খুব গরম আজ।

একটা কোল্ড ড্রিংক্ আনি? – আরে না না। ঠিক আছে। বরং একটু ঠান্ডা জল পেলে ভালো হয়।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই…

বলে লোকটা জল আনতে গেল। লোকটার চামচাগিরি এই গরমে একদমই ভালো লাগছিল না। কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি। আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম।

পার্কটার এককোণে বিরাট স্টেজ করেছে। বড়ো বড়ো স্ট্যান্ড ফ্যান চললেও গরমের তাতে বিশেষ যাচ্ছে-আসছে না। কারণ স্টেজটার মাথায় ত্রিপল। যেটা থাকলে হাওয়া চলাচল করতে পারে না। ফলে গরম আরও বেড়ে যায়। যদিও পার্কটায় প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ ভর্তি। বিশ বছর আগেও জায়গাটা এমনই ছিল। আসার সময় দেখছিলাম সেই বাড়িটা এখনও একই ভাবে আছে, কুড়ি বছর আগের মতো।

আসলে আজ এখানে আমার সংবর্ধনা। সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান প্রাপ্ত হবার পর এরকম অনেক জায়গাতেই আমার এমন সংবর্ধনা পর্ব চলছে। তবে অধিকাংশ আমন্ত্রণই আমি গ্রহণ করছি না। যেগুলো কোনও ভাবেই এড়াতে পারছি না কেবল সেগুলোতেই যাচ্ছি। ওরা যখন আজকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ করেছিল তখন জায়গাটার নাম শুনে এককথায় রাজি হয়ে যাই। কারণটা কি? কারণ হল, কুড়ি বছর আগে এখানে আমি থাকতাম।

সেই লোকটা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে আবার হাজির হল। সাথে একটা দামি সিগারেট প্যাকেট। আমার দিকে সেসব বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

– নিন স্যার।

জলটা বেশ ঠান্ডা। গলায় ঢালতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল। এবার একটা সিগারেট ধরালাম।

– আপনি এখানে আসতে এককথায় রাজি হয়ে যাবেন আমরা ভাবতেও পারিনি…

লোকটা আবার আহ্লাদে গদগদ হয়ে বকতে লাগল। যে-ক্লাবটা আমায় সংবর্ধনা দিচ্ছে ও তার সেক্রেটারি। নিমন্ত্রণ করার সময় যখন এসেছিল তখন জেনেছিলাম ও এই এলাকার সব থেকে বড়ো চালের কারবারি। ও সবসময়, মানে আমি যে দু’বার দেখলাম দুধসাদা জামা প্যান্ট জুতো পরে থাকে। কুড়ি বছর আগে অবশ্য ও এত সাদা জামা প্যান্ট পরত না। সিগারেটটা টানতে টানতে মনে পড়ে গেল কুড়ি বছর আগের কথা। তার আগে সিগারেট প্রায় খেতামই না বলা চলে। এখানে এসেই ধরেছিলাম একরকম। সিগারেট ধরাতে দেখলেই সুতপা রাগ করত খুব।

– আগে তো খেতে না। হঠাৎ ধরলে কেন?

অনুযোগ করেছিল ও। ভাবত টেনশন থেকেই আমার এই সিগারেট ধরা।

আস্তে আস্তে পার্কটার নির্জনতা কমে আসছে। টুকটাক করে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মাইকে ঘোষণা চলছে– আর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। বিখ্যাত সাহিত্যিক হীরক মিত্র আমাদের মধ্যে এসে গেছেন…

বাড়িটা সেই একইরকম আছে। কোথাও কোনও বদল নেই। শুধু রংটা বেশ আবছা হয়ে গেছে। দু’একটা সবুজ পাতা এদিক ওদিক কার্নিশে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো পুরোনো একটা ভাব এসেছে বাড়িটার শরীরে। যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম তখন বাড়িটা সবে হয়েছে মাত্র। যাকে বলে সদ্যোজাত। আমরাই প্রথম ব্যবহার করি তিনতলার ফ্ল্যাটটা।

বাড়িটা সাহাদের। আমাদের চুক্তি হয়েছিল বড়ো ভাই শংকর সাহার সাথে। তিন ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি। আগে টিনের বাড়ি ছিল। কলোনি এলাকা। তখনই সবে শেষ হয়েছিল টিনের বাড়ি থেকে ফ্ল্যাট বাড়িতে উত্তরণের। পুরো এলাকাটাই এরকম ছিল। আস্তে আস্তে বদল ঘটেছিল কলোনির চরিত্রে।

সুতপা ভাবত আমি সিগারেট খাই টেনশনের জন্য। আমি কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারতাম না যে আমার কোনও টেনশন নেই। সামান্য একটু-আধটু টেনশন থাকলেও ওটা বলার মতো বা ভাবার মতো কিছু না। অমন একটু-আধটু সকলেরই থাকে। আসলে সুতপা যবে থেকে আমার জীবনে এসেছিল তবে থেকে আমার সব টেনশন ভ্যানিশ হয়ে গেছিল। একটা সময় অবধি আমার অনেক অনেক বাঁচতে ইচ্ছে করত। সুতপা আসার পর সে ইচ্ছেটা চলে গেছিল। কথাটার ভুল মানে করলে হবে না। যেটা ঘটনা হয়েছিল, সেটা হল সুতপা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আর ভালো জিনিসের দীর্ঘায়ু হয় না। আমি তাই বুঝতে পারতাম এর কোথাও একটা শেষ আছে। আর সেই শেষের আগে চলে যেতে পারলে ভালো। মানে সুখ ফুরোবার আগে পালাও। ফলত, আগে সিগারেট খাবার যে অস্বস্তিটা ছিল, এসব ভাবনায় তা হারিয়ে গেল। সুতপা ভাবত আমি হতাশা থেকে মৃত্যুর কথা ভাবছি। আসলে ব্যাপারটা একদমই উলটো।

স্টেজের সামনের চেয়ারগুলো প্রায় ভরে গেছে। মাইকের গমগমানি বেড়েছে। স্থানীয় কলেজের একদল ছাত্র-শিক্ষক আমাকে আলাদা কোণে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বকাল।

আমরা সবাই স্টেজে উঠলাম। আমার বাঁদিকে স্থানীয় এমএলএ। ডানদিকে ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি। শুরুতেই একদল লাল পাড় শাড়ির যুবতি কোরাস গাইল। তারা নেমে যেতে শুরু হল পরের পর ভাষণ পর্ব। ভক্তি গদগদ ভাব নিয়ে এমএলএ, ক্লাব-এর সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট বলে গেল। সবই আমার প্রশংসা, ওদের ক্লাব কত মহান! একটি কমবয়সি ছেলে আমার লেখা থেকে পাঠ করে শোনাল। তারপর আমার হাতে মানপত্র, ফুলের স্তবক, মিষ্টি– আরও কী সব তুলে দেওয়া হল। সেক্রেটারি আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল– ফুলের ভিতর টাকার খামটা আছে।…

কুড়ি বছর আগে সাহাদের ফ্ল্যাটটায় আমি ঘর বেঁধেছিলাম সুতপার সাথে। একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। মাত্র তো একটা মাস আমরা ছিলাম। তবু এখনও ভাবলে মনে হয় অনেকদিন।

আমরা দুজনে একটু একটু করে ফ্ল্যাটটাকে সাজাচ্ছিলাম। প্রতিদিন কিছু না কিছু হাতে করে কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। পর্দা, পাপোশ, ফুলদানি, বেডকভার আরও কতো কি! এমনকী দুটো খতম হওয়া রেড ওয়াইনের বোতলে দুটো মানি প্ল্যান্টও এনে লাগাল সুতপা। ওর জন্য আমি পছন্দ করে কিনে এনেছিলাম একটা লাল রঙের নাইটি। প্রতিদিন গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত আমাদের। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার কাটিয়ে যখন সূর্যের হালকা আমেজ দেখা যেত, পাখিদের ডাক শোনা যেত, তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম তৃপ্তির আমেজ মেখে। আমরা দুজনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বাকি জীবনটা একসাথে কাটাব। সে প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি সুতপা রাখলেও আমি পারিনি। মাত্র একমাস পরেই আমাদের এই তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নমহল ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল।

এবার আমায় বলতে ডাকা হল। আমি আয়োজক এবং স্থানীয় মানুষদের অভিনন্দন জানিয়ে বলা শুরু করলাম।

‘আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। এই পাড়াটা আমার অত্যন্ত প্রিয় পাড়া। এই পার্ক আমায় অনেক স্মৃতি মনে পড়ায়। আপনারা হয়তো কেউ জানেন না এই পাড়াটায় আমি একসময় থেকে গেছি।’  আমার এই কথায় চারদিকে একটা বিস্ময়ের গুনগুন শুরু হল। এই তথ্য কেউই জানত না। না জানাটাই স্বাভাবিক। বা ভুলে যাওয়াটা। আয়োজক দাদারা মনে হল সবথেকে বেশি অবাক-অপ্রস্তুত হল। এতক্ষণ ওদের ভাষণে মনে হচ্ছিল আমার বিষয়ে ওরা সব জানে। মানে পাবলিককে তাই বোঝাচ্ছিল আর কী। আমি বলা থামালাম না।

– আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই পাড়ায় আমি এসে উঠেছিলাম একটি ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়িটা আজও আছে একই ভাবে। কিছুদিন ছিলাম। মাস খানেকের মতো। এই সময়েই আমি ‘লাইফলাইন চলছে’বলে গল্পটা লিখেছিলাম। এই বাড়িতে বসেই। আপনারা জানেন যা এখন দু-দুটি ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এবং দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাই বিশ বছর পর আজ যখন আমি এই গলিতে পা রাখলাম, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম আরও একটি গল্পের জন্ম হতে চলেছে… গোটা পার্কটা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল আমার কথা। একটা চিনতে না পারা পোকা পার্কের সব থেকে উঁচু গাছটার টঙে ভনর ভনর করলেও শোনা যাবে এমন এক স্তব্ধতা। বলতে বলতে আমার মন পার্কের আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম বিশ বছর পিছনে…

আমি হীরক মিত্র। আমার সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী পেশা লেখা। যা আমি আজও করে চলেছি। দীর্ঘস্থায়ী পেশা কথাটা বললাম এই কারণে যে, তার আগে আমি অনেক কিছু করেছি। কম্পিউটার অপারেটর, টিউশন, রাজনীতি আরও কত কিছু। কিন্তু শেষ অবধি বুঝলাম আমার দ্বারা ওই লেখাটাই হবে। দুম করে কোনও কিছু ছেড়ে নতুন কিছু শুরু করে দেওয়াটা আমার মজ্জাগত। কলেজ জীবনে হঠাৎ গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে একটা সেলসের কাজে ঢুকে পড়েছিলাম। পয়সাটা খুব দরকার মনে হয়েছিল সে সময়। বছর খানেক কাজটা করার পর আমারই মনে হল অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা রাখা প্রয়োজন। সারাজীবন একটা খিঁচ থেকে যাবে। বয়স থাকতে থাকতে করে ফেলা জরুরি। চাকরি ছেড়ে আবার কলেজে ঢুকে পড়লাম। একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকে। পাশ করার পর ভাবলাম ফোটোগ্রাফার হব। কোর্স-এ ভর্তিও হলাম। কিন্তু লাস্টে পরীক্ষা দিলাম না। ভেবে দেখলাম ফোটোগ্রাফির প্রাইমারি ইনভেস্টমেন্ট আমার পক্ষে অনেক। অনেক কিছু কিনতে হবে গোড়াতেই। তারপর কম্পিউটার অপারেটর হলাম। কিছুদিন পর সেটাও ছেড়েছুড়ে রাজনীতিতে। ট্রেড ইউনিয়নে হোলটাইমার। তাও ছাড়লাম নেতাদের কারবার দেখে। লাস্টে এই লেখা।

লিখতে লিখতেই আলাপ হয়ে গেল সুতপার সাথে। বিবাহিত। তবে স্বামীর সাথে থাকত না। পেশায় আর্কিটেক্ট। ইন্ডিয়ান রেলে।

ও-ও লিখত। তবে আমার মতো গদ্যের লোক ছিল না। কবিতা লিখত। খারাপ লিখত না। অনেকেই চিনত। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছিলাম ওকে। লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট আর কী। বুঝেছিলাম এই আমার মানুষ। এর জন্যই আমি অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। এর জন্যই জন্মেছি আমি। তখন আমার বছর চল্লিশ বয়স। ভবঘুরে মানুষ। তিনকুলে কেউ নেই। একটা বাড়ি আছে। তাতে থাকি, আর ভাড়ার টাকায় ভাত-বিড়ি হয়ে যায়। কিছুদিন মেশার পর বুঝলাম, ওরও আমাকে ভালো লেগে গেছে। সে সময়ে ওর বর সমানে চেষ্টা চালাচ্ছিল ওকে ফিরিয়ে নিতে। নরমে গরমে নানা ভাবে। সুতপা আমার থেকে বছর তিনেকের ছোটো। অর্থাৎ বয়সটা কম নয়। বাড়বে আরও। একা থাকার যন্ত্রণাও বাড়বে। তাই ও প্রায় সিদ্ধান্ত করেই ফেলেছিল বরের কাছে ফিরেই যাবে। সমস্যা যা আছে মানিয়ে নেবে। ঠিক এরকম একটা সময়ে ওর জীবনে আমি ঢুকে পড়লাম। সুতপার সব ভাবনা চিন্তা সিদ্ধান্ত আমূল বদলে গেল রাতারাতি। ডিভোর্সের মামলা করল ও। ওর বর এরকম পাকা গুটি কেচে যাওয়ায় ব্যাপক খেপল। চাকরি করা বউ কে আর ছাড়তে চায়। আমাদের পিছনে পড়ে গেল লোকটা।

ডিভোর্সের মামলা চলতে লাগল অনন্তকাল ধরে। কবে কি হবে জানি না। আদৌ হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তাহলে আমরা কী এভাবেই কাটাব বৃদ্ধবয়স অবধি! শেষমেশ দুজনে একদিন ঠিক করে ফেললাম গোপনে বিয়েটা সেরে একসাথে থাকা শুরু করব। যা আইনের চোখে মান্যতা পায় না। আর সুতপার বর জানতে পারলে এটা নিয়ে ঝামেলা পাকাবেই। যা হয় হোক, আগুনকে সাক্ষী রেখে আমি সুতপার সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম এমনই এক বৈশাখে। তারপর এসে উঠলাম সাহাদের তেতলায়।

সংবর্ধনা সভা শেষ হয়ে গেছে। আমি স্টেজ থেকে নেমে এসে মাঠের মধ্যে চেয়ার টেনে বসলাম। সাথে সাথে চারপাশে গুণমুগ্ধদের জটলা তৈরি হল। যাদের মধ্যে অনেকেই আমার নিয়মিত পাঠক, সামনে পেয়ে নানান প্রশ্ন করতে চায়। আবার অনেকে শুধু আমার নামটুকুই জানে। বইপত্তর কিছু পড়েনি। একজন বিখ্যাত লোকের

সংস্পর্শে আসতে ভিড় করেছে শুধু।

এখন আমি সত্যিই একজন বিখ্যাত জন। প্রায়দিনই নানা অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের সাথে আমাকে ডাকা হয়। প্রায় সব পুজো সংখ্যাতেই আমার গল্প বা উপন্যাস থাকে। বিভিন্ন সরকারি কমিটি, আকাদেমিতে আমার নাম থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক পর্যায়ে। কুড়ি বছর আগে যখন এখানে থাকতাম তখন আমায় প্রায় কেউ চিনত না। কলেজ স্ট্রিট, নন্দন চত্বরে ফেকলুর মতো ঘুরে বেড়াতাম। কাঁধে ব্যাগ, মুখে বিড়ি, না-কাটা দাড়ি। সুতপার যে আমাকে কী দেখে ভালো লেগেছিল, জানি না।

অনেকগুলো অটোগ্রাফের খাতা আমার সামনে এখন। একটা একটা করে সারতে লাগলাম সেগুলো। এমএলএ মশায় আমার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন।

– আমি এখানে চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি করছি। দু’বারের এমএলএ। তার আগে কাউন্সিলারও ছিলাম বহুদিন। আপনার মতো একজন বিখ্যাত মানুষ এখানে থেকে গেছেন অথচ আমরা কেউ সেটা জানতাম না!

ওনার এই অবাক হওয়া দেখে আমিও হেসে বললাম, আপনিও আমায় চিনতেন। মনে করতে পারছেন না।

– চিনতাম! কোন বাড়িটায় থাকতেন বলুন তো?

– পার্কের উলটোদিকের ওই বাড়িটায়। সাহাদের বাড়ি। তেতলায়। এমএলএ সাহেব জট ছাড়াতে না পেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। তারপর ক্লাব প্রেসিডেন্টকে বললেন, শংকরদা? তোমার কিছু মনে পড়ছে?

– নাহ্, তবে যেদিন ওনার বাড়িতে প্রোগ্রামটার ব্যাপারে যাই, সেদিন ওনাকে সামনে থেকে দেখে খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। মনে করতে পারছি না।…

আস্তে আস্তে ভিড়টা হালকা হয়ে এল প্রায়। মাথারা ছাড়া সকলে চলে গেছে একরকম। আমরা ক’জন মিলে পার্কের কোণের ক্লাবঘর খুলে বসলাম। সেক্রেটারি হাত কচলে বলল, একটু জলখাবারের আয়োজন রাখা হয়েছে। বসুন একটু।

এমএলএ সাহেবের কাজ ছিল। কিন্তু উনিও যেন আটকা পড়ে গেছেন আমার সম্বন্ধে পুরোটা জানার কৌতূহলে।

সুন্দর কাচের প্লেটে গরম গরম ফিশফ্রাই এল। সেক্রেটারি আমার একদম সামনে এসে বলল, স্যার, এমন সুযোগ তো বারবার আসে না, আপনি অনুমতি করলে একটু হুইস্কি দিয়ে সেবা করি।

আমি হেসে বললাম,

– তাও আছে! ঢালুন এক পেগ…

প্রথম পেগ শেষ করেই এমএলএ আমায় চেপে ধরলেন,

– দাদা আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন না, আপনার সাথে আগে কি আমার কখনও মোলাকাত হয়েছিল?

কৌতূহলে ওর গোল গোল চোখগুলো চকচক করছিল ওর দু’হাতের তিনজোড়া আংটির মতোই। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান মেরে বললাম, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সাহাদের তেতলায় আমি থাকতাম। একটা ঘটনার পর আপনার নেতৃত্বে একদল ছেলে এসেছিল আমার ফ্ল্যাটে…

…আমার এখনও মনে আছে দরজাটাকে ঢাকের মতো দুমদুম করে বাজিয়েছিল ওরা ‘দরজা খুলুন’ বলে চিৎকার করে। সুতপা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল ঘরের কোণে। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলেছিলাম, এভাবে দরজা ধাক্বাচ্ছেন কেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

প্রায় তেড়ে আসার ভঙ্গিতে ওরা বলেছিল, চোপ। বড়ো একেবারে ভদ্দোলোক এয়েছে। শুনে রাখুন, এটা ভদ্দোরলোকের পাড়া। সব শিক্ষিত মান্যগণ্য লোকেরা এখানে থাকে। এসব নষ্টামি এখানে চলবে না। তিনদিনের মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন…

পরে শুনেছিলাম সেদিন দুপুরে সুতপার স্বামী এসে বাড়িতে হুজ্জোত করে গেছিল, যখন আমি বা সুতপা কেউ ছিলাম না।

ক্লাবঘরটা মর্গের ঠান্ডা ঘরের মতো হয়ে গেল যেন। অসম্ভব নিস্তব্ধতা। এমএলএ, ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি সবাই মাথা নীচু করে বসে। আমি নিজেই বোতল থেকে আরেকটা পেগ ঢেলে নিলাম গ্লাসে। এক চুমুকে সেটা শেষ করে উঠে পড়লাম।

– আচ্ছা চলি তাহলে। ভালো থাকবেন।

পার্কের গেট অবধি ওরা সবাই চুপ করে অনুসরণ করল আমাকে। সংবর্ধনায় পাওয়া ফুল, মালা ও যাবতীয় সব কিছু ক্লাবঘরেই পড়ে রইল। সেটা দেখেও ওরা কেউ কিছু বলতে সাহস করল না। আমি গেটের কাছে এসে বললাম, আপনাদের আর আসতে হবে না। আমি একটু সাহাদের বাড়ি ঘুরে যাব, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।

এমএলএ ভদ্রলোক আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কি বলছেন! আপত্তি! আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। কুড়ি বছর আগে কম বয়সের তেজে অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম আমরা, জানি আপনি সে অপমান কোনওদিনও ভুলতে পারবেন না। তবু ছোটো ভাই ভেবে ক্ষমাঘেন্না করে দেবার চেষ্টা করবেন।

আমি মাননীয় এমএলএ-র পিঠে হাত রেখে বলি, আমি কিছু মনে রাখিনি। তাহলে কি আসতাম? মনে রেখে কি হবে বলুন, তাতে তো কিছু বদলাবে না।

ক্লাব সেক্রেটারি ছলছলে চোখে জিজ্ঞেস করল, বউদি এখন কেমন আছেন? উনি কি আপনার সাথেই আছেন?

আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মানা করার জন্য তো আর সুতপা নেই। ওরা আমার উত্তরের জন্য প্রতীক্ষারত। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে পরপর দু’তিনটে টান মারলাম সিগারেটে। হুইস্কির নেশাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে মাথায়। সন্ধ্যা নেমে এসেছে পুরোপুরি। পার্কটা এখন নিকষ কালো। সোডিয়াম ভেপারের আলো তাতে খুব বেশি নাক গলাতে পারছে না বড়ো বড়ো গাছপালার জন্য। আমি ওদের সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম, সেদিনের ঘটনার পরদিন আপনাদের বউদি, মানে আমার সুতপা রেললাইনে সুইসাইড করেছিল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...