মনটা ভালো নেই দীপ্তির। ফোনটা বেজে চলেছে, কিন্তু তুলতে ইচ্ছে করছে না। তুললেই কথা বলতে হবে। কিন্তু যে ফোন করছে সে নাছোড়বান্দা। ছাড়বার পাত্র নয়। অগত্যা দীপ্তিকে ফোনটা ধরতেই হল, ‘হ্যালো!’
‘হাই, কে দীপ্তি?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাবা! কী ব্যাপার তোর? দেড় বছর তোর সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। চিনতে পারছিস তো? আমি সূচি।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, গলাটা তোর একই আছে। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলি?’
দীপ্তি সাধারণ ভাবেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়, কিন্তু গলার স্বরে উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করে সূচি।
‘কী হয়েছে রে তোর দীপ্তি? গলার স্বরটা কেমন যেন লাগছে। রাগ করিস না প্লিজ। আমারই দোষ, এতদিন তোকে কন্ট্যাক্ট করতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রতিটা মুহূর্তে তোর কথা আমার মনে হয়েছে। তোর জন্যই মলয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল।’
‘এখন তুই কোথা থেকে বলছিস?’
‘সবে পরশু দেশে ফিরেছি। জানিস-ই তো মলয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে গিয়েছিলাম। ওর ওখানে কোম্পানির সঙ্গে দেড় বছরের কন্ট্র্যাক্ট ছিল। আমিও ওখানে একটা চাকরি খুঁজে জয়েন করে নিয়েছিলাম। তবে এত সব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমার মোবাইলটা শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। গতকাল শহরে পৌঁছেছি। আজ সকালে প্রথম তোকেই ফোন করলাম। এবার দেখবি একদিন তোর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি। এখন বল তো, তোর বাড়ির সকলে কেমন আছে? কাকু-কাকিমা, সৌরভদা আর উজ্জ্বল?’
এক নিশ্বাসে সবকিছু বলে দেবার পর সুচি খেয়াল করে দীপ্তি যেন মুখে তালা দিয়ে রেখেছে। ওর কোনওরকম প্রতিক্রিয়া সুচি বুঝতে পারে না।
ধৈর্য হারায় সূচি, ‘কীরে কী হল তোর? তখন থেকে আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। তুই তো কিছুই বলছিস না… কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ সূচির আওয়াজে ওর অধৈর্য ভাবটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
‘সবকিছু বদলে গেছে রে সুচি এই দেড় বছরে… বাবা আর নেই, মা বিছানায় পড়ে, প্যারালিসিস। দাদা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মদের নেশা ওকে গ্রাস করছে। বউদি ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে…’
‘আর উজ্জ্বল?’
‘উজ্জ্বল ঠিক আছে। এখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওর-ও যে কী হবে এখনও জানি না। সুচি, বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই… বলতে বলতে, দীপ্তির চোখের জল বাঁধ মানে না।
‘কাঁদিস না দীপ্তি… বি ব্রেভ… কলেজে সবথেকে সাহসী বলে পরিচিত, অন্যের যে-কোনওরকম সমস্যায় এগিয়ে এসে তার সমাধান বার করতে যে এক মুহূর্ত ভাবত না, সেই দীপ্তির কাছে নিজের সমস্যার কোনও সমাধান নেই, এমন কখনওই হতে পারে না… কাম অন ইয়ার। এই কথাটা আগে তুই সবাইকে বলতিস এখন আমি বলছি, সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে। চল, আমি পরের সপ্তাহে আসছি। একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ফোনটা কেটে গেল।
কলিংবেল-টা বেজে ওঠে। শাড়ির আঁচলে চোখের জলটা মুছে নিয়ে দীপ্তি সদর দরজাটা খুলে দেয়। রোজকার সেই চিরপরিচিত দৃশ্য। মদ এবং সুগন্ধির চেনা গন্ধটা এসে নাকে ঢুকল দীপ্তির। নেশার ঘোরে সৌরভ দরজায় ঠেসান দিয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে। ওকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন বন্ধু যারা নিজেরাও কেউ সুস্থ নয়, কম-বেশি সকলেই নেশায় বুঁদ। দাদার হাত ধরে দীপ্তি ঘরের ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই সুযোগে কেউ দীপ্তির হাত-টা ছুঁয়ে নেয়, কারও গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ে দীপ্তির পিঠে। পেছন থেকে কেউ দীপ্তির কোমরটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বোনের সম্মান রাখাটা দাদার কর্তব্য কিন্তু সেই দাদা নিজেই যেখানে বেহুঁশ সেখানে বন্ধুদের ও প্রতিরোধ করবে কী ভাবে? দীপ্তির চোখটা আবার জলে ভিজে আসে।
বাবার মৃত্যুর পর, ব্যাবসার সব দায়িত্ব, টাকাপয়সা সবকিছুই সৌরভের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংকের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যাবসায় মন দেয় সৌরভ। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে টাকাও। কাঁচা টাকা হাতে আসতেই বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সৌরভের পা মাটিতে থাকে না। দামি গাড়ি, দামি শখ, বিদেশি মদ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় সৌরভের। মা জয়ন্তী স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। সৌরভের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল কিন্তু জয়ন্তীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কারণে বিয়ে আটকে যায়। পাত্রীর বাবা রমানাথবাবু চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেক বুঝিয়ে জয়ন্তীকে সুস্থ করে তোলা হয়। রমানাথবাবু জয়ন্তীকে বলে তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে অনুরোধ জানান যাতে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হলেও বদলায়। বিয়ে হলে ছেলেও বাড়িমুখো হবে এটাও ওনার বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়ার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল।
অনেক ভেবেচিন্তে বিয়ের দিন স্থির করা হল। কিন্তু বিয়ের দিন মদের নেশায় সৌরভ বিয়ের আয়োজন ঠিকমতো করা হয়নি বলে রমানাথবাবুর সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসল।
ছেলের ব্যবহারে লজ্জিত জয়ন্তী, রমানাথবাবুর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে গেলে, পাত্রী সঞ্চিতা উঠে এসে জয়ন্তীর হাত ধরে থামায়। সঞ্চিতা জয়ন্তীর অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত বোধ করে। ছেলের জন্য মায়ের এই অপমান মেনে নিতে অসুবিধা হয় ওর। শান্তস্বরে জয়ন্তীকে বলে, ‘কাকীমা, এটা আপনি কী করছেন? এরকম ছেলের জন্য আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন? সৌরভের স্ট্যাটাস আমাদের থেকে একটু বেশিই মনে হয় উঁচু হয়ে গিয়েছে। আমিই এই বিয়ে করতে অস্বীকার করছি।’
পরিস্থিতি সামলে শেষমেশ সঞ্চিতা, জয়ন্তীর বাড়িতে বউ হয়ে এল। কিন্তু সৌরভকে বদলাতে পারল না সঞ্চিতা। মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সৌরভকে সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা বিফল হলে, বিয়ের তিন বছরের মাথায় সঞ্চিতা ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।
এই ধাক্বা জয়ন্তী সহ্য করতে পারলেন না। সেরিব্রাল হয়ে পক্ষাঘাতে সম্পূর্ণ ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।
সকালে সৌরভ অন্য মানুষ। মদের ঘোর কেটে গিয়ে হুঁশ ফিরে আসলে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হতো। মা, দীপ্তি, উজ্জ্বল সকলের কাছেই ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করত না। কিন্তু হলে কী হবে? সন্ধে হলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আকণ্ঠ গিলে পুরো মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরত।
মাঝেমধ্যে দীপ্তি সৌরভকে বোঝাবার চেষ্টা করত, ‘দাদা, তুই আর কারও কথা না ভাব, বউদি আর পারিজাতকে তো বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস। তাছাড়া উজ্জ্বল এখনও ছোটো আছে। কী অবস্থায় রাত্রে বাড়ি ফিরিস একবারও ভেবেছিস কি? আর তোর বন্ধুবান্ধবগুলোও বা কী? ওদের সঙ্গে মিশিস কেন?’
‘ওদের সম্পর্কে কিছু বলিস না। বাবার ব্যাবসাটা দাঁড় করাতে ওরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, নয়তো আমি ব্যাবসার কী-ই বা জানতাম। ওদের জন্যই এত তাড়াতাড়ি ব্যাবসার এতটা উন্নতি করতে পেরেছি।
আর ওরা সবাই ভালো বাড়ির ছেলে। কমবেশি সকলেই ড্রিংক করে। ওদের নিজেদের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে। শুধু আমারই একটু বেহাল অবস্থা হয় ড্রিংক করলে। কেন, তোর মনে হয় না যে আমার বন্ধুরা তোকে ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে?’
মনে মনে হাসে দীপ্তি। কাকে বলবে সত্যিটা কী? সৌরভের মদ্যপ বন্ধগুলোর চোখে লোভ, লালসা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি দীপ্তির। ওদের সামনে যেতে ভয়ে, ঘৃণায় দীপ্তির ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। কিন্তু কাকে বলবে এই কথাগুলো? সৗরভ মানতে রাজিই নয় যে ওর বন্ধুরা দীপ্তিকে নিজেদের লালসার শিকার বানাতে পারে। দাদা নিজে সুস্থ থাকলে তবেই না বোনের কষ্টটা বুঝতে সক্ষম হবে। সুতরাং সকলের অলক্ষে চোখের জল ফেলা ছাড়া দীপ্তির উপায় কী?
সুচি কথামতো পরের সপ্তাহেই দীপ্তির বাড়ি এসে হাজির হল। সুচিকে দেখে দীপ্তির এতদিনকার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে সব ঘটনা সূচি দীপ্তির কাছ থেকে জেনে নিল। গলা জড়িয়ে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ কাঁদল।
চোখের জল ফুরিয়ে এলে, সূচি সোজা হয়ে বসল। দীপ্তির মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে সূচি বলল, ‘চোখের জল মুছে ফেল, দীপ্তি। এই সমস্যার কোনও না কোনও বিহিত নিশ্চয়ই আছে। হার স্বীকার কেন করবি? এবার একটু হাস তো।’
‘দীপ্তি, তোর মনে আছে মলয় কী প্রচণ্ড গুটখা খেত? ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারছিল না। প্রবলেমটা তোকে বলতেই তুই মজা করে যে সমাধানটা দিয়েছিলি সেটা যে কতটা কাজ দিয়েছিল সেটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? ঘটনাটা ভাবলে এখনও আমার হাসি পায়।’
ঘটনাটা মনে আসতে দীপ্তির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর কথামতো, সুচি একটা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় মলয়ের পকেট থেকে গুটখার প্যাকেটগুলো বার করে কনডোমের কয়েকটা প্যাকেট রেখে দিয়েছিল মলয়ের অজান্তে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে গুটখা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে সকলের সামনে কনডোমের প্যাকেট হাতে উঠে আসতে সকলের ঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছিল মলয়কে। ব্যাস পকেটে গুটখা রাখার অভ্যাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মলয়। শেষমেশ দীপ্তির পরামর্শে সুচি মলয়কে কিছুদিন নেশামুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে গেলে মলয়ের গুটখার নেশা একেবারেই চলে যায়।
দীপ্তিকে হাসতে দেখে সুচির মুখও হাসিতে ভরে ওঠে।
চোখে-মুখে জল দিয়ে সুচি একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগ খুলে একটা ক্যামেরা বার করে দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিল, ‘এই নে, এটা তোর জন্য, ভিডিও ক্যামেরা।’
‘বাবাঃ, এটা তো খুব দামি ক্যামেরা। এত দাম দিয়ে আমার জন্য এটা আনার কী দরকার ছিল?’ দীপ্তি কৃত্রিম রাগ দেখায়।
‘কী দরকার ছিল…?’ সুচি দীপ্তিকে ভেংচি কাটে। ‘ফালতু বকবক বন্ধ কর। ক্যামেরার ফাংশনগুলো দ্যাখ। দারুণ ভিডিও তোলা যায় ক্যামেরাটায়।’
ইতিমধ্যে উজ্জ্বলও স্কুল থেকে এসে পড়ে। সুচি আর সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা দেখে ও আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘সুচিদি এটা বিদেশ থেকে এনেছ? কি দারুণ ক্যামেরাটা। আমি এটা দিয়ে ছবি তুলব।’
‘বাবাঃ! উজ্জ্বল, তুই কত লম্বা হয়ে গিয়েছিস। বেশ একটা বড়োবড়ো ভাব চলে এসেছে।’
‘দিদি, আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে আমি তোমাদের কথাবার্তা সব ভিডিও করব,’ বলে উজ্জ্বল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘দীপ্তি, আমি ভাবছি এটা দিয়ে তোর সমস্যারও একটা সমাধান করা যাবে।’
দীপ্তি অবাক চোখে তাকায় সুচির দিকে, ‘কীভাবে সেটা সম্ভব?’
‘রাত্রে যখন সৌরভদা বাড়ি ফিরবে তখন লুকিয়ে আড়াল থেকে দাদা এবং দাদার বন্ধুদের কীর্তি সব শ্যুট করতে হবে। সকালে পুরো ভিডিওটা সৌরভদার সামনে টিভির পর্দায় চালিয়ে দিলেই দাদা বুঝতে পারবে ওর বন্ধুরা কীরকম এক-একটা রত্ন,’ সুচি মনের মধ্যে থাকা সমাধানটা দীপ্তির কাছে স্পষ্ট করে।
উজ্জ্বল আর সুচি সৗরভের বাড়ি ফেরার আগেই ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যায়। সুচি বরের থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েই দীপ্তির বাড়ি এসেছিল। বিয়ের আগেও বহুবার দুই বন্ধু একে অপরের বাড়ি রাত কাটিয়েছে। কখনও কখনও সপ্তাহ কেটে গেলেও নিজের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হতো না। দু’জনের বাড়িতেই এটা নিয়ে বাদবিবাদ কখনও হয়নি কারণ সকলেই জানত দু’জনে হরিহরাত্মা। মলয়ও তাই সুচির ইচ্ছায় বাদ সাধেনি।
রাত এগারোটার কাছাকাছি ডোরবেল বেজে উঠতেই সুচি আর উজ্জ্বল, দীপ্তিকে ইশারা করে দরজাটা খুলতে। ওরা দুজন পর্দার পেছনে জায়গা করে নেয় যেখান থেকে সদর দরজাটা পরিষ্কার দেখা যায়। সুচি হাতের ক্যামেরাটার রেকর্ডিং অন করে দেয়।
দরজা খুলতেই সৗরভকে ধরে ওর এক বন্ধু দীপ্তির দিকে এগিয়ে আসে, ‘এই নাও, তোমার ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’ আর একটি ছেলে দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখী… আমাদেরও একটু এভাবে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারো তো সোনা।’ ছিটকে সরে আসে দীপ্তি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সুচির হাতটা নিশপিশ করতে থাকে।
অন্য আরও তিনবন্ধু দরজা ঠেলে সৌরভের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারই মধ্যে একজন দীপ্তিকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। সৌরভের কোনওদিকে খেয়াল নেই। নেশায় বুঁদ অবস্থায় সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ে। বোনের প্রতি বন্ধুদের অভব্য ব্যবহার কিছুই চোখে পড়ে না ওর।
দীপ্তি উজ্জ্বলকে ডাকে। সবাই ঘরে ঢুকে পড়াতে ও ভয় পেয়ে যায়। উজ্জ্বল লেবুর জল নিয়ে ঘরে ঢুকে সৗরভের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দেয়।
‘লেবুর জল আমাদেরও একটু দাও উজ্জ্বলবাবু। তোমার দিদিকে দেখে আমাদের নেশা আরও চেপে বসছে। আমরাও তোমার দিদিকে বড়ো ভালোবাসি…,’ বলতে বলতে একটি ছেলে দীপ্তির হাত ধরে টেনে কোলে বসাতে যায়।
‘আমার দিদির হাত ছাড়ুন,’ উজ্জ্বলের তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বরে ছেলেটি দীপ্তির হাত ছেড়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে জোরে ধাক্বা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।
সুচি আর চুপ থাকতে পারে না। একবার ভাবে পুলিশ ডাকবে কিন্তু তাহলে সৌরভদাকেও পুলিশ ছাড়বে না… দীপ্তি কীভাবে এগুলো রোজ সহ্য করে। পরক্ষণেই মন ঠিক করে নেয়। ভয় ঝেড়ে ফেলে ক্যামেরাটা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে বসবার ঘরে ঢোকে। ক্যামেরাতে প্রুফ রেকর্ড করাই আছে সুতরাং লোকগুলোকে বাড়ির বাইরে বার করতেই হবে। কঠিন গলায় সুচি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হচ্ছে এখানে? আপনাদের লজ্জা করে না? সৌরভের বন্ধু হয়ে ছোটো বোনের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছেন। কাকিমা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, উজ্জ্বল এখনও ছোটো, স্কুলে পড়ে আর সৌরভদা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে… আর আপনারা এই সুযোগে বাড়ির ভিতর ঢুকে এসে যাচ্ছেতাই আচরণ করছেন। এই মুহূর্তে আপনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো আমি এখুনি পুলিশ ডাকব,’ সুচি মোবাইল উঠিয়ে ডায়াল করতে আরম্ভ করে।
সুচির রণচণ্ডী মূর্তি দেখে আর পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে, সৌরভ ছাড়া সকলে উঠে পড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। দরজা দিয়ে বেরোতেই উজ্জ্বল দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুচিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দীপ্তি আর উজ্জ্বল সৌরভকে শোবার ঘর অবধি নিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল সৌরভের। মাথাটাও ভারী ভারী ঠেকছে। গতকাল রাতে মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুগুলো না থাকলে কী যে হতো কে জানে? মনে হল ওদের একবার ফোন করে ধন্যবাদ জানানো দরকার। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, চোখে পড়ল খাবার টেবিলে বসে দীপ্তি সুচির সঙ্গে গল্প করছে।
‘আরে সুচি না, তুই কখন এলি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলি? কোনও খবর নেই এতদিন পর? মানসকে পেয়ে আমাদেরই ভুলে গিয়েছিলি?’ মস্তিষ্কে জোর দিয়ে সৌরভ সুচির বরের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।
‘দাদা, মানস নয়, মলয়। মলয়ের সঙ্গে দেড় বছরের জন্য বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সবকিছুই কেমন বদলে গেছে। তুমি এখানে থেকেও না থাকারই সমান… নিজের লোকেদেরই তুমি ভুলে গেছ…,’ সুচি গলার দৃঢ়তা বজায় রাখে। জানে যেমন করেই হোক সৌরভের বিবেককে জাগাতে হবে।
‘সুচি তুই কী বলতে চাইছিস?’ সৌরভ সুচির পাশের চেয়ারটা টেনে ওর মুখোমুখি হয়।
‘তোমাদের বাড়ির পরিবেশ খুব বদলে গেছে। …কাকু বেঁচে নেই। কাকিমা বিছানায় পড়ে। বউদি, পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে আর তুমি…?
‘হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস সুচি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু এভাবেই বদলে যায়…’ সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘তুই একটু বস সুচি আমি ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
দীপ্তি চা তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখল। ইতিমধ্যে সুচি ডাইনিং হলে রাখা টিভি-টার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাটা অ্যাটাচ্ করে রেখেছিল। সৗরভ এসে চেয়ার টেনে চায়ে চুমুক মারতেই সুচি সামনে এসে দাঁড়াল, ‘দাদা, টিভির রিমোট-টা ধরো। টিভিটা অন করো, ভিডিও ক্যামেরায় একটা ভালো ভিডিও বানিয়েছি। ক্যামেরাটা বিদেশ থেকে দীপ্তির জন্য এনেছি… তুমি ভিডিও-টা দেখে বলো আমি কেমন বানাতে পেরেছি শর্ট ফিল্ম-টা। আমি ততক্ষণ দীপ্তিকে রান্নাঘরে একটু হেল্প করে দিই,’ বলে সুচি দীপ্তির সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
সৗরভ চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টিভি-টা অন করে দিল। চোখ টিভির পর্দার দিকে। নড়েচড়ে বসল সৗরভ। ভাবতে পারেনি পর্দায় ওরই ছবি ফুটে উঠবে। টিভির পর্দায় নিজের অবস্থা, নিজেরই ড্রইংরুমে বন্ধুদের হাতে দীপ্তি আর উজ্জ্বলের হেনস্থা দেখে লজ্জায়, রাগে সৗরভের মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল। যে বন্ধুদের ও অগাধ বিশ্বাস করেছে, যাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে চায়নি দীপ্তির মুখ থেকে, তারা যে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে, ও কি এটা কোনওদিন বিশ্বাস করত? নিজের দুঃখ, লজ্জা ঢাকবার জন্য সৗরভ দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। নিজের ওপরেই ঘৃণা বোধ করে সৗরভ।
সুচি এসে দাঁড়ায় টেবিলের পাশে। টিভি বন্ধ করে দেয় টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে। ভিডিও-টা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
‘সরি… দাদা’, বলে সৌরভের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দেয় সুচি। ‘দীপ্তি আর কাকিমার বারণ সত্ত্বেও তুমি বন্ধুদের অগাধ বিশ্বাস করে এসেছ। কোনওদিন ওদের আসল চেহারাটা জানারও চেষ্টা করোনি। এর জন্য দীপ্তিকে কী কী সহ্য করতে হয়েছে নিজের চোখেই দেখলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে… আমি এর জন্য সত্যিই দুঃখিত।’
‘তুই কেন ক্ষমা চাইছিস? দোষ তো আমি করেছি। এত বড়ো অন্যায় করেছি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তুই ভালো কাজই করেছিস। আমার জন্য দীপ্তিকে অসম্মানিত হতে হয়েছে, উজ্জ্বলের উপরেও না জানি এই সব ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে কে জানে? মদের নেশায় আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি যে বাড়ির লোকদের ছেড়ে আমি বাইরের লোককে বিশ্বাস করেছি। ওদের বোঝানোতেই সঞ্চিতাকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমিই প্ররোচিত করেছি। ছোট্ট পরি-কে নিয়ে চলে যেতে ও বাধ্য হয়েছে। রোজ ভাবি মদ ছোঁব না কিন্তু সন্ধে হলে কী যে হয়… জানি না… আমার কী ভবিষ্যৎ?’
‘দাদা, এতটাও ভেঙে পোড়ো না,’ সুচি বোঝাবার চেষ্টা করে, ‘তুমি মনে জোর আনলে অবশ্যই মদ ছাড়তে পারবে… যাবে আমার সঙ্গে দাদা?’
‘কোথায়?’
‘দাদা আজকেই চলো আমার সঙ্গে যেখানে গুটখার নেশা ছাড়াবার জন্য মলয়কেও নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই নেশা ছাড়াবার রিহ্যাব। যাবে তো দাদা?’
সৗরভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দীিঀ৫ এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল সৗরভ বুঝতে পারেনি। আনন্দে দীপ্তি পিছন থেকেই দাদার গলা জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে বইতে থাকে আনন্দাশ্রু। সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিকে বুকে টেনে নেয়। ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে সুচির চোখেও জল চলে আসে।
সুচির দু’বছরের বিবাহবার্ষিকীর দিন দীপ্তি সকাল থেকেই উপস্থিত। দুই বন্ধুর কথার যেন কোনও শেষ নেই। মলয় দু’জনকে কিছুটা প্রাইভেসি ছেড়ে দিতে বাইরের ছোটোখাটো কাজগুলো সারতে বেরিয়েছে। অনুষ্ঠান তো সেই সন্ধেবেলা। ক্যাটারার বলাই আছে সুতরাং বাড়িতে রান্নার কোনও ঝামেলা নেই।
‘হ্যাঁরে দীপ্তি, সৗরভদা তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তাই না,’ একা পেয়ে সুচি প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় বন্ধুর দিকে, ‘বউদিকে কবে বাড়ি নিয়ে আসছিস? তাড়াতাড়ি করে বউদিকে বাড়ি আন তবেই না আমি আমার বউদিকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারব।’
‘মানে? কী যে বকিস, কোনও মাথামুন্ডু থাকে না।’
‘সেই! এখন আমার কথা তোর ফালতুই মনে হবে,’ কপট রাগ দেখায় সুচি, ‘তুই তো জানিস না দীপ্তি, আমার জ্যেঠুর ছেলে সিদ্ধার্থ দিল্লিতে চাকরি করে। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর তোকেও।’
‘আমাকে?’ আশ্চর্য হয় দীপ্তি।
‘হ্যাঁ, কলেজে ছিলাম যখন তখন দু’তিনবার ও কলেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তখনই ও তোকে আমার সঙ্গে দেখেছে। তাছাড়া তোর অনেক গল্পই আমি ওর সঙ্গে করেছি যার মধ্যে মলয়ের গুটখার নেশা ছাড়াবার ঘটনাটাও রয়েছে। বিকেলে সিদ্ধার্থ-ও আসছে।’
লজ্জায় দীপ্তির মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সুচির কাছে মনের ভাব লুকোবার জন্য উঠে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করলে, সুচি দীপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।