অজয়ের টুর আছে। বাড়ি থেকে বেরোবে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে মা তনুজা এবং স্ত্রী রিনি।

মায়ের মুখ গম্ভীর দেখে অজয় বলল, মা, এত মন খারাপ করছ কেন? মাত্র এক সপ্তাহের জন্য তো টুর-এ যাচ্ছি। রিনিকে দ্যাখো, ও তো মন খারাপ করছে না, হাসিমুখে রয়েছে। টেক কেযার মা। নিজের এবং রিনির খেযাল রেখো। শনিবার সকালে আমি ফিরে আসব।

বাই মা, বাই রিনি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল অজয়।

তনুজা কিছুক্ষণ যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থেকে, তারপর বিষণ্ণ বদনে দরজা বন্ধ করলেন।

রিনি নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে মোবাইল ফোনটা টেবিল থেকে হাতে তুলল।

দুকামরার ফ্ল্যাট। তনুজার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে তিনি

ড্রইংরুম-এর সোফায় বসে থাকেন। ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর আজও তাই সোফায় বসলেন তনুজা।

ছেলে-বউমার বেডরুম-এর বাইরেই রয়েছে সোফাটি। ওখান থেকে ঘরের ভিতরের কথা শোনা যায় অনেকটাই।

দরজা বন্ধ করে রিনি কারওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। প্রথমে নীচু স্বরে কথা বলছিল। কিন্তু কথা বলতে বলতে স্বর কখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে, তা খেয়াল করেনি রিনি। তাই, তনুজা স্পষ্টতই শুনতে পেলেন, কারও সঙ্গে এখন লাঞ্চ-এ বেরোবে রিনি এবং সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরবে।

আধা ঘন্টা বাদে সেজেগুজে, হাতে পার্স নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল রিনি। তনুজা অবাক হয়ে দেখলেন যে, তাঁকে কিছু না বলেই, তাঁর সামনে দিয়ে রিনি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

মাথার যন্ত্রণা শুরু হল তনুজার। দুর্ভাবনা গ্রাস করল তাঁকে। মা-ছেলের সুখের সংসারে ঢুকে, এ মেয়ে সব তছনছ করে দিতে চলেছে ভেবেই, দ্বিগুন হল মাথার যন্ত্রণা। তনুজার তখন মনে পড়ে গেল, অজয় যখন রিনির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা তাঁকে বলেছিল, তখন তিনি খুশি হয়েছিলেন, অকপটে স্বাগত জানিয়েছিলেন রিনিকে। ভেবেছিলেন তাঁর ছেলের জীবন আরও আনন্দে ভরে উঠবে।

অজয় বিয়ে করার ঠিক দুবছর আগে, এক পথ-দুর্ঘটনায় মারা যান অজয়ের বাবা। তাই, মা-ছেলে মন খারাপ নিয়ে দিনযাপন করত। তারপর রিনি বউ হয়ে আসার পর, তনুজা এবং অজয়ের মন খারাপের রেশ কেটে গিয়েছিল অনেকটাই।

তনুজা যেমন শিক্ষিতা, তেমনই উদারমনা এবং লড়াকু। স্বামীকে হারানোর পর, ছেলেই তাঁর সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিল রিনি বউ হয়ে আসার আগে পর্যন্ত। কিন্তু এখন তনুজার খুশি যেন স্পিরিটের মতো হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

তনুজা প্রাচীনপন্থীও নন মোটেই। এক সময় কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন।

নারী-পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব কিংবা মেলামেশাকে তিনি নীচু নজরে দেখেন না। কিন্তু, অজয় টুর-এ যাওয়ার পরই কেন রিনির কাছে এত ছেলে আসে, তা ভেবেই খটকা লাগতে শুরু করে তাঁর মনে।

একবার তো অজয় টুর-এ বেরিয়ে যাওয়ার এক ঘন্টা পর একটি ছেলে আসে তাঁদের ফ্ল্যাটে। কলিং বেলের শব্দ শুনে তনুজা দরজা খোলেন।

নমস্কার আন্টি, আমি সুদীপ, রিনির বন্ধু। ও কোন ঘরে?

তনুজা রিনির ঘর দেখিয়ে দিতেই, ছেলেটি আর কোনও কথা না বলে সোজা রিনির বেডরুম-এ চলে যায়।

অনেকক্ষণ কোনও সাড়া না পেয়ে তনুজা ডাক দেন রিনিকে। কিন্তু রিনির পরিবর্তে সুদীপ দরজার বাইরে এসে বলে, রিনির খুব মাথা ধরেছে, রেস্ট নিচ্ছে।

ওইরকম কথা শুনে তনুজার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, তা তুমি বাবা কী করছ?

অমি ওর মাথার পাশে বসে আছি। রিনিই আমাকে ফোন করে ডেকেছে। বলেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ছেলেটি।

রাগে, অপমানে তনুজার তখন ইচ্ছে হয়েছিল, দরজা খুলিয়ে ছেলেটিকে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে। কিন্তু, নিজের অসহায়ত্বের কাছে হেরে গিয়ে সে কাজ আর করতে পারেননি তনুজা। কারণ, ততক্ষণে কিছু একটা আন্দাজ করে রিনি দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল। তার পরনে তখন রাতপোশাক। সে তনুজার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, আমার কাছে যারা আসবে, তাদের এত প্রশ্ন করবেন না। একটা কথা জেনে রাখুন, আমি স্বাধীনচেতা। যেমন খুশি, যেভাবে খুশি চলব। বেশি খবরদারি সহ্য করব না। আমি কাউকে ভয় পাই না। আর এ নিয়ে যদি ছেলের কাছে নালিশ করেন, তার ফল খুব খারাপ হবে।

এ কথা শুনে রাগ সামলাতে পারলেন না তনুজা। বললেন, কেন, কী করবে তুমি আমার? নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার।

মা-ছেলের নামে থানায় গিয়ে এমন কমপ্লেন করব যে, জামিন পাবেন না। মনে রাখবেন, বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত তোলা আর পন চাওয়ার কেস কিন্তু নন-বেলেবল। দাপটের সঙ্গে জানায় রিনি।

রিনির শাসানি শুনে ভয়ে ঘেমে স্নান করে গেলেন তনুজা। তাঁর মাথার মধ্যে তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমার সহজ-সরল ভদ্র ছেলেটা এ কোন রাক্ষসীর পাল্লায় পড়ল!

এরপর মন খারাপ করে সোফায় বসে পড়লেন তনুজা। তাঁর দুচোখ গড়িয়ে তখন জলের ধারা নামছে। আর এর ঠিক মিনিট দশেক পরে, সুদীপের হাত ধরে সেজেগুজে বেরিয়ে গেল রিনি।

না, এখানেই থেমে থাকেনি রিনির ঔদ্ধত্য। অজয় বাড়ির বাইরে গেলেই, সুদীপ ছাড়াও আরও প্রায় তিন-চারজন ছেলে নিয়মিত এসে রিনির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত।

রিনির অসভ্যতামি দেখে তনুজা প্রতি মুহূর্তে শুধু ভাবতেন, কী করে ছেলেকে তিনি বাঁচাবেন এই মেয়েটির হাত থেকে!

অনেকদিন সহ্য করার পর তনুজা একদিন রিনিকে বলেই বসলেন, তুমি অজয়কে ছেড়ে চলে যাও না কেন? যে-কোনও একজনের সঙ্গে থাকলে ভালো হয় নাকি?

তনুজার কথা শুনে রিনির সপাট জবাব, থাকব এখানেই। আর জেনে নিন, একজনের কাছে বাঁধাও থাকব না।

তাহলে অজয়কে বিয়ে করেছিলে কেন?

আপনার ছেলে আমাকে ফুঁসলে বিয়ে করেছে। খাঁচায় বন্দি থাকার মতো মেয়ে আমি নই। তাই, যত চুপচাপ থাকবেন, মা-ছেলের ততই মঙ্গল।

সেদিন রিনির স্পর্ধা দেখে সত্যিই খুব ভয় পেযে গিয়েছিলেন তনুজা। তাই, আর কথা বাড়াননি।

অজয় টুর-এ গেলে মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর বউয়ের সঙ্গে কথা বলত। রিনি তখন এমন অভিনয় করত যে, অজয় বুঝতেই পারত না কী ঘটে চলেছে ওর অনুপস্থিতিতে। শুধু তাই নয়, অজয় বাড়ি থাকলে তো রিনি এমন ভালোবাসা দেখায় যে, হঠাৎ কেউ দেখলে ভাববে, পতি-অন্তপ্রাণ। আর এসব দেখে তনুজার যখন সহ্য হতো না, তখন তিনি মনমরা হয়ে থাকতেন।

বাড়ি ফিরে মাকে গম্ভীর থাকতে দেখে অজয় জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বাড়িতে না থাকলে কি শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া হয়? এমন মুখ গোমড়া করে আছো কেন?

ছেলের প্রশ্ন শুনে তনুজার চোখ বেযে যখন জল গড়িয়ে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই তনুজার দুঃখ রাগে পরিণত করল রিনি। সে বলল, আমরা শাশুড়ি-বউমার মতো নই, মা-মেয়ের মতো। তুমি ভেবো না, আমাদের মান-অভিমান চলতেই থাকে।

রিনির কথা শুনে গা জ্বলে গেল তনুজার। একবার ভাবলেন, ছেলেকে সব বলে দেবেন, মুখোশ খুলে দেবেন রিনির। কিন্তু রিনির শাসানির কথা মনে পড়ে গেল। মা-ছেলে আইনি ঝামেলায় পড়ে যাবেন, এই ভয়ে আর মুখ খুলতে পারলেন না। পরিবর্তে, রিনির থেকে পরিত্রাণের উপায় শুধু ভাবতে থাকলেন।

সত্য চাপা থাকে না। তাই অজয়েরও চোখ খুলে গেল একদিন।

 

টুর না থাকলে, কলকাতার অফিসে গিয়ে কাজ করতে হয় অজয়কে। মার্কেটিং-এর কাজ, তাই সারা কলকাতা ঘুরেই কাজ করতে হয় তাকে। একদিন সহকর্মী প্রতীককে নিয়ে এক বড়ো রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করতে গেল অজয়। রেস্তোরাঁয় ঢুকেই ওর চোখে পড়ল, রিনি একজন তরুণের সঙ্গে বসে লাঞ্চ করছে। অজয় নিজেকে আড়াল করার জন্য একটা পিলারের পিছনের চেয়ারে বসল। তারপর মোবাইল ফোন থেকে কল করল রিনিকে।

রিনি ফোন তুলে বলল, হ্যালো।

কোথায় তুমি? জিজ্ঞেস করল অজয়।

এক বন্ধুর বাড়িতে।

বাড়ি ফিরবে কখন?

দেখছি। তাড়তাড়ি ফিরব।

এই পর্যন্ত রিনির মিথ্যেচার শোনার পর অজয় আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। সোজা গিয়ে রিনির টেবিলের সামনে দাঁড়াল। রাগে ওর মুখ লাল হয়ে গেছে।

অজয়কে দেখে একটু চমকে ওঠার পর, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ও, গোয়েন্দাগিরি করছ? তোমার মা পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই?

শাট-আপ।

আলাপ করে নাও, এ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সুদীপ।

এই কথা শুনে অজয়ের রাগ আরও বেড়ে যায়। তবে সে কিছু বলার আগে রিনি আবার বলে, এখানে বেশি সিনক্রিয়েট কোরো না, ফল ভালো হবে না।

লাঞ্চ-টাইম ছিল, তাই রেস্তোরাঁয় প্রচুর লোক। তা দেখে অজয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাড়ি চলো, যা কথা হবে বাড়িতে গিয়ে ওঠো।

দেখছ না, এখন আমি লাঞ্চ করছি। যাও, সন্ধেবেলা দেখা হবে।

রাগে অজয় কাঁপছিল। ঘটনা অপ্রীতিকর হয়ে উঠতে পারে দেখে, অজয়ের সহকর্মী প্রতীক অজয়কে রেস্তোরাঁর বাইরে নিয়ে আসে হাত ধরে। তারপর বলে, যা ঘটল তা খুব অস্বস্তিকর। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিস অজয়। রিনির মেজাজ খুব একটা ভালো লাগল না আমার।

অজয় আর অফিস গেল না। প্রতীকের হাতে অফিসের কাজগপত্র দিয়ে ফোনে

বস-এর থেকে হাফ-ডে ছুটির অনুমতি নিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেল সে।

অসময়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক হলেন তনুজা।

অজয় পুরো ঘটনার কথা জানাল ওর মাকে। তিনি মাথায় হাত রেখে বসে পড়লেন সোফাতে।

সন্ধের একটু আগে বাড়ি ঢুকল রিনি। তনুজা এবং অজয়কে বসে থাকতে দেখে সে বলল, কি মা-ছেলে পঞ্চায়েত বসিয়ে দিয়েছ আমার বিরুদ্ধে?

অজয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে।

পার্সটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে ধপাস করে সোফায় বসে রিনির জবাব, কে বের করবে আমাকে, তুমি? বেশি বাড়াবাড়ি করলে মা-ছেলেকে এমন শাস্তি দেব না, সারাজীবন জেলে পচে মরবে। আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে যত কম ঘাঁটাবে, ততই মঙ্গল তোমাদের।

তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন? কোনও জোর জবরদস্তি তো ছিল না?

ও সব কথা ছাড়ো। সামাজিক স্বীকৃতি আর অর্থের প্রয়োজন ছিল, তাই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। মনে রেখো, আমি ইশারা করলে দশটা ছেলে আমার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়ে যাবে।

ধমকে, চমকে পার্সটা সোফা থেকে তুলে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে গেল রিনি।

এই অবস্থা দেখে, মা-ছেলে অসহায় ভাবে বসে রইলেন ড্রইংরুম-এ।

এরপর অজয় রিনির সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। তনুজাও তাই করলেন।

কিছুদিন পর ১৫ দিনের জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার অর্ডার এল অজয়ের।

অজয়ও যেন হাঁফিযে উঠছিল বাড়ির এমন আবহে থাকতে। তাই, সিঙ্গাপুর যাওয়ার অর্ডার আসার সঙ্গে-সঙ্গে সে অ্যাকসেপ্ট করে নিল। সে এই ভেবে নিজেকে শান্ত রাখে যে, সিঙ্গাপুরে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেবে রিনির বিরুদ্ধে কী স্টেপ নেওয়া যায়। তাই সে তার মাকেও মাথা ঠান্ডা রেখে সাবধানে থাকার কথা বলে, সিঙ্গাপুর রওনা দেয়।

ছেলের অনুপস্থিতিতে তনুজা আরও অসহায় হয়ে পড়েন। সারাদিন শুধু ছেলের করুণ মুখটা তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। ফোনে অজয়ের গম্ভীর, হতাশ কণ্ঠস্বর শুনে কেঁদে ফেলেন তনুজা।

না, এভাবে তো চলতে পারে না। নিজের ছেলের জীবন তিনি এভাবে নষ্ট হতে দেবেন না। রিনির মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এই কথা ভেবে একদিন তিনি কল করেন রিনির মা-কে। কিন্তু তনুজার থেকে সবকিছু শোনার পর রিনির মা দীপা যা বললেন, তা শুনে তনুজার তো মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা।

দীপা জানালেন, আমাদের মেয়ে এমনই স্বাধীনচেতা। আমরা ব্যস্ত থাকি সারাদিন। দূর থেকে কী-ই বা করতে পারি আমরা? তাছাড়া রিনি এখন আপনার বউমা। তাকে মানিয়েগুছিয়ে নিতে হবে আপনাকেই। আর তা যদি না পারেন, তাহলে মা-ছেলের চুপ করে সব মেনে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ হবে বলে আমার মনে হয়।

Bengali story Surprise

এদিকে অজয়ের অনুপস্থিতে রিনি যেন স্বর্গরাজ্য পেয়ে গেছে। সকালে সুদীপ আসে তো বিকেলে অন্য কেউ ওর বেডরুমে। দরজা বন্ধ রেখে চলে হইহুল্লোড়, আরও কত কী! সব দেখেশুনেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হন তনুজা। কিন্তু মনে মনে ছেলেকে এই বিপদ থেকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে থাকেন।

একদিন তনুজা আগে থেকে জেনে যান যে, বিকেল তিনটের সময় ঈশান নামের একটা ছেলে নিতে আসবে রিনিকে।

তনুজা জানতেন, রিনি আগে থেকে রেডি হয়ে থাকে না। সেই সময়টাকে কাজে লাগাতে নীচে নেমে গেলেন তনুজা।

অ্যাপার্টমেন্ট-এর মেইন গেট-এর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন তনুজা। ওখানেই দেখা হয়ে গেল ঈশানের সঙ্গে।

রিনির কাছে যে-সব ছেলেরা আসে, তার মধ্যে ঈশানকে একটু অন্যরকম মনে হয়েছে তনুজার। অন্য ছেলেগুলোর মতো অত অভদ্র নয় বলেই মনে হয়েছে।

মুখোমুখি হতেই ঈশান জিজ্ঞেস করল তনুজাকে, আরে আন্টি, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভালো আছেন তো?

আছি বাবা একরকম। বাজারে যাব, রিকশা পাচ্ছি না, তাই দাঁড়িয়ে আছি।

আপনি দাঁড়ান, আমি স্ট্যান্ড থেকে রিকশা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

না না বাবা, তোমায় কষ্ট করতে হবে না। রিনি জানতে পারলে বকবে। থ্যাংক ইউ বাবা। এই যে-হেল্প করতে চাইলে, এতেই আমার মন ভরে গেল। আর যারা রিনির কাছে আসে, তারা যা ব্যবহার করে, খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তুমি খুব ভালো ছেলে বাবা। গড ব্লেস ইউ।

অ্যান্টি আর কারা আসে রিনির কাছে?

সুদীপ আর তমালের নাম জানি, বাকিদের নাম জানি না। সরি বাবা, কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তুমি বাবা রিনিকে বোলো না। ও আমাকে শাসিয়েছে, কাউকে এসব বললে আমাকে আর আমার ছেলেকে জেলে পাঠিয়ে দেবে। তুমি রিনিকে বলবে না প্লিজ।

কথা শেষ করে তনুজা এগিয়ে গেলেন রিকশা স্ট্যান্ড-এর দিকে। আর যাওয়ার আগে তিনি আড়চোখে দেখলেন যে, ঈশান গম্ভীর হয়ে গেল। আর ঠিক এই প্রতিক্রিয়া-ই ঈশানের থেকে পেতে চেয়েছিলেন তনুজা। তাঁর উদ্দেশ্য যে সিদ্ধিলাভ করেছে, তার প্রমাণ পেলেন কিছুক্ষণ বাদে। ঈশানের সঙ্গে মুভি দেখবে বলেই বেরিয়েছিল রিনি কিন্তু এক ঘন্টা হতে না হতেই মুখ গোমড়া করে বাড়ি ঢুকে নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আর রিনি তাঁর সঙ্গে কোনও ঝামেলা না করায়, তনুজা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন যে, ঈশান তাঁর নামে নালিশ করেনি রিনির কাছে।

রিনিকে জব্দ করার প্রথম উদ্যোগ সফল হওয়ায়, দ্বিতীয় উদ্যোগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন তনুজা। একদিন হঠাৎ এলও সেই সুযোগ।

সম্ভবত মোবাইল বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল রিনি। তাই ল্যান্ডলাইনে কেউ কল করছে। ফোন তুললেন তনুজা।

হ্যালো।

ওহ্ আন্টি আপনি? রিনি কোথায়? ওর মোবাইল ফোন সুইচ অফ বলছে…!

তনুজা গলা নামিয়ে বললেন, সুদীপ ঈশান ওদের সঙ্গেই আছে হয়তো।

ওরা কারা? আপনাদের আত্মীয় কেউ?

না না বাবা, ওই তুমি যেমন বন্ধু, ওরাও তেমনই।

কয়েক সেকেন্ড থামলেন তনুজা। তারপর বললেন, সরি বাবা, রিনিকে কিছু বোলো না প্লিজ, আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাটা। রিনি জানতে পারলে আমি খুব ঝামেলায় পড়ে যাব। ও বলেছে, আমি কাউকে কিছু বললে, আমাকে আর আমার ছেলেকে জেলে পাঠাবে। তুমি আমার ছেলের মতো বাবা, এই বুড়ো মানুষটার রিকোয়েস্ট রেখো। রিনিকে আমার নাম করে কিছু বোলো না প্লিজ।

তনুজার কথা শুনে ছেলেটি বলল, ঠিক আছে আন্টি, আমি আপনার নাম বলব না কিন্তু একটা শর্তে। এর পর যখনই রিনির কাছে অন্য কেউ আসবে জানতে পারবেন, আগে থেকে আমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন। আমার মোবাইল নম্বরটা লিখে নিন। আমার নাম তমাল।

মোবাইল নাম্বারটা লিখে নিয়ে ফোনটা ছেড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলেন তনুজা। তারপর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, ঘাম জমে গেছে। তিনি বাধ্য হয়ে যে-খেলায় মেতেছেন, রিনি জানতে পারলে যে তাঁর জীবনে চরম বিপদ নেমে আসতে পারে, তা ভেবেই তাঁর রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে।

ঠিক দুদিন বাদে এক রেস্তোরাঁয় সুদীপ দেখা করবে জানতে পেরে গেলেন তনুজা। কারণ, রিনি এখন তনুজাকে কেযার করে না। তাঁর সামনেই প্রকাশ্যে কাউকে দেখা করার কথা জানায় ফোন করে।

কথা মতো তনুজা চুপিচুপি ফোন করে জানিয়ে দিলেন তমালকে। আর অনুরোধ করলেন, দেখো বাবা, আমার নাম নিও না। হাতজোড় করে রিকোয়েস্ট করছি।

নিশ্চিন্ত থাকুন আন্টি, আপনার নাম করব না। আমার বড়ো উপকার করলেন আপনি। থ্যাংকস।

তমালের থ্যাংকস পেয়ে কিছুটা ভয় কাটল তনুজার। ফোন রেখে এক গেলাস জল পান করলেন তিনি।

রিনি সুদীপের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেল। আর তনুজা অপেক্ষা করতে লাগলেন, এরপর কী ঘটে তা জানার জন্য।

 

ঘন্টাখানেক বাদে ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠল। তনুজা ফোন তুলে হ্যালো বলতেই তমালের গলা শুনতে পেলেন, আন্টি, থ্যাংকস আ লট। আজ রিনির মুখোশ খুলে দিয়েছি। অনেক লুটেছে আমার থেকে। বাজারি মহিলা একটা। সুদীপও জানাল, ওর থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঝেড়েছে। আমরা দুজনেই থাপ্পড় মেরেছি রিনিকে। ওকে আমরা সহজে ছাড়ব না। ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করেছে আমাদের। রিনিকে শায়েস্তা করার জন্য আপনার হেল্প চাই আন্টি। এরপর বাড়িতে কেউ আসার আগে আবার আমাকে জানাবেন। আমরা গিয়ে সারা পাড়ায় ওর মুখোশ খুলে দেব। আপনারাও বাঁচবেন আন্টি। ফোন করবেন প্লিজ।

ফোন ছেড়ে সোফায় বসলেন তনুজা। আবার একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলেন তিনি।

কিছুক্ষণ বাদে বাড়ি ঢুকল রিনি। তাকে পুরো বিধ্বস্ত লাগছিল দেখতে। এসেই চুপচাপ নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাতে উঠে আর খাবারও খায়নি।

ওই দিনের ঘটনার রেশ থাকার জন্যই হয়তো দিনচারেক আর কারও সঙ্গে দেখা করেনি। কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়? তনুজা শুনতে পেলেন, আবার কাউকে একটা বাড়িতে আসতে বলল রিনি। তাই এই সুযোগ আর হাতছাড়া করলেন না তিনি। রিনি বাথরুমে ঢুকতেই, নিজের মোবাইল ফোন থেকে টুক করে একটা কল করে খবরটা তমালকে জানিয়ে দিলেন তনুজা।

 

সন্ধে সাতটা। রিনির ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতরে রয়েছে জনৈক তরুণ।

কথামতো সুদীপ ও তমাল এসে উপস্থিত হল। ওদের সঙ্গে এসেছে স্থানীয় ক্লাবের আরও পাঁচ-সাতজন যুবক।

রিনির ঘরের দরজা নক্ করল ওরা। রিনি ভাবল, ওর শাশুড়ি। তাই, ভেতর থেকে ধমকের সুরে বলল, দরজা ধাক্কা দিচ্ছেন কেন? দেখছেন না আমার ঘরে লোক রয়েছে?

ততক্ষণে দরজায় লাথি মারতে শুরু করেছে ক্লাবের ছেলেরা।

চমকে গিয়ে একটা শাড়ি কোনও রকমে গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে দেয় রিনি। সুদীপ এবং তমাল গালিগালাজ করতে করতে ওকে টেনে বাইরে একেবারে রাস্তায় নিয়ে যায়। ভেতরে থাকা ছেলেটি তখন কোনও রকমে প্যান্টটা পরেছে কিন্তু জামা পরতে সময় পায়নি। ক্লাবের দু-তিনজন মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অন করে ভিডিয়ো করতে শুরু করেছে। আর রাস্তায় তখন সারা পাড়ার লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখতে শুরু করে দিয়েছে।

 

সুদীপ এবং তমাল তখন ক্লাবের ছেলেদের মাধ্যমে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে, বাড়ির বউ, স্বামীর বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে ফস্টিনষ্টি করে, আজ হাতেনাতে ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয়, এও সবাই ততক্ষণে জেনে গেছে যে, নিরীহ শাশুড়িকে ধমকে চমকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে।

তনুজারা ওই পাড়ায় দীর্ঘদিন ফ্ল্যাট কিনে বাস করছেন। পাড়ার অনেকেই তাঁদের ভালো মানুষ হিসাবেই জানে। তনুজার ছেলে অজয়েরও সামাজিক সম্মান আছে।পাড়ার মহিলারা মোবাইল ক্যামেরার সামনে রিনিকে দিয়ে দোষ স্বীকারও করিয়ে ছেড়েছে। আর, ক্লাবের ছেলেদের সহযোগিতায়, আইনজীবীর মাধ্যমে সমস্ত অন্যায় লিখিত ভাবে রিনির থেকে আদায় করে নিয়েছেন তনুজা। একাধিক প্রতিবেশী সাক্ষীও দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। আর ওই লিখিত কাগজের একটা কপি সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবী এবং ক্লাবের ছেলেদের মাধ্যমে থানায়ও জমা করিয়ে রিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান তনুজা।

এরই মধ্যে রিনির ঘরে থাকা ছেলেটির ভিডিয়ো বয়ান নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর, তখনই নিজের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে তনুজাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে রিনি।

ছেলে অজয় অফিসের কাজে বিদেশে ব্যস্ত থাকবে, এই ভেবে কোনও কিছু জানাননি তনুজা।

নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি ফেরার কথা জানায় অজয়। ফ্লাইট ল্যান্ড করার আগে

এযারপোর্ট-এ পেঁছে যান তনুজা।

এযারপোর্ট-এর বাইরে আসতেই অজয় তনুজার ফোন পায়।

মাকে এযারপোর্ট-এ দেখে চমকে যায় অজয়। ওর মনে ভয় চেপে বসে। কিন্তু মাকে হাসিমুখে দেখে অবাক হয় পর মুহূর্তেই।

অজয় কিছু বলার আগেই তনুজা তাকে জড়িয়ে ধরে আবেগের সুরে বলেন, বিপদ কেটে গেছে অজয়, রিনিকে আমি তাড়িয়ে ছেড়েছি।

কীভাবে!

অজয় বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। তনুজা তখন রিনির দোষ স্বীকার আর থানায় জানানো অভিযোগের কপি তুলে দেন অজয়ের হাতে।

কপি পড়ার পর অজয় স্তম্ভিত হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড বাদে যখন ঘোর কাটে, তখন তনুজাকে প্রশ্ন করে, অসম্ভবকে সম্ভব করলে কী ভাবে মা!

আমি তোর মা, আমার চোখের সামনে অন্যায় ভাবে কেউ তোকে কষ্ট দেবে, জীবন শেষ করে দিতে চাইবে আমি কী করে চুপচাপ বসে থাকব বল? তনুজার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।

এযারপোর্ট থেকে গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে তনুজা সমস্ত ঘটনা জানালেন অজয়কে। সব শুনে অজয় বলল, নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুমি আমার জন্য যা করলে মা, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজ। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। লভ ইউ মা।

মায়ের দুকাঁধ ধরে শিশুর মতো বুকে মাথা রাখে অজয়। তনুজার চোখ আবার জলে টইটম্বুর। মা-ছেলের মনে তখন গভীর সুখের অনুভতি। যেন যুদ্ধ শেষে নবজীবনলাভ। পিছনের সিটে সুখ বোঝাই করে গাড়ি ছুটে চলেছে বাইপাসের রাস্তা ধরে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...