একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তন্বী। বারান্দার রংচটা গ্রিলটা ধরে। বারান্দার গ্রিলটা যেন তন্বীর প্রাণের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বর্ষার দিনে মুঠোতে শক্ত করে ধরে, এক দৃষ্টিতে দ্যাখে কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে ঝরে মাটিতে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল ভূমির ঢাল ধরে ছোটো ড্রেন, হাইড্রেন হয়ে হু হু করে বইছে। হয়তো নদী হবে বলে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসমতো বারান্দায় গিয়ে এক মনে কী যে ভাবে তন্বী কে জানে? পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তন্বীর। ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবে। উঠোনের কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছটা সকাল-সন্ধে পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাখিদের সংসার যেন তন্বীর খুব চেনা হয়ে গিয়েছে। কাঁঠাল গাছটাকে বর্ষার আগাছা আর বিভিন্ন লতাগুল্ম আঁকড়ে ধরে থাকে। বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতায় জল গড়িয়ে পড়ে। গাছ-গাছালি বেশ ঝাঁকড়া হয়ে যায় এই সময়টায়। বিভিন্ন ঋতুতে গাছগুলোর বিভিন্ন রুপ দেখেছে। আর সকাল-সন্ধে পাখিদের সংসার, আনাগোনা সব এখন নখদর্পণে তন্বীর।

সকালের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙানিয়া পাখপাখালি সারাদিন কী ব্যস্ত থাকে। আবার কোথায় উড়ে চলে যায় দূর আকাশে। মন দিয়ে পাখিদের খুনসুটি দেখে। কখনও পাখি হতে ইচ্ছা করে তন্বীর। আবার সন্ধ্যায় আকাশ-পথ চিনে কীভাবে যে ওরা ফেরত আসে বাসায়, তার কূলকিনারা খোঁজার চেষ্টা করে। এই পাখিগুলোর ব্যস্ত আনাগোনা দেখতে দেখতে কখনও হিংসা হয়। ভাবতে থাকে এরা তো কেউ বেকার নয়।

বৃষ্টিভেজা কচি সবুজ পাতা তন্বীর খুব প্রিয়। রাতের খাবার সেরে প্রতিদিন ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। দৈত্যের মতো আবাসানগুলো শহরের আকাশ, মেঘ, সব যেন গিলে খাচ্ছে। তবুও একফালি আকাশ এখনও দেখা যায়। আর শীতের বেলায় ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। আগে তো হিমালয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই চড়াগুলো বারান্দা থেকে দেখা যেত স্পষ্ট। কয়েকটা বছরে কেমন যেন বদলে গেল শহরটা। জ্যোত্স্না রাতে চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ দেখা যায় এক টুকরো মেঘের ফাঁকে। রাত বাড়লে হারিয়ে যায়। শহরের নিয়ন আলোয় আকাশের তারাগুলো আত্মগোপন করে। আজ রোহনের কথা মনে পড়ছে খুব। চাঁদের মায়াবি আলো এসে পড়ে তন্বীর চোখেমুখে। সন্ধ্যার দিকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী টিউশন পড়তে আসত।

বেশ কিছু দিন আগে স্থানীয় একটি নার্সারি স্কুলে শিক্ষিকার পদে কাজ করত সে। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জেরবার হয়ে যায়। এক সময় সেই কাজটা ছেড়ে দেয়। ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখের ঘোর কাটাতে বাইরের আলোতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেয়। আবার রাতের খাবার সেরে বেশ কিছুক্ষণ একাগ্র চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলটা ধরে। শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে অপূর্ব কাঠের দ্বিতল ঘরে তন্বীদের বাস। এই শহরে কিছুদিন আগেও ছবির মতো কাঠের কারুকাজ করা সুন্দর ঘরগুলো শহরের অহংকার ছিল। তন্বীদের পুরোনো কাঠের ঘরটা এখনও প্রমোটারদের থাবা থেকে বেঁচে আছে।

বাবা বলাই চৌধুরী-রা তিন ভাই। তাদের মধ্যে বড়ো তন্বীর বাবা। আর দুই ভাইয়ে একজন থাকে বিদেশে। আর একজন দিল্লিতে কর্মরত। বহুদিন শিলিগুড়িতেই আসেনি কেউ। তন্বী কাকুদের চিনতেই পারবে না। তবে অ্যালবামে ছবি দেখেছে সবার।

বার্মা টিকের কাঠের দ্বিতল বাড়িটার অধিকাংশ রুম জরাজীর্ণ। নীচের ঘরগুলোর মধ্যে একটায় বইয়ের দোকানের গোডাউন। কিছু ভাড়া পাওয়া যায়। সেই টাকা দিয়ে মাঝেমধ্যে ঘর মেরামত করা হয়। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে এক সময় এই কাঠের ঘরটা ছিল দেখবার মতো। পঁক পঁক রিকশার হর্নের শব্দ শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েে তন্বীর। শিলিগুড়ি রিকশার শহর নামে খ্যাত।

উঠোন থেকে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে উপরের কাঠের বারন্দায় উঠতে হয়। তারপর সার-সার দুটি ঘর। বন বাংলোর মতো একটা অনুভূতি হয় রুমে ঢুকলে। এই দুটো ঘরেই তন্বীদের সংসার। বাকি ঘরগুলো ভাম, বিড়ালদের বাস, ব্যবহার হয় না। ফুল বাগিচায় সাজানো গোছানো উঠোন। লাল টুকটুকে জবা ফুল ফুটে থাকে উঠোনময়। নয়নতারা, টগর, বেলি আর রাতে রজনীগন্ধার সুবাসে মনটা ভরে ওঠে।

তন্বীর মা পুজো অর্চনা নিয়ে থাকেন। প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে আসেন। খুব সখের বাগান তাঁদের। একটা বাংলা শর্ট ফিল্মের শুটিংও হয়েছিল।

তন্বীর বাবা বলাই চৌধুরী যজমানি করে রোজগার করেন। তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে মানুষ করেছেন বহু কষ্টে। বড়ো সাধ ছিল মেয়ে একটা সরকারি চাকরি করবে। রোজ সকালে ফুলের সাজি আর সিঁদুরগোলা পাত্র নিয়ে পুজো করতে বার হয়ে যান তিনি। তন্বীর মা রুমা ফুলের সাজি আর একটা ছোটো বাটিতে সিঁদুর গুলে রাখেন পরিপাটি করে।

রেল লাইন পার হলেই লোকাল বাসস্ট্যান্ড। সকালের দিকে স্ট্যান্ডে থাকা বাসগুলোতে ফুল, ধূপ দিয়ে পুজো করেন বলাইবাবু। এছাড়াও বেশ কিছু বাঁধা দোকান, সেলুনে পুজো সেরে দুপুরে ঘরে ফেরেন। হাটবারে ওঁদের বাড়ির দেযাল লাগোয়া জায়গায় শাকসবজির পসরা নিয়ে বসে সবজি বিক্রেতারা। এক পা বাড়ালেই হাটবাজার, সবই হাতের মুঠোয়।

বৃষ্টির দিনে আজ মনটা কেমন করে উঠল তন্বীর। খুব রোহনের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেছে। রোহনের স্বপ্ন দেখেছে সে। বহুদিন রোহনের সঙ্গে দেখা হয় না। ছোটোবেলার প্রিয বন্ধু যেন স্বপ্নে ধরা দিল ভোর রাতে। বেশ কয়েক বছর হল রোহন আর এ শহরে আসেনি।

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কখনও মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক। গাছের শাখায় শাখায় কচিপাতা গজিযে উঠছে। বৃষ্টি ভেজা সবুজ গাছের পাতায় টলটলে বৃষ্টির ফোঁটা, দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনটার কথা। কলেজ পথে একদিন রোহনের চারচাকা গাড়িতে ফুলবাড়ি ক্যানাল ধরে গাজলডোবা গিয়েছিল।

টুকটুকে পুতুল পুতুল চেহারার তন্বী খুব আকর্ষণীয় ছিল। তাদের অজান্তে ভালোবাসার একটা অজানা স্রোত প্রবাহিত ছিল। দুটো পরিবার আসতে পেয়েছিল। তিস্তা ক্যানাল বর্ষার অতি বৃষ্টিতে টইটুম্বুর। দুপাশে ঘন লকলকে সবুজ ছুঁয়ে গাজোলডোবায় পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। ওদের মনের ভেতর বইত ভালোবাসার অন্তঃসলিলা। কলেজ লাইফ বেশ কেটেছে। কলেজ জীবনের স্মৃতি ফিল্মের রোলের মতো ভেসে আসছে। কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে রোজকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তন্বী।

ইতিহাসে মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করে ঘরে বসে আছে তন্বী। কোনও চাকরি জোটেনি। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে নজর রাখে। দরখাস্তও করে। সাফল্য আসেনি এখনও। আসলে শিক্ষকতার পেশায বিএড খুব জরুরি। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে তন্বী, লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া আকাশকুসুম কল্পনা।

এদিকে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দফতরে অ্যাপ্লাই করেই চলেছে। কিন্তু সুযোগ আসেনি একটাও। কিছুদিন আগে একটা নার্সারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিযেছিল। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

সামনের বড়ো রাস্তাটা পার হলেই রোহনদের বিশাল বাড়ি। প্রশস্ত উঠোন। যখন ছোটো ছিল ওরা একসঙ্গে খেলাধূলা করত। প্রাইমারি থেকে কলেজে পড়া পর‌্যন্ত ওরা দুজন দারুণ জুটি। রোহন পড়াশোনায খুব ভালো। উচ্চমাধ্যামিকে স্কুলের টপার হয়েছিল। তন্বীও মনযোগী ছাত্রী ছিল। ছোটোবেলার খেলার সাথি ওরা। কলেজেও একসঙ্গে পড়েছে। রোহনদের বাড়ির সহযোগিতা দারুণ ভাবে পেযেছে তন্বী। আসলে তন্বীর বাবা রোহনদের পরিবারের কূল-পুরোহিত। রোহনের বাবার বিয়েও পুরোহিত ছিলেন বলাইবাবু।

বেশিরভাগ সময় রোহনদের বাড়িতে কাটাত তন্বী। রোহনের মা মিতার খুব পছন্দের মেয়ে ছিল সে। রোজ স্কুল শেষে যখন রোহনদের বাড়িতে খেলতে আসত, মাথার ঘন কালো কোঁকড়া চুলে কৃষ্ণচড়ার ঝুঁটি বেঁধে দিতেন রোহনের মা। আত্মীয-কুটুমদের মধ্যে কানাঘুষো হত, তন্বীকে বউ করে নিয়ে আসবে ঘোষ পরিবার। কিন্তু তন্বীর মা আবার খুব গোঁড়া। ধর্মকর্ম পুজো নিয়ে থাকেন। বলবার সাহস হয় না মিতার।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষ শহরের নামজাদা ব্যবসাযী। কযেটা গোডাউন রযেে। বাদল ঘোষ ধনেমানে বড়ো হলে কী হবে, লেখাপড়া ছিটেফোঁটাও জানেন না। স্কুলছুট হয়ছিলেন। সে আর এক গল্প। পণ্ডিত স্যারের কানমলা খেযে নাকি আর স্কুলমুখো হননি। কিন্তু এখন এই শহরের বেশ ধনী ব্যবসায়ী। বাদল ঘোষের বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যাবসাটা ওদের পরিবারের মজ্জাগত। এখন বাদলবাবু ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ। এদিকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত।

রোহন কলেজে অনার্সে ভালো ফল করেছে। রোহনের বাবা খুব খুশি। এই আনন্দে ঠিক করেছেন রোহনকে কলকাতায হোস্টেলে রেখে পড়াবেন। ব্যাবসার সুত্রে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন ছিল রোহন। কিন্তু মন বসেনি। মাঝপথে সব ছেড়ে চলে আসে। সুযোগ পেলেই তন্বীকে নিয়ে শুকনার জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়ে। রংটঙের টযট্রেনের নির্জন ষ্টেশনে বসে চলে ওদের প্রেমালাপ। কখনও দিনের শেষে ধূমাযিত কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে, ভালোবাসায বুঁদ হয়ে যায দুজনে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মোমো শপে গরম মোমো খেযে বাড়ি ফেরে।

এদিকে তন্বী ইতিহাসে এমএ করছে বিশ্ববিদ্যালয থেকে। মাঝপথে রোহন সব ছেড়ে চলে আসায, রোহনের বাবা-মায়ের মন খুব খারাপ। তন্বীদের সঙ্গে রোহনদের একটা ঘরোযা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাড়াপড়শি, আত্মীযমহলে আলোচনা করে অনেকে। তন্বীও ফের ভর্তি হতে বলে রোহনকে। যাইহোক রোহন নেক্সট ইয়ার বেঙ্গালুরুতে বিজনেস ম্যনেজমেন্টে ভর্তি হয়। এখন ওখানেই থাকে। বেশ মন বসে গিয়েছে। চিরবসন্তের শহরে এক অন্য জগতের পড়াশোনা নিয়ে মজে গেছে। শিলিগুড়ি আর আসতেই চায় না রোহন। টাকা পযসার তো আর অভাব নেই। বাবা টাকা পাঠান।

এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বিজনেস ম্যনেজমেন্ট পাশ করে নামকরা বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে আসীন। বেকার বসে থাকতে হল না আর। প্রথম দিকে তন্বীর খোঁজ খবর নিত। ফোন করত নিয়ম করে। কিছুদিন হল সেসব পাট যেন চুকে গেছে।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষের বাড়িতে ঘটে গিয়েছে অঘটন। পুলিশ রেড হয়েছে। রেশন দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছেন বাদলবাবু। রাজনীতির কেউকেটা হয়ে নাকি পার পাওয়া যাচ্ছে না।

কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে গুদামে, বাড়িতে পুলিশ প্রশাসন রেড করে বেআইনি শস্য উদ্ধার করেছে। দুর্নীতির শিকড় নাকি বহুদূর। মন্ত্রী-আমলারাও যুক্ত। আসলে এদেশে শস্য নিয়ে দুর্নীতি মারাত্মক। আর এরাই আবার রাজনীতির হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। কাজেই বলাই ঘোষ গ্রেফতার হয়েছেন। তদন্তে কী হবে কেউ জানে না!

বিভিন্ন সংবাদপত্রে রেশন দুর্নীতি নিয়ে কযেকদিন ধারাবাহিক লেখাও বার হয়েছে। রোহনের কানে সব খবর গিয়েে। লজ্জায় ঘৃণায় রোহনের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর শিলিগুড়ির বাড়ি আসা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কীভাবে বন্ধু আত্মীয়দের মুখ দেখাবে রোহন! চায়ের দোকান থেকে ঘরে-বাইরে আড্ডায় এখন মুখরোচক খবর, বলাই ঘোষের দুর্নীতি।

এরকম বিপর্যয়ের মুখে একদিন রোহনের ফোন আসে। তন্বীর মুখে সে ঘটনার সত্যাসত্য জানতে চায়। তন্বী রোহনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর বহুদিন আর ফোন করা হয়নি। মনে হয় রোহন এড়িয়ে যাচ্ছে। তন্বী খুব বাস্তববাদী। মনে মনে ঘরের বারন্দার গ্রিলটা ধরে ভাবে কতো কী। আবার এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের আর এক নাম লড়াই। ছোটো থেকে দেখেছে বাবাকে, কী ভাবে জীবনসংগ্রাম করে তাকে মানুষ করেছেন।

সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তন্বীর। জীবন যন্ত্রণার বহু করুণ-কাহিনির সাক্ষী সে নিজে। হয়তো আরও পথ যেতে হবে তাকে। জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিতে চায় তন্বী। তাই হতাশার কোনও ঠাঁই নেই তন্বীর অভিধানে। সম্পর্কে এইভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। রোহন তন্বীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও সে রোহনকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

এদিকে বলাই ঘোষের জামিন হয়েে কিন্তু কেস চলছে। বলাই ঘোষ বিচারাধীন। তাঁর অনুগামীরা জামিনের দিন ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। সংবাদে সচিত্র এমন সংবাদ পড়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে তন্বী। ওদের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যায় মহকুমা শাসকের দফতরের জাতীয পতকাটা পতপত করে উড়ছে। আর ওইখানেই আদালত। তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে পতাকাটার দিকে। আনমনা হয়ে যায়।

তন্বীর বাবার বয়স হচ্ছে। সেদিন পুজো করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। মুখ দিয়ে ফেনা বার হচ্ছিল। পাতলা ছিপছিপে চেহারার মানুষ। লো-প্রেশারের রোগী। অনেকবার তন্বীর মা বলেছেন মেযোর জন্য পাত্র খুঁজতে। কিন্তু তন্বী নারাজ। মা যতবার বলেছেন, তন্বী তুই সব খুলে বল। তন্বী ততবার বলেছে, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, কিছু একটা করব।

এমন সময় একটা কলিং বেলের শব্দে তন্বী দরজা খুলে দেখে পিয়ন কাকু। বহুদিন পর দেখা। আসলে আজকাল চিঠিপত্তর তেমন আর আসে না। একটা বাদামি খাম তার হাতে ধরিয়ে দিল লোকটি। খামের মুখ খুলে দেখে ইন্টারভিউ লেটার। গ্যাংটকে ভেনু। সময় তারিখ সব দেওয়া আছে। মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। মাকে সব বলল। বাবাও ফিরেছেন পুজোর কাজ সেরে।

সপ্তাহে নিয়ম করে একটা খবরের কাগজ রাখে তারা। সাপ্তাহিক কাগজে দেশবিদেশের খবর থাকে। বেশ কিছুদিন আগে একটা ভালো মাইনের চাকরির বেসরকারি কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে অবেদন করেছিল। পদটি অফিস সহকারীর। এক নামকরা ওয়াটার পাম্প কোম্পানির অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট। সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরে এই কোম্পানির মূল অফিস। হিল এরিযায নতুন অফিস খুলবে। তরাই-ডুযার্স, অসম, সিকিম এলাকার চা-বাগিচায় ওয়াটার পাম্পের ডিমান্ড রযেছে।

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্টারভিউ-এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সেভক রোডের কাছে একটা টাটা সুমোতে চেপে বসে তন্বী। বেলা দশটার মধ্যে গ্যাংটকে পৌঁছে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হতে হবে। সাক্ষাত্ প্রার্থীরা একটা হোটেলের করিডরে অপেক্ষা করছে। এই হোটেলটা থেকে দূর পাহাড়ের উপত্যকার মাঝে তিস্তা নদী দেখা যায়। হোটেলের পিছনের দিকে কনফারেন্স রুমে বসবার ব্যবস্থা। কাগজপত্র ভেরিফিকেশন হবার পর ইন্টারভিউ-এর সময় হল। কযেজনের পর ডাক পড়ল তন্বীর।

শীতশীত আবহাওয়া। আজ যদিও আকাশে সূর‌্যের দেখা মিলেছে। ফাইল নিয়ে বোর্ডের সামনে চেযারে বসতেই, সারা শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করল সে। খুব চেনা মানুষ ইন্টারভিউ বোর্ডের হেড। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোলাপি হাফ সোয়েটার। চশমার ফাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো ঘুরছে। চোখ আর জোড়াভুরু দুটো খুব চেনা। পাশে বসে এক আধুনিকা। কাগজপত্র মিলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপের ছলে ভদ্রমহিলা অনেক কিছু প্রশ্ন করলেন। কিন্তু সেই চেনা মানুষটির যখন প্রশ্নের পালা এল কোনও প্রশ্ন না করে, ওকে বলে শেষ করলেন।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইন্টারভিউ কেমন হল তন্বী? তন্বী বাবার কথা এড়িয়ে বলল, হয়েছে চলো, দেরি হয়ে যাবে। লাস্ট বাসটা ধরতে হবে।

কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, বাবা সহজেই বুঝলেন। খানিকটা হেঁটে বাজারের বাসস্ট্যান্ডে কিছু শুকনো খাবার কিনে, বাসের জানলার দিকে সিট নিয়ে বসল তন্বী। মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্ট দেখা যায তিস্তার মূল স্রোতে কত অনামি জলধারা এসে মিশছে। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, সবুজ উপত্যকায ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গ্যাংটক ছাড়িয়ে বাসটা পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে ছুটছে। জানলার দিকে তাকিয়ে রোহনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, এক সমযে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিযে পড়েছে তন্বী। হঠাত্ বাসটা বাঁক নিয়ে ব্রেক কষলে এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে যায তন্বীর।

এখন রাস্তাটা তিস্তা নদী ঘেঁষে চলেছে। সামনেই তিস্তা বাজার জনবসতি। বাসের জানলা থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রধান নদী তিস্তায়, রঙ্গিত নদী মিশছে। সিকিম থেকে রঙ্গিত, তিস্তা বাজারে তিস্তার মূল প্রবাহে মেশে।

তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমস্থল লাভার্স মিট দেখতে দেখতে কেমন নস্টালজিক হয়ে যায তন্বী।

রোহনের আজকে না চেনার ভান নাকি কোম্পানির প্রোটোকল কোনটা সঠিক ভাবতে থাকে তন্বী। কখনও নিজেকে সান্ত্বনাও দেয়। ভাবতে থাকে এমনটাই কাঙ্খিত ছিল। অভিমানে গাল বেয়ে দুফোঁটা মুক্তো দানা ঝরে পড়ে। রোহনের সাথে হঠাত্ দেখা হওয়া যেন স্মৃতির দরজা ধরে এক ঝলক ফিরে দেখার অপেক্ষা। কে জানে যদি আবার সেই দিনগুলো ফিরে আসে!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...