দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুলল হরিয়ালি। কোলে দু বছরের ছেলে-সহ মেয়ে জামাই। জামাইয়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট, মেয়ের মাথায় এক গলা ঘোমটা যদিও এটা তার বাপের বাড়ি। যদি সব ঠিকঠাক থাকত, তাহলে ঘোমটার বহর থাকত না।

চল টুসু জলকে যাব, রানিগঞ্জের বড়তলা ঘুইরবার বেলা দেঁখায় আইনব কয়লা খাদের জলতুলা।

এখন পৌষ মাস। মাসভর সন্ধ্যা বেলায় টুসু গান শোনা যায় এই পাড়ায়। ভদ্রলোকের ভাষায় এটা বাউরি পাড়া। তবে এখানে বেশ কয়েক ঘর শুঁড়ি, গোয়ালা থেকে দু ঘর বিহারি, আর এক রাজপুত পরিবারেরও বসত। দয়াল সিং-এর পূর্বসূরিরা নিজেদের ঠাকুর পরিচয় দিয়ে থাকলেও অর্থনীতির কারণে এই অন্তজ সমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিম বর্ধমানের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই অঞ্চলে মানভুঁইয়া বাংলার সাথে হিন্দি-বিহারি মিশেল দিয়ে কথা বলে অবাঙালি পরিবারগুলো যারা দীর্ঘ দিন বাঙালিদের মাঝে থেকে বাংলাটাই স্কুলে মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছে। অবশ্য যাদের পয়সা আছে তারা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে যায়, তাদের কারও কারও দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। টুসু যদিও অঘ্রাণের শেষে আমন ধান তোলার পর এক ধরনের শস্যোৎসব, টুসু পাতাও হয় একটি সরায় চালের গুঁড়ি মাখিয়ে, তার ওপর তুষ ও ধান বিছিয়ে, দূর্বা ঘাস ও আলো চাল লাগানো গোবরের ঢেলা রেখে। কিন্তু পুরুলিয়া ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই ডিশেরগড় সাঁকতোড়িয়া অঞ্চলে ইদানীং নিম্ন বর্ণের যে পরিবারগুলি টুসু বা ভাদু পরবের ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে তারা আর কেউই বলতে গেলে কৃষিজীবী নয়। দু চারটি পরিবারের আবাদি জমি আছে, চাষও করে। তবে তাদের ছেলেপুলেরা আর হাল ধরতে চায় না। দেখেছে কয়লার কারবারে অনেক বেশি লাভ। জমিতে হাল দিলে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য ধরার পরেও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা। সেখানে আরও খানিকটা গভীরে খুঁড়ে যদি নিশ্চিত আমদানি হয় তো মানুষ সেদিকেই তো ঝুঁকবে। চোরা খাদানের জেরে ধস নামলে ইসিএল-কে দোষারোপ করে ক্ষতিপূরণ চায় স্থানীয় বাসিন্দারা, অন্য দিকে বৈধ বা অবৈধ খনি থেকে কয়লা চুরি বহু লোকের স্বীকৃত পেশায় দাঁড়িয়ে গেছে।

এবার টুসু পাতা হয়েছে মাখন বাউরির ঘরে। তার মেয়ে ময়না আসরের মধ্যমণি। কন্যাকে ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর বেশ একটা সমীহ ভাব। সে নাকি একবার বাজারের মাঝে হাটবারে চারটে ছেলেকে কোমর থেকে বেল্ট খুলে পেঁদিয়েছিল। ছেলেগুলো তাকে জিন্স, টি-শার্ট পরা দেখে শিস দিয়েছিল। ময়না তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দাখিল হয়েছে। হতে পারে কোটায় সুযোগ, তবু বাউরি ঘরের মেয়ে বাবুঘরে বাসন না মেজে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে দেখে, ওই অঞ্চলের অনেকেই সমীহ মিশ্রিত কৌতূহলের চোখে দেখেছিল সেইসময়। দুহাজার সালের পর যেমন ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উৎপাদন হচ্ছে, তেমন হতো না নব্বইয়ের গোড়াতেও। ময়নাকে নিয়ে মেয়েদের মুখে মুখে টুসু গানও রচিত হয়েছে।

ময়নারানি বাপ-সোহাগি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে গো

তার সাথে লাইগতে গিয়ে চুয়াড় ব্যাটা মরে গো।

আসরে ছিল লাখো। লাখো বাউরি নয়, সিং। জশাইডি গ্রামের একমাত্র রাজপুত পরিবারের মেয়ে। নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিলেও ভদ্রলোকের ভাষায় বাউরি পাড়ার লোক হিসাবে দেগে গেছে। তাছাড়া তপশিলি জাতিভুক্ত হতে পারলে সুযোগসুবিধা আছে বলে তার দুই ভাই রাজু আর কিসান মিথ্যেটা ভাঙাতে খুব একটা উৎসাহী নয়। তারা বরং স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে তপশিলি জাতির শংসাপত্র যোগাড় করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছে। তবে দুজনেই অলস ছাত্রজীবন না কাটিয়ে যথাক্রমে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরেই পড়াশুনোর ইতি টেনে স্বনির্ভরতার তাগিদে ঝালবাগান মোড়ে পান সিগারেটের গুমটি দিয়েছে। লাখো গ্রামের বাউরি আর গোয়ালা মেয়েদের চেয়ে নিজেকে আলাদা ভাবে না। বাংলাতেই কথা বলে আর দুর্দান্ত ভাদু, টুসু এমনকী মনসামঙ্গল গাওয়ার দৌলতে এই জাতীয় আসরে তার জায়গা বাঁধা।

ময়নার বীরত্বের কাহিনি আর তাকে নিয়ে বাঁধা গান শুনতে শুনতে লাখো ভেতরে ভেতরে বেশ উদ্দীপিত বোধ করছিল। তাকে স্কুল, দোকান, কাজের বাড়ি ইত্যাদি যাওয়া-আসার পথে কয়েকটা ছোকরা প্রায় রোজ উত্যক্ত করে। আজেবাজে ইঙ্গিত করে, সাহেব মেমদের কুৎসিত কাণ্ডকারখানার ছবি দেখাতে চায় জোর করে। শ্যামল নামের ছেলেটা একবার প্রেমপত্র দিয়েছিল। কিন্তু সে একা আসে না, তার সাথে তার তিনজন বন্ধুও থাকে যারা খ্যা খ্যা করে হাসে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়। ওদের চোপা করেছে, সবাই মিলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ঘিরে ধরলে হাতে পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করেছে, ওদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে বলে সতর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু কোনওদিন একটা চড় মারার সাহস হয়নি।

কী করে হবে? ওরা চারজন লাখো একা। ওরা বড়ো ঘরের ছেলে, লাখোর মতো স্কুল করার পর লোকের বাড়ি কামিন খাটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় একথা ওদের বাড়ির লোক অবিশ্বাস না করলেও স্বীকার করতে চাইবে না। অন্তত শ্যামল, অমিতাভরা তাই দাবি করে লাখোর দরবার করার হুমকি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে লাখো কল্পনা করতে লাগল, হারামিগুলো আবার লাগতে এসেছে, আর ও পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিচ্ছে। তার কোমরে বেল্ট নেই তো কী, গাছের ডাল কি রাস্তার থান ইট তো আছে। আহা যদি জিন্স পরতে পেত কস্তুরী, বর্ণালিদের মতো!

গানে গলা মেলাতে গিয়েও লাখো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেগুলোর সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খারাপ মন্তব্য থেকে এবার হাত ধরে টানাটানি, জোর করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা এইসব শুরু করেছে। যা সব ছবি দেখায় অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার সাথে সাথে ভয়ে হাত-পা পেটে সিঁধোয়। আবার শুনতে পায় ছোটো বোন গৌরীকে নাকি তাদের সাথে হাহাহিহি করতে দেখা গেছে। বোনকে সাবধান করতে গেলে সে উলটে দিদিকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়।

‘কী রে লাখো কী ভাবছিস? চুপচাপ ক্যানে?’

‘বড়ো জাড়াচ্ছে। যা ঠান্ডা।’

আজ চাউড়ির দিন, গোবরমাটি দিয়ে ঘর নিকোনোর কথা। মাখন বাউরির যেহেতু পাকা ঘর তাই ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। যে তোলা উনোনটায় বাঁউড়ির দিন পিঠে হবে তাতে গোবর-মাটি লেপা হয়েছে। সেটাই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে বারান্দার মধ্যিখানে আর তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আঁচ পোয়াতে পোয়াতে মেয়ে বউরা আসরে মেতেছে। আগামীকাল টুসুর জাগরণ অর্থাৎ নিশিপালন। টুসুর ভোগ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে হলুদ মুড়ি, ছোলা-মটর ভাজা, জিলিপি ও নানা ধরনের মিষ্টি আয়োজন হলেও জাগরণের জন্য বাঁউড়ির মূল আসর হয় মাখন বাউরি আর গণেশ মণ্ডলের বাড়ি। এদের বাড়িতে গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোক আর বনেদি পরিবারের মহিলাদেরও নেমন্তন্ন থাকে। তারা ছোটো জাতের বাড়িতে চালের তৈরি পিঠে না খেলেও, শুকনো ছোলা, মটর, মিষ্টি দাঁতে কেটে ধন্য করে দেয়। লায়েক গিন্নির সাথে ঠিক ছোঁক ছোঁক করে তার অকালকুষ্মাণ্ড মেজো ছেলেটাও এসে হাজির হয়। সে নাকি গাড়ি করে মাকে পৌঁছোতে আসে। ওদের চারজন ড্রাইভার, সবাই কি একসাথে ছুটিতে থাকে নাকি এদিন? আসলে কিংশুক আসে মেয়েদের আসরে চোখ দুটো একটু সেঁকে নিতে। শীতের মধ্যে সবার শরীর সোয়েটার চাদরে ঢাকা থাকলেও, কে পেংলি আর কে ডবকা ঠাওর করা যায়। ছেলেকে নিয়ে লায়েক গিন্নি, তার জা ও ভাসুরঝি ভেতরে ঢুকতে সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল। তাদের বসার জন্য দালানে চেয়ার পেতে দেওয়া হল।

‘এই লাখো, তুই একটো গান ধর ক্যানে, তুর পছন্দের গান।’ বলল স্বয়ং ময়না।

কিংশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে যা একখানা হাড়হিম করা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিল যে কল্পিত, সাহসিকতা ভুলে আগামীদিনের সম্ভাব্য বাস্তবতা মনে করে লাখোর ভেতরটা গুড়গুড় করতে লাগল। সে সকলের তাড়ায় ধরল–

‘আদারে-বাঁদাড়ে ঝিঙা ও ঝিঙা তুই বাড়িস না।

আমার ভাদু শিশু ছিলা ঝিঙা রাঁইধতে জানে না।’

‘ইটো তো ভাদু গান বটে। তুর কী হঁইছে বলত? আইসে অব্দি আনমনা।’

‘আরে, ভাদুর জায়গায় টুসু বসায়েন দিলেই উটো টুসু গান হঁইয়ে যায়। তা উয়ার কারও সাথে কুছু চক্বর-টক্বর চইলছে বুঝি?’ ওপাশ থেকে ফোড়ন কাটল কিংশুক।

অতসী কিংশুকদাদাবাবুর রসিকতায় হেসে গান ধরল– ‘আমার টুসু মান কইরেছে

মানে গেল সারা রাইত।

খুল টুসু মানে কপাট আইসছে তুমার প্রাণনাথ।।’

সমবেত গানে গলা মেলালেও লাখোর ভেতরে স্বস্তি নেই।

কিংশুকের জ্বলন্ত চোখের সাথে চোখাচোখি হলেই ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জ্বালায় সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছিল। কিংশুক দেখতে পেয়ে খুব আন্তরিকতাপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী হল? শরীর খারাপ নাকি? ইস্কুলে দিদিমণি কুছু বইলছে, মেইরেছে?’

লাখো মাথা নাড়ে। প্রথমটায় জানাতে না চাইলেও সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে সব উগরে দিয়েছিল। কিংশুক লাখোকে ঝালবাগান মোড়ের গরাইদের বাঁধা চায়ের দোকানে বসিয়ে একরকম জোর করে তেলেভাজা, জিলিপি আর চা খাওয়ায়। বাড়িতে এইসময় স্কুল থেকে ফিরে ভাতই খায় লাখো। খেয়ে অসিত চৌধুরীর বাড়িতে কাজে যায় বিকেলের বাসন মাজতে।

কাজটা সে নিজের মর্জিমাফিক করে। খেয়াল খুশি মতো কামাই, বেলা পার করে চৌধুরী কর্তাগিন্নির মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে যখন খুশি হাজিরা দিলেই হল। তবে বিকেলে ওবাড়ি কাজ করতে যাওয়ার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। চৌধুরীদের বড়ো মেয়ে ওই একই স্কুলে পড়ে। বয়সে লাখোর চেয়ে ছোটো হলেও দু ক্লাস উঁচুতে। সেও তৈরি থাকে খেয়েদেয়ে মার্বেল নিয়ে গুলি খেলার জন্য। দায়সারা কাজ চুকিয়েই লাখো মেতে ওঠে মনিবকন্যার সঙ্গে গুলি খেলায়। মৈত্রেয়ী হারলে আবার ঝালবাগান মোড়ের বুড়োর দোকান থেকে মার্বেল কিনে আনে মায়ের কাছে চেয়েচিন্তে পয়সা জোগাড় করে। কিন্তু লাখো হারলে নতুন গুলি কেনার পয়সা লাগে না। সে জানে মিতু অর্থাৎ মৈত্রেয়ী কোথায় নিজের মার্বেলের বাক্স লুকিয়ে রাখে। লাখোর চুরির ঠেলায় মিতু কতবার যে নিজের গোপন প্রকোষ্ঠ লুকিয়েছে তার লেখাজোকা নেই। যখনই গুলি বার করতে যায় দেখে গুনতিতে খান পাঁচ ছয় কি আরও বেশি কম পড়ছে। লাখোর ওপর চোটপাট করলে মিতুর মা মিতুকেই বকে। কাজের মেয়ে ছাড়া তার চলে না। আর কাকাবাবু গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করার বদলে বউয়ের ওপর চোটপাট করে বেশি। তাই কাকিমা ঝিয়ের হাতেপায়ে ধরে খোশামোদি করে। লাখোও সেই সুযোগে এনতার বেয়াড়াপনা করে নেয়।

কয়েক দান গুলি খেলার পর মিতুর বন্ধুরা ডাকতে আসে খেলার জন্য। বুড়ি-চু, ডাংগুলি, কবাডি, এক্বাদোক্বা, লুকোচুরি, নামডাকাডাকি, স্কিপিং– কতরকম। খেলার ভেন্যু নির্ভর করে কী খেলা হচ্ছে তার ওপর। কবাডি, বুড়ি-চু, কিতকিত কিংবা এক্বাদোক্বা হলে সাধারণত ডিপিএস-এর স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের শান বাঁধানো ব্যাডমিন্টন কোর্টে চলে যায়। অন্যান্য খেলা কারও বাড়িতেও হতে পারে।

এমনিতে মিতুর বন্ধুরা কামিনের সঙ্গে গল্পগাছা না করলেও, খেলায় নিজেদের দল ভারী করার জন্য লাখোকে নিয়ে টানাটানি করে। মিতু তো মাছ মাংস দুধ ফল খেয়েও পেংলি, ক্ষীণজীবী। ওদিকে লাখো মাড় খেয়েও চারটে মিতুকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে। বুড়ি-চু, ডাংগুলি আর কবাডিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র পাড়ার কোনও কোনও ছেলে পারে তাকে মাত দিতে। এই তো আজ বিকেলেও কবাডিতে কস্তুরীদের দলের খেলোয়াড়দের বলে বলে আউট করেছে। গাছে চড়াতেও তার জুড়ি নেই। পরের গাছের ফল-পাকুড়কে নিজের ভাবতে হলে এটুকু দক্ষতা তো রাখতেই হবে। আগে মারামারি লাগলে মেয়েরা গায়ের জোরেও কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠত না। এখন বড়ো হয়ে গেছে বলে হাতাহাতি লাগে না। না হলে গুলি চুরির জন্য রোজই খণ্ডযুদ্ধ বাধার কথা। এখন মিতুদের বন্ধুরা প্রায় দিনই ছুটোছুটি খেলার বদলে রাস্তায় পা়য়চারি করতে করতে গালগল্প করে। ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে ঝিগিরি করা মেয়ের তেমন প্রাণের কথোপকথন থাকে না। তাই ইদানীং খেলার পরিকল্পনা বাতিল হলে লাখোকে বিকেলটা নিজের সমতুল্য সামাজিক পদমর্যাদার সঙ্গী জুটিয়ে আড্ডা মারতে হয়। নাহলে গাছের মগডাল হোক কি কিতকিতের কোর্ট– লাখোকে যশাইডি আর ঝালবাগানের মেয়েরা সমঝেই চলে। এমন ডাকাবুকো মেয়ে কিনা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

সেদিন কিংশুক লাখোকে বলেছিল, ‘পা থেইক্যে জুতাটো খুলে মুখে মাইরতে লারলি বানচোদগুলার? আমি থাইকলে দেখাইন দিথম মজা। আমার গাঁয়ের বিটির গায়ে হাত দেয় শূয়ারের বাচ্চাগুলান? আমায় আগে বলিস নাই ক্যেনে? বিচি কেইটে হাতে ধরায়েন দিথম। কিংশুক লায়েককে সবাই চিনে। তুঁই ভাবিস না। উয়াদের আমি খবর লিছি।’ দোকানে কিংশুকের জনা সাতেক বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কিংশুকের দাদা কুন্তলের অ্যাকাউন্ট-এ ধারে চা, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়ার বিনিময়ে লায়েক ভ্রাতাদ্বয়ের উচ্চারিত কথার দোয়ারকি দেয়।

আশ্বাস পেয়ে লাখো খেয়ে নিল। কিংশুক তার পিঠে কাঁধে মাঝেমাঝে হাত বোলাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে বলল, ‘চল তুখে ঘর পৌঁছায়েন দি।’ লাখো তার ষোলো বছরের জীবনে এমন আজব কথা কোনওদিন শোনেনি যে তাকে কেউ ঘরে পৌঁছোতে চাইছে। ভেতরটা একরকম পুলকে উছলে উঠলেও কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘একা যেইতে পাইরব। তুমি আপনার বন্ধুদের কাছে থাক।’

কিংশুক দায়িত্ববান বড়ো দাদার মতো গ্রামতুতো বোনের রক্ষক হয়ে কিছুদূর গিয়েই দুধনাথের গোয়ালটার আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে আচমকা লাখোকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। লাখো ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তার ডান হাতখানা সজোরে পেছন দিকে মুচড়ে ধরল।

‘আঃ! আমার লাইগছে। ছেইড়ে দাও।’

‘তুকে আমি বদমাস ছিলাগুলার হাত থেইকে বাঁচাব, বদলে আমারও তো কুছু চাই।’

‘আমায় ছাড়ো বলইছি। না তো খুব খারাপ হবেক। আমি কাকিমাকে বইলে দুবো।’

‘আমি শ্যামলার পারা কেরানির ব্যাটা লই। লায়েক বাড়ির ছিলা, আদিত্য লায়েকের ব্যাটা, কুন্তল লায়েকের ভাই। তুর মতো বিটিছিলাকে আমি পায়ের জুতা বানায়েঁ রাইখতে পারি। বেহায়া মাগি ইস্কুল গিয়ে পড়াশুনার বদলে রাস্তার ছিলাদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করিস? দাঁড়া আমি তুর বাপকে জানাছি। মদনার কাছে আট গাড়ি গোবর চেঁইছিল দাদা, চার গাড়ি দিয়ে পাত্তা নেই। মদ গিলে পইড়ে থাকে, আমরা ডাইকলে আসে না।’

‘তুমরা টাকা বাকি রাখো যে।’

‘কী বইললি, খুব বাড় হঁইনছে লয়? যত বড়ো মুখ লয় তত বড়ো কথা? বাপ আর বিটি দুজনাকেই শায়েস্তা কইরতে হবেক।’

তারপর থেকে মা কালীকে ডাকতে ডাকতে একদিকে শ্যামলবাহিনী আর একদিকে কিংশুক লায়েককে চুক্বি দিতে হচ্ছে। শ্যামলরা সাঁকতোড়িয়া কলোনিতে থাকে, কিন্তু কিংশুক তো একই গ্রামের ছেলে। পৌষ পরব, পিঠেপুলি, টুসু গান– সব আনন্দ ভয়ের মেঘে ঢেকে গেছে। ও অন্যমনস্ক হবে না তো কী? মাখন বাউরির মেয়ের বীরত্বের কথা স্মরণ করেও মনে বল পাচ্ছে না।

নদী ঘাটে ভিড় দেখলে বোঝা যায় পুণ্যপিপাসার কাছে শরীরের কষ্টবোধ তুচ্ছ। এইসময় সকালের তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, চার-পাঁচ প্রস্থ গরম জামা পরেও পাঁজরের কনকনানি কাটতে চায় না। দামোদরের হিমেল জলে এরই মধ্যে নানা বয়সি মেয়ে-পুরুষের সমাবেশে যেন মেলা লেগেছে। বয়স্ক মহিলা ও বাচ্চা দু-একটি মেয়েদের কেউ কেউ স্নানের পর শুকনো কাপড় পরলেও বেশিরভাগ মেয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ার আড়াল না পেয়ে সেই পরেই বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে। লাখোও কাঁপতে কাঁপতে ভেজা সালোয়ার কামিজ গায়ে বাড়ির পথ ধরল। পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডায় জ্বলছে, হাতের পাতায় সাড় নেই, দাঁতে দাঁতে খটখটানি থামতেই চায় না। ঘাট থেকে যশাইডি গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পথ। হাসপাতাল ও ঝালবাগান মোড় পর্যন্ত অটো কি বাসে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে খরচ বেশি, পুণ্য কম। তার বাড়ি থেকে একমাত্র সেই আসে সকলের হয়ে পুণ্যার্জন করতে। মিতুদের বাড়ি আজ কাজে যাবে না, কেবল বিকেলে গিয়ে পিঠে নিয়ে আসবে। তারপর মাখন বাউরির ঘরে মোচ্ছব, রাতভর। হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাল লাখো।

‘কী রে, তখন থেইকে ডাকছি, শুনতে পাস না?’ শ্যামল, অমিতাভ, শিশির আর ছোটন। শ্যামল আর ছোটনের বাইকে ওরা চারজন।

লাখোর বুকের মধ্যে যে-স্রোতটা বয়ে গেল সেটার তাপমাত্রা কত কে জানে? ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আবার পা বাড়াল।

শ্যামল বলল, ‘বড়ো জাড়াচ্ছে লয়, আয় তুকে মোটর সাইকিলে বাড়ি পৌঁছায়েন দিয়ে আসি।’

‘দরকার নাই, আমার পা আছে।’ বাজার ছাড়িয়ে তখন এমডি অফিসের কাছাকাছি। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে গেছে।

‘পায়ে হেঁইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বুকে সর্দি বইসে যাবে। আমার মোটর সাইকেলে উঠ।’ শ্যামলের ইশারায় অমিতাভ এসে লাখোর হাত ধরল। রাস্তায় লোকজন আছে, তাই ভয়টা কমে গেল। হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিতে অমিতাভ যেন একটু টলে গেল। টাল সামলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল অমিতাভ, ‘দেইখ্যে লুব তর কত ত্যাজ।’ লাখো চ্যাঁচালে হয়তো লোক জড়ো হতো, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে গেল।

সন্ধেবেলায় মিতুদের বাড়ি থেকে সবে পিঠে নিয়ে ঝালবাগান মোড় হয়ে গাঁয়ের গলিতে ঢুকছে হঠাৎ মুখে ঘাড়ে গলায় বরফ জলের কনকনে স্পর্শ, পর মুহূর্তে অবর্ণনীয় জ্বালা। ঠান্ডা নয়, প্রচণ্ড তপ্ত কিছু যেন চামড়া গলিয়ে মুখ থেকে গা বেয়ে নামছে। চিৎকার করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল লাখো। দুটো মোটরবাইক গর্জন করে চলে যাওয়ার শব্দ হল। আশপাশের দোকানগুলো থেকে চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এল। যশাইডি গ্রামে ঢোকার দুটো পথ আছে, একটা ঝালবাগান মোড়ে, আর একটা হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তায় পড়ে।

কিংশুকের দাদা কুন্তলের গাড়ি করে অর্ধচেতন দেহটাকে ভর্তি করা হল সাঁকতোড়িয়া হাসপাতালে। হাসপাতালটা এমনিতে ইসিএল-এর হলেও স্থানীয় মানুষও কম খরচে চিকিৎসা পায়। ডাক্তাররা কেউ কেউ গরিবগুর্বোকে ওষুধ টষুধ দিয়ে দাক্ষিণ্যও করে থাকে।

মাসখানেক পর জীবিত ছাড়া পেল ঠিকই তবে মুখ আর গলা ঝলসে পুড়ে গেছে, মাথা তুলতে পারে না লাখো, খুব সামান্য ঘোরানো যায়। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ শ্যামলদের ধরে নিয়ে গেলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কেউ বলে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কেউ বলে জামিনে ছেড়েছে। তবে তারা আর লাখোর পথ আগলে দাঁড়ায় না, আর লাখো তো রাস্তায় বোরোয়ই না বলতে গেলে। ওদিকে কিংশুকও লাখোকে দেখলে ‘মুখপুড়ি’ বলে মাঝেমাঝে সম্বোধন ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর জ্বালায় না। বাজারে শ্যামলদের সঙ্গে তাকে গল্পও করতে দেখা গেছে। গাঁয়ের মেয়ের গায়ে হাত দিলে শাস্তি জানা আছে, কিন্তু তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারলে কী কর্তব্য জানা নেই সম্ভবত। গৌরীকে আর সাবধান করতে হয় না, সে দলবল ছাড়া স্কুলে যায় না।

গৌরীর বিয়ের জোর চেষ্টা চলছে। পাত্রপক্ষ ধানবাদ জেলার কুমারডুবিতে থাকে। তাদের হাজার বায়নাক্বা। কুমারডুবিতে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে একটা চালু গোলদারি দোকান আছে। দোকানটা একেবারে জিটি রোডের ওপরই বলা যায়। রোজগারপাতি ভালোই। তিন ননদ, কোনও দেওর-ভাসুর না থাকায় একমাত্র ছেলে বলা গেলেও সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট বলা যায় না। মেজোমেয়েকে পার করতে হবে বলে লছমনের বাবা চাইছেন পণের টাকাটা তার ছেলের তরফের কুটুমের কাছ থেকে আদায় হোক। যে যেখানে মহাজন।

লাখোর মুখ পোড়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মা হরিয়ালি অসিত চৌধুরীদের বাড়ি কাজে আসে এবং সেইসূত্রে শাশ্বতী চৌধুরীর প্রিয় বান্ধবী। অবশ্য যে গাঁয়ের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ কম বেশি চুরি করে, সেখানে লাখোর মা আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম। মেয়েরও হাতটান ছিল, কিন্তু মায়ের সামনে আলমারির চাবি ফেলে রাখলেও ভয় নেই। এমন মানুষ যতই কামাই করুক হাতছাড়া করা যায় না। বড়ো মেয়ে আইবুড়ো থাকতে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে হরিয়ালি মন খারাপ করে। বছর খানেক পেরিয়ে গেছে, মেয়ের বিকৃত মুখে ছিরিছাঁদ ফেরেনি। লাখোর এখনও কথা বলতে, খাবার গিলতেও কষ্ট হয়। জলখাবার খেতে গিয়ে লাখোর মা প্রায় দিনই চোখের জল ফেলে।

গৌরীর বিয়েটা বোধহয় কেঁচিয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ পণ নিয়ে বড়োই রগড়ারগড়ি করছে। রাজু কিসান পালা করে কুমারডুবিতে গিয়ে আলোচনা করেও কোনও রফাসূত্র বার করতে পারছে না। হরিয়ালি ছেলেদের দোকানে পাঠিয়ে ভাবছে আজ মিতুদের বাড়ি যাবে কিনা। এমন সময় উঠোনের দরজায় টোকা। এক কালো রোগা ছোকরা।

‘ইয়ে কা দয়াল সিংকা ঘর হ্যায়?’

‘হঁ বটে, কিন্তু উ তো অনেকদিন হইল মইরে গেছে। আমার স্বামী ছিলেক।’

‘মালুম হ্যায়। কেয়া ধানবাদমে গুরুচরণ বাঘেল কি ঘরমে আপ কি কিসি বেটি কি শাদি কি বাত চল রহি হ্যায়?’

‘হঁ হঁ। রাজু কিসানকে খবর কইরছি। উয়াদের সাথে কথা বলুন।’ হরিয়ালি একদম হিন্দি বলতে পারে না, খুব ভালো বুঝতেও পারে না। ছেলেরাও স্থানীয় ঝাড়খণ্ডি উপভাষার বাংলাতেই স্বচ্ছন্দ, কিন্তু বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদেরকেই এগিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া গৌরীর বিয়ের কথা চলছে যেখানে সেইখানে দুই ছেলেই যাওয়া আসা করেছে। সুতরাং সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারাই বেশি উপযুক্ত। হরিয়ালি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল, ‘বসুন, আপ বইঠিয়ে। লাখো, যা তো রাজুকে ডেইকে লিয়ে আয়।’ বলেই বলল, ‘থাক তুকে আইসতে হবেক লাই। আমি ষষ্ঠীর ভাইকে বুইলছি।’ মুখ পোড়া মেয়ের কেচ্ছা আর এক মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোক জানতে পারুক চায় না। তাই লাখোর বৃত্তান্ত সেখানে জানানো হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি।

‘আপ পরেশান না হো, ম্যায় আপসে বাত করনা চাহতা হুঁ।’

‘হাম বাত মানে হিন্দিতে বাত কইরতে লারি। আমার ছিলাগুলাকে ডাক দিচ্ছি। উয়াদের সাথে কথা করুন। তাতখে মুখে টুকদু কুছু দ্যান।’

‘আমি বাঙালিই। আপনারা রাজপুত না? হিন্দি জানেন না?’

‘বইলতে লারি। ছুটু থেইকে বাংলাতেই কথা বইলছি লয়। অ্যাই ষষ্ঠী, অ্যাই মহেশ, রাজুদাকে টুকদু খবর কইরে আয় না। বল ঘরকে কুটুম আইসছে, জলদি আসে যেমন।’

ছেলেটার নাম প্রসূন মিশ্র। কুমারডুবিতে শঙ্কর টকিজ নামে তাদের একটা সিনেমা হল ছিল, এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট হয়েছে, নীচে দুটো দোকান ঘর পেয়েছে প্রসূনরা। একটাতে নিজেদের আসবাবের দোকান করেছে আর একটা ভাড়া দেওয়া আছে এক মুদিখানার কারবারিকে। দোকানটা বাবা আর দাদারা দেখে, প্রসূন নিজে স্কুলে পড়ায়। কিন্তু এত কথা ও হরিয়ালিকে কেন বলছে? হরিয়ালি তো কিছু জানতে চায়নি।

ছেলেটা নিজের বাড়ির সম্পর্কে টুকটাক নানা কথা বলে গেল। যা বাবা! গৌরীর শ্বশুরবাড়ির কথা, লছমনের অর্থাৎ গৌরীর হবু বরের কথা তুলছেই না। প্রশ্ন করলে দায়সারা জবাব। তাহলে কি গুরুচরণজিরা পাঠায়নি একে? নাকি এ নিজেই? কথাটা হরিয়ালির মাথায় আসতেই খাতিরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। উঠোনের দরজা দিয়ে রাজু ঢুকতেই বলল, ‘ইনার নাম পরসূন, পর্সূন কী যেন? ও মিশ্রা। পর্সূন মিশ্র। কুমারডুবি থেইকে আইসছে।’

একথা সেকথার পর প্রসূন গলা খাঁকারি দিয়ে খোলসা করল। সে হরিয়ালির মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। দেওয়া-থোওয়া ওদের সাধ্যমতো, কোনও দাবিদাওয়া নেই। হরিয়ালি তো হাতে স্বর্গ পেল, ‘আপনার, তুমার মা-বাবার সাথে কথা বুইলে..ছ? উনারা কী বলেন দেইখতে হবেক লয়?’

‘মা-বাবা রাজি নন। ওনারা মুখ পোড়া মেয়েকে বউ করতে চান না।’

‘মানে?’ এবার হরিয়ালির দশগুণ অবাক হওয়ার পালা। প্রসূন তাহলে গৌরীকে নয়, লক্ষ্মী অর্থাৎ লাখোকে বিয়ে করতে চায়? ইয়ার্কি করছে না হরিয়ালি স্বপ্ন দেখছে।

‘তুমি আমার ওই মেয়ের কুথা জাইনলে কেমন কইরে?’

‘গুরুচরণজির ছেলে লছ্মন আমাদের ওই দোকানঘর ভাড়া নিয়েগোলদারির দোকান দিয়েছে। কতগুলো শয়তানের জন্য ওর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনটা তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।’

রাজু মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হরিয়ালি জল মিষ্টি পরিবেশন করে বলল, ‘আপনি… তুমি আজ দুপুরে আমার কাছকে ভাত খেয়ে যাবে। এ রাজু কিসনাকেও ডাক। কথা বইলতে হবেক।’

‘আর কাউকে ডাকার দরকার নাই। বিয়া আমি কইরব না। আমার মতো মুখপুড়িকে কেউ জেনেশুনে বিয়া করে?’ লাখো অন্ধকার ভেতর ঘর থেকে বাইরে এল। ও লোকজনের সামনে বড়ো একটা বেরোতে চায় না।

‘জেনেশুনেই তো কথা পাড়ছি।’ প্রসূন বলল।

‘কিন্তু আপনার বাপ-মার মত নাই। বিয়া হবে কী কইরে?’

‘বিয়েটা আমি করব। আমার মা-বাবা নয়। ওনারা রাজি হবেন না বলেই আমি নিজে কথা করতে এসেছি।’

‘আমার পারা মিয়াকে কেউ বিয়া করে? মা উয়াকে বুঝাও।’

‘হঁ বাবা। তুমার মা-বাবা রাজি লয়, ভগবানের শাপে আমার বিটিটোর এই অবস্থা। কুনো দিন উয়ার বিয়া হবার কথা লয়। ঘরে কামকাজ কইরে আপন মনে থাইকছে। তুমি জিদ কইরে বিয়া কইরলে তুমার বাড়িতে মেইনে লিবেক ক্যানে?’

রাজু এবার বলল, ‘মা ভাত বসাও। আমি কিন্তু জলদি বাইরব। কিসনা একা দোকান বন্ধ কইরতে লাইরবেক।’

‘সবসময় বিয়ে কি মা-বাবারা মেনে নিতে পারে? ওনারা স্কুল টিচার ছেলের জন্য মোটা টাকা দর হাঁকবেন। আমি পণ নেব না। শুধু একটা মেয়ের সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে তার কিছুটা পুষিয়ে দেব, মানে ওর তো কোনও দোষ নেই, ও কেন সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে?’

হরিয়ালির নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দেখতে শুনতে ভালো ছোটো মেয়ের পাত্র ঠিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, আর বিকৃত মুখ বড়োটির জন্য যেচে এত ভালো পাত্র আসছে। আসছে কী, সাধছে, তাও আবার বিনা পণে। সে ছেলেকে ইশারা করল দিদিকে রাজি করাতে। নিজে উঠোনের এক কোণে তৈরি মাটির উনোনে ভাত ও তরিতরকারির জোগাড় করতে বসল। ইস্! কাল মিতুদের গাছ থেকে এঁচোড় নিয়ে এলে পারত। এখন অতিথিকে ভদ্রস্থ কী খাওয়ানো যায়? অল্প পোস্ত আছে। আলু পোস্ত করা যায়। সঙ্গে মাচায় যে কুমড়োর লতাটা উঠছে সেখান থেকে কয়েকটা কুমড়ো ফুল তুলে বেসনে ভেজে দেওয়া যায়। হরিয়ালি দোনোমনো করে সম্ভাব্য জামাইয়ের আদরের তোড়জোড় শুরু করল। কিন্তু এখন রাঁধতে বসলে খাবে কখন? শেষে কাজ চালানোর জন্য লাখোকে পাঠালো মিতুর মায়ের কাছ থেকে খানিক তরকারি ব্যাঞ্জন চেয়ে আনতে।

গৌরী স্কুল থেকে ফিরে দেখে এক ছোকরাকে নিয়ে বেশ খাতিরদারি চলছে। সে লছমন ভেবে বেশ একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে ঘরে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। আলগোছে দু-একটা কথাও হল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ওর আগমণের উদ্দেশ্য জেনে গৌরীর মূর্ছিত হওয়ার পালা। লছমনের ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রসূন তো প্রথম দর্শনেই চোখের সঙ্গে মনটাও আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল। তার মুখপোড়া দিদির পাশে এই ছেলেটা? দিদির চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতেই পড়ে সে। দু বছর পর মাধ্যমিক পাসও করে যাবে। বড়ো ঘরের স্কুল টিচার ছেলে তবু তার বছর বছর ফেল মারা কামিন খাটা দিদিটাকে বিয়ে করতে চায়! আর তাদেরই দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মুদিখানা চালানো ছেলে গৌরীর মতো মেয়েকে নেওয়ার বিনিময়ে এত দর হাঁকছে?

লাখোকে প্রথমটায় রাজি করানো যাচ্ছিল না। বস্তুত হরিয়ালি আর তার দু ছেলেরও মনে হচ্ছে মুখপোড়া মেয়ে ঘরে কাজকর্ম করে মা-ভাইয়ের সংসার টেনে নিয়ে যেতে পারে। ও চলে গেলেই বরং অসুবিধা। বরং গৌরীটাকে প্রসূনের মতো পাত্রের সঙ্গে জুততে পারলে সব দিক থেকেই মানানসই হয়। কিঞ্চিদধিক পড়াশুনো শেখা ও অক্ষত থাকার সুবাদে গৌরী লোকের বাড়ি তো দূর ঘরেও কাজকর্ম করতে বিশেষ রাজি নয়। তাই হরিয়ালির ছেলেরা বড়দিকে রাজি করানোর চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে প্রসূনকে ছোড়দির দিকে ফেরাতে। তার মা-বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে দুটো বিকল্পের পথই খোলা রাখতে চাইছে। লাখো বেগতিক দেখে ঘাড় নেড়ে দিল। মেয়েরা যে শ্বশুরঘরে দাসত্ব করলেও গিন্নি আর বয়স পেরিয়ে বাপের ঘরে খেটে খেলেও আশ্রিতা, সেটা উপলব্ধি করার জন্য বেশি দূর পড়াশুনোর দরকার হয় না।

এরপর তিন বছর কেটে গেছে। প্রসূনের জেদ আর আন্তরিকতাই বজায় থেকেছে। গৌরীরও যেন কোনও অনিচ্ছুক পাত্রের পুরি ঘরওয়ালি হওয়ার বদলে একজনের আধি ঘরওয়ালি হওয়াতেই বেশি আগ্রহ। শালির বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে জামাইবাবু লড়ে যাচ্ছে। লছমনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে।

ভাই ও জামাইদাদার নতুন উদ্যোগে গৌরীরও বিয়ে হতে চলেছে কালীপাহাড়িতে। ছেলের নাকি কয়লা খনিতে মোটা মাইনের কাজ। অসিত চৌধুরী অর্থাৎ মিতুর বাবা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন খনি বলতে চোরা খাদান। এখানকার বহু লোকে জানেই না কোনটা বিধিসম্মত আর কোনটা বেআইনি খনি, বা জানলেও সেখানে কাজ করার মধ্যে অনৈতিক কিছু দেখে না। যেমন ইসিএল বা ডিপিএস-এর লাইন থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ নেওয়াকে বেশির ভাগ বাসিন্দা অনেকটা স্থানীয় মানুষের মৌলিক অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, চুরি মনে করে না, আর করলেও ‘বেশ করেছি’ ভাব। খুব কম বাড়িতে কুয়ো বা পাম্প আছে। বড়ো বড়ো অট্টালিকাতেও ইসিএল-এর পাইপ লাইন থেকে শাখা প্রশাখা বার করে ট্যাঙ্ক ভরা হয়। একসময় কল্যাণেশ্বরীর জল ব্যবহূত হতো পানীয় জল হিসাবে, এখন সেটার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ইসিএল-ই ভরসা। হুকিং-এর তার ধরপাকড়ের সময় বাজেয়াপ্ত হলেও জলের লাইন কেটে দিলে আগুন জ্বলবে, কারণ অঞ্চলটার অধিকাংশ জায়গায় মাটির নীচটা ফাঁপা, কুয়ো খুঁড়লে জলের বদলে কয়লা নয়তো গহ্বর পাওয়া যাবে, আগুন আর ধোঁয়াও বেরিয়ে আসে জমির ফাটল বেয়ে। যশাইডি গাঁ, ঝালবাগান কলোনি আর বানডাঙার কয়েকটা বাড়িতে কুয়ো থাকলেও ‘কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ডাল’ দর্শনেরই জয়জয়াক্বার। কয়লা খাদানে জলও জমে, যে জল পাম্প করে আসানসোলের দু একটা অঞ্চলে, রানিগঞ্জ শহরের কিছু জায়গায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই ‘ধসা ওয়ার্ড’-এ মাটির নীচে কেবল কয়লা কিংবা আগুন। জনস্বার্থে কারচুপির জন্য প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ানদের নতুন নতুন উদ্ভাবন রীতিমতো পেটেন্টের দাবিদার হতে পারে।

গৌরীর দুই ভাই রাজু আর কিসান ছোটো বোনের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে বেশ গর্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতা জানিয়েছিল অসিত চৌধুরীর বাড়িতে, বসার ঘরে চা খেতে খেতে তারা মাটির নীচ থেকে কয়লা কাটার ঠং ঠং শব্দ শুনতে পেয়েছে। অমন বিপজ্জনক বাড়িতে যে বোনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকতে পারে না তা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে অসিতবাবু রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। জামাইয়ের করা সম্বন্ধ কি হেলাফেলা করা যায়। তাছাড়া ঘনঘন দিদির বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকা নিয়ে লোকে ঠাট্টার ছলে একটু আধটু কথাও শোনাচ্ছে– দুই মেয়েকেই এক গাছতলে ফোকটে বেঁধে দিয়েছে লাখোর মা। সুতরাং অসিতবাবুর অকারণ আশঙ্কায় কান দেওয়ার মানে হয় না। বরং শাশ্বতী চৌধুরী মেয়ের বিয়েতে দেওয়া থোয়া নিয়ে কথা বলেন তার প্রিয় বান্ধবী লাখোর মায়ের সঙ্গে।

দ্বিরাগমণে ছোটো মেয়েদের আসতে দেরি দেখে লাখোর মা ঘরবার করছে। সে আজ বাবুঘরে যাবে না, সে যে লোকের বাড়ি কাজ করে তা জামাইরা জেনে ফেললেও গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। সকাল দশটা নাগাদ আসার কথা ছিল, বিকেল সাড়ে চারটে গড়াতে চলল। মিতুর মায়ের মতো মেয়েদের নিয়ে অত আতুপুতু করা লোকের বাড়ি খেটে খাওয়া মায়েদের থাকে না। কিন্তু এত দেরি? হরিয়ালি কেন, তাকে ঘণ্টাখানেক আগে দুশ্চিন্তার জন্য মুখ ঝামটা দেওয়া রাজুও উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিফোন বুথে ছুটল।

প্রায় সাথে সাথেই দুই ভাই একত্রে ঘরে ঢুকল। কিসান হাঁপাতে হাঁপাতে খাটিয়ায় বসে পড়ল।

‘কী হইল রে? গৌরীর একটো খবর লিয়ে আসতে পাঠালম রাজুকে সিটো না কইরে ঘরকে চলে এলি যে? বুনটোর জইন্য কি টুকদু চিন্তা হয় না তুদের?’

‘মা!’ ডাকটা আর্তনাদের মতো শোনাল যেন। ‘গোরীদের বাড়িটো ধসে গেঁইনছে। দিলীপ খাদে ছিল। উঠে আইসতে পারে নাই। আর ছাদ চাপা পইড়ে গৌরী আর উয়ার শাশুড়িটোও গেঁইনছে। দোফোর থেইক্যে হাসপাতাল ডাক্টার এইসব চইলছে উয়াদের। বডি এইমাত্তর হাসপাতাল থেইক্যে ছাইড়লেক।’

লাখো উঠোনে বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া হেঁসেলে চায়ের যোগাড় করছিল। বোন-ভগ্নীপতি আসবে বলে মাকে সাহায্য করতে কুমারডুবি থেকে দৌড়ে এসেছে। বাসনপত্র ফেলে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়ে জামাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অলীক সাব্যস্ত হওয়াতে হরিয়ালি ডুকরে উঠল, ‘হেই ভগমান, ভগমানের কেমুন বিচার গো! আমার মুখপুড়ি বিটিটোকে ছেইড়ে ভালোটাকে লিয়ে লিলেক…!’

(এই গল্পের সব চরিত্র ও নাম কাল্পনিক)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...