বকুলগাছটার ভেতরে কী ছিল কে জানে! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই গাছটা কেমন যেন মোহময়ী রহস্যের ঘোমটা পরে নিত। তখন তার পাতায় পাতায় হিল্লোল। ডালপালায় দু’হাত বাড়ানো আর্তি। ইমন এসব ছোটোবেলায় বুঝত না। ধীরে ধীরে পরত খোলার মতো জেনেছে নিজের অনুভূতি দিয়ে। পুরো বর্ষাকাল এখন তাকিয়ে থাকে বকুলগাছটার পাতার দিকে। গাঢ় সবুজ পাতার প্রান্তে সামান্য কোঁকড়ানো ভাব, স্থূল চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে দেখলে, যেমন সব মেয়ের লম্বা চুলেই ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের বকুলগাছের সব পাতাতেই তেমন প্রান্ততরঙ্গ দেখা যাবে, ইমন লক্ষ্য করেছে।

– এই ইমন, ইস্কুল যাবি না?

ইমনের মা প্রতিভা মেয়ের কাছে জানতে চায়। ইমনের আজ স্কুলে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। স্কুলে পড়াশোনা বিশেষ হবে না। নাম কা ওয়াস্তে স্কুল। তাই যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা নেই। আবার সিএল-ও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিছুটা সময় নিয়ে ইমন নিজেকে রাজি করায় স্কুলে যাওয়ার পক্ষে।

– হ্যাঁ মা, যাব। তুমি ওয়াড্রোব থেকে কমলা ঘিয়ে পিত্তর সিল্কটা বের করে রাখো। আর কালো ব্লাউজটা। আমি বাথরুমে গেলাম।

– কোনটা বলতে কোনটা বের করব! তুই এসেই বের করিস।

প্রতিভা ঈষৎ বিরক্ত হয় মনে মনে। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না। শাড়ি ব্লাউজ বার করে দিতে তার অসুবিধা নেই কিন্তু ঠিক ঠিক কোনও দিনই বার করতে পারে না।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে ইমন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, তবে তোমার পছন্দের শাড়ি একটা বেছে দাও। যেটা পরলে তোমার মেয়েকে যে-কোনও পাত্রের একবারেই পছন্দ হয়ে যায়।

– সে ভাগ্য কি আমার হবে! তোর বাবা থাকলে এত চিন্তা করতাম না!

ইমন মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। হড়াৎ করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তার দেরিও হয়ে গেছে। ন’টা কুড়ির শিয়ালদা লোকালটা ধরতে হবে। হাতে আর মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ মিনিট। এই ট্রেনটা মিস করলে পরেরটা ন’টা পঞ্চাশে। বলরামপুর স্টেশন থেকে বারুইপুর এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। স্কুল অবশ্য স্টেশনের কাছেই। রিকশায় পাঁচ মিনিট আর হাঁটলে মিনিট দশেক। আজকাল লোকের যা চাপ গাড়ি ঘোড়া চালানোই যায় না। ইমন অবশ্য রোজ রিকশাতেই যায়। লোকের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি তার ঠিক পছন্দ হয় না। গা চিড়বিড় করে যেন। অবশ্য ট্রেনের কথাটা আলাদা। উপায় নেই। তবুও সে চেষ্টা করে লেডিজ কম্পার্টমেন্ট ধরতে।

হাতে সময় না থাকলে মানুষ বাথরুমে ঢুকেই জামাকাপড় খুলে ফেলে। তারপর ঝপাৎ ঝপাৎ জল ঢালে শরীরে। নগ্নতার গা মোছে। কিন্তু ইমন সেটা পারল না। বাথরুমের জানলা দিয়ে বকুলগাছটা দেখা যায়! আজ ইমনের চোখে পড়ল বকুলগাছটা কেমন চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যদিনের থেকে বেশ অন্যরকম তাকানো। ইমন কিছুতেই সালোয়ার খুলতে পারে না। কোনওদিনই পারে না। ইমন আজ বাথরুমের ছোটো জানলাটা বন্ধ করে। খুব লজ্জা পাচ্ছে আজ তার। জানলাটা বন্ধ করার পরেও সে জামাকাপড় পরেই স্নানটা সারে। বাথরুম থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে যেন বাঁচে। বকুলের চোখের আড়াল না হলে লজ্জা যেন যাবার নয়।

অনেকটা জায়গা নিয়ে ইমনদের বাড়ি। বাড়ির পরেই পরিখা। আসলে লম্বা খালের মতো চারদিকে চারটে পুকুর। বাবা খুব গর্ব করে পুকুরগুলোকে পরিখা বলত। তাই ইমনও পরিখা বলে। সেই পুকুরগুলোর চওড়া উঁচু পাড়। সেই উঁচু পাড়ে নানান বৃক্ষের সমাবেশ। শিরীষ, সেগুন, সোনাঝুরি, অর্জুন, কদম প্রভৃতি দামি কাঠের গাছগুলো পুকুরের বাইরে সার সার দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রহরী। তাদেরই মধ্যে পশ্চিম দিকে ইমনের প্রিয় বকুল গাছ ঝাঁকড়া হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। বকুলগাছটা ইমনের বাবারও প্রিয় ছিল। আলাদা ভাবে যত্ন করত বকুলগাছটার, ইমনের মনে আছে। আর মনে আছে একটা কথা। গাছটা বসানোর দিনেই বাবা কাউকে ফোনে বলছিল, গাছটা যতদিন বাঁচবে তোমাকে পাব!

পরিখার ভেতরে যত ফলের গাছ। নানান আমগাছ। এমনকী একটা আলফানসো আমেরও গাছ বসিয়েছিল ইমনের বাবা। কোথা থেকে কিনে এনেছিল ইমন জানে না। ইমন তখন খুব ছোট্ট। ক্লাস থ্রি। জাম, লিচু, জামরুল, সবেদা, চালতা, ডেয়াঁ ফল। এমন ফল নেই তাদের বাগানে, যা এ অঞ্চলে ফলে না। ইমনের সামনেই গাছগুলো বড়ো হল, এখন ফল দিচ্ছে। সব ঠিকঠাক। যেমন যেমন বাবা বলেছিল, দেখিস আম ফলবে আগে, তারপর লিচু, হয়তো সে বছরই জাম ধরবে। চালতার একটু দেরি হবে। সবেদা অল্প অল্প দু’বছর পর থেকেই ফলবে। সব বাবার কথামতোই ফল দিচ্ছে। শুধু বাবাই হঠাৎ করে চলে গেল। দুদিনের ধুম জ্বর। ডাক্তার, হসপিটাল করার আগেই সব শেষ।

ইমনের তখন ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। চেনে না জানে না এমন সব লোক বাবার বসানো গাছগুলোর গায়ে উঠে পড়ছে যেন। গাছগুলো তখনও বেশ ছোটো। ধাক্বা মারলে ভেঙে যাবে। ইমনের খুব রাগ ধরছিল লোকগুলোর উপর। তার থেকেও বিস্ময়। এত লোক কেন! দৗড়ে ঘরে ঢুকে দেখে বাবা বিছানায় নিস্পলক শুয়ে। সেই প্রথম মৃত্যু-ছুঁয়ে দেখে ইমন। তবু তার মনে যে-প্রশ্নটা প্রথম জাগে, সেটা বকুলগাছটা নিয়ে। বাবার থেকে জানা হল না, বকুলগাছটা কার নামে বসানো!

বাবা মারা যাওয়ার পর বকুলগাছটার যত্ন নিতে শুরু করে ইমন। কিন্তু বৃক্ষের যত্ন কিবা! যত্ন নেবার কিছুই নেই। ইমন লোক দিয়ে বকুলগাছটার গোড়ার মাটি কুপাতো। মা হাঁ হাঁ করে উঠত! কাঠের গাছের অত যত্ন নিতে হবে না!

তবু ইমন লুকিয়ে সার কিনে আনত। বোনডাস্ট। ছড়িয়ে দিত বকুলতলায়। কিন্তু বকুলের শিকড় তো অনেক গভীরে! তার জল হলেই চলবে। তবে গভীর শিকড়ে বকুলটা আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিচ্ছিল ইমনকেও। ইমন প্রথম দিকে গাছটার প্রতি বাবার ভালোবাসার কথা ভেবে যত্ন করত। বাবার কোনও গোপন মানুষের কথা ভেবে হয়তো বসানো।

সে মাকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। তার মা বকুলগাছটা সম্বন্ধে কিছুই জানত না। তাছাড়া মা তখন সদ্য বিধবা হয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম। ঢেউ-এর মাথায় পানসি নৗকার মতো চলছে কোনওক্রমে তাদের সংসার। ইমনের বাবার দোকান বিক্রির টাকায় আর বাগানের ফলমূল বেচে কত আর চলে সংসার। সোনায় হাত পড়ে বছর বছর। প্রতিভার বকুল নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় কোথায়! ইমন হয়েছে বাবার মতো! ইমনের বাবার মোড়ের মাথায় স্টেশনারি দোকান ছিল। লাভ ছিল ভালোই। কিন্তু লাভের থেকে বাবার খরচ ছিল বেশি। তাছাড়া দোকানের টাকা জমিয়েই তো বাবা সখের এই বাড়ি বাগান করেছিল।

একটু বড়ো হতে, ক্লাস টেন ইলেভেনে উঠতে বকুলগাছটার ফুল ফোটে, ফল হয়। পাকা ফল বকুলগাছের গোড়ায় বিছিয়ে পড়ে থাকে। বিস্কুট রঙের ফল অনেকটা খেজুরের মতো। বকুলফুলের কী সুবাস। প্রাণ ভরে যায় যেন। তখন থেকে বকুলগাছটা তার কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। বাবার প্রিয় মানুষ, কিংবা তার নিজস্ব বন্ধু। বকুলগাছটা যেন তখন থেকেই কথা বলে ইমনের সঙ্গে। ইমন তখন থেকে একটু একটু বুঝতে শেখে বকুলের ভাষা।

– এই ইমন, দিনরাত বকুলতলায় কী করিস তুই?

ছোটোবেলায় ইমন সঙ্গীর অভাবে খেলতে পেত না। কিন্তু তার খেলার সঙ্গীর অভাব হয়নি। বাগানের সবকটা গাছ ছিল তার বন্ধু। বিশেষকরে বকুলের সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব। বকুলটাকে নিয়েই সে পুতুল খেলত। তখন খুব মোটা হয়নি। ফুট খানেক বেড় আর সবে সবে বাড়ির দোতলা ছুঁয়েছে তখন। গাছের গোড়ায় কাপড়ের বেড় দিয়ে শাড়ি পরাত। কখনও ইমন বকুলকে মেয়ে করে বিয়ে দিত বাগানের সেগুন গাছের সঙ্গে। আবার কখনও বকুলকে নিয়ে নিজেই বর-বউ খেলত। কখনও সে বউ, কখনও বকুল। তার সময় কেটে যেত কোনও বন্ধু ছাড়াই।

– আসছি মা!

আসছি বলেও ইমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত বকুলগাছটার সঙ্গে।

ইমনের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা অন্য একটা কারণেও নেই। সুমনবাবু স্কুলের নতুন ম্যাথের টিচার। মাস ছয়েক জয়েন করেছে। ইমনের থেকে টিচার হিসাবে জুনিয়র। কী নাকি বিসিএস দেবে বলে টিচারি নেয়নি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে স্কুলে ঢুকে বিসিএস-এর জন্যও পড়ছে। ক’মাসেই স্কুলে খুব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তো সুমনবাবু বলতে অজ্ঞান।

যদিও কো-এড স্কুলে ছাত্রীরা সবথেকে পছন্দ করে তাদের সুন্দরী কেমিস্ট্রি টিচার ইমনকে। কিন্তু ছাত্রীরা তো আর ছেলেদের মতো হই হই করে জানান দিতে জানে না। তারা ইমনকে ভালোবাসে গোপনে, মনে মনে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখে। ছাত্ররা সেই মাথায় করে রাখা সুমনবাবুর সঙ্গে ইমনদির তুলনা করে। কে বেশি ভালো তাই নিয়ে। আর প্রতিবার নিজেরাই জিতিয়ে দেয় সুমনবাবুকে। এইসব ইমনের একদম ভালো লাগত না প্রথম প্রথম। তখন ভাবত জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে! এই স্কুলে আর না।

তারপর ঘটনা বদলে গেল অন্যদিকে। ছাত্রদের প্রিয় সুমনবাবু কয়েক মাসেই ইমনদির সঙ্গে এক রিক্সায় স্টেশন থেকে স্কুলে যেতেই ইমনের স্কুলটা আবার ভালো লাগতে শুরু করে। কিন্তু ছেলেটার বড্ড তাড়া। সব যেন একদিনেই চায়। গ্রীষ্মের শুরুতে স্কুলে জয়েন করল। বর্ষা পড়তে না পড়তেই ইমনকে প্রপোজ করে বসে। আর সারাটা বর্ষা জ্বালাচ্ছে, কী হল ইমন আমাকে চুমু দেওয়ার?

আরে বাবা বললেই কি সবাই এত দ্রুত সব কিছু পারে? ইমন ছোটোবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। সুমনের সব কথায় চুপ থাকা মানে কি যে ইমন তার সব কথা মেনে নিয়েছে! যদিও ইমনের সুমনকে খুব ভালো লাগে। ইমনের বাবার মতোই দিলদার হাসি। দেখতেও সুন্দর। ম্যাথে মাস্টার্স করা। যে-কোনওদিন বিসিএস লাগিয়ে দেবে। পাত্র হিসাবে সত্যিই ভালো সুমন। কিন্তু ইমন যেই সুমনের কথা ভাবে, বিশেষকরে বাড়িতে থাকলে, বকুলগাছটার পাতায় পাতায় মন খারাপের পলক পড়ে। ইমন বুঝতে পারে।

ইমন এক পা বাড়ায় সুমনের দিকে আর বাড়ি ফিরেই দু’পা পিছিয়ে যায় বকুলগাছটার কথা ভেবে। সে বকুলগাছটাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। পুরো বর্ষাটা সে ভাবছে উচ্ছল সুমনকে কী বলবে! হ্যাঁ বলাটাই স্বাভাবিক। তবু বকুলগাছটা পিছনে টানছে খুব। আজ আবার সুমনের নানান পরিকল্পনা ইমনকে নিয়ে। শিক্ষকদিবসের তাড়াতাড়ি ছুটিতে ওকে নাকি মুখ ফুটে জানাতেই হবে, ভালোবাসি।

ইমন মাকে কিছুই বলে না। প্রতিভা একটুতেই উৎকণ্ঠিত হয়। না হলে আজকের দিনে মাত্র সাতাশ বছরের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ মাথায় ভাদ্রের তালপড়া ব্যথা নিয়ে চিন্তা করে না। ইমন সুমনের কথা ভেবেই আজ স্কুলে যেতে চাইছিল না। অথচ তার কথা ভেবেই স্কুলের দিকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

স্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত রিকশায় আসতে আসতেই সুমন ইমনকে জানিয়ে দিয়েছে, আজ তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সেই থেকে ইমন রেগে আছে সুমনের উপর। সুমন যেন ধরেই নিয়েছে ইমন ওকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতে বাধ্য। অবশ্য একা সুমন কেন, সারা স্কুল যেন ধরেই নিয়েছে দুই সুন্দরের মিলন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ ইমন নিজেই জানে না সে সুমনের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী। বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে।

অবশ্য আজকে এই মুহূর্তে ইমন সুমনের উপর রেগে আছে অন্য কারণে। ইমন আজ স্কুলের ধকলের কথা ভেবে পিওর সিল্ক শাড়ি পরেছে। কিন্তু তার চেহারা রোগার দিকে। আগে থেকে যদি বলত, তাহলে সে তাঁতের শাড়ি পরে আসত। তাঁতের শাড়িতে তাকে মানায় ভালো।

স্কুলের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান বড়ো করে কিছু হয় না। প্রার্থনার সময়েই বড়দি শিক্ষকদিবস সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর জানিয়ে দিয়েছেন, উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের ক্লাস নেবে। বড়োদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা আর ছোটোদের মধ্যে গুনগুন গুঞ্জন। টিফিনের আগেই সব স্যার ম্যাডামরা যে যে-ক্লাসের ক্লাসটিচার সেখান থেকে ছোটোখাটো উপহার পেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে। ইমনও ক্লাস নাইন ‘বি’-এর ছেলেমেয়েদের থেকে একটা দামি পেন পেয়েছে। প্রতি বছর সে এদিন তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের লজেন্স দেয়। আজ সে ভুলে গেছে একদম। খুব রাগ হয় সুমনের উপর। তার ছন্দে বাঁধা জীবন, যেখানে বকুলফুলের মৃদু সুবাস নিয়ে সে বেঁচে থাকে, সেখানে সুমন তার সমস্ত আকর্ষণ দিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। বাবার তৈরি বাড়ি ছেড়ে সে যাওয়ার কথা ভাবেনি এখনও। বিয়ের কথা তো সুমনের নাছোড় আবেগের আগে কখনও ভাবেইনি! ইমন মনে মনে ঠিক করে, আজই সুমনকে না বলে দেবে। সুমনের মায়ের সামনেই ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে। জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে বকুলগাছটাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়।

ট্রেনে একটাও কথা বলেনি ইমন। সুমনের পাশে শক্ত হয়ে বসে আছে। মনে মনে শক্ত হয়ে উঠতে শরীরের কাঠ কাঠ ভাবটা খুব কাজে দেয় ইমন জানে। কিন্তু সুমন সেসব খেয়ালই করছে না। সে আগের মতোই কানের কাছে বকবক করে চলেছে আলতু ফালতু অথবা দামি সব আবেগের কথা। ইমন সেসব আবেগ নিতে পারছে না। সে হয়তো তার সব আবেগ জমা রেখে এসেছে বকুলগাছের পাতায় পাতায়।

বারুইপুর থেকে সোনারপুর হয়ে চম্পাহাটি এমন কিছু দূর না। জায়গাটা এখনও গ্রাম গ্রাম। অনেকটা তাদের বলরামপুরের মতোই। চম্পাহাটি থেকে রিকশা নিতে হয় সুমনের বাড়ি পর্যন্ত। বেশ পুরোনো পাড়া। ছাড়াছাড়া বাড়ি। সুমনদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দুজনে একছাতার নীচেতেই সুমনের বাড়ি ঢোকে। সুমনের মা-ই দরজা খোলে। সুমনের মাকে দেখেই ইমনের মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ইমন বুঝতে পারে, ভদ্রমহিলা ভাদ্রের বৃষ্টিভেজা বিকালে ছেলে কোনও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবু আপ্যায়নে আন্তরিকতার অভাব রাখে না, সম্ভবত ছেলের সততার উপর বিশ্বাস রেখে।

– মা, এ ইমন। আমাদের স্কুলের জনপ্রিয় কেমিস্ট্রির টিচার। আমার থেকে টিচার হিসাবে সিনিয়র তবে এমনিতে জুনিয়র। ভালো গান গাইতে পারে। আবৃত্তিও শিখেছে ব্রততীর কাছে…

সুমনের মা হেসে ফেলেন। ছেলেকে ভালোই চেনেন। বলেন, তুই সব বলবি না ওকেও কিছু বলতে দিবি!

তারপর ইমনকে হাত ধরে নিয়ে যান নিজের ঘরে। ফ্যান চালিয়ে বসান বিছানায়। আর নিজে পাশের রান্না ঘরে চলে যান, জল, শরবত আনতে। সেখান থেকে কাচের গ্লাসে স্টিলের চামচ দিয়ে টুং টাং করে শরবত বানাতে বানাতে ইমনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। সুমন এইসময় ছাতা মাথায় সাইকেল নিয়ে বের হয়। সম্ভবত ইমনের জন্য মিষ্টি কিনতে। ইমন ভাবে আসার সময়ই তো কিনে নিতে পারত সুমন। আচ্ছা বোকা সুমনটা। বকবক করা ছাড়া কিচ্ছু জানে না।

– কী নাম মা তোমার? পাগলটা হুড়মুড় করে কী বলল বুঝতে পারিনি। খুব জ্বালায় না, তোমায়!

– আমি ইমন বিশ্বাস।

– কোথায় বাড়ি তোমার? বাড়িতে কে কে আছে?

– জয়নগর লাইনের বলরামপুরে বাড়ি আমার। বাবা নেই। মা আর আমি থাকি। শরবত করা বন্ধ রেখে সুমনের মা ঘরে ঢুকে আসে। ইমনের খুব কাছে এসে বলেন, কোথায় বাড়ি বললে?

– বলরামপুর।

– তোমার বাবার নাম কী?

ইমন তার বাবার নাম বলে।

সুমনের মা এবার খাটে বসা ইমনের মুখটা তুলে ধরে বলেন, তোমাদের বাড়িতে একটা বকুলগাছ আছে না? বাড়ির পশ্চিমদিকে?

কথাটা শেষ করতে করতে সুমনের মা জানলার কাছে চলে যান। ইমন হঠাৎ যেন কোনও পরিচিতকে দেখতে পেয়েছে পূর্বজন্ম থেকে, জানলার কাছে গিয়ে সুমনের মায়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, আপনি কী করে জানলেন? আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকে বকুলগাছ আছে!

সুমনের মা জানলা দিয়ে যেন বহুদূরে তাকিয়ে। দিগন্ত থেকে বলে, আমার বাপের বাড়িও তো বলরামপুরের পাশের গ্রাম সুজনপুর।

তারপর ইমনকে জানলার কাছে টেনে যুবতির উচ্ছ্বাসে প্রৌঢ়া  বলেন, দেখো দেখো ইমন, আমাদের পশ্চিমেও একটা বকুলগাছ। বলরামপুরের বকুলগাছটার সমবয়সিই হবে জানো!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...