ভোটবাক্সের কথা ভেবে সবাই গরিবদের মূলধন করছে৷ কিন্তু বাস্তবে,গরিবদের কথা কোনও রাজনৈতিক দলই ভাবে না৷ কয়েক মাস আগের ঘটনা৷ অন্ধ্রপ্রদেশের একজন অটো মেকানিকের কন্যা ঐশ্বর্যা রেড্ডি, নিজের মেধার জোরে দিল্লির অন্যতম কুলীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অঙ্কে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুল ফিজ প্রভৃতি অনেকানেক খরচা সামাল দিতে, হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ঐশ্বর্যা। কিন্তু দুঃখের বিষয় একসময় কলেজ কর্তৃপক্ষ তার উপর চাপ সৃষ্টি করা শুরু করল, হোস্টেল ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
আর্থিক অনটনের সংসারে যেখানে একটা ল্যাপটপ কেনাও ব্যয়বহুল, সেখানে পড়ার খরচ চালিয়ে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর নয়। মেয়েটি এই আর্থিক বোঝা মা-বাবার উপর চাপানো নৈতিক মনে করেনি বলে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
যারা মনে করেন আমাদের দেশে গরিব, দলিতদের সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়ন ঘটছে, তারা আসলে আকাশকুসুম কল্পনা করছেন। দেশে বর্তমানে শুধু ফারাকটা ধনী-গরিবে নয়, জাতি, ধর্ম, আঞ্চলিকতা, ভাষা– সবেতেই এই অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে। আসলে আমরা বহু টুকরোয় বিভক্ত। যে-ই এই সীমারেখা লঙ্ঘন করার উপক্রম করে, তাকেই এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়।হেনস্থা করা হয় নানা প্রকারে। শুধু অপমান বা কটূক্তিতেই থেমে থাকে না– খাওয়াদাওয়া, রীতিনীতি, সামাজিক আচার ব্যবহার, আর্থিক অস্বচ্ছতা, নানা বিষয় নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করে অপদস্থ করা হয় মানুষটিকে। এমনকী ফিজ বাড়িয়ে বা বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগ করা থেকে তাকে বঞ্চিত করেও এই আর্থিক বৈষম্যকেই প্রকট করে তোলা হয়।
দলিত বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণিটিকে বরাবরই উচ্চবর্গীয়রা খাটো নজরে দেখে এসেছে। কথায় আচারে ব্যবহারে, সামাজিক মেলামেশা থেকে তাদের ব্রাত্য করে রেখেছে। এত বছরে একটি মানসিকতা স্পষ্ট যে, দীন ও জাতিতে নিম্নবর্গের মানুষ হওয়া মানেই, সরকারের ভিক্ষাপ্রার্থী হওয়াই তার অদৃষ্ট। আধার, প্যানকার্ড প্রভৃতি সমস্ত পরিচয়পত্রে, কোথাও না কোথাও এই বার্তা স্পষ্ট ভাবে লুকোনো থাকে যে, ব্যক্তিটি কোন সামাজিক স্তরের প্রতিভূ।
লেডি শ্রীরাম কলেজ আগাগোড়াই বিত্তশালী বাপেদের আদরিণী কন্যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে সমাদৃত। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, দিল্লি ক্লথ মিলের মালিক শ্রীরামের নামাঙ্কিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়েছিল দিল্লির অন্যতম সম্ভ্রান্ত অঞ্চল লাজপত নগরে, যেখানে নিম্নবর্গ থেকে একটি মেয়ে উঠে আসাকে কেউ ভালো চোখে নেয়নি। ফলে অচ্ছুতের মতো তাকে তার সহপাঠীরা দূরে সরিয়ে রেখেছিল।
এখন প্রশ্ন উঠছে মেয়েটি আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিল কেন? কারণ এটাই যে, সে চায়নি তার কৃতিত্বের জোরে উঠে আসা এই জায়গাটি থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হওয়ায়, তার হতাশাগ্রস্ত মুখটা বাবা-মা দেখুক। সমস্যাটা শুধু আর্থিক সংগতির নয়। মেধাবীদের কোনও না কোনও উপায়ে অর্থ বা স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়ে যায়। জাতপাতের কারণে যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় রোজকার জীবনে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই কঠিন। ভারতবর্ষের এই নিষ্ঠুর চেহারাটা যতদিন না বদলাবে, ততদিন প্রাণ যাবে আরও কিছু গরিবগুর্বোর।