়িয়ে গেছে তাই আমাদের আর মিউজিয়াম দেখার সুযোগ হল না। তবে জগতের মুখে তার বিবরণ শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো হল। এই মিউজিয়ামে আছে অনুরাধাপুর ও শ্রীলংকার নানা ঐতিহাসিক স্থানে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের শিল্পবস্তু, খোদাই করা নানা ভাস্কর্য এবং সেকালের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তুর সমাহার। অনুরাধাপুর দর্শন এখানেই শেষ।

গাইড জগৎকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে জানালাম, আমরা মুগ্ধ। জগৎ গ্রামের ছেলে হলেও নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখেছে। বই পড়ে ঐতিহাসিক তথ্যগুলিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বিদেশি ভ্রমণার্থীদের তার সুন্দর উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি দিয়ে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। জগৎ বিদায় নিলে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। আমাদের আজকের রাত্রিবাস অনুরাধাপুরের এক হোটেলে– ‘মেরিডিয়া লেক’।

যাত্রাপথে আমাদের ড্রাইভার হেমন্ত আর একবার গাড়ি থামাল। রাস্তার ধারেই বিশাল লেক, নাম নুয়ারাওয়া। এবারে হেমন্তই আমাদের গাইড। সে জানাল, এই লেকটি অনুরাধাপুরে পুর্ব দিকে অবস্থিত প্রায় ১২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে। এই লেকের আর এক নাম নাকারা ভাপি। প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায় যে এই লেক রাজা পান্ডুকাভারা খনন করেয়েছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২০ সময়কালে। এর পরিমার্জিত রূপ বর্তমানে আমরা দেখছি। লেকের ধারের গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে লেকের রূপ ধরে রাখলাম ক্যামেরায়।

হোটেল ‘মিরিডিয়া লেক’ মন্দ নয়। ঘরগুলি বেশ বড়ো ও সুসজ্জিত। আমাদের টুর প্যাকেজের শর্ত অনুযায়ী ডিনার এই হোটেলই ব্যবস্থা করবে। খাবার বেশ ভালো কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ, শ্রীলংকার স্থানীয় মেনুও রয়েছে। আমরা বুফে সিস্টেমে ডিনার সেরে যে যার নিজের নিজের ঘরে চলে গেলাম। সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে, কাল সকালেই আবার যাত্রা, ডামবুলা হয়ে ক্যান্ডির পথে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

  •  প্যাকেজ টুরে বিদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে শুধুই পাসপোর্ট লাগবে বাকি সব দায়িত্ব ভ্রমণ সংস্থার।
  •  শ্রীলংকার প্যাকেজ টুর করায় বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা। সময় সীমা ৬ দিন-র০ দিন। সেই অনুযায়ী ভ্রমণসূচী ও আর্থিকমূল্য পরিবর্তিত হয়।
  •  শ্রীলংকা ভ্রমণে কলম্বো দিয়েই ভ্রমণ শুরু করতে হবে কারণ প্রধান বিমানবন্দর কলম্বো।
  •  প্যাকেজ টুরে হোটেল, গাড়ি, খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা ভ্রমণ সংস্থা করবে।
  • শ্রীলংকা থেকে কেনাকাটা করা যেতে পারে চা-পাতা, মূল্যবান পাথর, মশলা।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...