‘এই ছেঁড়া মাতলা!’

শান্তনুর এত বিস্ময়ের কারণ খুঁজে পেল না মারুনা। মাতলার একটা ছোটো শাখা নিশ্চয়ই, তাই ছেঁড়া মাতলা। কিন্তু শান্তনুর কথায় মনে হচ্ছে এই নদীর অনুষঙ্গে কোনও স্মৃতি মনে পড়ে গেছে ওর! যাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন মেমরি। চোখটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল তার। তাদের সব জার্নিতেই কি পিয়ালীর ব্যাগেজ বয়ে বেড়াতে হবে?

গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে যে-কোনও স্পটে পৌঁছেই শান্তনু বলছে ‘এখানে আমরা এসেছিলাম।’ এমনকী ছবি তুলতে তুলতে বলল ‘ঠিক এই সিঁড়িটার সামনে পিয়ালীর একটা ছবি আছে। স্মাইল!’ মারুনার হাসিটা বেঁকে গিয়েছিল ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। শান্তনুর এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কোনও অর্থই খুঁজে পায়নি মারুনা। মারুনা তো সেধে ওর জীবনে আসেনি, পিয়ালীকেও তাড়ায়নি।

মানুষের জীবনের প্রথম আতান্তরটি বোধহয় ‘ওই যাঃ, পাখি উড়ে গেল, দুশ যাঃ!’ উড়ে গেল, না উড়িয়ে দিল কেউ, মারুনা বুঝতে পারেনি। শান্তনুর সঙ্গে এই দেড়বছরের একত্রযাপনে কখনও এসেছে এমন সঙ্কট? আসেনি। সে বরাবরই অজস্র মনোযোগ পেয়েছে, অজস্র আদর, তার মনে হতে শুরু করেছিল সে একেশ্বরী। কিন্তু সুন্দরবনে না এলে সে যে এত দীন– তা তো বুঝতেই পারত না।

আপনজন হোটেল, পাখিরালয়, ঘাটে নেমে জায়গাটার কোনও বিশেষত্ব খুঁঝে পায়নি। ঘাটের কাছে, যেমন হয় আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রে, হরেক জিনিসের দোকান, ডাব খাবার ভিড়, সেগুলো ফেলে বাঁদিকে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওদের হোটেল। বিশাল বড়ো, আর ছিরিছাঁদহীন, বাথরুম-টাথরুম খুব খারাপ নয়, কিন্তু পুরোটাই জেনারেটর নির্ভর। বাপরে! এই মার্চ মাসে দোলের সময় এখানে আসে কেউ? মারুনার মনে হল ওরাই এ মরশুমের শেষ পর্যটক।

আসলে এবার ওদের অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। কখনওই সুন্দরবন নয়। কিন্তু মারুনার একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হবার কথা ছিল জানুয়ারিতে, সেই জন্য লম্বা কোনও টুর আগে থেকে বুক করা হয়নি। অথচ সেই সেমিনার জানুয়ারিতে হল না, পেছিয়ে গেল, মাঝখান থেকে লম্বা টুরও হল না। মারুনা প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘চলো গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি’ শান্তনু অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘তুমি তো গান জানো না!’

কথাটা ঠক করে লেগেছিল মারুনার বুকে। ও জানে, এরপর অবধারিতভাবে পিয়ালীর গানের প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ালী দারুন গান গাইত, রবীন্দ্রসংগীত থেকে সেমি ক্লাসিক্যাল সবই। মারুনা চুপ করে শুনবে, কোনও কথা বলতে পারবে না, কারণ কথাটা তো সত্যি। পিয়ালী তো সত্যিই দারুণ গান গাইত। ওর গান শুনে মারুনাও তো মুগ্ধ হয়েছে, এখনও হয়। ওর একটা গান এখন এফএম, টিভি, পুজো প্যান্ডেল সর্বত্র বাজছে, বলিউডে বড়ো ব্রেক পেয়েছে যে-গানটা গেয়ে ‘নাজুক কলহাইয়া মোরি’।

মারুনার তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘আমি গান জানি না বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তুমি। এখন তা হলে আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে অসুবিধে কোথায়?’

বড়ো টুর হল না, লং-ড্রাইভ হল না, ফেব্রুয়ারিতে মারুনার মা অসুস্থ হলেন হঠাৎ, তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোম, ঘর ছোটাছুটি– শান্তনুই করল বেশি। মার্চ আসতে দুজনের মনের অবস্থাই সাংঘাতিক, কোথাও একটা যেতেই হবে। শহরের সব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেদুইন ট্রাভেলসেরই, দোলে সুন্দরবন প্যাকেজে দুটো সিট পড়ে আছে। ঝটপট সেটাই বুক করে ফেলল শান্তনু।

সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর এই তাদের প্রথম বাইরে যাওয়া। পিয়ালী শান্তনুকে ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিল অনেকদিন, সেখানে কে এক মিউজিক ডিরেক্টর পবন চতুর্বেদীর সঙ্গে লিভ-ইন করছিল, এটাও জানা ছিল। এসব সত্ত্বেও সে শান্তনুকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিল না। মুম্বইয়ে সুবিধে করতে না পারলে কলকাতায় ফিরে আসবে, তাই শান্তনুকে কুশন হিসেবে রাখতে তার ইচ্ছে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শান্তনু তা মেনে নেবে কেন? শুরু হল টানাপোড়েন। শান্তনু না চাইলেও অ্যাডাল্টরির অভিযোগ আনতে হল। যেহেতু ওটাই স্ট্রং গ্রাউন্ড। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হলেও শান্তনু যে কেন পিয়ালীকে সর্বসমক্ষে ব্যভিচারিণী বলতে চায়নি, তা মারুনার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয়, পিয়ালী ফেরত নিতে এলেও জরুরি ডকুমেন্টস ছাড়া, তার ব্যবহূত জিনিসপত্র, কসমেটিক্স, ব্যাগ, শাড়ি, অন্য পোশাক, টুকটাক গয়না কিছুই কেন শান্তনু ফেরত দেয়নি, এমনকী পিয়ালীর লঁজারি পর্যন্ত।

ছোট্ট ফ্ল্যাট নয়, বেশ বড়ো বাড়ি শান্তনুর, মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটলেই বাড়িটা। বাড়ি ঘিরে বিশাল বাগান, এমনকী একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সেই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে ঠাসা শুধু পিয়ালীর জিনিস। ওটা আগে ওদের বেডরুম ছিল। এখন শান্তনু তার আর মারুনার জন্য অন্য একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। মারুনার প্রতি তার যত্ন ও আদরের কোনও ত্রুটি নেই। মারুনার প্রতিটি সুবিধে অসুবিধের দিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। কিন্তু ওই যে তালাবন্ধ ঘরটা, ঘরে ঠাসা পিয়ালীর জিনিস। সারাক্ষণ মারুনার মনের সবটুকু জুড়ে আছে ওই স্মৃতির ঘর। এখানেও যেন সেই ঘরটা সঙ্গে বয়ে এনেছে ওরা। শান্তনু সেটা সারাক্ষণ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর মারুনা একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, একটুও আনন্দ পাচ্ছে না তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম যৗথ ভ্রমণে। তার খালি মনে হচ্ছে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। বাড়িই ভালো।

নদী এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, বিকেলের হলুদ আলো গাছগুলোর মাথা আলগোছে ছুঁয়ে আছে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি যে নেই, তা বোঝা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে চাপা টেনশন দেখে। সূর্যাস্তের ছবি তুলতেই হবে। বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখার মতো সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। বেশিরভাগই আলাদা ক্যামেরা আনে না আজকাল, মোবাইলেই তোলে। মারুনাও তার মোবাইল বার করে ফেলল। সূর্য, নদী, অরণ্য– নৈর্ব্যক্তিক এই ছবিগুলো অন্তত পিয়ালীর কথা বলবে না।

‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না!’

শান্তনু আচমকা এত প্রাবল্যের সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখল যে আর একটু হলেই তার মোবাইলটা হাত ফসকে জলে পড়ে যাচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়ে সে পেছন ফিরে বলল ‘যাচ্ছিল মোবাইলটা। এত এক্সাইটমেন্টের হয়েছেটা কী? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই তো জল আর জল দেখে যাচ্ছি।’

শান্তনু নাটকীয় গলায় বলল,

‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তোর হয়েছে বিকল– তাই না রে? ওরে অবোধ বালিকা, এক্সাইটেড হব না! ওই যে গাইডটা দেখছ, সকাল থেকে আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছে, ওই যে, কলকেতার বাবুরা হাঁ করে যার জ্ঞানবাণী গিলে যাচ্ছে, ওই লোকটা কে জানো?’

‘কে? ডোনাল্ড ট্র্যাম্প? না রয়েল বেঙ্গল টাইগার?’

‘তার চেয়ে বেশি। সকাল থেকে তাই ওকে এত চেনা-চেনা লাগছিল। আরে সেবার যখন পিয়ালীকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম, এই লোকটাই গাইড ছিল। ওর নাম হচ্ছে আশুতোষ খাঁড়া। পিয়ালী ওর কাছ থেকে একটা রুটম্যাপ লিখে নিয়েছিল। লোকটার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। পিয়ালী ওকে দুশো টাকা দিয়েছিল আলাদা করে।’

পিয়ালী, পিয়ালী, পিয়ালী! উঃ! মারুনার মুখ নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু সে যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘কাগজটা কোথায়?’

‘মানে?’

‘ওই যে বললে কাগজে রুটম্যাপ লিখে দিয়েছিল’,

শান্তনুর মুখ হাজার দীপশিখায় জ্বলে ওঠে। ‘আছে। আমি দিইনি তো কিছু ফেরত। আমার সঙ্গে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, আমার সূত্রে যা যা অর্জন করেছে পিয়ালী, সব, সব  রেখে দিয়েছি। ওই তালা বন্ধ ঘরে আছে। ওয়াল ক্যাবিনেটের বাঁদিকের তিন নম্বর খোপে পেয়ে যাবে।’

মারুনা যেন এতক্ষণে একটা আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়। ওয়াল ক্যাবিনেটের তিন নম্বর খোপে যেন ওর সুখের ঘরের চাবি আছে। সে বেশ গুছিয়ে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে পশ্চিম আকাশের দিকে, মুরুবি৩ চালে বলে ‘একি! সূর্যাস্তের ছবি তুলবে না?’

সকাল থেকে যতটা খারাপ গেছে, সন্ধেটা তার তুলনায় অনেক অনেক ভালো কাটল। হোটেলটা খুব খারাপ না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে। যদিও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, এল শেপের স্কুলবাড়ির মতো। তার ওপর লোডশেডিং-এর দৗরাত্ম্য। বাথরুমে একরাশ অজানা পোকা, গা ধুতে গিয়ে চোখে নাকে ঢুকে গেল। তিনতলার ঘর, ছাদ রোদে তেতে আগুন হয়ে আছে। গা ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বেশ আরাম হল। সারা হোটেলে নাকি দুটো মাত্র এসি ঘর, যারা আগে বুক করে এসেছে তারা পাবে। নীচে এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল খুব। ম্যানেজারকে যাচ্ছেতাই করে কথা শুনিয়ে এল কয়েকজন। ‘আগে জানালে আমরাও এসি বুক করে আসতে পারতাম। কেন সেই অপশনটাও দেওয়া হল না!’

কিছুক্ষণ চলল এরকম, তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আসন্ন সন্ধের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। বারান্দা থেকে দেখল সন্ধেলাগা নদীর ওপর চাঁদ উঠল, সোনার থালার মতো চাঁদ। মারুনার আচমকা মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। যে সে পূর্ণিমা নয়, দোলপূর্ণিমা। দোল আর পরের শনি-রবি এই মিলিয়েই তো ট্রিপটা সম্ভব হয়েছে তাদের। আজ দোল, অথচ এক ফোঁটা আবিরও কেউ কারও কপালে ছোঁয়ায়নি। ফোনে কয়েকটা মেসেজ এসেছে, ‘হ্যাপি হোলি’। এছাড়া সারাদিনে মনেই পড়েনি আজ দোল। প্রতিবার দোলে তাদের বাড়িতে উৎসবের মেজাজ, মা পূর্ণিমার শিন্নি দেয় একদিকে, অন্যদিকে মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে রং মেখে হুল্লোড় করে। এখানে না এলে এবারও সেখানেই থাকত। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠেই মিলিয়ে গেল। মহাসমারোহে দোল পালন করতে না পারা, শান্তনুর লাগাতার পিয়ালী – পিয়ালী– সব মুছে গেল মুহূর্তে। নদী আর তার বুকে মস্ত চাঁদ, মারুনার সমস্ত না-পাওয়াকে তুচ্ছ করে দিল। বারান্দায় আরও অনেকে চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছিল। তাদের কথাও মারুনার কানে গেল না। কতক্ষণ যে সে ওইভাবে বসেছিল কে জানে। হঠাৎ ট্রাভেলসের একটা ছেলে এসে প্লেটে প্লেটে চাউমিন দিয়ে গেল, আর সেটা দেখেই নিশ্চয়ই শান্তনু বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ছেলেটাকে বলল, ‘চা দেবে না?’

‘এটা খেয়ে নিন, চা আসছে।’ বাব্বা! ছেলেটার গলা কী গম্ভীর! খেতে খেতে সেই গম্ভীর গলা চড়িয়ে ছেলেটা বলে গেল, ‘চা খেয়ে নীচের লনে আসবেন। যাত্রা হবে।’

‘কী যাত্রা ভাই?’

‘বনবিবির পালা।’

শান্তনুর সামনে বসে খেতে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল মারুনার। হয়তো বলে বসবে, সেবার পিয়ালীর সঙ্গে যখন এসেছিল, বিকেলে ঠিক এই টিফিনই খেয়েছিল। তাকে আশ্বস্ত করে শান্তনু কিছু বলল না, চাউমিনটা চেটেপুটে খেয়ে নিল, তারপর বারান্দা থেকে নীচের লনে উঁকি মেরে বলল, ‘দেখেছ, স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে।’

মারুনাও উঁকি মারল নীচে। খুব নীচু মঞ্চ, স্টেজের পেছনে কয়েকজন বসে মেক-আপ করছে। যারা স্টেজ বাঁধছিল, তারাও মেক-আপ নিতে বসে গেল একটু পরে। একজন ব্যানার টাঙিয়ে দিল একটা, তাতে লেখা ‘মা নৃত্যাঞ্জলি অপেরা’। দেখে মজা লাগল মারুনার।

‘যাবে না নীচে? ওঃ তোমার তো আবার গান-টানে ইন্টারেস্ট নেই।’

মারুনার বুক ধক্ করে উঠল। গান থেকে পিয়ালীতে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না শান্তনুর। বিয়ের পর এই তাদের প্রথম যৗথ ভ্রমণ, যাকে মধুচন্দ্রিমা বলাই দস্তুর, একেবারে পলিটিক্যালি কারেক্ট, চাঁদও উঠেছে সঙ্গতি রেখে– তবু সারাক্ষণ পিয়ালী-পিয়ালী জপে কেন যে কানের পোকা বার করে দিচ্ছে লোকটা? হয় ও অতিবোকা, নয় অতি হূদয়হীন, নয় যে কী ভেবে পেল না মারুনা। সে শান্তনুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নেমে এল নীচে।

স্নান সেরে লংস্কার্ট আর কুর্তি পরেছিল। চুল খোলা, চোখে কোহল, ঠোঁটে লিপবাম, বডি পারফিউমের গন্ধটা তাকে ঘিরে রেখেছে। লনে সারি সারি পাতা চেয়ারে চাঁদের নীচে বসে তার নিজেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল। যেন শান্তনুর সঙ্গে নয়, সে একাই এসেছে। একটু পরে যাত্রা শুরু হল। গরিব বিধবা মায়ের সন্তান দুখে, সে কীভাবে বনবিবির কৃপায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেল– এই প্রচলিত লোকগল্প নিয়েই পালা। যাত্রা ফর্মটা তার কোনওদিন দেখা না থাকায় প্রথম প্রথম হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে লোকশিল্পের শক্তি টের পেল। গানে, অভিনয়ে গোটা সুন্দরবনের লোকজীবন, নদী, অরণ্য, নোনামাটি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে যখন দুখে গান ধরল ‘এই মায়ানদী ক্যামনে হব পার’– অকারণেই তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল শান্তনু কখন এসে মন দিয়ে তার ছবি তুলছে।

পালার শেষে দুখে সকলের কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করছিল। মারুনা দেখল দুখে আসলে একটি ছোটো মেয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে আর গানের গলার তো তুলনা হয় না। সে একবার ভাবল শান্তনুকে বলবে মেয়েটার ছবি তুলতে। ভয়ে বলল না। শান্তনু যদি বলে বসে পিয়ালীও সেবার এমন আবদার করেছিল।

রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও মেনু নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের সঙ্গে বেগুনি! ছোঃ! ফিশফ্রাই করতে পারল না! আর ওটা চিলি চিকেন হয়েছে? মারুনা আদৗ রাঁধতে জানে না, তাই খাওয়া নিয়ে সে কোনও সমালোচনায় যায় না। তার তো ভালোই লেগেছে। একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। সে শান্তনুকে বলে ফেলল ‘চলো না, একটু হেঁটে আসি।’

শান্তনু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, ‘চলো যাই।’

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এল। বাজার এলাকাটুকু ছাড়া পাখিরালয় একটা সাধারণ গ্রাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম হয়ে গেছে। ওরা দুজন, নদী আর চাঁদ ছাড়া কেউ নেই চরাচরে। মারুনার ভয় করছিল একটু। সে শান্তনুর পাঞ্জাবি টেনে বলল ‘চলো ফিরি।’

শান্তনু তখনি আঙুল দেখিয়ে বলল ‘ওই জেটিটা’।

মারুনা ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখল একটা পরিত্যক্ত জেটি, এই দ্বীপ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর বুকে প্রসারিত হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর মাটির নয়, জেটিটা নদীর আর চাঁদের। মারুনার খুব ইচ্ছে হল ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে। ও শান্তনুর হাত ধরে টানল, ‘চলো না, ওই জেটিটায় গিয়ে একটু দাঁড়াই।’

শান্তনু এর উত্তরে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আবার। মারুনা বুঝতে পারে আবার পিয়ালীকে নিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে ওর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, এধরনের কথায় মারুনা হার্ট হচ্ছে, তাই হয়তো বলতে পারছে না। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও জেটির দিকে ছুটে যায়। শান্তনু আঁতকে ওঠে ‘মারুনা শোনো, ওটা ভাঙা জেটি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’

মারুনা ছুটতে ছুটতেই বলে ‘ভাঙুক, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো তাই, ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে।’

শান্তনু ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে। ‘না ভাঙবে না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি আমি।’

কান্না থেমে যায় মারুনার। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! মারুনা কি কুকুর নাকি এত অপমান সয়ে পড়ে থাকবে? ‘আমি যাব, চলে যাব, বারবার এভাবে পিয়ালীর কথা বললে।‘

‘আর বলব না মারুনা, ক্ষমা, ক্ষমা, শুধু একটা কথা, শেষবারের মতো।’

জেটিটা প্রবল টানে মারুনাকে। তবু সে থমকে যায় শান্তনুর কথা শোনার জন্যে।

‘এই জেটিতে দাঁড়িয়েই পিয়ালী ওই বাস্টার্ডটার কথা আমাকে বলেছিল, যেটার সঙ্গে ও থাকে মুম্বইতে। আমি চাই না মারুনা, তুমি ওই জেটিতে যাও।’

কান্নায় জড়িয়ে আসে শান্তনুর গলা। চাঁদের আলো পড়ে সেই চোখের জলে। মারুনা অবাক হয়ে দেখে শান্তনুর চোখে নদী, তার এপার-ওপার দেখতে পায় না সে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...