সবাই চান শ্রবণসুখ উপভোগ করতে। কিন্তু নানারকম কারণে এই শ্রবণসুখ থেকে বঞ্চিত হন অনেকে। শুধু বার্ধক্যজনিত কারণেই নয়, অকালেও অনেকে কানে শুনতে পান না ঠিক ভাবে। তাই, চাই সর্তকতা এবং সঠিক চিকিৎসা। মনে রাখবেন, আমাদের কান মস্তিষ্কের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রক্ষা করে, ঠিক তেমনই শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। অতএব, প্রত্যেকে যাতে কানের যত্ন এবং সুরক্ষা নিয়ে শ্রবণসুখ উপভোগ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে কানের স্বাস্থ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন কনসালট্যান্ট ইএনটি অ্যান্ড হেড নেক সার্জন ডা. দেবায়ন তরফদার।
শ্রবণশক্তি হ্রাসের কারণ
শব্দদূষণ: আমাদের কোলাহলপূর্ণ বিশ্বে শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস (NIHL) একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। কল-কারখানায় যন্ত্রপাতির শব্দ, কনসার্ট, এমনকী ব্যক্তিগত অডিও ডিভাইস থেকেও নির্গত উচ্চ মাত্রার শব্দের আবহে দীর্ঘক্ষণ থাকা, কানের ভিতরের সূক্ষ্ম কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই কোষগুলি শব্দ কম্পনকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে মস্তিষ্কে পাঠায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই কোষগুলি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়।
সংক্রমণ: কানের সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে ‘ওটিটিস মিডিয়া’ (মধ্যকর্ণের সংক্রমণ) এবং ‘ওটিটিস এক্সটার্না’-র (সাঁতার কাটার সময় দূষিত জল থেকে কানে সংক্রমণ) সমস্যা।
ওটিটিস মিডিয়া: প্রায়শই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের কারণে এই সমস্যা হয়। এটি কানে ব্যথা, গায়ে জ্বর, কানের পর্দার পিছনে তরল জমা হওয়া ইত্যাদির সমস্যা তৈরি করে। সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে (CSOM) কানের পর্দায় স্থায়ী ছিদ্র হতে পারে, যা আরও সংক্রমণ এবং গুরুতর জটিলতা তৈরি করতে পারে।
প্রতিরোধ: ঘন ঘন হাত ধোয়া, নোংরা জলের সংস্পর্শে না আসা এবং শিশুদের টিকাদান করা ইত্যাদি। বিশেষকরে যেসব শিশু বারবার ঠান্ডা লাগা এবং কানের ব্যথায় ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করলে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কানের পর্দা স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রোধ করা সম্ভব।
চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কান পরিষ্কার করা। কিন্তু কানের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল হলে, সেক্ষেত্রে (CSOM) সার্জারি-র প্রয়োজন হতে পারে।
ওটিটিস এক্সটার্না: সাধারণত ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের কারণে চুলকানি, লাল ভাব এবং কানে পুঁজ জমে যেতে পারে। প্রতিরোধ: কান শুষ্ক রাখা, তুলো দিয়ে পরিষ্কার এড়িয়ে চলা (যা আরও ভিতরে ময়লা ঢুকিয়ে দিতে পারে) এবং সাঁতার কাটার সময় ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করা কানের স্বাস্থ্যরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিফাঙ্গাল কানের ড্রপ এবং খাওয়ার ওষুধ।
প্রাথমিক লক্ষণ এবং চিকিৎসা
প্রায়শই ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। যার ফলে প্রাথমিক লক্ষণগুলি প্রকট হয় না অনেক সময়। তাই সজাগ থাকা প্রয়োজন এবং সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োজন।
সাধারণ প্রাথমিক লক্ষণ:
- দূরভাষে কথা শুনতে অসুবিধা, বিশেষকরে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে।
- ঘন ঘন লোকেদের কথা পুনরাবৃত্তি করতে বলা
- টিভি বা রেডিওর শব্দ অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়া • উচ্চ শব্দ শুনতে অসুবিধা
- মানুষ বিড়বিড় করছে বলে মনে হওয়া।
ক্লিনিক্যাল ট্রিটমেন্ট
Chronic Suppurative Otitis Media বা CSOM ( মধ্যকর্ণের সংক্রমণ) কিংবা অটোস্ক্লেরোসিস (স্টেপস ফিক্সেশন) ইত্যাদি সার্জারির মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা যেতে পারে। কানের সার্জারি সাধারণত মাইক্রোস্কোপ বা এন্ডোস্কোপের সাহায্যে করা হয়। তাই এগুলি রোগীদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
এক্সপোজার সীমিত করুন: উচ্চ শব্দের আবহে থাকা বন্ধ করুন অথবা সময়কাল কমিয়ে দিন।
কানের সুরক্ষা: কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে ইয়ার প্লাগ বা ইয়ারমাফ ব্যবহার করুন।
৬০/৬০ নিয়ম: ব্যক্তিগত অডিও ডিভাইস ব্যবহার করার সময়, একবারে ৬০ মিনিটের বেশি কিছু শুনবেন না এবং সর্বোচ্চ ভলিউমের ৬০ শতাংশের বেশি শব্দ কানে নেবেন না।
দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ: শব্দের উৎস থেকে দূরত্ব বাড়ান।
নিয়মিত পরীক্ষা: যারা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, তাদের মাঝেমধ্যে কানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।
অডিওলজিক্যাল মূল্যায়ন: শ্রবণশক্তি হ্রাসের ধরন এবং মাত্রা নির্ধারণের জন্য একজন অডিওলজিস্ট দ্বারা শ্রবণশক্তি পরীক্ষা অপরিহার্য।
শ্রবণযন্ত্র: এই হিয়ারিং ডিভাইস শ্রবণ সমস্যা দূর করে এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে উন্নতি করতে পারে।
কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট: তীব্র শ্রবণশক্তি হ্রাসের ক্ষেত্রে, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট শ্রবণ স্নায়ুকে সুস্থ-স্বাভাবিক করতে পারে। পরামর্শ এবং সহায়তা: শ্রবণশক্তি হ্রাস পেলে, মানসিক এবং সামাজিক প্রভাব মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা: নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা এবং শব্দের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি এড়ানো। এছাড়া, প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ উল্লেখযোগ্য ভাবে শ্রবণ সমস্যা দূর করতে পারে।
শ্রবণতন্ত্রের স্বাস্থ্য: শ্রবণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে ছোটোবেলা থেকে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য সুষম খাদ্য অপরিহার্য হলেও, কিছু পুষ্টি কানের স্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। সেইসঙ্গে, এড়িয়ে চলতে হবে শব্দদূষণ।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: ভিটামিন সি, ই এবং বিটা-ক্যারোটিন, কানের ভিতরের সূক্ষ্ম কোষগুলিকে র্যাডিক্যাল দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। ফল, , শাকসবজি এবং বাদামে পাওয়া যায় এইসব ভিটামিন।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: স্যামন এবং টুনার মতো মাছে পাওয়া যায় স্বাস্থ্যকর চর্বিগুলি। তাই এইসব মাছ মাঝেমধ্যে খাওয়া উচিত। এর ফলে কানের ভিতরের রক্তপ্রবাহ উন্নত হবে।
জিঙ্ক: এই খনিজটি কোষের বৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং টিনিটাস থেকে রক্ষা করতে পারে। শামুক এবং কুমড়োর বীজে পাওয়া যায় এই জিঙ্ক।
ম্যাগনেসিয়াম: গবেষণায় দেখা গেছে যে, ম্যাগনেসিয়াম শব্দজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারে। পালং শাক, বাদাম এবং মটরশুটিতে পাওয়া যায় ম্যাগনেসিয়াম।
ফলিক অ্যাসিড: এই ভিটামিন-বি কানের ভিতরের রক্ত প্রবাহ উন্নত করতে পারে। শাকসবজি, সাইট্রাস ফলে পাওয়া যায় ফলিক অ্যাসিড।
অতিরিক্ত সোডিয়াম এড়িয়ে চলুন: উচ্চ সোডিয়াম গ্রহণের ফলে কানের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
জীবনযাত্রায় নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রবণশক্তি হ্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা এবং লাইফস্টাইল ডিজিজ-এর সঠিক চিকিৎসা আপনার শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে। সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ
কানের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য একটি বহুমুখী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে শব্দ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সংক্রমণের দ্রুত চিকিৎসা, শ্রবণশক্তি হ্রাসের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্তকরণ এবং চাই স্বাস্থ্যকর জীবনধারা। আপনার কানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যদি আপনার কোনও উদ্বেগ থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন ইএনটি স্পেশালিস্ট-এর পরামর্শ নিন।