বাঙালি বিয়ে বেনারসি ছাড়া ভাবা যায় না। পরম্পরাগত অভ্যাস আজও বাঙালি দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। যদিও আচার-রীতি-অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অনেক পরিবর্তন তারা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবুও তাদের আদরের কন্যাকে বিয়ের আসরে তারা দেখতে চান লাল বেনারসি আর চোলিতে।

বর্ণাঢ্য এই জমকালো বিয়ের শাড়ির জন্মস্থান ‘বেনারস’। ইতিহাসের পাতায় পাতায় বেনারসির ঐতিহ্য খোদাই করা। মসৃণ রেশমের শাড়ির গায়ে সোনালি বা রুপোলি জরির বর্ণময় সাবেক শৈলীটি বেনারসের নিজস্ব সম্পদ।

১৭ শতকে বেনারসি শাড়ি তৈরি হওয়া শুরু হলেও তা উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছোয় ১৯ শতকে। মোগল আমলে কলকা আর লতাগুল্মের ঠাস বুননে এক একটা শাড়ি নান্দনিকতা এবং শিল্পকর্মের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। তিনজন কারিগরের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৪ দিন থেকে ৬ মাস লেগে যায় এক একটি শাড়ি তৈরি করতে। শাড়ির নকশার উপর নির্ভর করে কতটা সময় লাগবে।

শুধুমাত্র কনের সাজই নয়, বিয়ের আসরে সম্ভ্রান্ত রুচির গৃহিণী তথা কমবয়সি আধুনিকাদের অঙ্গেও শোভা পায় চিরকালীন বেনারসি। এককথায় বলা যেতে পারে বাঙালি বিয়ের ঐতিহ্যকে আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে বেনারসি শাড়ি।

মূলত চার ধরনের বেনারসি শাড়ি প্রস্তুত হয়। পিওর সিল্ক কাতান বেনারসি, অর্গাঞ্জা বা কোরা বেনারসি, তাঞ্চই বেনারসি এবং টিস্যু বেনারসি। জর্জেট এবং শাত্তির – এই দুটো ফ্যাব্রিকও এখন বেনারসিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে ট্র্যাডিশনাল নকশার পাশাপাশি কলকা, বুটি, জংলা, ভাসকাট, কাটওয়ার্ক ডিজাইনের চাহিদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোগল জমানায় মুসলিম কারিগরদের নকশার ধারাবাহিকতা আজও অক্ষুণ্ণ– তবে নকশায় হেরফের আনতে এই সময়ের তাঁতিরাও বেনারসি নিয়ে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন।

কাতান – সিল্কের সুতোর ঠাস বুনোটে এই শাড়ি তৈরি করা হয়। গিনি বুটি থেকে শুরু করে নানা ধরনের জংলা নকশা এবং লতাগুল্মের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয় জরির ব্যবহারে।

তাঞ্চই – জামেওয়ার নকশার সাবেক বর্ণাঢ্যতাই এই শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য। সম্প্রতি নকশায় তারতম্য আনতে আঁচল এবং বর্ডারের কাজে আলাদা আলাদা নকশার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। আঁচলে কলকা থাকলে বর্ডারে রাখা হচ্ছে জ্যামিতিক প্যাটার্ন।

টিস্যু – সোনালি জরির ঠাস বুনোটে তৈরি করা হয় এই শাড়ি। নকশার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল জলে ভাসা পদ্ম। আঁচল এবং কুঁচির নকশায় সামঞ্জস্যতা বজায় রাখা হয়।

কাটওয়ার্ক – করাতকাজ নকশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় এই শাড়িতে। জুঁই, গাঁদাফুল, লতাপাতার মোটিফ বেশিমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।

বুটিদার – ডার্ক রঙের পিওর সিল্কের উপর সিল্কসুতো, সোনালি ও রুপোলি জরির কাজ এই শাড়িকে আকর্ষণীয় করে তোলে। জরি বুটি, লতাপাতা বুটি, আঙুরগুচ্ছ আশরফি বুটি, রেখা বুটি, ঝুমুর বুটি, লতিফা বুটি, বালুচরি বুটি ইত্যাদি নকশার মেলবন্ধন ঘটে এই সব শাড়িতে।

এখন অনেকেই সাবেক বেনারসি ছেড়ে হাফ অ্যান্ড হাফ বেনারসি পছন্দ করছেন। এতে শাড়ির বেসটা কাতান রেখে ঘিচা বা চান্দেরির কম্বিনেশন করা হচ্ছে। কখনও ঘিচার সঙ্গে পশমিনারও মিক্স অ্যান্ড ম্যাচও করা হচ্ছে। এই শাড়িগুলি দেখতে অনেকটা মেখলার মতো। এছাড়াও লহঙ্গার অনুকরণে কাতানে সিকুইন্স, জরদৌসির ভারী নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, সঙ্গে নকশাদার ব্লাউজ। স্টোন বসানো ব্রোকেডের কাজও এখন বেনারসি শাড়িতে খুব চলছে। ডবল শেডের বেনারসি শাড়িও এখন অনেকে বাছছেন তবে দুইরঙা জামেওয়ার এবং তাঞ্চই শাড়ির চাহিদা তুঙ্গে। রিসেপশনের জন্য এই দুইরঙা শাড়ির চাহিদা বেশি হলেও বিয়ের কনের জন্য কিন্তু লালের নানা শেড, ফুশিয়া ও ম্যাজেন্টাই রয়েছে পছন্দের শীর্ষে। পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ষাট-পঁয়ষট্টি হাজার অবধি নানা দামের বেনারসি শাড়ি রয়েছে বিভিন্ন দোকানে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...