আয়ুষ মন্ত্রালয় দ্বারা জারি হওয়া সরকারি বিজ্ঞপ্তি বা যাকে আদেশনামাও বলা যায়, সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কোভিড ১৯-এর চিকিৎসার নিয়মাবলী অনেকটা অন্ধবিশ্বাস এবং ভুলে ভরা। যোগাচার্য কিংবা আযুর্বেদাচার্য-র ডিগ্রি গলায় ঝুলিয়ে যারা ঘুরছেন, সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে তাদের অনেক সুবিধে হয়েছে ব্যাবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। অথচ, এই সুবিধাবাদীরা মন্ত্র, তন্ত্র, যজ্ঞ, কীর্তন কিংবা অন্য কোনও ভাবেই কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেননি। এতে বাহবা কুড়োনোর কৌশল এবং কিছু লোককে ব্যাবসায়িক সুবিধে করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও লাভ হয়নি। বাস্তবে দেখা গেছে, লাভের কথার অর্ধেকই নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে রয়েছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে ঘোষিত হওয়া ওই আদেশনামা যাতে নিজেদের বিরুদ্ধে না যায়, তার জন্য আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল, কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ সহজে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তবুও স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মন্ত্রী ডা. হর্ষবর্ধন এই আদেশনামার পক্ষেই প্রচার চালিয়েছেন।

এই আদেশনামায় বলা হয়েছিল, করোনামুক্ত হওযার পরও সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে হলে নিয়মিত যোগাসন এবং প্রাণাযাম করতে হবে। আর এর জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওযার কথাও বলা হয়। যে-বিশেষজ্ঞদের কথা বলা হয়েছে, গেরুয়াধারী সেই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে অনলাইন ক্লাস চালু করে দিয়েছেন।

ব্যায়াম থেকে প্রাণায়াম, সবই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো করারও নির্দেশ জারি হয়েছে। কিন্তু যদি প্রাণায়ামে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যেত, তাহলে চিকিৎসকের আর প্রয়োজন হত না!এই সেকেন্ড ওয়েভ যখন দেশে আবার শুরু হয়েছে, তখনই এই প্রসঙ্গ আবার সামনে চলে এসেছে৷ আসলে, মানুষ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিপদে পড়েন, তাহলে তখন যাতে চিকিৎসকদের দিকে আঙুল তোলা যায়, তাই এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।

একদিকে জড়িবুটি আর প্রাণায়ামে করোনা প্রতিরোধ করা যাবে বলা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। আর এর ফলে সাধারণ মানুষ এখন বিভ্রান্ত। কার পরামর্শ নেবে মানুষ? আয়ুষ বিশেষজ্ঞের, নাকি অন্য  চিকিৎসকের?

ধর্মগুরুরা চমক দিলে ক্ষতি নেই কিন্তু যেন আর্থিক বিনিময় না হয়। কিন্তু যখন থেকে সরকারি নির্দেশ তাদের পক্ষে গেছে, তখন থেকে তাদের দম্ভ এবং ক্ষমতা বেড়ে গেছে। ওনারাও এখন  চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ দেওযার অধকারি! কারণ, ওনারা তো স্বঘোষিত গুরু। কিছুদিন তাদের ব্যাবসা বন্ধ ছিল, এখন ধর্ম প্রচারক সরকার তাদের আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

আমলকী, হরিতকী, অশ্বগন্ধা, চ্যবনপ্রাশ প্রভৃতি যে-সমস্ত ওষুধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সবই আয়ুর্বেদ গুরুদের পরামর্শ মতো নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু, এ সবের প্রয়োগের কী ফল হচ্ছে, সেই বিষয়ে কোনও অনুসন্ধান করা হয়েছে কি? রোগীর রোগ সেরেছে কিনা কেউ জেনেছে কি?এই দ্বিতীয় দফার করোনা আক্রমণে সেটা কতটা কার্যকর হচ্ছে তা বোঝার উপায়ই বা কী? ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এ বিষয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করলেও বিষয়টিকে আমল দেওয়া হয়নি।

এই মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই চিকিৎসা করা উচিত, সেল্ফ মেডিকেশন করা উচিত নয়।

আমাদের দেশে এই পরম্পরা আছে যে, কেউ রোগগ্রস্ত হলে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি মতো কিংবা বন্ধু-আত্মীয়ে পরামর্শমতো প্রথমে আযুর্বেদচিকিৎসা চলে। আর অসুস্থতা যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় তখনই একমাত্র নিরুপায় হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। আর এই পরম্পরাকে সমর্থন করে সুবিধে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডা. হর্ষবর্ধন।

সবচেয়ে মজার কথা, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কিংবা প্রাণায়ামকে করোনা প্রতিরোধের অস্ত্র বলে কেন্দ্রীয় সরকারি সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, অথচ সরকার রোগ নিরাময়ে এসবকে মাধ্যম করছে না। আসলে সরকার ভালো মতোই জানে, এসব কোনও কাজে আসবে না। শুধু আর্থিক সুবিধে নেওযার জন্য এবং ভোট ব্যাংককে পোক্ত করার জন্যই রাজনৈতিক সমর্থন করে চলেছে। অথচ কী মর্মান্তিক বিষয় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে বাঁচার মরিযা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভ্রান্তিকর সরকারি নির্দেশ মেনে!

সরকার রাজনৈতিক কারণে অনেক কৌশল অবলম্বন করে, এটা কোনও নতুন বিষয় নয়। কিন্তু কোভিড ১৯-এর বিষয়ে যদি একই জনবিরোধী অবস্থান নেয়, তাহলে তা সবার স্বাস্থ্য এবং জীবন নিয়ে ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছু নয়। এ খেলা বিপজ্জনক।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...