চলন্ত ট্রেনে ঠিক আমার সামনে একটি পরিবারের চারজন জার্নি করছিল। বাবা, মা এবং তাদের দুটি সন্তান। মেয়েটির বয়স ৮-১০ বছরের মধ্যে হবে এবং ছেলেটি ৬-৭ বছরের। তাদের জামাকাপড় দেখে মনে হচ্ছিল সম্ভ্রান্ত এবং শিক্ষিত পরিবার। বেশ কিছুটা সময় অতিক্রম করে যাওয়ার পর বাচ্চা দুটির মধ্যে মোবাইল নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ট্রেনের ওই কম্পার্টমেন্টে বাচ্চা দুটি ছাড়া সকলেই প্রায় গুরুজন ব্যক্তি বসেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই অনেকেরই চোখ পড়ল দুটি বাচ্চার ঝগড়ায়।

ঝগড়া গিয়ে দাঁড়াল মারামারিতে। বোন, ভাইয়ের গালে জোরে থাপ্পড় মারলে ভাইও বোনের চুলের মুঠি ধরে টান দিল। ওদের মা বা বাবা কেউই শাসন করার চেষ্টা করলেন না। শুধু মা নরম সুরে ছেলেকে বকলেন, ‘সোনা এরকম করে না, তুমি তো গুড বয়।’

ছেলে মায়ের মুখের উপরেই উত্তর দিল, ‘নো মম, আই অ্যাম আ ব্যাড বয়।’

‘ছিঃ, এরকম বলে না, তুমি কনভেন্ট স্কুলে পড়ো। ইউ আর সাচ আ গুড বয় আই নো’, শাসনের বদলে মায়ের গলায়  প্রশংসারই সুর বাজল।

বাচ্চা মেয়েটি খেয়াল করলাম মায়ের মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ‘মা-মা প্লিজ এবার আমার নিজের মোবাইল চাই নয়তো এটাও আমি ভেঙে দেব, তাহলে তুমিও ইউজ করতে পারবে না।’

মা-কে দেখলাম হাসিমুখে মেয়েকে বলছেন, ‘ছিঃ এরকম কথা বলতে নেই। তুমি এখন বড়ো হয়েছ।’

‘টিচারের মতো জ্ঞান দিও না প্লিজ, মেয়ের উত্তর।

এতক্ষণে বাচ্চাদুটির বাবা মুখ খুললেন, ‘এভাবে মায়ের সঙ্গে কথা বলে কেউ?’ মেয়েটি চুপ করলে, ভদ্রলোক নিজের স্ত্রী-কে বললেন, ‘এই সব তোমারই শিক্ষার ফল।’

‘কেন, শুধু শুধু মিথ্যা বলছ? তুমিই তো বাচ্চাদের আদর দিয়ে মাথায় তুলেছ।’

পরিবারটির চারজনের কথোপকথনে এবং আচরণে ততক্ষণে ট্রেনের ওই কামরায় সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, বাচ্চাদের ওইরকম অভদ্র ব্যবহারের আসল কারণটা কী। বাড়িতে অতিরিক্ত তোষামোদ পাওয়া এবং সঙ্গে শাসনের অভাব।

আমরা বড়োরা কোনও রকম ভাবনা-চিন্তা না করেই সাধারণত বাচ্চাদের সামনেই যে-কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিই। এটা ভুলে যাই যে বাচ্চারা খেলতে খেলতেও আমাদের সব আলোচনা শুনছে এবং মাথায় রাখছে। আমরা বড়ো, তাই বাইরের লোকের সামনে ইচ্ছেমতো মুখোশ ব্যবহার করি কিন্তু ওরা বাচ্চা। তাই ভিতরের কথা ওরা লুকোতে পারে না। চট্ করে বাইরের লোকের সামনে নিজের আচরণ বদলে ফেলতে ওরা জানে না। ফলে এমন কথাও ওরা বলে ফেলে যেটা মাঝেমধ্যে বড়োদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আজকের এই ব্যস্ততার যুগে বাচ্চাদের আচরণ নিয়ে এই ধরনের সমস্যা প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। বাচ্চাদের মধ্যে কথা না শোনা, রাগ, জেদ, বদমায়েশি খুব বেশি চোখে পড়ে এখন। অনেক অভিভাবকেরাই বুঝতে পারেন না, কী করে বাচ্চাদের স্বাভাবিক ব্যবহারে অভ্যস্ত করাবেন যাতে অপরের সামনে লজ্জায় না পড়তে হয়। বাচ্চারা খারাপ আচরণ করলে মা বা বাবা বেশিরভাগই ব্যাপারটা এড়িয়ে যান এই কথা বলে যে, তাদের সন্তানের মুড এখন ভালো নেই। অথচ সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্টদের মতে এটা শুধু বাচ্চার মুড নয়, বাচ্চা নিজের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না বলেই এমন আচরণ করছে।

তাদের মতে ছোটো থেকেই বাচ্চাকে সঠিক আচরণে অভ্যস্ত করাতে হবে অভিভাবকদেরই, যাতে খারাপ-ভালোর সঙ্গে পরিচিত হতে পারে বাচ্চারা। দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে তারা। এছাড়াও বড়োদের ইচ্ছে বা যুক্তি ছোট্ট শিশুর উপর চাপিয়ে দেওয়াটাও বাচ্চাদের উপর নির্যাতন করারই সমান। এটাও বাচ্চাদের মানসিক উদ্বেগেরই কারণ।

কী করা উচিত

 ১) বাচ্চাদের সামনে বড়োদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা উচিত নয়। যে-কোনও বিষয়ে কথাবার্তা বলার সময় খুব সাবধান থাকা উচিত কারণ, বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি বড়োদের বলা প্রতিটা শব্দ অনুকরণ করে।

২) ক্রিয়েটিভ কাজে বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখুন যাতে বাচ্চা বোর না হয় এবং মনের মধ্যে জানার একটা ইচ্ছা তৈরি হতে পারে।

৩) বাচ্চাকে ভালোবাসুন, আদর দিন কিন্তু জীবনের মূল্যবোধগুলির সঙ্গেও ওকে পরিচয় করান। খেলার মাধ্যমে, ছোটো ছোটো গল্পের মধ্যে দিয়ে মূল্যবোধের শিক্ষা দিন। শিক্ষামূলক গল্পের বই কিনে দিন পড়ার জন্য।

৪) শিক্ষার মানে এবং গুরুত্ব বাচ্চাকে শেখানো উচিত। বাচ্চাকে গড়ে তোলার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৫) বাচ্চাকে সময় দিন, মন খুলে বাচ্চার সঙ্গে মিশুন তাতে বাচ্চার মনে কী চলছে সেটা বুঝতে আপনার অসুবিধা হবে না। বাচ্চা যদি কোনও অন্যায় করে সেটা সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দিতে পারবেন।

৬) বাচ্চা কথা না শুনলে, তাকে মারধর না করে তার পছন্দের অ্যাকটিভিটি থেকে তাকে সরিয়ে দিন। যেমন গল্প বলা বন্ধ করে দিন বা কথা না শুনলে বাইরে গিয়ে খেলা কয়েকদিন বন্ধ করে দিন। বেশি জেদ করলে বলতে পারেন, পছন্দের খেলনা তাকে দেওয়া হবে না যদি সে জেদ করতেই থাকে।

কী করবেন না

 ১) বাচ্চাকেও গুরুত্ব দিতে হবে, বাচ্চা ভেবে ভুল করলে চলবে না। বড়োরা যখন নিজেদের কথায় ব্যস্ত থাকবে তখন বাচ্চা হয়তো খেলছে বা পড়াশোনা করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বড়োদের কথা মন দিয়ে শুনে থাকতে পারে। বাচ্চার মস্তিষ্ক বড়োদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।

২) নিজের ইচ্ছে বাচ্চার উপর চাপাবেন না, তাতে ভালো কথাও বাচ্চার উপর চাপ সৃষ্টি করবে। বাচ্চা নিরাশ হয়ে পড়তে পারে।

৩) সব কাজের ভালো এবং খারাপ দিকটা বাচ্চাকে বোঝাতে হবে। বাচ্চার সব কথা সময় বার করে ধৈর্য নিয়ে শুনতে হবে। ওদের এড়িয়ে যাওয়া বা ইগনোর করা উচিত হবে না।

৪) বাড়ির বা বাইরের কোনও ব্যক্তির সঙ্গে বাচ্চার তুলনা একেবারেই করবেন না এতে সেই ব্যক্তির প্রতি রাগ এবং ঘৃণা বাড়বে আপনার বাচ্চার। সব বাচ্চার মধ্যেই নিজস্ব অনেক গুণ থাকে যেগুলো খেয়াল না করার ভুল করবেন না।

৫) সব অভিভাবকরাই নিজেদের সন্তানকে স্মার্ট এবং ইনটেলিজেন্ট দেখতে চান। কিন্তু স্মার্ট বানাতে গিয়ে বাচ্চাকে বয়সের তুলনায় ম্যাচিওর করে তুলবেন না।

৬) নিজের স্বপ্ন, বাচ্চার মাধ্যমে সাকার করার চেষ্টা করবেন না। বাচ্চাকে নিজের স্বপ্নের উড়ান ওড়াতে, সাহায্য করুন। আপনি জীবনে কী করতে চেয়েছিলেন, কী করতে পারেননি এগুলির প্রভাব বাচ্চার উপর কোনওভাবেই পড়তে দেবেন না।

৭) ভয় দেখিয়ে বাচ্চাকে দিয়ে কাজ করাবেন না। এর ফলে বাচ্চা কাল্পনিক পরিস্থিতি থেকেও ভয় পেতে শুরু করবে। বাচ্চার  মানসিক বিকাশও ঠিকমতো হবে না। বাচ্চার ইচ্ছে না থাকলেও বাচ্চা ভুল করবেই।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...