সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ বদলেছে। মেয়েরাও উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেরিয়ার গড়ছে। পুরুষদের সঙ্গে কোনওভাবেই সেখানে তফাত করা চলে না। তবুও বাড়ির ভিতরের চিত্রটার অতটা রদবদল হয়নি। চাকরিতে ঢুকলেও মেয়েরাই কিন্তু বাড়ি, সংসার সন্তান সবই দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চাপ সহ্য করে সংসারের চাপে, কিছুটা হলেও উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে একটা অপরাধবোধ জন্ম নিচ্ছে মেয়েদের মনে। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে তারা কি ঠিকভাবে সংসার, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব child care পালন করতে পারছে? এই অপরাধ বোধ আরও বাড়তে থাকে যখন সন্তানের জন্মের এক-দুই মাসের মধ্যেই সন্তানকে বাড়িতে রেখে মা-কে বাধ্য হতে হয় অফিস জয়েন করতে।

আগে সংযুক্ত পরিবারে ‘মা’ ছাড়াও বয়োজ্যেষ্ঠরাও থাকতেন শিশুর যত্ন child care নেওয়ার জন্যে। কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে শুধুই বাবা, মা আর সন্তান। তাই শিশুর জন্মের পরও তার দেখাশোনা, যত্নের পুরো দায়িত্বটাই মায়ের উপরেই বর্তায়। এই ক্ষেত্রে শিশুর দেখাশোনা অথবা কেরিয়ার এই দুটোর মধ্যে একটাকেই বেছে নিতে হয় মেয়েদের। আমাদের যা সমাজব্যবস্থা তাতে স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর যত্নের দায়িত্ব মায়েরই উপর, তা সেই ‘মা’ যত বড়োই চাকরি করুক না কেন অথবা যত অর্থই উপার্জন করুক না কেন।

সুজাতা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উঁচু পদে বহাল। মেটারনিটি লিভ কষ্ট করে দু’মাস নিতে পেরেছে। এখন ওর মেয়ে মাত্র ২৬ দিনের হয়েছে। বাড়িতে স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই। স্বামীও পারবে না ছুটি নিতে। অফিসের নিয়ম মেনে অগত্যা ওর কাছে দুটো রাস্তা খোলা রয়েছে। এক– ভালো একজন পরিচারিকা পাওয়া। সুজাতা অফিস চলে গেলে যে কিনা বাচ্চার যত্ন করতে পারবে দায়িত্বের সঙ্গে। আর দ্বিতীয় রাস্তা হল আপাতত চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই সন্তানের যত্নের পুরো দায়িত্বটা একাই পালন করা। শেষমেশ দ্বিতীয় রাস্তাটাই সুজাতা বেছে নিয়েছে কারণ ভরসা করতে পারবে এমন কাউকে সুজাতা এখনও খুঁজে পায়নি।

সুজাতার মতন হাজার হাজার মায়েরা সন্তানের দেখাশোনা করার জন্যে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মনে একটাই অপরাধের বোঝা যে তারা কেরিয়ার নিয়ে কিছু ভাবতে পারেননি। আবার অনেকে বেবি সিটারের ভরসায় বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে দিয়ে চাকরিতে জয়েন করেন। মনে মনে তারা নিজেদেরই দোষারোপ করেন যে কেরিয়ারে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে নিজের সন্তানকে তারা অবহেলা করেছেন। এছাড়া চাকুরিরতারা করবেনটাই বা কী?

এই প্রশ্নের কোনও সঠিক উত্তর নেই। এই সব ক্ষেত্রে পরিবেশ, মনের ইচ্ছা, কোনটাকে ইমপর্টেন্স দেওয়া জরুরি ইত্যাদির একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাতৃত্ব, যে-কোনও মেয়ের জীবনেই একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। অনেক মেয়ে রয়েছেন যারা সদ্য মা হয়েও দক্ষতার সঙ্গে সব ম্যানেজ করে কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। আবার অনেকে যে-কোনও মূল্যে নিজের সন্তানের যত্নকেই child care প্রাধান্য দিতে চান।

প্রত্যেক চাকুরিরতাই চান সন্তান হওয়ার পরেও তাদের যাতে চাকরি ছাড়তে না হয় কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় চাহিদামতো হয় না। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব, অফিসে কাজের সময়সীমা, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সদস্যের অভাব এইসব কিছুই চাকরির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণগুলোর জন্যেই সদ্য-মায়ের পক্ষে বাচ্চাকে একলা বাড়িতে রেখে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবুও কয়েকটি উপায় আছে যাতে নিশ্চিত হয়ে মায়েরা নিজেদের চাকরি বজায় রাখতে পারেন।

সঠিক কোম্পানি বাছা – প্রথমে এমন কোম্পানি বাছা উচিত যেখানে কাজের সময়, অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কম। অফিসের টাইম-টা ফ্লেক্সিবল হলে সুবিধা হবে।

একটা রুটিন তৈরি করুন – সন্তানের জন্মের পরে যখন অফিস জয়েন করার কথা ভাববেন, নিজেই একটা রুটিন তৈরি করে নিন। এটা মনে রাখবেন আপনাকেই ঠিক করে নিতে হবে কোন সময় থেকে কোন সময় অবধি কী কী কাজ আপনি করতে পারবেন। এই ভাবে টাইম ম্যানেজমেন্ট করে আপনি নিজের অনেক অসুবিধে দূর করতে পারবেন।

নিজেকে গুছিয়ে নিন – অগোছালো অভ্যাস বর্জন করুন। ছোটো ছোটো জিনিসের জন্যে আলাদা বাক্স অথবা জায়গার ব্যবস্থা রাখুন। এর ফলে জিনিস চট্ করে খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ হবে। বাচ্চার জিনিসপত্র এক জায়গায় গুছিয়ে রাখুন। বাকি জিনিসের জন্য আলাদা করে জায়গা করুন যাতে হঠাৎ করে কোনও প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা না পেরিয়ে যায়।

জীবনসঙ্গীর সাহায্য নিন – সন্তান ছোটো অবস্থায় জীবনসঙ্গীর সাহায্য নিন। ওনাকে বলুন ছোটোখাটো কাজগুলো করে নিতে কারণ উনিও বুঝবেন আপনার পক্ষে একা সবকিছু সামাল দেওয়া অসম্ভব।

বাচ্চার দেখাশোনার জন্যে মহিলা রাখুন – বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে রাখতে না চাইলে, কোনও পরিষ্কারর পরিচ্ছন্ন মহিলাকে বাড়িতে রাখুন যে কিনা আপনার অনুপস্থিতিতে মায়ের মতোই বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে।

বাচ্চার সংস্পর্শে থাকুন – বাড়িতে বাচ্চাকে রেখে অফিস আসতে হলে অথবা ডে-কেয়ারেও বাচ্চাকে রাখলে দিনে অন্তত ৫-৬ বার ফোনে বাচ্চার খোঁজ-খবর নিন। দুপুরে যদি বাড়ি আসা সম্ভব হয় তাহলে একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যাওয়া উচিত হবে।

ভাবনা-চিন্তা করে কাজের গুরুত্ব বুঝুন – সন্তানের জন্মের পর, বিভিন্ন কাজের মধ্যে গুরুত্বের মাপকাঠির সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়। কোন কাজ করলে বাচ্চার উপর তার কী প্রভাব পড়বে তা ভেবে দেখা উচিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার, কথাবার্তা মার্জিত হওয়া উচিত এবং স্নেহপূর্ণ ব্যবহার এই সময় একান্ত ভাবে কাম্য।

এই বিষয়টি নিয়ে অনেকরকম পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে পাওয়া গেছে চাকুরিরতাদের বাচ্চারা সহনশীল বেশি হয়। নিজেদের সমস্যা সহজে সমাধান করার ক্ষমতাও ওদের মধ্যে অনেক বেশি থাকে এবং নিজের ভালো করার ইচ্ছেও তাদের মধ্যে বেশি থাকে।

ইন্সটিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ সমীক্ষা চালিয়েছিল চাকুরিরত মহিলাদের নিয়ে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মহিলাই জানিয়েছেন, বাচ্চাকে খুব ছোটো থেকেই বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্যে একলা রাখতে তারা কমবেশি বাধ্য হয়েছিলেন। এর ফলে তাদের বাচ্চারা খুব শিগগির-ই আত্মনির্ভর এবং স্বাধীন চেতনায় বড়ো হয়ে উঠতে পেরেছে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...