শিশু আর অপরাধ? এই ভাবনাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে যে, মানুষের অপরাধ প্রবণতা শৈশবেই তৈরি হয়। সমাজে বাড়ছে অপরাধ। বোঝা দরকার, শৈশবে চাপা অপরাধ প্রবণতার জন্যই কেউ কেউ অপরাধের জগতাটাকে বেছে নিচ্ছে, নাকি হঠাৎ-ই মানসিক পরিবর্তন ঘটছে কারও কারও মধ্যে? অপরাধ করার মধ্যেই কি লুকিয়ে আছে একটা দুর্নিবার আকর্ষণ?

মনোবিদদের মতে, শৈশবেই শিশুর মনে অপরাধপ্রবণতার বীজ ধীরে ধীরে শিকড় মেলতে আরম্ভ করে। একদিকে যেমন অবহেলা, অনাদর, অপরের বিতৃষ্ণা শিশুমনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে তেমনি পরিবারের সদস্যদের মাত্রাতিরিক্ত আদর, ভালোবাসাও শিশুর চরিত্র গঠনে নঞর্থক প্রভাব ফেলে। সন্তানকে প্রয়োজনের বেশি আদর দিতে গিয়ে তাদের চরিত্র গঠনে অভিভাবকরা মনোযাগ দিতে ভুলে যান। বিপদের শুরু সেখান থেকেই। সন্তান ধীরে ধীরে কখন যে মা-বাবার শাসনের গণ্ডি পার করে ফেলে অভিভাবকেরা বুঝেও বুঝতে চান না। কেউ কেউ নিজেদের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে সন্তানের মধ্যে ব্যবহারিক পরিবর্তন খেয়ালই করেন না। ফলে অনেক সময়ই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে বসে অথবা কখনও সভ্যতার সীমাও অতিক্রম করে।

সৌরভ-কে এলাকায় সকলেই চিনত ভালো ছাত্র হিসেবে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, পড়াশোনা, খেলাধুলোয় তুখোড়। মা-বাবা বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। গিটার, ভায়োলিনের মতো বাদ্যযন্ত্রে দুরন্ত হাত, ফলে পাড়ার যে-কোনও অনুষ্ঠানে খুবই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিল। একদিন শোনা গেল সৌরভের বাবা নাকি ছেলের বালিশের তলা থেকে একটা ধারালো ছোরা খুঁজে পেয়েছেন হঠাৎ-ই। ছেলের ঘরে ঢুকেছিলেন কোনও কাজে। কয়েকদিন পর সেই ছোরা নিয়েই ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের উপর, সামান্য কথাকাটাকাটির জেরে। জানা যায় ওই বয়সেই সৌরভ সোনা পাচারকারী আর ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে যুক্ত।

কিন্তু এমন একটা পরিণতির দিকে সৌরভ এগোল কীভাবে? মনোবিদের কাছে সৌরভ স্বীকার করে, মাফিয়াদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে কয়েকদিনের মধ্যেই মা-বাবাকে খুন করার ছক কষেছিল সে। মনোরোগের শিকড় সন্ধান করে দেখা যায়, সংসারে মা-বাবার ঝগড়া লেগেই থাকত। ছোটো থেকেই তা দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছিল সৌরভ ফলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতেই সে বেছে নেয় অপরাধ জগতকে। অর্থের অভাব না থাকলেও, সমাজবিরোধী হয়ে উঠতে মনস্থির করে। সৌরভের এই অপরাধ-প্রবণতার জন্য পরোক্ষ ভাবে দায়ী সৌরভের মা-বাবাই। নিজেদের অসুখী দাম্পত্য-কে যদি ছেলের নাগালের বাইরে রাখতেন, তাহলে হয়তো ছেলেটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে বড়ো হতে পারত। শৈশবটা তার এই ভাবে বিষিয়ে যেত না।

কিছুদিন আগেই এই একই ধরনের ঘটনা সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা করে নিয়েছিল। সাড়া ফেলেছিল দেশের সর্বত্র। ‘উদয়ন’ বৃত্তান্ত। ‘সাইকো কিলার’ নাম দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রথমে নিজের মা-বাবাকে হত্যা করে বাগানে পুঁতে দেয় সে। পরে কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের প্রেমিকা-কে হত্যা করে নিজের বাড়ির ভিতরেই তাকে কফিন বন্ধ করে বেদি বানিয়ে ওই ঘরেই বসবাস করতে থাকে।

কিন্তু এই বিকৃত মানসিকতার জড় কিন্তু উদয়নের শৈশবেই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন মনোবিদরা। স্কুলের ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও মায়ের অতিরিক্ত শাসন, মায়ের মানা সত্ত্বেও বাড়ির বাইরে পা-রাখার অপরাধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকার বাথরুমে আটকে থাকার শাস্তি সহ্য করতে করতে উদয়নের মন পড়াশোনা থেকে সরে যেতে আরম্ভ করে। মাত্র এগারো বছর বয়সেই সোশাল মিডিয়ার (অরকুট) প্রতি আকৃষ্ট বোধ করতে থাকে উদয়ন। ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিবাদ করাটাও উদয়নের মায়ের অভ্যাস ছিল, ফলে ছেলেও এই পরিবেশেই বড়ো হয়েছিল।

অত্যাধিক মানসিক চাপের ফলে উদয়ন পড়াশোনা শেষ করতে পারে না এবং বাড়ি থেকে ক্রমাগত চাকরির চাপ সহ্য করতে না পেরে মনোবিকারগ্রস্ত রোগীতে পরিণত হয়, যার পরিণতি দাঁড়ায় ছেলের হাতে মা-বাবার হত্যা এবং হত্যার ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। এমনকী মায়ের মৃত্যুর পরেও সই জাল করে মায়ের পেনশনের টাকাও তুলে নিত উদয়ন।

ফেসবুকের মাধ্যমে উদয়নের বন্ধুত্ব হয় আকাঙক্ষার সঙ্গে। দু’জনে একসঙ্গে লিভ ইন করতে শুরু করে কিন্তু পুরো সম্পর্কটাই ছিল মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে। নিজের চাকরি সম্পর্কে পুরোটাই মিথ্যা বলে উদয়ন। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দোষে এবং আকাঙক্ষার টাকা হস্তগত করার লোভে আকাঙক্ষাকেও খুন করে উদয়ন। এক্ষেত্রেও মনোবিদরা, উদয়নের শৈশব-ই তার অপরাধ মনের মূল রসদ জুগিয়েছে বলেই মনে করছেন।

এতো গেল অবহেলা, অতিরিক্ত শাসনের পরিণতি কিন্তু অযথা অতিরিক্ত আদর, সন্তানের দোষ স্বীকার না করে তার সামনেই অপরকে দোষী সাব্যস্ত করে বকাঝকা করাটাও কিন্তু শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলে।

অন্য একটি ঘটনায়, ঝগড়া হলেই ছেলে বঁটি নিয়ে মাকে তাড়া করত। সঙ্গে অশ্রাব্য গালাগালি। বাবা-কাকা বাধা দিতে এসে নিজেরাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন কতবার। সমাজে বদনামের ভয়ে পুলিশের কাছে পরিবারের কেউ যাননি। হামলা করেই ছেলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেত। সারারাত সমাজবিরোধী বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করে ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে আসত বছর চোদ্দোর ওই কিশোর। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হতে বসেছিল। মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে বোঝা যায় ছেলেটি ম্যানিক সাইকোটিক ডিসঅর্ডারের শিকার। এর মূল কারণ পরিবারের সকলের অতিরিক্ত আদর। কেউ একজন শাসন করতে এলেই অপর সদস্যরা তাকে বাঁচাতে উদ্যত হতো। মিলত প্রশ্রয়। ফলে বুক ফুলিয়ে অপরাধ করাটা নেশার মতো হয়ে যায়। বাড়তে থাকে সমাজবিরোধী মানসিকতা।

লিঙ্গ নির্বিশেষে অপরাধের শিকড় জারিত হয় শৈশবেরই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে– এমনটাই মত মনোবিদদের। অষ্টাদশী শ্রীপর্ণার প্রথম প্রেম ফেসবুকের মাধ্যমে এক ডাক্তারের সঙ্গে। নিজেও ডাক্তার বলে মিথ্যা প্রচার করে সে। ছেলেটি মিথ্যাটা জেনেও শ্রীপর্ণাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু শ্রীপর্ণার ইচ্ছে লিভ ইন। ছেলেটি রাজিও হয়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শ্রীপর্ণা ছেলেটিকে ডমিনেট করা শুরু করে। কথায় কথায় ছেলেটির গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না। ছেলেটিকে ছুরি দিয়ে মারবার চেষ্টা করে দু’বার এবং নিজেও সাতবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে অন্য পুরুষদেরও প্রেমে পড়ে এবং নেশার (নানাবিধ) শিকার হয়ে পড়ে।

মনোবিদ কেসটা স্টাডি করেন। জানা যায় ছোটোবেলায় মেয়েটি তার মা-কে হারায়। ব্যবসায়ী বাবা, মা-মরা আদুরে মেয়ের কোনও কিছুরই অভাব রাখেননি। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বদমেজাজি মেয়ে ‘না’ শোনা বরদাস্ত করতেই শিখল না। স্নেহান্ধ বাবার প্রশ্রয়ে মেয়েটার মনে ‘অপরাধ’ বাসা গেড়ে বসল।

এই ধরনের ঘটনা এখন সমাজে আকছার ঘটছে। মানুষের কাছে সময়ের মূল্য যত কমছে ততই অপরাধ জগতের রমরমা বাড়ছে। মানুষ বেশি করে মানসিক বিকারের শিকার হচ্ছে। মানুষের ধৈর্য কমছে, মূল্যবোধ কমছে, মানসিক চাপ বাড়ছে। স্কুলের মতো জায়গায় যেখানে বিদ্যা দেওয়া-নেওয়াটাই প্রধান, সেখানেও এখন সামান্য কারণে অথবা কারণ ছাড়াই সহপাঠীকে হত্যা করছে কোনও কিশোর, যার অপরাধ করার বয়সই তখনও হয়নি। তবে কেন নিজের বন্ধুকে মারতে উদ্যত হচ্ছে সে ওই বয়সে? তাহলে কি শৈশবের ফেলে আসা অতীতটাতেই লুকিয়ে থাকছে ভবিষ্যতের অপরাধ করার কারণটা?

আজকাল কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে প্রতিহিংসাপ্রবণতা এতটাই বেশি মাত্রায় চোখে পড়ছে, তাতে মনোবিদেরা যথেষ্ট চিন্তিত। সামান্য কথাকাটাকাটি অথবা সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটলেও নতুন প্রজন্ম হিংস্র হয়ে উঠতে দেরি করছে না। শৈশবে অত্যাচারিত হওয়া, মা-বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পারিবারিক অশান্তিই যে এর প্রধান কারণ সেটাতে সম্মত মনোবিদরা।

সুমন-কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানা থেকে। জানা যায় এলাকারই একটি মেয়ের গলায় ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিল সে। অথচ স্বভাবে রুমন খুব ধীর, নম্র, ভদ্র বলেই পরিচিত ছিল। তবে বলা যেতে পারে কিছুটা ইনট্রোভার্ট। সে কি করে এমন কাজ করতে পারল?

সাইকায়াট্রিস্ট, চিকিৎসা করতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন, মা-কে বাবার হাতে মার খেতে দেখে সুমন বড়ো হয়েছিল। অথচ তার মা-বাবা দু’জনেই শিক্ষিত। বাড়ির অশান্তির কারণে মা-ও সুমনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না এবং সুমনের যখন নয় বছর বয়স, মা, সুমনকে ছেড়ে ডিভোর্স নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পাতেন। ফলে সমাজটার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়েই সুমন বড়ো হয়েছিল এবং মেয়েটির কাছে প্রেমের প্রত্যাখ্যান সে বরদাস্ত করতে পারেনি। সম্পর্কে সমস্ত বিশ্বাস ও হারিয়ে ফেলেছিল।

শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হলেও, অপরাধ করার মানসিকতা তৈরি হতে পারে বলেও মনোবিদরা মনে করছেন। সিনেমা আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। হিন্দি ছবি ‘হাইওয়ে’তে আলিয়া ভট্টও শিশুবয়সে নিজের পরিবারেরই সদস্যের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল। এরপর অপরাধে নিজেকে না জড়ালেও নিজের স্ট্যাটাস, পারিবারিক সম্মান সব ছেড়ে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের একটি মানুষকে ভালোবেসে অর্থ যশ, প্রতিপত্তি থেকে দূরে চলে যেতে একবারও ভাবেনি। নিজের বাড়ি, শহরের মানুষের উপর তৈরি হয়েছিল অপরিসীম ঘৃণা।

তেরো বছর বয়সি রেহানার ক্ষেত্রে পরিণামটা ছিল একটু অন্যরকম। এমনিতে শান্ত স্বভাবের মেয়ে মাঝেমধ্যেই আচমকা খেপে উঠত। ভেঙে ফেলত বাড়ির দামি আসবাবপত্র। মা-বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকায় ঠাকুমা-ঠাকুরদার কাছে থাকত রেহানা। কলকাতার নামি স্কুলের ছাত্রী ঠাকুমা-ঠাকুরদার গায়েও হাত তুলত। চিকিৎসার জন্য মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে, চিকিৎসক জানতে পারেন শৈশবে রেহানা নিজের কাকার যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। মা-বাবাকে জানালেও তারা কেউ আমল দেননি। সেই থেকেই রেহানার মনোবিকারের শুরু।

অভিভাবকেরা আজ এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন যে, নিজেদের এই গাফিলতি ঢাকতে সন্তানকে যথেচ্ছা স্বাধীনতা দিয়ে বসছেন। পরিবারে গোনাগুনতি সদস্যের মধ্যেই ভুলবোঝাবুঝি, মতবিরোধের দেয়াল উঠছে। এক বাড়িতে থেকেও সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার যোগসূত্রটা কিছুতেই ঠিকমতো গড়ে উঠছে না। ফলে ধীরে ধীরে অভিভাবকেদের ছাতার তলা থেকে ক্রমশ সরে আসতে আসতে, নতুন প্রজন্ম মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। জন্ম নিচ্ছে মনোবিকার। বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা।

সাবধানতার প্রয়োজন – ছোটো ছোটো অপরাধ প্রবণতা চোখে পড়লেই দেরি না করে মনোবিদের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। শুরুতেই চিকিৎসা হলে রোগীরা সাধারণ জীবনে ফিরতে পারবে। সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে হবে। তার স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা একান্ত কাম্য কারণ কাদের সঙ্গে আপনার সন্তান মেলামেশা করছে সেটার খবর মা-বাবার কাছে থাকা উচিত। ছেলেমেয়ের উপর খবরদারি না করে সস্নেহ দৃষ্টি রাখতে হবে তাদের উপর।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...