পর্ব – ১
বেলা সোয়া দশটা নাগাদ আলিপুর থানায় একটি মারুতি ওয়ান থাউজেন্ড কার এসে থামে। গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসেন বছর ষাটেকের এক ব্যক্তি। যথেষ্ট স্থূলকায়, মুখ চোখ ভারী ভারী, চোখের নীচে অ্যালকোহলিক ফ্যাট, ভদ্রলোক উচ্চতায় প্রায় ছ’ফুট, পরনে ক্রিমরঙা ট্রাউজারস, গায়ে হাফ হাতা নীল শার্ট ছেড়ে পরা, পায়ে এক জোড়া চপ্পল। ভদ্রলোকের চুল উশকোখুশকো। দু’চোখ ভরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি থানার প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট্রি কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করেন, ভাইসাব, ওসি-সাহেব কাঁহা বৈঠতে হ্যায়?
–কেন, ওসিকে কী দরকার? পালটা প্রশ্ন বাঙালি কনস্টেবলের।
–মুঝে এক ইনফর্মেশন দেনা হ্যায় উনকো। কাল রাত মেরে ঘরমে এক মৌত হো গয়ি, চাপা উত্তেজনা ভদ্রলােকের গলায় ফুটে ওঠে।
–ও আচ্ছা, আপনি এক কাজ করুন, একটু এগিয়ে বাঁদিকের ঘরে যান, ওখানে ডিউটি অফিসার মি. সান্যাল আছেন এখন চার্জে, ব্যাপারটা ওনাকে বলুন। মৃত্যুর কথাটা সেন্ট্রি কনস্টেবলকে খুব একটা নাড়া দিল বলে মনে হল না।
সেন্ট্রি কনস্টেবলের নির্দেশ মতন ভদ্রলোক এগিয়ে যান, ডিউটি অফিসারের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, মে আই কাম ইন স্যার?
সকালবেলার পেপারটা সবে মাত্র চোখ বোলাচ্ছিলেন মি. সান্যাল। টেবিলের ওপরে রাখা চা। একটু একটু করে চা পান, একটু একটু করে কাগজ পড়া, এতেই অভ্যস্ত তিনি। সেদিনও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। এমন সময় এই আপদ, পেপার থেকে চোখ সরিয়ে নাকের ওপর ঝুলে থাকা চশমাটা একটুও পেছনে না ঠেলেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জরিপ করেন তিনি। মুখ থেকে স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বেরিয়ে আসে, ইয়েস্, প্লিজ কাম ইন্।
ভদ্রলোক দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসেন। বোধ হয় জীবনে এই প্রথম থানায় এলেন। তিনি চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ান।
প্লিজ সিট ডাউন, চোখের ইঙ্গিতে চেয়ারটি দেখান সান্যালবাবু, তারপর বলেন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইয়ু মিস্টার…
–আগরওয়াল, চেয়ারে বসতে বসতে কথা সম্পূর্ণ করেন ভদ্রলোক।
–ইয়েস মি. আগরওয়াল…
–দেখিয়ে সাব, মেরে ঘরমে কাল রাত আচানক এক মৌত হো গয়ি, উত্তেজনায় অফিসারের কথা শেষ হবার আগেই নিজের বক্তব্য বলে ওঠেন ভদ্রলোক। ভীষণ টেনস্ড দেখায় তাঁকে।
–থমকে যান ডিউটি অফিসার, হাতে ধরা খবরের কাগজটা সরিয়ে রেখে সরাসরি ভদ্রলােকের চোখের ওপর চোখ রাখেন তিনি, জারা ডিটেলসমে বতায়েঙ্গে প্লিজ?
একটু থামেন মি. আগরওয়াল। বোধ হয় মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নেন একটু। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এরপর তিনি বলতে শুরু করেন, –স্যার, আমার নাম ঘনশ্যাম আগরওয়াল। আমি আপনার থানার এলাকায় বর্ধমান রোডের ওপর সত্যম টাওয়ারের কাছে থাকি। দিন তিনেক আগে আমার বাড়িতে দীর্ঘদিনের পুরোনো বন্ধু মি. চমন গোলচার মেয়ে এসেছিল নেপাল থেকে। শুনেছি মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল ওখানকারই এক ধনী পরিবারের ছেলে কি সাম রতনের সঙ্গে। কিন্তু বিয়েতে ছেলেটির বাবা রাজি ছিল না। জাতপাত নিয়ে নানান ঝামেলা চলছিল। কিন্তু ছেলে এবং মেয়ে দু’জনই একদম ডিটারমাইন্ড ছিল যে শাদী ওরা করবেই। একটু দম নিয়ে তিনি আবার বলেন– এ সবই আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শোনা।
–আপনার সঙ্গে চমন গোলচার আলাপ কতদিনের? হঠাৎ পাশের টেবিলে বসা বছর বত্রিশের পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করেন মি. আগরওয়ালকে।
প্রশ্নের ধাক্বায় একটু থমকে যান মি. আগরওয়াল। নিজের সমস্যা নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, এতক্ষণ তিনি চারিপাশে কে বা কারা আছেন দেখবার ফুরসত পাননি।
ডিউটি অফিসার বললেন, উনি মি. সুমিত রক্ষিত, এ সময় ইনভেস্টিগেশনের চার্জে আছেন। আপনার কেস খুব সম্ভবত উনিই টেক আপ করবেন। আপনি ওনার সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে যান।
আচ্ছা, সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন মি. আগরওয়াল। তারপর বলতে থাকেন, চমন লালের সঙ্গে আমার ব্যবসা সূত্রে আলাপ প্রায় দীর্ঘ বিশ বাইশ বছর আগে। পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আমার ফ্যামিলির সঙ্গে ওর ফ্যামিলির। দিনে দিনে আমারও ছেলে-মেয়ে বউ-এর সঙ্গে ওর পরিবারের লোকজনের সম্পর্ক এমনই দাঁড়ায় যে আমার বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হবে আর চমন লালের ফ্যামিলি আসবে না এরকমটা না মুম্কিন হয়ে দাঁড়ায়। বছরে দু’তিনবার আমার বাড়ির কেউ না কেউ যায় নেপালে, আই মিন্ চমন লালের বাড়ি। আবার ওর বাড়ির লোকজনও যখন খুশি আসে আমাদের কাছে। বিশেষ করে ব্যবসার কোনও কাজে এলে আমার বাড়িতেই ওঠে ওর লোকজন।
–কীসের ব্যবসা আপনাদের? ইন্টারাপ্ট করেন যুবক অফিসার।
–গারমেন্টস-এর, ওর সঙ্গে মূলত আমার গারমেন্টস-এরই ব্যবসা। এছাড়া আমার অন্যান্য ব্যবসাও আছে তবে তা অন্য লোকেদের সঙ্গে।
–অ্যাকচুয়ালি যে মারা গেছে সে কি চমন গোলচারই মেয়ে? ওসব কথা এড়িয়ে মূল প্রসঙ্গে যেতে চান মি. রক্ষিত।
–ইয়েস স্যার, আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, ওরই মেয়ে, আমার এখানে বেড়াতে এসে এভাবে মারা গেল মেয়েটা… বন্ধুর কাছে আমি কীভাবে মুখ দেখাব বুঝতে পারছি না স্যার, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন শোনায় তার কণ্ঠস্বর।
–মেয়েটার নাম কি? ধারাল প্রশ্ন অফিসারের। পেন, ডাইরি নিয়ে প্রস্তুত তিনি প্রয়োজনীয় নোট নেবার জন্য।
–স্যার, মরুশ্বেতা গোলচা।
–বয়স?
–প্রায় বাইশ-তেইশ।
–বাবার নাম তো বললেন চমন গোলচা, তাই না? যথেষ্ট অ্যাক্টিভ দেখায় মি. রক্ষিতকে। অ্যাড্রেসটা?
–প্রপার অ্যাড্রেস স্যার… একটু ইতস্তত করেন ভদ্রলোক।
–ঠিক আছে, আপনার বাড়ি গিয়ে আমি সেটা নিয়ে নেবখন। আচ্ছা, ডেডবডিটা এখন কোথায়?
–আমার বাড়িতেই স্যার, দোতলার গেস্টরুমে।।
–মেয়েটা মারা গেল কীভাবে বলুন তো? অতি সাধারণ একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন অফিসার খুব ক্যাজুয়ালি।
–কী জানি স্যার, এমনি এমনি মরে গেল মেয়েটা, কেমন বোকা বোকা শোনাল আগরওয়ালের মন্তব্য।
–বাজে কথা রাখুন মশাই, ধমকে ওঠেন অফিসার, একটা জলজ্যান্ত ইয়ং মেয়ে এমনি এমনি মরে গেল? চলুন দেখি, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মি রক্ষিত।
–স্যার, স্যার, হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন মি. আগরওয়াল।
–আবার কী হল?
–স্যার মাস ছয়েক আগে মেয়েটার কিডনির কী একটা অপারেশন হয়, এই কলকাতারই বেলভিউ নার্সিং হোমে। শুনেছিলাম অপারেশনে কিছু গন্ডগোল হয়েছিল, আমার মনে হয় স্যার সেজন্যই… কথা সম্পূর্ণ হয় না মি. আগরওয়ালের, অফিসারের তীব্র দৃষ্টি তার ওপর সার্চ লাইটের মতন।
–তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং। মি. আগরওয়ালের কথার মাঝখানেই বলে ওঠেন মি. রক্ষিত।।
–না মানে, কেমন যেন থতমত খেয়ে যান মি. আগরওয়াল, আমার মনে হয়, হয়তো সে কারণেই…. কথা শেষ হয় না তার এবারও।
–আই সি, বিড়বিড় করতে থাকেন অফিসার। ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে উঠছে। এই ভদ্রলোক তো দেখছি শুরু থেকেই লাইন অফ ইনভেস্টিগেশনটা ডিরেইল করতে চাইছেন।
তারপর মি. রক্ষিত বলে ওঠেন, মি. সান্যাল জিডিতে আমায় একটা আউট দিন। বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখবেন। এফআইআর এখনই ড্র করতে হবে না। আগে আমি পিও ভিজিট করে আসি, তারপর ওটা করা যাবেখন। আর পুরো ঘটনাটাই শুনলেন তো আপনি, বড়োবাবুকে ব্যাপারটা একটু জানিয়ে রাখবেন। এটাও বলবেন যে, কেসটা আমি টেক আপ করছি। আর মোবাইলে যে দু’জন কনস্টেবল ছিল ওরা কোথায়?
–ওরা স্যার সামনের গাছতলায় চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি স্যার, বললেন মি. সান্যাল, তারপর জোরে চ্যাঁচালেন, দফা, এই দফা।
দরজার বাইরে সেন্ট্রি কনস্টেবলের সঙ্গে আড্ডা মারতে থাকা হোমগার্ড ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে। বলে, স্যার ডাকছেন? ভীত সন্ত্রস্ত মুখ।
–স্যার ডাকছেন? ভেংচি কাটেন সান্যালবাবু। থাকো কোথায়? যাও, এক্ষুনি মোবাইলে যে দু’জন কনস্টেবল ডিউটিতে আছে তাদের ডেকে পাঠাও। বলো তাদের যে রক্ষিতবাবু বেরোবেন।
মি. রক্ষিত ততক্ষণে ডাইরি কাগজ কার্বন, আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেন। দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে বলেন, সেন্ট্রি, ড্রাইভারকে গাড়ি লাগাতে বলো।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মি. ঘনশ্যাম আগরওয়ালের ওয়ান থাউজেন্ড কারের পিছু পিছু ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হল পুলিশের জিপ । গাড়িতে বসেই অফিসার থানার লাগোয়া ডানদিকের শিব মন্দিরের দিকে একবার চেয়ে দ্রুত প্রণাম সেরে নেন। মন্দিরের ওপরে অশ্বত্থ গাছটায় একটা কাক তখন বিশ্রী ভাবে একটানা ডেকে চলেছে। গাড়ি দুটি ক্রমশ থানা কমপাউন্ড ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে।
পর্ব – ২
ঘটনাস্থলে পৌঁছোতে বেশি দেরি লাগে না। মি. আগরওয়ালের গাড়ি এক বিশাল গেটওয়ালা বাড়ির সামনে এসে থেমে যায়। পিছন পিছন থামে পুলিশের জিপ। সামনের গাড়ি থেকে থেমে থেমে চারবার হর্ন বাজে, গেট খুলে যায়। খানিকটা ভেতরে ঢোকে গাড়ি তারপর থেমে যায়, পুলিশের জিপ থামলে মি. রক্ষিত নামেন, চারিপাশ একবার দেখে নেন। বাড়ির লনে বেশ কিছু মানুষের জটলা। পাঁচিল ঘেরা প্রায় বিঘা খানেক জমির একপাশে মি. আগরওয়ালের তিনতলা বাড়ি। গেট থেকে মোরাম ঢালা পথ, পথের দু’পাশে ছবির মতন সাজানো রঙিন ফুলগাছের টব সারি সারি, ঘাসের মসৃণ গালিচা। এক থমথমে ভাব, চাপা ফিসফাস, মৃদু গুঞ্জনের মধ্যে ভেসে ওঠে কয়েকটি শব্দ, পুলিশ আ গয়ি।
এ রকম সিরিয়াস পরিবেশেও মি. রক্ষিতের হাসি পেয়ে যায়, ভারি অদ্ভুত এই হিন্দি ভাষা। এ ভাষায় পুলিশ, গাড়ি, প্রভৃতি শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ। হিন্দিটা মোটামুটি জানেন মি. রক্ষিত, তবে ভালো বলতে পারেন না। হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত কর্মপদ্ধতি ছকে নেন মনে মনে। তার পাশে চলতে থাকা মি. আগরওয়ালকে জিজ্ঞাসা করেন, ডেডবডি কোন ঘরে?
–আইয়ে সাব আইয়ে, ফার্স্ট ফ্লোরমে।
শীঘ্রই তারা ঘটনাস্থলের মূল কেন্দ্র অর্থাৎ প্লেস অফ অকারেন্স-এ পৌঁছান। সেখানে মিসেস আগরওয়াল ও তার দুই মেয়ে প্রিয়া এবং জিনাত অত্যন্ত ভীত, শঙ্কিত এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়ে, প্রিয়ার চোখে জল।
–কৃপয়া আপলোগ থোড়া বাহার আইয়ে, মি. রক্ষিতের বিনম্র অনুরোধ যা প্রকৃতপক্ষে আদেশের সুরেই বুঝি উচ্চারিত হল। সকলে বাইরে এসে দাঁড়ালে মি. রক্ষিত সে ঘরে ঢোকেন,তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি ঘরের এলোমেলো বিছানায় শায়িতা মহিলার ওপর পড়ে।
সিঙ্গল মানুষের শোয়ার উপযোগী একটি ডিভানে নীল রাত্রিবাস পরা দুধসাদা এক নারীদেহ আগোছালো ভঙ্গিতে শুয়ে। মুখটা বাম দিকে খানিকটা ফেরানো, হাত দুটি অলসভাবে পাশে পড়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, মহিলাটি ঘুমোচ্ছেন। নীল নাইটিখানি মাঝামাঝি চেরা, পেটের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা।
তার নারীদেহের নিম্নাংশের একটি পাশ অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি পা নাভি পর্যন্ত উন্মুক্ত। বক্ষঃস্থল বেশ কিছুটা অনাবৃত। নিম্নাংশে একটি ছোটো প্যান্ট। মাথায় ঈষৎ দীর্ঘ ববচুল পোনি টেল স্টাইলে শক্ত করে টেনে বাঁধা। মুখের বাম গালের মাঝামাঝি ঠিক নারকেলি কুলের সাইজে একটি গাঢ় নীল ছোপ। ঠোটের কোণায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মৃদু আভাস। তবে পুলিশের দৃষ্টি সেটিকে ভিন্ন অ্যাঙ্গেলেই দেখতে চায়। অন্য কিছুর অনুসন্ধান? কিন্তু সেটা কী? পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও এর থেকে বেশি কিছু নজরে পড়ে না মি. রক্ষিতের। তিনি প্রয়োজনীয় নোট নেন দ্রুত। প্রস্তুত করেন মৃতদেহের একটি সুরথহাল রিপোর্ট। মি. আগরওয়াল ও তার স্ত্রীকে সই করান সাক্ষীর কলামে।।
এ সমস্ত কাজের ফাঁকে ফাঁকেই কতকগুলি প্রশ্ন অফিসারের মনে ধারাল সূচের মতন বিঁধতে থাকে। কিছু কি বাদ পড়ে গেল? মরুশ্বেতা মারা গেল কিন্তু কীভাবে? সবই কি দেখা হল ঠিকঠাক? এরপর শুরু হবে ইন্টারোগেশনের পালা। কিন্তু সে সবের আগে তো ডেডবডিটা ময়না তদন্তের জন্য পাঠাতে হবে। কিন্তু, একটা ‘কিন্তু’ মনের কোণায় নাড়া খায় দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের মতন। মেয়েটার গালের ওই গাঢ় নীল দাগটা কীসের? ঘটনাস্থলে অপরাধী কি কোনও ক্লুই ফেলে রেখে যায়নি? এরকম ঘটনা তো অপরাধ ইতিহাসে বিরল বললেই চলে। যদি ফেলে রেখে যায় তবে সেটা কী?
ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফুটপ্রিন্ট পাওয়ার কোনও রকম চান্সই নেই কারণ এ সমস্ত ক্ষেত্রে অন্যান্য কেসে যেমন হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি অর্থাৎ মারা যাবার খবর শুনে বাড়ির সবলোক দৗড়ে সে ঘরে ঢোকে এবং এটা ওটা ঘেঁটে, মৃতদেহ নেড়েচেড়ে দেখে টোটাল পিও-টাই ডিসরাপ্টটেড করে দেয়। ফলে পরবর্তীকালে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার যখন আসেন তখন পিও-তে আসামির কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফুটপ্রিন্ট আর অক্ষত থাকে না, প্রাথমিক তদন্তের বারোটা বেজে যায়, নষ্ট হয়ে যায় ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু’গুলি।
অত্যন্ত সতর্কতায় সম্পূর্ণ ঘরটিকে জরিপ করেন অফিসার। ঘরে আসবাব বলতে ডিভানের মাথার দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটি ছোটো টেবিল, তাতে জলের গেলাস ও একটি জারে জল রাখা, সম্ভবত তা স্পর্শ করেনি মেয়েটি। গেলাসটি ফাঁকা অবস্থায় উপুড় করে রাখা, জারটি জলে পরিপূর্ণ। ডিভানের অপর পার্শ্বে ঘরের বাকি আসবাব হিসাবে প্রায় পাঁচ ফুট দূরত্বে একটি তিনপাল্লার ড্রেসিং টেবিল ও একটি ছোটো বসার টুল। ড্রেসিং টেবিলের কাছে এগিয়ে যান অফিসার। ড্রেসিং টেবিলের ওপর বেশ কয়েক ফোঁটা… ওগুলো কী… রক্ত? …নীচু হন অফিসার, দৃষ্টি তীক্ষ্নতর হয়, ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সামান্য স্পর্শ করেই বুঝতে পারেন, টকটকে লাল ফোঁটাগুলি রক্ত নয়, নেলপালিশ জাতীয় কিছু এবং সেগুলি সম্ভবত গতকালই পড়েছে সেখানে। তাহলে তো ড্রয়ারে ওই রঙের নেলপালিশের শিশি থাকা খুবই স্বাভাবিক। ড্রয়ার ধরে টান মারেন মি. রক্ষিত। এক ঝটকায় খুলে যায় সেটা। ভেতরে একগুচ্ছ টিপের পাতা, চুলের ক্লিপ, সেন্ট, পাউডার কৌটো, নেলপালিশ? হ্যাঁ এই তো লাল নেলপালিশ, অর্ধেক ভর্তি। তাহলে তো মেয়েটির নখেও থাকতে পারে এই রং-এর নেলপালিশ। ওখানে দাঁড়িয়েই ঘাড় ঘোরান অফিসার, হ্যাঁ ঠিক, ঠিক মিলে যাচ্ছে। মেয়েটির নখেও লাল রং-এর নেলপালিশ।
নাঃ, বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান তিনি। পকেট হাতড়ে সিগারেট প্যাকেটটা বের করেন, একটা সিগারেট বার করে মুখে দেন অফিসার, দু-একবারের চেষ্টাতেই জ্বলে ওঠে ম্যাচ দপ করে। বুক ভরে একটা টান মেরে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকান, আঃ… মাথার ওপরে পাখাটা বন্ধ কেন? সুইচের দিকে হাত বাড়ান তিনি। হঠাৎ তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়… নেলপালিশ নেল, রাইট, মেয়েটির নখগুলি তো দেখা হয়নি। দ্রুত ইনভেস্টিগেশন বক্স থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যান তিনি। খুব সাবধানে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে নিখুঁত ভাবে মেয়েটির ম্যানিকিওর করা আঙুলের নখগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একে একে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন তিনি। ইয়েস, এই তো, নখের ভিতর দিকে কিছু আছে মনে হচ্ছে? অতি সন্তর্পণে ফরসেপ্সের সাহায্যে তিনি বেশ কিছু কোঁকড়ানো চা-পাতার মতো বস্তু বের করে আনেন মেয়েটির দু’হাতের আঙুলগুলি থেকে। একটা জটিল অঙ্কের সম্ভাব্য উত্তর মনে হচ্ছে পাওয়া যাচ্ছে, উত্তেজনায় দ্রুত হয় তার হৃদপিণ্ড। মনে মনে বলতে থাকেন, যদি তাই হয় তাহলে গালে নীল স্পট্টির ব্যাখ্যাও মিলে যাবে। কিন্তু সেটি মৃতার বাম গালে থাকবে কেন….স্পটটি তো ডান গালে থাকবার কথা। মেয়েটির নখ থেকে সংগৃহিত বস্তুগুলি তিনি পরিষ্কার সেলোফেন পেপারে ভরে নেন, ভরা হলে সেটির মুখ বন্ধ করে প্রপার মার্কিং করেন। প্রশ্নটা তখনকার মতন অমীমাংসিতই থেকে যায়। বাড়ির লোকজনদের ডেকে প্রয়োজনীয় সইসাবুদ করে বিছানার চাদর ইত্যাদি সিজ করেন নিয়মমাফিক। মৃতদেহটি ময়না তদন্তের জন্য পাঠাতে নির্দেশ দেন তার সাথে আসা কনস্টেবল দু’জনকে, সাথে প্রয়োজনীয় কাগজ। এরপর তিনি মি. আগরওয়ালের ওই ঘরটিতে তালা লাগিয়ে দেন। মি. আগরওয়ালকে বলেন, হ্যাঁ আগরওয়াল সাহেব, আপনার বাড়িতে কোথায় একটু বসা যেতে পারে বলুন তো? আপনাদের ফ্যামিলির কয়েকজনকে আমার সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে। ঘাবড়াবার কিছু নেই, নিয়মরক্ষা আর কি।
–হাঁ হাঁ সাব, এদিকে আসুন, শশব্যস্ত হয়ে পড়েন আগরওয়াল। অফিসারের জন্য ঠান্ডা পানীয়ের অর্ডার দেন চাকরকে। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে থাকেন অফিসার, জিজ্ঞাসাবাদের ছক কষতে কষতে।
পর্ব – ৩
ঠান্ডা পানীয় খেয়ে কিছুটা ফ্রেশ লাগে মি. রক্ষিতের। তিনি কাগজ-কলম নিয়ে তৈরি হন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। মি. আগরওয়ালকে জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা, ডেডবডিটা প্রথম কার চোখে পড়ে?
–আমার ছোটো মেয়ে প্রিয়ার, মরুশ্বেতার সঙ্গে ওরই বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল।
–ঠিক আছে, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, আর আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন।
মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জেনে আগরওয়াল সাহেব সামান্য ক্ষুব্ধ হন, কিন্তু উপায় নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি এবং তাঁর মেয়ে প্রিয়াকে বলেন অফিসারের কাছে যেতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত ভাবে ধীরে ধীরে সে ঘরে প্রবেশ করে প্রিয়া।
অফিসার বলেন, আপনি বসুন, বি কমফর্টেবল। মি. রক্ষিতের মার্জিত ব্যবহারে কিছুটা আশ্বস্ত হয় প্রিয়া। তারপর তিনি বলেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আপনি তো আপনার বাড়িতেই আছেন। যা যা জিজ্ঞাসা করব মাথা ঠান্ডা রেখে ঠিক ঠিক জবাব দেবেন তার, বুঝেছেন? আপনার বন্ধুর হত্যাকারী ধরা পড়ুক এটা নিশ্চই আপনি চান, আই নিড ইয়োর ফ্রেন্ডলি কো-অপারেশন, প্লিজ।
–মাথা নাড়ে প্রিয়া, মুখে কিছু বলে না। তবে তাকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখায়।
–দেখুন প্রিয়াদেবী, আপনার বাবা বললেন, মরুশ্বেতার সঙ্গে আপনারই ইন্টিমেসি সব থেকে বেশি ছিল, ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আপনি নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানেন? আই মিন, একজন বন্ধু হিসাবে আপনার পক্ষে এমন অনেক কিছু জানা সম্ভব যা অন্যান্যরা জানেন না, দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন অফিসার।
–কী বলব বলুন, উত্তর দেয় প্রিয়া, ভাষায় হিন্দি টান লক্ষণীয়। আচ্ছা ওর লাভার ছেলেটি কেমন, একটু ডিটেলস্-এ বলুন।
–ভালো ছেলে, বছর আঠাশ বয়স। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছিল নাকি, পাশ করতে পারেনি, তারপর আর পড়েনি শুনেছি। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলেটির বাবার প্রচুর পয়সা, নানান রকমের বিজনেস। ও বাবার বিজনেস দেখাশোনা করে। মরুশ্বেতার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় ওর, কাঠমান্ডুতে একই পাড়ায় থাকে ওরা।
–শুনলাম ছেলেটির সঙ্গে বিয়েতে মরুশ্বেতার মা-বাবা রাজি ছিল না, প্রশ্ন করেন অফিসার।
–মা নয়, ছেলেটির বাবা রাজি ছিল না। কাস্ট-ফাস্ট নিয়ে ওদের মধ্যে কি সব প্রবলেম ছিল। ছেলেটির সঙ্গে এই নিয়ে ওর বাবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে বহুবার। কিন্তু ও মরুশ্বেতাকে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছিল বাবার মতামত উপেক্ষা করেই।।
–এবার যখন মরুশ্বেতা এসেছিল আপনাদের বাড়ি তখন কি ও আপনাকে বলেছিল যে কবে ওরা বিয়ে করছে, ইত্যাদি?
–সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে, যতদূর মনে পড়ছে ফিফ্থ মার্চ ওরা বিয়ে করবে বলে ডেট ফাইনাল করেছিল এবং এবার কলকাতা আসার পিছনে আসল কারণই ছিল বিয়ে উপলক্ষ্যে কিছু প্রয়োজনীয় পারচেজিং করা।
–কবে এসেছিল?
–এসেছিল দিন তিনেক আগে, টেন্থ ফেব্রুয়ারি বিকালে। কী কী জিনিস কিনতে হবে সে ব্যাপারে প্রায় সারাদিন আলোচনা চলছিল এ কদিন।
–আচ্ছা আপনি এবার বলুন তো, এ বাড়িতে টোটাল মেম্বার ক’জন এবং তারা কে কে? অফিসার একটু অন্যদিকে নিয়ে যেতে চান আলোচনা।
একটু থেমে প্রিয়া বলে, মোট এগারোজন। বাবা-মা, দুই দাদা ও তাদের দুই ওয়াইফ, আমরা দু’বোন, এক ড্রাইভার, মেড সার্ভেন্ট ও একজন মেল সার্ভেন্ট। এর মধ্যে দুই দাদার তিন ইস্যুকে কিন্তু ধরা হয়নি, যথেষ্ট সপ্রতিভ এখন প্রিয়া।
–গুড্, আজ আপনি আপনার বান্ধবীকে কখন মৃত হিসাবে আবিষ্কার করেন? আবার মূল প্রসঙ্গে চলে যান অফিসার।
–কাল রাতে ডিনার টেবিলে আমরা সবাই একসাথে ডিনার করেছিলাম। গল্প করতে করতে বেশ একটু রাত হয়ে গেছিল। ওকে ওই ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে শুভ রাত্রি জানিয়ে যখন শুতে গেলাম রাত তখন প্রায় বারাটো।
–তা আপনারা সকলে ওপরে শুলেন, ওকে নীচে ফার্স্ট ফ্লোরে শুতে দিলেন কেন?
–ফার্স্ট ফ্লোরে বরাবরই দুটো ডাবল বেডেড এবং একটা সিঙ্গল বেডেড রুম রাখা আছে। গেস্টরুম হিসাবে মরুশ্বেতা আগে যতবারই এসেছে ওই ঘরেই থেকেছে। দক্ষিণের ঘরটা ছোটো হলেও একটা ব্যালকনি আছে, যেখানে দাঁড়ালেই পাঁচিলের ওপারের বিশাল মাঠটা চোখে পড়ে, সম্ভবত এ কারণেই ওই ঘরটা পছন্দ করত মরুশ্বেতা।
–ঠিক আছে, তারপর বলে যান আপনি।
–আজ সকালে আটটা বেজে যাবার পরও যখন দেখলাম ও ব্রেকফাস্ট করতে এল না তখন আমি নিজেই গেলাম ওর ঘরে। দু’ চারবার নক করে কোনও সাড়া পেলাম না, দুম দুম করে বেশ কয়েকটা ঘুষি মারতেই টুক্ করে আওয়াজ হল ছিটকিনি খুলে যাবার, দরজার পাল্লা সরে গেল, আমি যেই….
–দাঁড়ান, দাঁড়ান, প্রিয়ার কথায় হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে ওঠেন অফিসার, আপনি ঠিক বলছেন তো? মানে আপনি এসে দেখলেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, দু’ তিনবার ধাক্বা দেবার পর ছিটকিনি পড়ার আওয়াজ পান আপনি? আমি ঠিক বলছি তো? অফিসারের কাটা কাটা প্রশ্নের ধাক্বায় একটু ঘাবড়ে যায় প্রিয়া।
–না মানে, সেরকমই তো মনে হল, আমতা আমতা করতে থাকে প্রিয়া।
–মনে হলে চলবে না প্রিয়াদেবী, একদম সঠিক তথ্যটি দিতে হবে আপনাকে, আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না আপনার প্রতিটি কথা, প্রতিটি তথ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ যার ওপর ভিত্তি করে আমার ইনভেস্টিগেশন সঠিক অথবা বেঠিক পথে এগিয়ে যাবে, কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয় অফিসারের।
প্রিয়া চুপ করে থাকে।
ঘাবড়ে যাবেন না প্রিয়াদেবী, মাথা ঠান্ডা রেখে একটু ভেবে ভেবে বলুন, দেখবেন আপনি সব ঠিক ঠিকই বলতে পারছেন, আশ্বস্ত করেন অফিসার। আচ্ছা বলুন, তারপর কী দেখলেন আপনি? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক শোনায় মি. রক্ষিতের।
–আমি দেখলাম, ফের বলতে থাকে প্রিয়া, ডিভানের ওপর মরুশ্বেতা শুয়ে আছে একটু এলোমেলো ভাবে। প্রথমে ভাবলাম ঘুমোচ্ছে, গিয়ে ধাক্বা দিয়ে ডাকলাম এই মরুশ্বেতা, ওঠ, ওঠ, আর কত ঘুমাবি? হঠাৎ খেয়াল হল আমার এত ধাক্বাধাকিতেও ওর ঘুম ভাঙছে না, মনে হল শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না ওর। আমি দারুণ ভয় পেয়ে গেলাম, সাংঘাতিক কোনও আশঙ্কায় মাথাটা ঘুরে উঠল। আমি প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে মাম্মি-পাপাকে ডাকলাম কিন্তু ওরা সম্ভবত আমার ডাক শুনতে পাননি। তখন আমি ছুটে গিয়ে ওদের সব কথা বলি এবং ডেকে নিয়ে আসি এ ঘরে। ওরা ছুটে আসেন, পাপা ওর হাতের পালস্ ধরে বলেন ও মারা গেছে, বলতে বলতে কেঁদে ফেলে প্রিয়া, ওড়নায় চোখ মোছে, ফোঁপাতে থাকে।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি যান, আর আপনার পাপাকে একবার পাঠিয়ে দিন এ ঘরে। প্রিয়া উঠে চলে যায়।
–প্রিয়াদেবী, হঠাৎ ওকে ডাকেন আবার অফিসার। প্রিয়া পিছন ফেরে। গতি স্তব্ধ, চোখে কৌতূহল।
–আপনাকে আর একটু ডিস্টার্ব করব আমি, আপনি অনুগ্রহ করে যদি মরুশ্বেতার বাড়ি এবং যে ছেলেটির সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার ছিল, তার কনট্যাক্ট নাম্বার আমায় দেন…
–ঠিক আছে, আমি লিখে নিয়ে আসছি, বলে প্রিয়া।
–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
প্রিয়া চলে গেলে একটু পর সে ঘরে ঢোকেন মি. আগরওয়াল। দেখেন মি. রক্ষিত মাথা নীচু করে ডাইরিতে কী সব নোট করছে, পায়ের শব্দ শুনে লিখতে লিখতেই তিনি বলেন, আসুন মি. আগরওয়াল, বসুন। তারপর লেখা শেষ করে মুখ তোলেন তিনি। প্রিয়াকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন তার অনেকগুলিই রিপিট করেন অফিসার ক্রস ভেরিফিকেশনের জন্য। কিছু তথ্য কনফার্ম করা প্রয়োজন ছিল তার। প্রয়োজনীয় নোট নেন। তারপর বলেন, ঠিক আছে মি. আগরওয়াল, চলুন, ওই ঘরটাতে আর একবার যাওয়া যাক।
দোতলার ঘরটিতে ওরা দু’জন ঢোকেন। মি. রক্ষিত প্রথমেই ঘরের দরজার ছিটকিনিটি পরীক্ষা করেন নেড়েচেড়ে। বিড় বিড় করে বলেন, প্রিয়া তাহলে ভুল বলেনি, ঠিকই শুনেছিল। দেখছি ছিটকিনিটা ডান বা বাঁদিকে ঘোরানো একটু টাফ্, ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট মনে হচ্ছে। মি. আগরওয়াল সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে ভ্যাবাক্যাবলার মতন চেয়ে দেখতে থাকেন অফিসারের কাণ্ডকারখানা।
মি. রক্ষিত মনে মনে বলতে থাকেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল, তার অর্থ আততায়ী পালিয়ে গেছে অন্য কোনও পথে। তাই যদি হয়, প্রিয়ার বাকি কথা অনুযায়ী অন্য পথ তো একটাই অর্থাৎ ব্যালকনি, সেটা কোথায়? তিনি মি. আগরওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেন প্রিয়া বলছিল, এ ঘরে একটা ব্যালকনি আছে, সেটা কোথায়?
–কেন স্যার, ওই তো দেয়ালের গায়ে। হাত দিয়ে ঘরের অপর প্রান্তের দেয়ালে নির্দেশ করেন তিনি। তারপর এগিয়ে যান সেদিকে।
একটু মনোযোগী হয়ে না দেখলে বোঝা যায় না এত সুন্দর ভাবে দরজাটাকে দেয়ালের কোণার সঙ্গে মিশিয়েছে… আশ্চর্য! এরকম ফাইন্লি ফিনিশড্ ঘরে ছিটকিনির ডিফেক্ট? মনে মনে বলেন অফিসার। যাইহোক, দরজা আড়াআড়ি খোলে, সামান্য ঠেলা দিতেই খুলে গেল সেটা। এর কোনও লক্ নেই? জানতে চান অফিসার।
–হ্যাঁ, এই তো, পাশের দেয়ালের লাইটের সুইচগুলির মধ্যে একটি নির্দেশ করেন মি. আগরওয়াল, এটা টিপলেই দরজাটা বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি। কিন্তু এটা তো খোলা ছিল দেখছি, বিস্মিত হন তিনি।
রাইট মি. আগরওয়াল, আমার হিসাব মতন এটা খোলা থাকারই কথা, বলতে বলতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান মি. রক্ষিত। সম্ভবত আততায়ীরও ব্যাপারটা জানা ছিল। আরে এখানে যে একটা মদের বোতল পড়ে আছে দেখছি, বাঃ দারুণ। অতি সন্তর্পণে অফিসার বোতলটি সেলোফেন কাগজে মুড়ে নেন। প্রশ্ন করেন, ফার্স্ট ফ্লোরের ব্যালকনি গ্রিল দিয়ে টোটালি কভার করেননি কেন মি. আগরওয়াল?
–স্যার, আমি মানে, তোতলাতে থাকেন মি. আগরওয়াল, ভাবতেই পারিনি…
–সামান্য তিন ফুট উচ্চতার এই গ্রিলের রেলিং টপকে যে কেউ উপরে উঠে আসতে পারে সামান্য চেষ্টাতেই, বলেন অফিসার। মাটি থেকে এর উচ্চতা ফুট দশেক হবে। তিনি লক্ষ্য করেন ব্যালকনির সামনে বেশ কিছুটা স্পেস, তার ঠিক ওপারেই বিস্তৃত মাঠ।
–তবে? অফিসারের গলার স্বর অন্য রকম শোনায়, আপনি যে বলছিলেন মেয়েটা এমনি এমনিই মরে গেল? মোটেও তা নয় মি. আগরওয়াল। এটি একটি হত্যা।
–হত্যা ! চমকে ওঠেন আগরওয়াল।
–ইয়া, ইটস এ কেস অব ক্লিন মার্ডার, কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয় অফিসারের। আততায়ী আপনার বাড়ির সমস্ত কিছু জানে এবং চেনে। সে জানত মরুশ্বেতা এই ঘরেই শোবে, সে জানত ঘরের এই স্লাইডিং ডোরের কথা। খুব সম্ভবতঃ সে আগে থাকতেই এই ব্যালকনিতে এসে অপেক্ষা করছিল। মরুশ্বেতা ঘরে এসে দরজায় ছিটকিনি দিলে আততায়ী অপেক্ষা করে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সে। আততায়ীর কপাল ফেভার করে যায় মরুশ্বেতা শোবার আগে স্লাইডিং ডোরটা চেক করেনি, তাহলে হয়তো ওকে এভাবে বেঘোরে মরতে হতো না। যাই হোক, সে যখন ঘুমিয়ে পড়ে এই স্লাইডিং ডোর ঠেলেই ঘরে ঢোকে আততায়ী, ঘুমের মধ্যে তাকে আক্রমণ করে সে। মরুশ্বেতা বাধা দেবার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয় না। খুব সম্ভবত আততায়ী তাকে মুখ চেপে ধরে দম বন্ধ করে মেরে ফেলে এবং তারপর নিঃশব্দে এ পথেই চুপচাপ সরে পড়ে সে।
–কিন্তু স্যার, ওর মতন একটা নিস্পাপ মেয়েকে কে খুন করবে, কেনই বা খুন করবে? হতবুদ্ধি হয়ে প্রশ্ন করেন আগরওয়াল।
–ইয়েস, ঘটনাটা যে খুন এটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে, পিএম রিপোর্ট এলে ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া যাবে। কিন্তু এর পরের দ্বিতীয় এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই হল কেন এই খুন অর্থাৎ খুনের মোটিভটা কী? বলতে থাকেন অফিসার, আর মনে রাখবেন মি. আগরওয়াল সেটা জানার পরপরই বেরিয়ে আসবে সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তরটি অর্থাৎ হু ইজ দ্য মার্ডারার। চলুন মি. আগরওয়াল, এখন এ ঘর ছেড়ে যাওয়া যাক। তবে হ্যাঁ মনে রাখবেন, এ ঘরে কেউ যেন কোনও কারণেই প্রবেশ না করে। বেরোবার সময় ঘরটির স্লাইডিং ডোর লক করতে ভোলেন না, মুখে বলেন যদিও বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি ঘরটায়। তালা বন্ধ করতে করতে মি. রক্ষিত বলেন, আপনার বাড়ির সকল মেল মেম্বারদের এক জায়গায় হতে বলুন, একবার থানায় যেতে হবে ওদের। দেখবেন কেউ যেন বাদ না পড়ে। এখানকার ইনভেস্টিগেশন আপাতত শেষ।।
মি. রক্ষিত বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে যান জিপের দিকে, একজন যুবতি যখন খুন হয় তার নানান কারণ থাকতে পারে, তবে সব থেকে সহজ, সরল এবং প্রাথমিক যে কারণ থাকে মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য। আমার অনুমান যদি ভুল না হয় এক্ষেত্রে খুনি আগে ধরা পড়বে, তার পর ডিসক্লোজ হবে খুনের মোটিভ। জিপে ওঠার আগে একটা সিগারেট ধরান তিনি, ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন, চলুন ড্রাইভারসাহেব, থানায় ফেরা যাক।
গাড়ি চলতে থাকে ফিরতি পথে। তার একটু পরপরই মারুতি ওয়ান থাউজেন্ডে চেপে একরাশ অজানা আশঙ্কা উৎকণ্ঠা-সহ মি. আগরওয়াল ফ্যামিলির মেল মেম্বাররা, কি জানি কপালে কী আছে?
চলবে…