পর্ব – ৪

আগরওয়াল ফ্যামিলির সকলে থানায় পৌঁছোলে মি. রক্ষিত ওদের নির্দেশ দেন ইন্টারোগেশন চেম্বারের বাইরে বসতে! কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজে ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি, দ্রুত প্রয়োজনীয় নোট নেন। তারপর আগরওয়ালকে ডাকেন, একটা লিখিত কমপ্লেন দিতে বলেন তাকে। প্রয়োজনীয় কাগজ-কলম তিনিই জোগান দেন। তারপর ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে জিডি বইটা টেনে প্রয়োজনীয় লেখা সেরে নেন। একটা এফআইআর লজ করতে নির্দেশ দেন। আগরওয়ালের লিখিত কমপ্লেনের ওপর ভিত্তি করে। তারপর বাড়ির ছেলেদের সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য লিখে নেন তিনি মি. আগরওয়ালের কাছ থেকে। লেখা শেষ হলে নির্দেশ দেন ইন্টারোগেশন চেম্বারের বাইরে গিয়ে বসতে। খানিক পর সেই চেম্বারে তিনি যান, যাবার আগে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে যান, আমি রুমে গিয়ে বসছি, বেল বাজালে আপনারা এক এক করে ঘরে ঢুকবেন।

উপস্থিত সকলকে যথেষ্ট ভীত বলে মনে হয়।

রুমে বসে বেল বাজান মি. রক্ষিত, ঘরে প্রবেশ করেন মি. আগরওয়াল। যেহেতু তিনি ফ্যামিলির সিনিয়র মোস্ট মেম্বার সম্ভবত সকলে তাই তাকেই বাঘের মুখে এগিয়ে দিয়েছে প্রথমে।

তিনি ঘরে ঢুকতে মি. রক্ষিত বললেন, আপনাকে এ মুহূর্তে আর নতুন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব না আমি মি.আগরওয়াল, কেবল অনুরোধ করব আপনার জামাটা একবার খুলতে।

এই অদ্ভুত নির্দেশে সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে যান মি.আগরওয়াল, বেশ বিরক্তও হন। মুখে বলেন, এ কী বলছেন অফিসার, জামা খুলে আমায় নেকেড হতে হবে?

আমার মনে হয় বাংলাটা আপনি ভালোই বোঝেন মি. আগরওয়াল। আমার কথার ভুল অর্থ করবেন না প্লিজ। আপনাকে নেকেড হতে বলিনি আমি, বলেছি জাস্ট টু টেক অফ ইয়োর শার্ট, কী ধাতব শীতল শোনায় অফিসারের কণ্ঠস্বর।

আপনি কি আমায় সন্দেহ করছেন অফিসার, যথেষ্ট বিরক্তি ঝরে পড়ে আগরওয়ালের কথায়।।

–দেখুন টু বি ভেরি ফ্র্যাংক, সন্দেহের ঊধের্ব আপনারা কেউই নন, বরং তদন্তের স্বার্থে আপনার কো-অপারেশন আপনার নির্দোষিতাই প্রমাণ করবে মি. আগরওয়াল।

একটু ইতস্তত করেন ভদ্রলোক, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জামা খুলতে হয় তাকে। বুঝতে পারেন না তার জামা খোলায় এই কেসের কী উপকার হবে। তার জামা খোলা হলে সামনের টেবিল ল্যাম্পের জ্বলন্ত মুখটি ঘুরিয়ে আগরওয়ালের শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আলো ফেলেন অফিসার। ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হয় তার, ধীরে ধীরে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁজতে থাকেন কিছু। বোধহয় হতাশ হন। তারপর বলেন , ওকে মি. আগরওয়াল, থ্যাংকস ফর ইয়োর কো-অপারেশন। আপনি বাঁদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাশের ঘরে রাখা বেঞ্চিতে গিয়ে বসুন।

মুখে কিছু না বললেও অত্যন্ত রাগ ও বিরক্তি নিয়ে আগরওয়াল বাঁদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। ফের বেল বাজান অফিসার। ঘরে ঢোকেন আগরওয়ালের বড়ো ছেলে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকেও জামা খোলার নির্দেশ দেন তিনি এবং জামা খোলা হলে একইভাবে আলো ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ নিরীক্ষণ করেন। তারপর তাকেও পাশের ঘরের বেঞ্চে গিয়ে বসতে নির্দেশ দেন।

ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আগরওয়ালের দ্বিতীয় ছেলে এবং ড্রাইভারের ক্ষেত্রেও। এবার একটু হতাশ হয়ে পড়েন অফিসার, যা খুঁজছিলেন মনে হয় তা পাওয়া গেল না। তিনি মি. আগরওয়ালকে ডেকে পাঠান আবার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢেকেন তিনি, থমথমে মুখ, বিদঘুটে অফিসারের পরবর্তী নির্দেশ আবার কী হবে কে জানে!

আচ্ছা মি. আগরওয়াল, আপনার মেয়ে প্রিয়া বলেছিল আপনার বাড়ির অ্যাডাল্ট মেম্বার এগারোজন। এখানে আপনাদের চারজনকে পাওয়া গেল, আপনার স্ত্রী, দুই মেয়ে, দুই ছেলে বউ, মেড সার্ভেন্ট মিলে হল দশ জন। মনে পড়ছে একজন মেল সার্ভেন্টও আপনাদের বাড়িতে থাকে, সে কই?

–মেল সার্ভেন্ট স্যার? ওর নাম ছোটু দরজি, উত্তর দেন আগরওয়াল।

–হ্যাঁ, সে কই? তাকে আনেননি? গলায় স্পষ্ট বিরক্তির আভাস অফিসারের, আপনাকে বললাম না সববাইকে নিয়ে আসতে।

–স্যার, ছোটুকেও এনেছি, আপনার কাছে পাঠাইনি, মানে সার্ভেন্ট তো, গলায় অস্বস্তি ভদ্রলোকের।

–ওঃ হো, কী ধরনের লোক মশাই আপনি? সার্ভেন্ট তো কী হয়েছে? আপনার ইতস্তত করবার কিছু নেই, তদন্তের ক্ষেত্রে সকলেই সমান ইম্পর্ট্যান্ট, ডাকুন ওকে।

–স্যার, ও গাড়িতে বসে আছে, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি স্যার, এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি, দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি।

একটু পরে সেই ঘরে ঢোকে ছোটু দরজি। নেপালি চাকরটির দেহের গড়ন বেঁটে, যথেষ্ট বলিষ্ঠ শরীর। নেপালিদের ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করা একটু কঠিন। অফিসার দেখলেন, লোকটির মাথায় ধূসর টুপি, গলায় ছাই রঙা মাফলার, গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার, ময়লা ট্রাউজারস, পায়ে পুরোনো একজোড়া কেড্‌স। দু’চার কথা বলার পর অফিসার যথারীতি তাকে নির্দেশ দেন, সোয়েটার, জামা ইত্যাদি খোলার। খুবই স্বাভাবিক শোনায় তার কণ্ঠস্বর। ।

উত্তরে ছোটু বলে, সাব, মেরা বুখার হ্যায়, ইতনি জাড়ামে….

– কপড়া উতার, চিৎকার করে ওঠেন অফিসার, ওর কথা সম্পূর্ণ হয় না, নেহি তো অভি চার ডান্ডা লাগায়েঙ্গে তেরেকো।

দারুণ ভয় পেয়ে যায় ছোটু অফিসারের দাবড়ানিতে। ধীরে ধীরে টুপি, মাফলার খুলতে থাকে সে।

উত্তেজনায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে অফিসারের, টেবিলে রাখা জলের গেলাসটা তুলে দ্রুত কয়েক ঢোক জল খান, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন সামনে, গেলাসটা হাতেই ধরা থাকে তাঁর। গলার কাছে কীসের দাগ না, বিড়বিড় করেন তিনি।

চেঁচিয়ে ওঠেন, জলদি উতার কপড়া। গেলাস নামিয়ে রেখে টেবিলে রাখা লাঠিটায় হাত রাখেন তিনি। হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়, টেনশনে হাতের লাঠিটার ওপর ক্রমশ শক্ত হয়ে বসে মুষ্ঠি, চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন তিনি। টেবিল ল্যাম্পের আলো ছোটুর বুকে গায়ে হই হই করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষের গেঞ্জিখানা খুলে ফেলতেই…

–ইয়েস দ্যাট্‌স ইট, হাতের লাঠিটা সজোরে মারেন তিনি টেবিলে। চেঁচিয়ে ডাকেন, মি. আগরওয়াল, প্লিজ কাম ইন্, সি, হিয়ার ইজ ইয়োর কালপ্রিট।

একটু আগে জেরা এবং অফিসারের অদ্ভুত নির্দেশ পালন করতে হওয়ায় আগরওয়াল ফ্যামিলির লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন পুলিশের কাজকর্ম সম্বন্ধে। এমন সময়ে অফিসারের এই আদেশে তারা প্রায় হুড়মুড়িয়ে একসঙ্গে ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকে পড়েন। দেখেন, তাদের মেল সার্ভেন্ট ছোটু দরজি, নেপালি চাকরের বুকে টেবিল ল্যাম্পের আলো, বুকে-গলায় আঁচড়ের শুকিয়ে আসা দাগ। সামনে পুলিশ অফিসার, শরীরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত তার, বলিষ্ঠ ফর্সা দেহে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে এলোমেলো আঁচড়ের সামান্য শুকিয়ে আসা অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। আগরওয়াল পরিবারের লোকজন দারুণ অবাক, বুঝতে পারেন না অফিসার কী বলতে চাইছেন। ছোটু কেন কালপ্রিট হতে যাবে? দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত চাকর। মরুশ্বেতাকে মেরে তার লাভ কী? বিস্ময়ে কোনও কথা বের হয় না তাদের মুখ থেকে।

–কি রে হতভাগা, কেন মারলি মেয়েটাকে? জিজ্ঞাসা করেন অফিসার।

–আমি মারিনি সাব, আমি কিছু জানি না।

–জানিস না? তাহলে তোর বুকে, গলায় এসব দাগ কোত্থেকে এল হতভাগা? বল্, বল্, শালা, ধমক দেন অফিসার ক্রমাগত।

–আমাকে, আমাকে, ইয়ে মানে… তোতলাতে থাকে ছোটু।

–কী তোকে। কী তোকে, বল্ শালা। চিৎকার করেন অফিসার, হাতের লাঠিটা সজোরে আঘাত করেন ছোটুর সামনে রাখা চেয়ারের হাতলে।

–আমাকে বিল্লিতে আঁচড়ে দিয়েছে সাব। কেঁদে ওঠে ছোটু।

–বিশ্বাস করুন সাব, কিছু জানি না আমি।

–ঠিক আছে, কথা কীভাবে বার করতে হয় সেটা ভালো জানা আছে আমাদের। আচ্ছা-আচ্ছা ক্রিমিনাল পুলিসের কাছে মুখ খুলে দেয়। আর তুই তো…

প্রসঙ্গ পালটে মি. রক্ষিত বলেন, হ্যাঁ মি. আগরওয়াল, আপনার কেস মোটামুটি ডিটেকটেড। এই ছোটু মার্ডার করেছে মেয়েটাকে। এ ব্যাপারে সেন্ট পারসেন্ট কনফার্মড আমি। তবে ও হঠাৎ কেন মেয়েটাকে মারতে গেল সেটা শিগগিরি বার করে ফেলব আমরা।

–কিন্তু স্যার, ছোটুই যে মেরেছে মেয়েটাকে সেটা কীভাবে নিশ্চিত হলেন আপনি?

–সেটাই জানা বাকি আমাদের। তবে ঘটনা যেটা ঘটেছিল তা হল খানিকটা এরকম– মরুশ্বেতাকে যখন ও আক্রমণ করে তখন প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল সে। যে-কোনও মানুষ এ ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরোধ করে থাকে। মূলত তার হাত দিয়ে, মরুশ্বেতাও তাই করেছিল। ওর প্লাস পয়েন্ট ছিল আঙুলের দীর্ঘ নখগুলি। প্রাণ বাঁচাতে বেচারি মেয়েটি ছোটুকে পাগলের মতন আঁচড়াতে থাকে। ছোটুর বুকে, গলায় যে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখছেন তা আর কিছু নয়, মরুশ্বেতারই নখের আঁচড়। মেয়েটির বড়ো -বড়ো নখের আড়ালে ঢুকে থাকা চায়ের পাতার মতন অংশগুলি যে-কোনও মনুষ্যদেহের শুকিয়ে যাওয়া চামড়া ছাড়া আর কিছু নয়, তা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি আমার। দেখা যাক ফরেনসিক রিপার্টে কী বলে? একটু দম নিয়ে অফিসার ফের বলতে থাকেন, আপনারা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যান মি. আগরওয়াল। আপনাকে পরে রিং করব আমি, আশা করি তখনই আপনারা পরিষ্কার জানতে পারবেন এই গোলচা মার্ডারের রহস্য।

অফিসারের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হয় আগরওয়াল ফ্যামিলি এই কথা ভাবে যে, এরকম জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ অন্তত জড়িয়ে পড়েনি। শুধু তাই নয়, কেসটি দ্রুত ডিটেক্শনের পথে। অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আগরওয়াল থানা থেকে বেরিয়ে আসেন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন তারা। সঙ্গের লোকজন-সহ রওনা হন বাড়ি। যদিও তারা সকলেই আলোচনা করছিলেন, ছোটু যদি প্রকৃতই হত্যাকারী হয়ে থাকে, তাহলে কী কী সম্ভাব্য কারণে সে তাকে হত্যা করতে পারে।

পর্ব – ৫

সবাই চলে গেলে মি. রক্ষিত ছোটু দরজিকে বলেন, কিরে হতভাগা, ভালো মুখে সব বলবি, নাকি ধোলাই খাবি একটু?

–সাব, বিশ্বাস করুন সাব, আমি কিছু জানি না, হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ছোটু।

–তুই সব জানিস ছোটু, মেয়েটাকে তুই-ই মেরেছিস। এখন ভালোয়-ভালোয় যদি সব বলে দিস আমি দেখব তোকে বাঁচানো যায় কিনা, আর আমাকে যদি আরও খাটতে হয় তো বুঝতেই পারছিস…

–সাব, বিশ্বাস করুন, আমি মারিনি মেয়েটাকে, একই কথা বলতে থাকে সে।

–চো-ও-প শালা, ন্যাকামি হচ্ছে? চার ডান্ডা খেলেই দেখবি সব জানিস, তুই। এই সেন্ট্রি, চেঁচিয়ে ডাকেন অফিসার।

সেন্ট্রি কনস্টেবল এগিয়ে আসে, বলে, ডাকছেন স্যার?

–হ্যাঁ, রাম সিংকো বুলাও। উত্তেজিত হলে কিছু বাঙালি বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলেন, মি. রক্ষিতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটার ব্যতিক্রম ঘটল না।

মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করল রাম সিং নামে এক বিহারি কনস্টেবল। যাকে কেবলমাত্র দেখলেই ভিরমি খাবে সাধারণ মানুষ। আচ্ছা আচ্ছা ক্রিমিনাল রাম সিং-এর থার্ড ডিগ্রির কাছে হার মেনেছে। প্রায় সোয়া ছ’ফুট চেহারার বিশাল বপু নিয়ে একটা জিন্স ট্রাউজার-এর ওপর লাল টকটকে গেঞ্জি পরে হাজির হয় রাম সিং। মোটা গোঁফ, মাথায় চুল খানিকটা হালকা হয়ে এলেও নিয়মিত মুগুর ভাঁজা দেহ তার। ভাঙা চোয়াল, বলিষ্ঠ কাঁধজোড়া। চোখে কেমন এক অদ্ভূত হিংস্রতা ওর। অফিসারের সামনে এসে প্রথমে অ্যাটেনশন হয়, তারপর মোটা গোঁফে একবার তা দিয়ে ব্যারি টোনে বলে, হমে বুলায়া সাব?

–হ্যাঁ রাম সিং, এ ব্যাটা তো কিছু জানে না বলছে, তুমি একটু চেষ্টা করে দ্য্যখো তো কিছু বার করতে পারো কিনা।

–কীরে, কুছু জানিস? বলেই হাতের মুষ্ঠির উলটো পিঠ দিয়ে বেমক্বা এক বিরাশি সিক্বার থাবড়া মারে রাম সিং ছোটুর চোয়ালে। চেয়ার থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে যায় সে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝনঝন করে ওঠে তার। মাথাটা ঘুরতে থাকে কেমন।

হেঁ হেঁ করে বিশ্রী ভাবে হাসতে থাকে রাম সিং, হাসি শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় ছোটুর। রাম সিং বলে, সাব হামি তালে উকে থোড়া পাশের ঘরে লিয়ে যাই? দেখি ও কুছু জানে কিনা?

–ছোটু, রাম সিং তোর হাড় থেকে মাংসগুলো শুধু হালকা করে দেবে একটু, বলেন অফিসার, যা তাহলে ওর সঙ্গেই যা।

ভীষণ ভয় পেয়ে যায় ছোটু। সে বুঝে গেছে ভালোই যার হাতের একটা থাবড়া খেয়ে এই অবস্থা, তার হাতে কিছুক্ষণ মার খেলে কী পরিণতি হতে পারে। সে অফিসারের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, মুঝে মাফ্ কর দিজিয়ে সাব, মাফ্ কর দিজিয়ে।

–হুঁ …একটু টেনে বলেন অফিসার, পথে এস বাছাধন। মাফ্ তোকে কেবল একটা শর্তেই করা যেতে পারে ছোটু, যদি সব কথা তুই আমাদের কাছে খুলে বলিস।

একটু থমকে অফিসারের দিকে তাকায় ছোটু, চেষ্টা করে অফিসারের কথা বিশ্বাস করতে। ভাবে সব কথা বলে দেওয়া ঠিক হবে কিনা।

–দ্যাখ ছোটু, আবার বলেন অফিসার, খুন যে তুই-ই করেছিস তা আমরা জেনে গেছি, এখন সেটা যদি নিজে মুখে স্বীকার করিস তো তোর কেস আমি হালকা করে লিখব। ইচ্ছে করেই মিথ্যার আশ্রয় নেন অফিসার, তারপর বলেন, আর তা না করে যদি আমায় আরও খাটাস তো তোর ফাঁসি আমি করাবোই, অবশ্য তার আগে রাম সিং তোকে ধুনেই শেষ করে দেবে। রাম সিং নিয়ে যাও ওকে। ভয় দেখান অফিসার।

হেঁ হেঁ হেঁ, আবার সেই বিষাক্ত হাসি হাসে রাম সিং। মোচে তা দিতে দিতে বলে, উকে হামার পাস আপ ছেড়ে দিন সাব… সিরেফ আধা ঘণ্টা… হেঁ হেঁ হেঁ।

–সাব, ম্যায় সব কুছ বতা দেঙ্গে আপকো সাব, লেকিন মুঝে মারনা মত… কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বর ছোটুর, সে পা চেপে ধরে অফিসারের।

বিচক্ষণ অফিসার বুঝে যান সহজেই যে আসামি টোটালি ব্রেক করে গেছে এবার। মনে হচ্ছে সব কিছু নিজেই বলবে। তিনি তখন স্বাভাবিক কণ্ঠে ওকে বলতে থাকেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে ছোটু, তুই সব কথা বল, কিছু লুকোবি না কিন্তু। কেউ তোর গায়ে হাত দেবে না। ওঠ, চেয়ারে বস। ওঠ, হ্যাঁ জল খাবি একটু? জলের গেলাস এগিয়ে দেন তিনি ছোটুর দিকে।

একটু ইতস্তত করে ছোটু, তারপর কি ভেবে বলে, না সাব। খানিক বসে থেকে ধাতস্থ হয় একটু, অফিসারের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।

–হ্যাঁ, এবার বলতো ছোটু, মেয়েটাকে মারলি কেন তুই? মি. রক্ষিতের প্রশ্নের উত্তরে বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে ছোটু যা বলল তা খানিকটা এরকম–

–সাব, মরুশ্বেতা দিদিমণিকে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগত। দিদিমণি যখনই বাড়িতে আসত সব সময়ই চেষ্টা করতাম ওর কাছে কাছে থাকতে। কেন জানি না, দিদিমণিও কেন যেন আমার দিকে কেমন ভাবে তাকাত। মনে হয় সে আমার মনের কথা বুঝতে পারত। কিন্তু আমি নোকর আর উনি আমার মালিকের মেয়ের বান্ধবী, মানে উনিও মালকিন। মরুশ্বেতা দিদিমণিকে দেখলেই আমি কেমন যেন হয়ে যেতাম। ও আসলে, ওর ঘরের গোছগাছ আমিই করতাম। একবার ওর কয়েকটা জামাকাপড় চুরি করেছিলাম আমি, কারণ ওগুলো কাছে থাকলে দারুণ ভালো লাগত আমার।

–শালা পারভার্ট, তার মানে বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের প্রতিও তোর নজর ছিল বল?

বিশ্বাস করুন হুজুর, প্রিয়া দিদিমণি কিংবা জিনাত দিদিমণি কারও দিকে কোনওদিন কুনজর দিইনি আমি, ওদের প্রতি কোনও আকর্ষণও বোধ করতাম না, কেবল মরুশ্বেতা দিদিমণির ব্যাপারটা ছিল আলাদা, একদম অন্যরকম। ও যখনই আসত এ বাড়িতে, আমি কেমন যেন উত্তেজিত থাকতাম সব সময়।

–তা হঠাৎ ওকে মারতে গেলি কেন?

–সাব, এবারে যখন মরুশ্বেতা দিদিমণি বেড়াতে এল তখন চুপি চুপি আমি উঁকি মারি ওর স্নানঘরে। সে দৃশ্য একবার দেখলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে হুজুর, অমন ভরন্ত…

–চোপ্ হতভাগা, দাবড়ানি দেন অফিসার, আমি দেখতে যাব মেয়েমানুষের স্নান করা, ঠিক করে কথা বল গাধা কোথাকার। মাথা গরম হয়ে যায় অফিসারের ছোটুর বেআক্বেলে কথাবার্তায়।

থতমত খেয়ে যায় সে, বুঝতে পারে বেমক্বা ভুলভাল কথা বলে ফেলেছে। কী বলবে ভেবে পায় না, চুপ করে থাকে।

–কিরে হতভাগা, থামলি কেন, খাবি নাকি ডান্ডার বাড়ি? ওকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আরও রেগে যান অফিসার।

–হাঁ সাব, বলছি বলছি, তারপর থেকে সাব আমি যেন কেমন পাগল পাগল হয়ে যাই, দিনরাত আমার চোখের সামনে মরুশ্বেতা দিদিমণির ছবি ভাসতে থাকে। মরুশ্বেতা দিদিমণি আর প্রিয়া দিদিমণি এক সঙ্গে বসে গল্প করে, হাসে, ইয়ার্কি মারে, আমি টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে কিংবা কাপ-ডিশ মুছতে মুছতে কেবল ওকেই দেখতে থাকি কাজের ফাঁকে ফাঁকে। বারবার মনে পড়তে থাকে স্নানঘরের কথা।

আচ্ছা ছোটু, তোর বয়স কত এখন? হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথা বলেন মি. রক্ষিত।

–বেয়াল্লিশ হুজুর, একটু ভেবে উত্তর দেয় সে।

–তুই নিশ্চয়ই বিবাহিত।

–হ্যাঁ সাব, দেশে আমার বউ আর দুটো বাচ্ছা আছে। একটা ঝামেলায় আমায় দেশ ছাড়তে হয়, তারপর নানা জায়গায় ঠোক্বর খেতে খেতে এ বাড়িতে।

–কত দিন আছিস এ বাড়িতে?

তা প্রায় সাত-আট বছর হবে।

–ঠিক আছে, আগের কথা বল, তাড়া লাগান অফিসার।

–হাঁ হুজুর, ছোটু বলে চলে, দিনরাত তখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা, যে করেই হোক এক বার ওকে পেতেই হবে আমার। তাতে যা হয় হোক, চাকরি যদি ছাড়তে হয় ছেড়ে দেব। শুনেছি ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সামনের মাসে বিয়ে, কেনাকাটা করতেই এসেছে এবার কলকাতায়। বিয়ের পর আর কখনও যদি ও এ বাড়িতে না আসে? ইত্যাদি নানান কথা আমার মাথায় জট পাকাতে থাকে হুজুর। আমি মনে মনে প্ল্যান আঁটতে থাকি, কীভাবে ওকে পাওয়া যেতে পারে।

–আচ্ছা ছোটু, তোর কখনও মনে হয়নি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে তোর বিপদ হতে পারে?

–সত্যি কথা বলতে কি হুজুর, আমি ভেবেছিলাম ঘটনাটা কাউকে ও লজ্জায় বলতেই পারবে না। কারণ তাতে ওর মানসম্মান চিরকালের মতন নষ্ট হয়ে যাবে, ওর বিয়ে ভেঙে যাবে।

–ও শয়তান, তুমি তো দারুণ ঘুঘু দেখছি, স্বগতোক্তি করেন অফিসার। মুখে বলেন, ঠিক আছে, তারপর বল কী করলি তুই।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসে যায়… এ পর্যন্ত বলেই ছোটু থেমে যায়।

–কিরে হতভাগা, থামলি কেন? কী প্ল্যান আসল বল, চেঁচিয়ে ওঠেন অফিসার।

–আপনাকে আমি সব বলছি দারাগোবাবু, আপনি আমায় বাঁচাবেন তো, প্রতিজ্ঞা করছি জীবনে আর এরকম কাজ করব না আমি, অনুনয় করে ছোটু।

–ওরে গাধা, তোকে মারলে আমিই মারব, বাঁচালে আমিই বাঁচাব, সবই আমার কলমে, বাঁচতে যদি চাস তো সব খুলে বল আমায়।

কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ছোটু ফের বলতে থাকে, আমার জানা ছিল গেস্টরুমের যে-ঘরটিতে মরুশ্বেতা দিদিমণিকে শুতে দেওয়া হতো, সে ঘরের দেয়ালে একটা দরজা আছে যেখান দিয়ে ব্যালকনিতে যাওয়া যায়। দরজাটা পাশের দিকে খোলে। ব্যালকনিটা খোলা এবং ওর যে গ্রিল দেওয়া অংশটি আছে সেটি ধরে মাটি থেকে ওপরে ওঠা না-গেলেও ঝুলে নীচে নামা মোটেও কঠিন নয়। ছক সাজিয়ে ফেলি আমি মনে মনে। সেদিন রাত্রে আমি সকাল সকাল খেয়ে নিই, আমার জ্বর হয়েছে বলে অজুহাত দিয়ে রাত্রি আটটা নাগাদ শুতে যাবার নাম করে নীচে নেমে আসি আমার ঘরে।

–তোর ঘরটা কোথায়? জিজ্ঞাসা করেন অফিসার।

–গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে ‘সার্ভেন্টস রুম’ লেখা এক তলা দু-কামরার যে ঘরটা আছে, আমি ওখানেই থাকি। ওই বাড়ির মালিকের নির্দেশ সেটাই।

তারপর?

–তারপর হুজুর আমার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালি, ভীষণ টেনশন হতে থাকে, আমার ঘরে যে মদের বোতলটা রাখা ছিল সেটা থেকে খানিকটা ঢেলে খাই। একটু নেশা নেশা ভাব হয়। বেশ ভালো লাগে, মনে হয় টেনশনটা অনেক কমে গেছে। ঠিক করি বোতলটা সঙ্গে নিয়েই যাব। আমার ঘরের আলো নিভিয়ে চুপিসারে দরজা ভেজিয়ে দিই। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই গেস্টরুমের দিকে। গেস্টরুমের মধ্যে কোণেরটাতে মরুশ্বেতা দিদিমণি সাধারণত থাকেন, এবারও সেরকমই ব্যবস্থা ছিল। রুম লক্ করা ছিল না, হ্যাজবোল্ট টানা ছিল। ধীরে ধীরে সাবধানে কোনওরকম শব্দ না করে টেনে হ্যাজবোল্ট খুলে ঘরে ঢুকি, সুইচ টিপে নাইট বাল্ব জ্বালাই। দেখি সব কিছু ঠিকঠাক আছে। উপর থেকে প্রিয়া দিদিমণির খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। প্রথমে আমি বাইরের দরজার পাল্লা দুটো জোড়া করে সামান্য চাপ দিই। ফলে দরজাটা বেশ শক্ত ভাবে আটকে যায়। এরপর দেয়ালের সুইচ্ টিপে ব্যালকনির দরজাটা খুলি। ঘরের নাইট বাল্ব নিভিয়ে ব্যালকনিতে যাই, আর দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিই। ওখানেই অপেক্ষা করতে থাকি, মাঝে মাঝে বোতলটা থেকে একটু একটু গলায় ঢালতে থাকি।

–কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলি ওখানে? অফিসার উদগ্রীব হন।

–অনেকক্ষণ হুজুর। রাত প্রায় বারাটো নাগাদ মরুশ্বেতা দিদিমণি ঘরে ঢোকে, শুনতে পাই প্রিয়া দিদিমণি ওকে ‘গুডনাইট’ জানিয়ে গেল।

–কী করে জানলি যে তখন রাত বারোটা, বেশিও তো হতে পারে।

–না হুজুর, ঠিক তার পর পরই দূরে পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা ঘণ্টা পড়ে।

–আচ্ছা, তারপর কী হল?

–তারপর হুজুর আবারও অপেক্ষা করতে থাকি, মরুশ্বেতা দিদিমণি খানিক পর ঘর থেকে বেরিয়ে যান। সম্ভবত টয়েলেটে। একটু পর ফিরে আসে, দরজা বন্ধ করবার শব্দ পাই আমি। এরপর বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ ঘরের বড়ো আলো জ্বলতে থাকে, দিদিমণি বোধহয় কিছু করছিল। তারপর বড়ো লাইট নিভিয়ে নাইট বাল্ব জ্বালায় দিদিমণি।

–ব্যালকনি থেকে এত সব বুঝতে পারছিলি ঠিক ঠিক? বিস্মিত হন অফিসার।

–হুজুর ব্যালকনির দিকে একটা ভেণ্টিলেটার আছে, ওটা দিয়ে যে আলো বেরোচ্ছিল তা দেখেই সব বুঝতে পারছিলাম আমি, উত্তর দেয় ছোটু।

–আচ্ছা…, বলেন অফিসার, মনে মনে বলেন, শালা তো মহা খচ্চর দেখছি, তারপর কী হল বল?

–রাত দুটোর ঘণ্টা পড়লে আমি উঠে দাঁড়াই, ততক্ষণে বোতল শেষ, নেশাটা বড়ো বেশি হয়ে গেছিল বুঝতে পারছিলাম। খুব সাবধানে আস্তে আস্তে ব্যালকনির দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলি আমি, প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল নেশার ঘোরে এই বুঝি জোরে কোনও শব্দ হয়। ঘরে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিই, পাছে ঘরের আওয়াজ বাইরে যায়।

–তারপর?

–হুজুর ঘরে তখন নাইট বাল্বের থৈ থৈ আলোর বন্যা। নীল নাইটি পরে এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে ও, ঘুমন্ত। বেশ কয়েক মিনিট ধরে আশ মিটিয়ে দেখি ওকে। কাত হয়ে শোবার জন্য মরুশ্বেতাকে সাংঘাতিক রকমের আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছিল আমার। নিজেকে সামলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, একে মাথায় চড়া নেশা। সামনে আমার বহু আকাঙিক্ষত নারীদেহ। হাত বাড়িয়ে দ্রুত নাইট বাল্বটি নিভিয়ে দিলাম আমি, কারণ ভয় ছিল জেগে উঠে আলোতে আমায় দেখলে চিনে ফেলবে ও। খুব সাবধানে একটু ঠেলে চিৎ করে দিয়েই ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি।

–তোর পরনে তখন কী ছিল? ইন্টারাপ্ট করেন অফিসার।

–কেবল একটা লুঙ্গি।

–তারপর?

–আমি ওর গায়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। আমি জোর জবরদস্তি করতে থাকি। সেও বাধা দিতে থাকে প্রাণপণ। মেয়েটার গায়ে যে অত জোর থাকতে পারে, হুজুর আমার কোনও ধারণা ছিল না। সম্ভবত মদের নেশা বেশি হয়ে যাওয়ায় আমিও ঠিক ততটা জোর পাচ্ছিলাম না।

তারপর?

–ও চ্যাঁচাতে চেষ্টা করছিল প্রথম থেকেই, তাই ওর মুখটা চেপে ধরেছিলাম আমি। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে একজন পূর্ণবয়স্কা যুবতিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সজ্ঞানে কিছু করা একজন পুরুষের পক্ষে যে কতটা কঠিন তা আমার জানা ছিল না হুজুর। ব্যাপারটা ক্রমশই আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। কারণ এলোপাতাড়ি হাত চালাচ্ছিল ও। প্রচণ্ডভাবে আঁচড়ে দিচ্ছিল আমায় ওর নখ দিয়ে। ধস্তাধস্তির ফাঁকে একসময় ও মাথার কাছের বেড সুইচটা টিপে দেয়, ফলে ঘরটা আলোয় ভরে যায়। আমাকে দেখেই চিনতে পারে, তীব্র ঘৃণা ফুটে ওঠে ওর দু’চোখে। আমার ভুল হয়েছিল, সুইচটা গিট বেঁধে উপরে তুলে রাখা উচিত ছিল। আলো জ্বালাতে মুহূর্তে আমিও হকচকিয়ে যাই। সেই ফাঁকে ও বলে ওঠে, ছোটু, ছোড়দে মুঝকো, নেহি তো ম্যায় বতা দুঙ্গি সবকো। সঙ্গে সঙ্গে আমি আরও দৃঢ়ভাবে চেপে ধরি ওর মুখ, বাইচান্স যদি চিল্লে দেয় তো সর্বনাশ। অন্য হাতে দ্রুত অফ্ করি লাইট। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই, কাল যদি বলে দেয় ও সবাইকে, কী হবে তবে? মাথায় কী যেন ভর করে আমার, মুখ চেপে ধরা অবস্থায় প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারি ওর মাথায় যাতে ও চুপ করে যায়। কীভাবে কতক্ষণ ওর মুখ চেপে ধরেছিলাম জানি না। হঠাৎ মনে হল ও আর মোটেও প্রতিরোধ করছে না। প্রথমে ভাবলাম অজ্ঞান হয়ে গেছে, কিন্তু কি মনে হতে লাইট জ্বালালাম। দু-এক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মেয়েটা মারা গেছে। হুজুর কী বলব আপনাকে, সেক্স-ফেক্স তখন আমার গোল্লায় গেছে, ভয়েতে আমার প্রাণ যায় আর কি! কোনওমতে ব্যালকনির দরজা খুলে পালাতে পারলে বাঁচি।

–তারপর, তারপর কী করলি তুই?

–তারপর ব্যালকনির দরজা কোনওমতে ঠেলে বন্ধ করে গ্রিল ধরে ঝুলে এক লাফে মাটিতে, দৌড়ে ঘরে ফিরলাম। একবার ভাবলাম রাত্রেই পালিয়ে যাব কিনা। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল পালিয়ে গেলে আমার ওপরই সকলের সন্দেহ তীব্র হবে। মনে মনে নিশ্চিন্ত হই এই ভেবে যে মেয়েটা তো মরেই গেছে, বেঁচে থাকলে আমার নাম হয়তো বলে দিত। কিন্তু মরা মানুষ তো আর কথা বলে না। এই সব ভাবতে ভাবতে শেষ রাতের দিকে একটু চোখ লেগে যায়। ঘুম ভাঙ্গে সকলের চ্যাঁচামেচিতে।

–তারপর? জিজ্ঞাসা করেন অফিসার, যদিও তিনি জানতেন ঘটনার পরিসমাপ্তি এখানেই।

–তারপরের ঘটনা তো হুজুর সব জানেন, বলে ছোটু।

–ও আচ্ছা, টুক্ করে টেপের সুইচ অফ্ করেন মি. রক্ষিত। ছোটুর সঙ্গে সমস্ত কথোপকথন টেপ করে নেবার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সেটা অন করেছিলেন তিনি। তারপর তিনি সেন্ট্রিকে নির্দেশ দিলেন, সেন্ট্রি, এটাকে লক আপে ভরো তো।

–হুজুর আপনার কথা মতন সব কথা স্বীকার করলাম আমি, আপনি বললেন মাফ করে দেবেন আমায়, আপনার পায়ে পড়ি হুজুর আমায় ছেড়ে দিন। ফের পা জড়িয়ে ধরে ছোটু মি. রক্ষিতের।

–হতভাগা, আমি মাফ করবার কে? আমি তো আইনের চাকর। আমার ডিউটি আমাকে করতে হবে না? কাল তোকে কোর্টে পাঠাব, সেখানে তোর যা বলার বলবি, জজসাহেব তোকে মাফ করলে আমার কি?

–সাব, এবারকার মতো আপনি আমায় মাফ করে দিন, জীবনে আর এরকম কাজ আমি করব না সাব, চ্যাঁচাতে থাকে ছোটু।।

সেন্ট্রি কনস্টেবল ছোটুকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় হিড় হিড় করে। তারপর ধাক্বা মেরে হাজতে পোরে ওকে। হাজতের দরজায় তালা বন্ধ করে একবার চেক্ করে চাবির গোছা পকেটে পোরে।

মি. রক্ষিত সমস্ত তথ্য গুছিয়ে নিয়ে কেস ডাইরি লিখতে বসেন। কাল সকালে কোর্টে ফরওয়ার্ড করতে হবে আসামি! সঙ্গে ফার্স্ট সিডি সাবমিট করতে হবে, বেশ অনেকক্ষণ একটানা কেস ডাইরি লিখে চলেন তিনি। হঠাৎ এক জায়গায় এসে খটকা লাগে তার। ছোটু মেয়েটির পেটের ওপর বসে মুখ চেপে ধরে মারলে মেয়েটির বাম গালে স্পট আসে কীভাবে? যদি ধরে নেওয়া যায় ওই নীল স্পটটি বুড়ো আঙ্গুলের প্রচণ্ড চাপের ফলে সৃষ্টি? কীভাবে? …স্পটটা তো ওর ডান গালে হওয়া উচিত ছিল… তবে কি… তাই যদি হয়, দেখাই যাক না ব্যাপারটা পরীক্ষা করে, ভাবেন অফিসার। কেস ডাইরির বাকি অংশ লেখা বন্ধ রেখে তিনি সেন্ট্রিকে বলেন দুটো চায়ের অর্ডার দিতে। উঠে দাঁড়ান চেয়ার ছেড়ে, একটু আড়মোড়া দেন। তারপর পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরান, এগিয়ে যান হাজতের দিকে, ডাকেন, ছোটু কী করছিস?

হাজতে তিন-চারজন আসামি ছোটুর সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ সারছিল তখন। কে কোন কেসে কীভাবে অ্যারেস্ট হল সেসব গল্প হচ্ছিল তাদের। হঠাৎ অফিসারের চেনা গলা শুনে আশায় ছুটে আসে ছোটু। সে বলে, সাব, এবারের মতো আমায় মাফ করে দেন। জীবনে আর একাজ করব না আমি।

–হ্যাঁরে বাবা, ছেড়ে তো তোকে দিতেই হবে। কিন্তু কাল যে একবার কোর্টে যেতে হবে ছোটু। তুই জজসাহেবকে সব কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নিবি, বুঝলি? ক্ষমা করার হলে উনি ক্ষমা করে দেবেন তোকে ।

–সাব, উনি আমায় তাহলে ছেড়ে দেবেন তো?

–প্রথমবার অপরাধ করেছিস শুনলে দয়া করলেও করতে পারেন, ইচ্ছা করেই মিথ্যে বলেন অফিসার।

ইতিমধ্যে চায়ের দোকানের ছেলেটি দুটো ভাঁড়ে চা নিয়ে আসে, বলে, স্যার আপনার চা।

–এনেছিস? দে, বলে প্রথমে হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে নেভান তিনি, তারপর একটা ভাঁড় নেন। ছোটুকে বলেন, ছোটু, একটু চা খাবি নাকি?

হঠাৎ অফিসারের এরকম আন্তরিক ব্যবহারে একটু ঘাবড়ে যায় ছোটু। অদ্ভুত চোখে তাকায় মি. রক্ষিতের দিকে। ছোটুর পাশে থাকা বাকি আসামিরা হিংস্র চোখে দেখে। চা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি। সেও খানিকটা অবাক।

–আরে নে, নে, ধর। তাড়া লাগান অফিসার, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ছেলেটা?

গরাদের ফাঁক দিয়ে ভাঁড়ের দিকে হাত বাড়ায় ছোটু।

–ইয়েস দ্যাটস ইট, এটাই এক্সপেক্টেড ছিল, ছোটু আসলে লেফটি, বিড় বিড় করে বলেন অফিসার। স্পট-এর রহস্য খুলে যায়, একটা তীক্ষ্ণ হাসির ঝিলিক দিয়ে যায় অফিসারের বুদ্ধিদীপ্ত চোখে। এগিয়ে গেলেন তিনি তার অসম্পূর্ণ কেস ডাইরির টেবিলে, মনে মনে বললেন, মনে হচ্ছে কেসটা দাঁড়িয়ে গেল।

পর্ব – ৬

কিন্তু পরদিন ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নেয়। যে-বলটা এতক্ষণ মি. রক্ষিতের কোর্টে ছিল, তা বিপক্ষের ফেভারে চলে গেল। পরদিন ছোটুকে কোর্টে চালান করা হলে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে মোটেও দোষ স্বীকার করল না তার, বরং সম্পূর্ণ উলটো সুর গাইল। সে বলল, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ, আগরওয়াল ফ্যামিলির চাপে পুলিশ তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাচ্ছে। এ অপরাধের সঙ্গে বিন্দুমাত্রও জড়িত নয় সে।।

মি. রক্ষিত প্রমাণ হিসেবে তার টেপ করা ক্যাসেট শোনালেন জজসাহেব-কে। কিন্তু ছোটু দরজি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতন বলল, তাকে দিয়ে পুলিশ জোর করে ওসব বলিয়ে নিয়েছে। সে না বললে পুলিশ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলত। তাকে রাম সিং নামে একজন পুলিশ পিটিয়েছে থানায়। ও ধরনের স্বীকারোক্তি না দিয়ে উপায় ছিল না তার।

বিচারক সব শুনে বললেন, ছোটুকে নব্বই দিনের জন্য জেসি অর্থাৎ জেল কাস্টডিতে রাখতে। একই সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে আদেশ দিলেন এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইনভেস্টিগেশন সম্পূর্ণ করে চার্জশিট সাবমিট করতে। শুধু তাই নয়, তিনি মি. রক্ষিতের পেশ করা হানড্রেড সিক্সটি ওয়ান অর্থাৎ পুলিশ কর্তৃক সংগৃহীত জবানবন্দিকে বাতিল করে দিলেন তখনকার মতন। পরিবর্তে তাকে আদেশ দিলেন যথা শীঘ্র সম্ভব মেডিকেল ও ফরেনসিক রিপোর্টগুলি সংগ্রহ করে উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ-সহ আদালতে পেশ করতে।

এ ঘটনায় মি. রক্ষিত একটু মুষড়ে পড়লেন। ব্যাপারটা খুব সহজে মিটিয়ে ফেলবার একটা পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি, আসামিকে দিয়ে হানড্রেড ফর্টিওয়ান অর্থাৎ স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ছোটুর জবানবন্দি রেকর্ড করাবার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ছোটু সম্পূর্ণ বেঁকে বসল। খুব সম্ভবত গতকাল রাতে ছোটু যে সব ভেটেরান ক্রিমিনালদের সঙ্গে হাজতে ছিল, তারাই মগজ ধোলাই করেছিল ওর। সেন্ট্রি কনস্টেবলটা বলছিল, ও নাকি শুনেছে ওদের মধ্যে একজন ছোটুকে বলছে, আরে পুলিশ কখনও আসামির বন্ধু হয়? সব ছক, তোর ফাঁসি হবে। সে ধমক দিতে তখনকার মতো চুপ করে গেছিল নাকি শয়তানটা।

এখন সমস্যাটা হল, মার্ডার যখন হয় তখন রাত ধরা যাক দুটো, ঘটনাস্থলে তখন একমাত্র খুনি এবং ভিক্টিম। ভিক্টিম মৃত, আর খুনি তো তার দোষ স্বীকার করবেই না। এ ঘটনার কোনও আই উইটনেস নেই। এমতাবস্থায় কেসটা দাঁড় করানো বেশ কঠিন। কী করা যায় ভাবতে থাকেন অফিসার, পুরো ব্যাপারটা সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ওপর নির্ভর করে খাড়া করতে হবে।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট জিনিসটা ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী একটি কনক্লুসিভ এভিডেন্স হিসাবে বিবেচিত হয়। যদি মদের বোতলে পাওয়া ফিঙ্গার প্রিন্টের সঙ্গে শয়তান ছোটুর ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলেও যায় তাহলে ব্যালকনিতে ছোটুর উপস্থিতি প্রমাণ করবার চেষ্টা সফল হলেও হতে পারে কিন্তু খুনের অভিযোগ কি টিকবে তাতে? ছোটু হয়তো বলে বসবে, ও ওর ঘরে বসেই মদ খাচ্ছিল, পুলিশ ওর ঘর থেকে বোতল সিজ্ড করে মিথ্যে মামলা সাজাচ্ছে যে ব্যালকনিতে পাওয়া গেছে ওটা। তাহলে? মহা দুশ্চিন্তায় পড়েন মি. রক্ষিত। দেখা যাক মেডিকেল রিপোর্ট কী বলে?

এদিকে পরদিন সকালেই আগরওয়াল ফ্যামিলির লোকজন আলিপুর থানায় পৌঁছে ছোটু দরজির কীর্তিকলাপ জানতে পারেন। যদিও প্রথমে তাদের কাছে মি. রক্ষিতের দেওয়া বর্ণনা এক আষাঢ়ে গল্প বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন তারা টেপ করা কথোপকথন শুনলেন, ছোটুর গায়ের নখের আঁচড় তারা আগেই দেখেছিলেন, তাদের সন্দেহ দূর হল। সম্পূর্ণ ঘটনার একটা বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা তাদের খানিকটা নিশ্চিন্ত করল যে, প্রকৃত হত্যাকারীকেই পুলিশ চিহ্নিত করেছে। তখন তারা মনেপ্রাণে চাইলেন যে আইনের কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে আসামি যেন গলে পালাতে না পারে।

দু-পাঁচ দিন অন্যান্য কেস কানেকশন নিয়ে ব্যস্ততায় কাটে মি. রক্ষিতের। কিন্তু দিবারাত্রি তার মাথায় কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে যে, একজন খুনি কেবলমাত্র প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে? যদিও তিনি জানতেন এখনও তার হাতে ব্রহ্মাস্ত্র মজুত।

ছ’দিন পর মি. রক্ষিত ফরেনসিক ও মেডিকেল রিপোর্ট পান। তাতে বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক খবর থাকলেও নিরাশাজনক কিছু তথ্যও হাতে আসে তাঁর। যেমন ছোটুর আঙুলের ছাপের সঙ্গে পিও-তে পাওয়া মদের বোতলের আঙুলের ছাপ মিলে যাবার রিপোর্ট যা তদন্তের ফেভারে আসবে কিছুটা। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টে বলা হল মরুশ্বেতার অ্যাসফেকসিয়াল ডেথ ঘটেছে অর্থাৎ শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে, যা কিনা হোমিসাইডাল ইন নেচার। এর বেশি স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই তাতে। ভিক্টিমের অ্যাপারেল্স-এ কিংবা শরীরে কোনও ফরেন ফ্লুয়িড বা পার্টিকেল্সের চিহ্নমাত্র নেই, এমনকী সিজ্ করা বিছানার চাদরেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

এছাড়া ছোটুকে মেডিকেল করাবার সময় তার বুকে শুকিয়ে আসা যে ক্ষতগুলি ছিল তার সঙ্গে মৃতার নখের কার্ভেচার তুলনার ক্ষেত্রেও কোনও ডেফিনিট ওপিনিয়ন হয়নি। তাহলে? বাকি কেবল একটি রিপোর্ট যার ওপর নির্ভর করছে মি. রক্ষিতের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের সুযোগ বা সম্ভাবনা এবং সেটি হল, মৃতার নখের কোণায় পাওয়া ফরেন পার্টিকেলগুলি আসলে কী? দেখা যাক কপালে কী আছে, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মি. রক্ষিতের বুক থেকে।

ইতিমধ্যে মরুশ্বেতার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, হবু জামাই প্রমুখ অসংখ্য লোকজনেরা দফায় দফায় এসে দেখা করেছেন মি. রক্ষিতের সঙ্গে। শোকার্ত ব্যক্তিদের সান্ত্বনা দিয়েছেন তিনি, বুঝিয়েছেন কেসের মেরিট-ডিমেরিট্‌স প্রভৃতি। বার বার বলেছেন, ভাববেন না আপনারা। এই জঘন্য অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবেই। সাধ্যমতো চেষ্টা করব আমি।

আরও দু’দিন পর সেই বহু আকাঙ্খিত রিপোর্টটি হাতে আসে মি. রক্ষিতের। রিপাের্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে, মৃতার নখের কোণায় যে ফরেন পার্টিকেলগুলি পাওয়া গেছে সেগুলি ডেফিনিটলি  হিউম্যান বডি স্কিনেরই ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশ। উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মি. রক্ষিত। ঈশ্বরের দুনিয়ায় বিচার নিক্তি মেপে হয়। এবার ছুড়ব ব্রহ্মাস্ত্র।

পরদিনই মি. সমিত রক্ষিত সমস্ত রিপোর্ট পেশ করেন বিচারকের সামনে এবং একই সঙ্গে জোরালো আবেদন জানান। যেহেতু এই কেসে দুর্ঘটনাবশত কোনও আই-উইটনেস নেই, তিনি আসামির ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্ট করাতে চান যা কিনা আইনের চক্ষে সর্বাধুনিক এক বৈজ্ঞানিক এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কনক্লুসিভ এভিডেন্স হিসাবে স্বীকৃত।

সকল ঘটনা এবং উপযুক্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে বিচারক আসামি ছোটুর ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্ট করাবার অনুমতি দেন।

মি. রক্ষিত আর দেরি করেন না, তার পরদিন তিনি ছোটুকে নিয়ে মেডিকেল বোর্ডের সামনে উপস্থিত হন, আদালতের নির্দেশ তার কাগজপত্রের সাঙ্গে অনিবার্য ভাবে জুড়ে দিতে ভোলেন না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎকরা স্থির করেন, ছোটুর দেহ থেকে পরীক্ষার জন্য সামান্য ব্লাড নিয়ে সেই ব্লাডসেলের সঙ্গে তুলনা করা হবে মৃতার হাতের নখে পাওয়া শুকিয়ে যাওয়া হিউম্যান স্কিন পার্টিকেল্সগুলির।

সপ্তাহ খানেক পর মি. রক্ষিত বিচারকের সামনে মেলে ধরেন বিশেষজ্ঞদের সই এবং সিলমোহর মারা আধুনিক বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব অবদান, ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্ট টেস্ট-এর রিপোর্ট, যা আইনের চোখে এক অভ্রান্ত প্রমাণ বলে স্বীকৃত। সেই রিপোর্টে দিনের আলোর মতন স্পষ্ট করে লেখা ছিল, মৃতার নখের কোণায় পাওয়া শুকনো হিউম্যান স্কিন পার্টিকেলসের সঙ্গে ছোটুর ব্লাডসেলের ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্ট হুবহু মিলে গেছে। আসামি ছোটুর শাস্তির পক্ষে কেবল এই এভিডেন্সটুকুই যথেষ্ট ছিল।

আসামির পক্ষে কোনও উকিল ছিল না। ছোটুকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলে সে তার বিপক্ষে সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণগুলির ব্যাপারে সন্তোষজনক কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কিছুদিন পর মামলার রায় বের হয়। আদালত চত্বরে তখন লোকে লোকারণ্য, অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ উন্মুখ হয়েছিলেন সেই রায় শোনার অপেক্ষায়!

আদালতের রায়ে জানা যায়, ছোটু দরজি নরহত্যার দায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির তিনশো দুই ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। রায় শুনে আদালত থেকে উৎফুল্ল চিত্তে বেরিয়ে আসেন মি. রক্ষিত, অভ্যাসবশত সিগারেট ধরান, লাইটার পকেটে ফেলে ধোঁয়া ছাড়েন দীর্ঘ, আঃ… রিলিফ। দেখতে পান, আগরওয়াল ও গোলচা ফ্যামিলির লোকজনেরা দ্রুত এগিয়ে আসছে তার দিকে।

সমাপ্ত 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...