মঞ্জরির আজকাল কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, অথচ আগে ও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। সেই কবে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে শিশিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সেই থেকে সংসারটা যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সংসার ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার কোনও আগ্রহই বোধ করেনি কোনওদিন।
ছেলে-মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। শিশিরও ব্যাবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকে। ছেলে অতনু এমএস করতে আমেরিকা গিয়েছিল এখন ওখানেই ও ওয়েল সেটেলড। মঞ্জরি ভালো মতোই জানে ও কোনওদিন দেশে ফিরবে না। এষা আর মঞ্জরির সম্পর্কটা ঠিক মা-মেয়ের মতো নয়। দুটিকে দেখে মনে হয় অসমবয়সি বান্ধবী। সর্বদা একসঙ্গে, দেখে মনে হয় না ওদের জীবনে অন্য কারও প্রয়োজন আছে।
অথচ এই বন্ধুত্বের মায়াও মঞ্জরিকে ত্যাগ করতে হল। আগের সপ্তাহেই এষাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসে মঞ্জরি চোখের জল কিছুতেই আটকাতে পারল না। মনে হচ্ছিল শরীরের একটা অংশ যেন কেটে নেওয়া হচ্ছে। অথচ মিলানে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার কথাটা যখন এষা জানিয়েছিল তখন সবথেকে বেশি খুশি বোধহয় মঞ্জরি-ই হয়েছিল।
শিশির অবশ্য ওকে বলেছিল মহিলাদের কোনও সংস্থার হয়ে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার জন্য কিন্তু মঞ্জরি রাজি হয়নি। ওর মনে হয় সোশ্যাল ওয়ার্কের নামে সমাজসেবা করাটা সংস্থার উদ্দেশ্য নয় বরং অর্থবান স্বামীদের অর্ধাঙ্গিনিরা নিজেদের টাইম পাস করার জন্য এই সব সংস্থায় জয়েন করে। অন্যদের মতো কার চারিত্রিক দুর্বলতা কোনটা, কে কোন গয়না কিনল বা কত টাকা গয়না কিনতে খরচ করল অথবা বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে দামি আসবাবপত্র বা নতুন ক্রকারি দেখাবার মতো মানসিকতা মঞ্জরির ছিল না। আগেও ও দুবার সংস্থার হয়ে কাজ করেছে কিন্তু পুরোটাই ছিল দুঃস্থ পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ। বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন কাটাতে ওর খুব ভালো লাগত। ও যেন নিজের শৈশবে ফিরে যেতে পারত, ভুলে যেত পঞ্চাশের কোঠা ও পার করে ফেলেছে। কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে সংস্থা যখন ওকে ছাড়তে হয়েছিল তখনকার স্মৃতি ওর কাছে মোটেই মধুর ছিল না। সংস্থার অন্যান্য সদস্যরা ওর এই হঠাৎ ছেড়ে দেওয়াটা ভালো চোখে দেখেননি এবং এই বিষয়ে কিছু কটূক্তি শুনতেও মঞ্জরি বাধ্য হয়েছিল।
এষা চলে যাওয়ার পর সময় কাটাতে মঞ্জরি প্রায়শই বাড়ির কাছের পার্ক-টায় গিয়ে বিকেলে বসত। বাচ্চাদের খেলাধূলো দেখতে দেখতে বেশ সময়টা কেটে যেত। একদিন পার্কে বসে মোবাইলে এষার পাঠানো ছবিগুলোতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল মঞ্জরি, হঠাৎই ধ্যানভঙ্গ হল একটি কণ্ঠস্বরে, ‘এক্সকিউজ মি’।
চমকে তাকাতেই দেখল সামনে ২৯ বছর বয়সি একজন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটি বেশ লম্বা এবং হ্যান্ডসাম। বেঞ্চে পাশে রাখা মঞ্জরির পার্স-টা সরাতে অনুরোধ করছে। পার্সটা সরাতেই যুবকটি মঞ্জরির পাশে এসে বসল।
মিনিট পাঁচেক এইভাবেই কাটল দু’জনের। কেউ কাউকে চেনে না। যুবকটি মাঝেমধ্যেই অধীর আগ্রহ নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে কারও যেন অপেক্ষা করছে। মঞ্জরি কোতূহল দমন করতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, ‘কারও অপেক্ষা করছেন?’
মঞ্জরি প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যুবক সুতরাং তাকে প্রশ্ন করার অধিকার ওর নেই। নিশ্চই যুবকটি বিরক্ত হয়েছে ওর আচরণে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, যুবকটি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মঞ্জরি-কে বলল, ‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… আমি একজনের আসার অপেক্ষা করছি… কিন্তু আপনি একলা নাকি?’
‘হ্যাঁ… বাড়িতে ভালো না লাগলে এখানে এসে একটু বসি। আমার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত মানুষ শুধু আমি ছাড়া। হয়তো আপনজনের সঙ্গ পাওয়ার আশায় এখানে এসে বসে থাকি’, মঞ্জরির কথায় হতাশা ফুটে উঠলেও একটু মজার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলল।
‘হয়তো… হয়তো এটাই ঠিক। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডের অপেক্ষা করছি। অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না বলে হাফ গার্লফ্রেন্ড বলাটাই ভালো। ও বাচ্চাদের হোস্টেলে অফিসার ইনচার্জ। ওর প্রচুর কাজ থাকে সুতরাং টাইমে কোনও দিনই আসতে পারে না’, পাশে বসা মঞ্জরিকে মনের কথা খুলে বলে যুবকটি। মঞ্জরির ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতা অনুভব করে ও যে, নিজের কথা বলতে দ্বিধা করে না। নিজের পরিচয় দিয়ে নামটা বলে মঞ্জরিকে, ‘আমার নাম সম্রাট, আর আপনার?’
‘মঞ্জরি’, একটু ইতস্তত করে মঞ্জরি নিজের পরিচয় দেয়।
‘আপনার গার্লফ্রেন্ডের নামটা কি আর কেনোই বা ও এখনও আপনার হাফ গার্লফ্রেন্ড?’
‘ওর নাম রিয়া… মুম্বইতে আমরা ক্লাস সেভেন অবধি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। তারপর ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কলকাতায়। হঠাৎ-ই তিনমাস আগে ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়। প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও একে অপরের পরিচয় দিতেই বুঝতে পারি যে ও আমার পুরোনো পরিচিত। ব্যস, তারপর থেকেই মেলামেশা শুরু হয়। আমরা দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করি কিন্তু এখনও কেউ কাউকে ওই তিনটে ম্যাজিক শব্দ বলে উঠতে পারিনি।’ মঞ্জরিকে এত কথা বলতে গিয়ে সম্রাট কিছুটা লজ্জা বোধ করে।
‘তাহলে তো তুমিও রিয়ার হাফ বয়ফ্রেন্ড, তাই না?’ মঞ্জরি বুঝতে পারে ছেলেটির সঙ্গে গল্প করতে ওর বেশ ভালো লাগছে।
‘না… না একদমই না কারণ রিয়া আমার মনের কথা খুব ভালো করেই জানে। আমি অত রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না কিন্তু ম্যাডাম… বাপরে, পুরোনো দিনের সাইলেন্ট মুভির হিরোইন। আগেও যেমনি নায়িকারা নায়কদের নিজেদের পিছনে ছুটিয়ে মারত এখনকার মেয়েরাও ছেলেগুলোকে বাধ্য করে পিছনে পিছনে দৌড়োবার জন্য।’ সম্রাটের এই শিশুর মতো স্বীকারোক্তি মঞ্জরির হৃদয়ে স্নেহের উদ্রেক করে। ওর প্রতি কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করে মঞ্জরি।
‘সম্রাট, তুমি যা বললে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের উপর। আমি কোনওদিন কাউকে আমার পিছনে দৗড় করাইনি। যেদিনই বুঝেছিলাম শিশিরকে ভালোবাসি, সেদিনই সময় নষ্ট না করে ওর কাছে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। শিশির কেন, আমি কারও কাছেই মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। আমার সন্তানই হোক বা বন্ধু, সকলের কাছেই আমার ফিলিংস পরিষ্কার হয়ে যায়।’ মঞ্জরি কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে পড়ে।
‘ঠিকই বলেছেন, আমিও চুপ থাকতে পারিনি। রিয়াকে পরিষ্কারই নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। এখন ওর মুখ থেকে শুনতে চাই আমার প্রতি ওর কী ফিলিংস’, উত্তেজিত হয়ে পড়ে সম্রাট।
‘সম্রাট, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটার জন্য লোকে আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে। কিন্তু এটার জন্য জীবনে অনেক কিছু শিখেওছি। রিয়ার মনের কথা কীভাবে বার করবে আমি তোমাকে বলে দেব… ঠিক আছে?’
‘ডিল?’
‘ডিল!’
দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে মঞ্জরি বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে।
সেক্টর ফাইভে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সম্রাট ভালো পদে কাজ করে। ও একাই কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে। মা-বাবা দুজনেই মুম্বই থাকেন। সম্রাটের স্বভাব মিশুকে হলেও খুব কমজনই ওর হূদয় অবধি পৌঁছোতে পারত। বন্ধু বাছার ব্যাপারে ও খুব চুজি ছিল। মঞ্জরির স্নেহশীল ব্যবহারে সম্রাট ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। দুজনের মধ্যে প্রায়শই দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে, ফোনেও দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে।
মঞ্জরির সঙ্গে দেখা হলেই, সম্রাট হাজারো মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্যা মঞ্জরির সামনে উজাড় করে দিত সমাধান পাওয়ার আশায়। মঞ্জরিও ধীর ভাবে সম্রাটের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত। রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন যখনই সম্রাটের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠত, মঞ্জরি তৎক্ষণাৎ গভীর ব্যাখ্যার মাধ্যমে রিয়া সম্পর্কে সম্রাটের মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করে দিত।
সম্রাট বুঝে গিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ মঞ্জরির কাছে আজও প্রেম শব্দটার একটা গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। বয়সের সাথে সাথে মঞ্জরির জীবন থেকে প্রেম দূরে সরে যেতে পারেনি। তাই সম্পর্কের মাধুর্য আজও মঞ্জরিকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রেমকে অবহেলা করলে মঞ্জরি সেটা সহ্য করতে পারে না। তবে মঞ্জরির মূল্যবোধগুলো জীবনের প্রান্তে এসে অনেক বেশি পরিপক্ব যার প্রশংসা সম্রাটকে মনে মনে করতেই হয়। মঞ্জরির স্নেহধন্য হয়ে সম্রাট মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি লাভ করে। মঞ্জরিও সম্রাটের উৎসাহে প্রভাবিত হয়ে মনের মধ্যে এক উদ্দাম শক্তির প্রকাশকে অনুভব করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দুজনে এক অজানা সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে লাগল।
প্রায় একমাস বাইরে বাইরে থাকার পর শিশির বাড়ি ফিরে নতুন এক মঞ্জরিকে আবিষ্কার করল। এই মঞ্জরি অনেক বেশি হাসিখুশি। লাল কেপ্রির উপর লম্বা ক্রিম কালারের কুর্তা পরে, পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে যে মেয়েটি শিশিরকে স্বাগত জানাল সে যেন তিরিশ বছর আগের ফেলে আসা মঞ্জরি।
সুটকেশ হাতে করে নিজের ঘরে ঢুকতেই শিশির দেখল খাটের পাশে রাখা সোফাটায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে একজন অচেনা যুবক। শিশির কিছু বলার আগেই মঞ্জরি কফির ট্রে সাজিয়ে ঘরে ঢুকল। শিশিরের সঙ্গে সম্রাটের পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার বন্ধু সম্রাট।’
শিশিরকে অবাক হতে দেখে এবার সম্রাটই কথা বলল, ‘জানি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন কারণ আমাদের বয়সের অনেকটা তফাত। তবু আমিও এই সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বই বলব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? আমি ওনাকে আমার বন্ধু বলতে পারি?’ সম্রাটের সরলতা মুহূর্তে শিশিরের মন জয় করে নিল।
‘শুধু বন্ধু বললেই হবে, মন থেকেও তো ওকে বন্ধু বলে মেনেও নিতে হবে। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে ও এমন একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে যাতে আমাদের ম্যাডাম দুনিয়াদারি সব ভুলে গিয়েছে। যাক একটা ভালো হয়েছে, এবার থেকে কলকাতার বাইরে গেলে মঞ্জরিকে নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।’ শিশির সম্রাটের পিঠ চাপড়ায়। কফি খেতে খেতে তিনজন গল্পে বুঁদ হয়ে যায়। সময়ের খেয়াল থাকে না কারওরই।
রিয়াকে নিয়ে সম্রাটের চিন্তা দেখে মঞ্জরি মাঝে মাঝে না হেসে পারত না। রিয়ার মনের কথা জানার জন্য সম্রাট ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নিজেদের সম্পর্কটাকে একটা নাম দেওয়ার অধীর অপেক্ষায় থাকত। মঞ্জরি সম্রাট-কে রিয়ার সামনে একটু রিজার্ভ থাকার পরামর্শ দিল যাতে রিয়া নিজে থেকে সম্রাটের প্রতি ইন্টারেস্ট নেয়। মঞ্জরির কথা মেনে সম্রাট রিয়াকে বারবার ফোন আর মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। কাজের প্রেশারের দোহাই দিয়ে হোয়াট্সঅ্যাপ থেকেও নিজের নাম তুলে নিল। এতে ভিতরে ভিতরে সম্রাট কিছুটা আন-ইজি ফিল করলেও শেষমেশ ও যা চাইছিল তাই হল।
কফি শপে মুখোমুখি বসে দুজন। সম্রাট চাইছিল রিয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে। মঞ্জরির কথা মনে পড়ল। নিজেকে রিয়ার চোখে কাচের মতো পরিষ্কার করে তুলে ধরার দিন শেষ। নিজের আঙুলগুলো নিয়েই খেলা করতে লাগল সম্রাট। রিয়া একটু অবাকই হল। ওর সামনে সম্রাটকে এতটা চুপচাপ হয়ে থাকতে কোনওদিন দেখেনি। ওর অনর্গল কথার স্রোতের মাঝে লাগাম লাগাবার কাজটা রিয়াকেই করতে হতো। সম্রাটই মুখ খুলল তবে নিজের কথা দিয়ে নয়। অফিসের নানা সমস্যা, তাই নিয়ে কথা। চুপচাপ খানিক্ষণ শোনার পর রিয়া বোর হতে শুরু করল, ‘প্লিজ সম্রাট… অফিসের কথা ছাড়ো না। বরং তোমার ছোটোবেলা, কলেজের কথা বলো। স্কুলে তোমাকে দেখেছি, তখন তুমি খুব চুপচাপ থাকতে।’
‘উফ! আবার আমার লাইফের বোরিং অধ্যায়গুলো’, কপট বিরক্তি প্রকাশ করল সম্রাট।
‘আমার তো খুব ভালো লাগে তোমার সম্পর্কে জানতে।’
‘রিয়েলি… কিন্তু আমার কথা ভালো লাগার নিশ্চয়ই একটা কারণ তো হবে?’ আশা জাগে সম্রাটের মনে।
‘সব কিছুর কি কারণ থাকতেই হবে… তোমার চিন্তাধারাই অন্যরকম।’
‘আমার উপর রাগ করে কি লাভ? আমাকে তুমি ভালোবাসো, এই কথাটা তুমিই বলতে পারছ না উলটে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ।’
‘সব কথা মুখে বলার দরকার পড়ে না। আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে চাপ সৃষ্টি করেছি? তোমার কথায়, মেসেজে সব পরিষ্কার এমনিতেই হয়ে গেছে’, রিয়া হাসি চাপতে পারে না।
সম্রাট এবার সত্যি রেগে যায়, ‘হ্যাঁ, আমি মানুষটাই এরকম। মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। অথচ এতদিন হয়ে গেল তুমি সেই
মা-বাবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই রয়ে গেলে।’
‘আরে বাবা… এত রাগ। ঠিক আছে, আজ থেকে আমি তোমার ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। কি… আশ্রয় দেবে তো?’
আনন্দে সম্রাট রিয়ার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। মনে মনে মঞ্জরিকে ধন্যবাদ জানায়। সাফল্যের এই রাস্তা তো ওই সম্রাটকে চিনিয়ে দিয়েছে।
বাড়ি পৌঁছেই সম্রাট মঞ্জরিকে ফোন করল। কিন্তু ফোনে মঞ্জরিকে না পেয়ে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে ও শুয়ে পড়ল। সকালেও কোনও উত্তর না দেখে আবার ফোন করতে লাগল কিন্তু কোনও সাড়া নেই। এবার চিন্তা হতে শুরু করল সম্রাটের। শিশির শহরের বাইরে সুতরাং দূরে কোথাও যাবে না মঞ্জরি। তাহলে ফোন ধরছে না কেন? ঠিক করল অফিস যাওয়ার আগে একবার মঞ্জরির বাড়ি হয়ে যাবে। গাড়ি বার করতে যাবে এমন সময় মঞ্জরির ফোন এল। মঞ্জরি জানাল গতকাল থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না।
‘আমি এক্ষুনি আসছি’, বলে সম্রাট গাড়ি বার করল। রিয়াকে ফোন করে জানাল যে, একজন বন্ধু অসুস্থ হওয়াতে ও তার বাড়ি যাচ্ছে। ওখান থেকেই অফিস চলে যাবে আর বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পারলে ও যেন রাগ বা চিন্তা না করে।
মঞ্জরির বাড়ি গিয়েই প্রথমে ওর কাছ থেকে ডাক্তারের ফোন নম্বর নিয়ে ডাক্তারকে কল করল। মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করে সম্রাট অফিস গেল। বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করল। সম্রাটের সঙ্গে দেখা হতেই রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বন্ধু কেমন আছে?’
‘মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম। এবেলা অনেকটা ভালো।’
‘তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ।’
‘হ্যাঁ, মঞ্জরি তো আমার বন্ধু।’
‘মানে?’ রিয়ার গলায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ে।
‘মানে, তোমারও কি মনে হয় যে একজন পুরুষ কখনও কোনও মেয়ের বন্ধু হতে পারে না?’ খুব সিরিয়াস শোনায় সম্রাটের কণ্ঠস্বর।
‘সম্রাট, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন আধুনিকা। নিশ্চই বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু ৫০ বছর বয়সি কাকিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব? এটা একটু বাড়াবাড়ি হল না… আই কান্ট বিলিভ ইট…’ বলে রিয়া উঠে দাঁড়াল।
মঞ্জরির বাড়ি হয়ে সম্রাট তাড়াতাড়িই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। খুব ক্লান্ত বোধ করছিল সম্রাট। সারাদিনের ছোটাছুটি, স্ট্রেস তার উপর রিয়ার অবুঝের মতো ব্যবহার। রাগে সম্রাটের মাথাটা দপদপ করছিল। ও একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকাল সকাল মঞ্জরি ফোন করল ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। অনেক সুস্থ শোনাচ্ছিল ওর গলা। কিন্তু সম্রাটের গলা শুনে ভালো লাগল না মঞ্জরির, ‘কী হল সম্রাট? মন ভালো নেই নাকি? রিয়া ভালো আছে?’ মঞ্জরির গলা চিন্তিত শোনাল।
‘মঞ্জরি, রিয়া বড্ড ছেলেমানুষ। ও কি সত্যিই কোনওদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারবে আমার সঙ্গে?’
‘কেন নতুন করে কী হল আবার?’ মঞ্জরি এটা জিজ্ঞেস করতেই সম্রাট গতকালের পুরো ঘটনা খুলে বলল ওকে।
‘সম্রাট এতে রিয়ার কি দোষ? আমরা এমন সংস্কার নিয়ে বড়ো হই যে নিজেদের স্বাধীন ভাবে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না। সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার কিছু লোক এমন কিছু নিয়ম শৃঙ্খলে আমাদের মনটাকে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা সেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে ভয় পাই। সারা জীবনই সেটা অাঁকড়ে বেঁচে থাকতেই ভালোবাসি। রিয়াকেও একটু শুধু বোঝাতে হবে। তুমি চিন্তা কোরো না প্লিজ… দেখছি এখন কী করা যায়’, মঞ্জরির কথায় সম্রাট আশ্বস্ত হয়। ফোন রেখে দেয় মঞ্জরি।
দুদিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে মঞ্জরি। সুস্থ হতেই দোকানে গিয়ে প্রচুর চকোলেট কিনে সম্রাটের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে, রিয়া
যে-বাচ্চাদের হোস্টেলের ইনচার্জ, সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়। ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে চকোলেট বণ্টনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেই ওর আশা মতো ওকে হোস্টেলের ইনচার্জ রিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফরসা, তন্বী চেহারার যে-মেয়েটির কাছে মঞ্জরিকে নিয়ে যাওয়া হল সেই মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সম্রাটের কাছে কোনওদিন ছবিও দেখেনি মেয়েটির কারণ সম্রাটের ইচ্ছা ছিল রিয়ার সঙ্গে ওকে মুখোমুখি আলাপ করিয়ে দেবে। মনে মনে রিয়ার সৗন্দর্যের প্রশংসা করল মঞ্জরি। মঞ্জরি নিজের নাম বলল না। ও জানত রিয়া ওকে সামনাসামনি কখনও দেখেনি। সুতরাং ওকে দেখেও রিয়া কিছুতেই চিনতে পারবে না।
রিয়া মঞ্জরিকে হোস্টেলের খেলার মাঠটায় নিয়ে গেল। ওখানেই হোস্টেলের সব বাচ্চদের একত্রিত করা হল। বেশিরভাগই পাঁচ থেকে দশ বছর বয়স। ওখানে যেসব বাচ্চারা থাকে তাদের
থাকা-খাওয়া-জামাকপড় আর পড়াশোনা করাবার সুব্যবস্থা একটি এনজিওর উপর। রিয়া মঞ্জরিকে বলল, ‘জানেন ম্যাডাম, এদের সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কাটে। ওদের থেকেই আমি শক্তি ও সাহস পাই। জীবনের একটা নতুন দিশার সন্ধান ওদের মাধ্যমেই আমি খুঁজে পেয়েছি।’
বাচ্চাদের প্রতি রিয়ার ভালোবাসা মঞ্জরিকে মুগ্ধ করল। রিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি বাচ্চা এগিয়ে এসে রিয়ার দিকে একটি চকোলেট বাড়িয়ে দিল, ‘ম্যাম এটা আপনি খান।’ রিয়া সামান্য একটু ভেঙে নিয়ে বাকিটা ওর হাতে ধরিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করল আর ওকে খেলতে পাঠিয়ে দিল।
‘ওর নাম শ্রেষ্ঠ। একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর মা-বাবা মারা যায় আর ওর চোখও নষ্ট হয়ে যায়। কেন জানি না, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওর দুঃখ দেখতে পারি না, বাচ্চাটার প্রতি অসম্ভব একটা টান অনুভব করি। আমারও কোনও কষ্ট হলে আমাকে ছুঁয়ে ও বলে দেয় যে আমার মন খারাপ। আমাকে খুশি করার সবরকম চেষ্টা করতে থাকে।’
‘সত্যিই… খুব দুঃখের। তবে একটাই ভালো হয়েছে সে তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।’
‘আমি জানি না ম্যাডাম এটা আপনি কতটা বুঝবেন… শ্রেষ্ঠ আর আমি একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এত ভালো বন্ধু আমার আর নেই’, মঞ্জরির কাছে রিয়ার নিজেকে তুলে ধরতে কোনও অসুবিধা হল না। মঞ্জরির মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য।
‘তাহলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর পরেও তুমি কি চাইবে না যে, তোমাদের বন্ধুত্বটা এরকমই অটুট থাকুক? পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেই কি তোমার জীবন থেকে বন্ধুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? একটা বয়সের পর মনের চাহিদা কি সত্যিই দাবিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়? ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ যদি আজকের মতোই তোমাকে ভালোবাসে, একাত্মতা অনুভব করে, তাহলেও কি বয়সের এতটা তফাতের কথা মনে রেখে তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা কমিয়ে ফেলতে হবে? সম্পর্কটা তখন বদলে বন্ধুত্ব থেকে অন্য কিছু হয়ে যাবে? কী নাম দেবে সেই সম্পর্কটার? হয়তো কোনও-ই নাম নেই সম্পর্কটার, সেই ক্ষেত্রে তুমি কী করবে রিয়া?’ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মঞ্জরি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।
‘ভালোবাসাটা তো একইরকম থাকবে, আমার দিক থেকেও আবার শ্রেষ্ঠর দিক থেকেও। আর নাম… সম্পর্কটার নাম তো বন্ধুত্বই থাকবে। এখনও তাই। পরেও ব্যাপারটা একই…’, রিয়াকে চিন্তিত লাগে।
‘যদি শ্রেষ্ঠ আর তোমার সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব বলা যায় তাহলে সম্রাট আর মঞ্জরির সম্পর্কটাকে নয় কেন…?’ বলতে বলতে মঞ্জরির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চেপে রাখা অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে ওর দু’চোখ বেয়ে।
সময় গড়িয়ে চলে। দু’জনেই বসে থাকে চুপচাপ। মঞ্জরি-ই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, ‘আমি আজ উঠি রিয়া। কাল আমার বাড়িতে এসো। সম্রাটকে ওখানেই ডেকে নেব। প্রচুর গল্প করার আছে তোমাদের সঙ্গে।’ রিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে মঞ্জরিকে বিদায় জানায়।
রিয়ার মনে হল আজ ওর সামনে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হল। অপরকে ভালোবাসা, তার জন্য চিন্তা করা, ত্যাগ, আকর্ষণ ইত্যাদি মানুষের সুকোমল বৃত্তিগুলিরই অন্য নাম। এগুলির একত্রে সমাবেশই গড়ে তোলে বন্ধুত্ব সুতরাং এটা সম্পূর্ণই মনের সম্পদ। একজন মানুষের মন একটাই হয়… বন্ধুত্ব কেন তাহলে মনের না হয়ে বয়সের উপর নির্ভর করবে?
সঙ্গে সঙ্গে রিয়া সম্রাটকে মেসেজ করল, সম্রাট…
সম্পর্কের গভীরত্ব এতদিন আমি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনি। কোনও সম্পর্কই ফুরিয়ে যাওয়া উচিত নয় জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত। আমার ইচ্ছে তোমার এবং মঞ্জরির বন্ধুত্ব সারাজীবন সুরভিত হয়ে থাকুক। আজ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সেরা উপরহাটা হল ‘বন্ধুত্ব’।
ইতি তোমার রিয়া।