প্রথমবার এক সরকারি কাজে লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণে যাতায়াত পুরোপুরি ছিল আকাশপথে– অর্থাৎ বিমানে কোচি পৌঁছে আবার আকাশপথে আগাত্তি দ্বীপে পৌঁছোনো। লাক্ষাদ্বীপের মধ্যে এই একটি দ্বীপেই বিমান অবতরণ করতে পারে। এই আগাত্তি দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ছিল আকাশপথে। তবে বিমানে নয় হেলিকপ্টারে।
এই ভ্রমণের বিশেষত্ব হল, কোচি থেকে সব পরিবহন ও পর্যটন হবে জলপথে জাহাজে। ভারতীয়দেরও লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের অনুমতিপত্র লাগে। এই সফরে অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করে দেবে আয়োজক সংস্থা অর্থাৎ ‘স্পোর্টস’। সারাবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের অনুমতি পায়, ফলে অনেককে বিফল মনোরথ হতে হয়। যেহেতু দ্বীপের অভ্যন্তরে সরকারি পর্যটক আবাস ও হোটেলের সংখ্যা হাতেগোনা, তাই ‘স্পোর্টস’ আয়োজিত সফরে পর্যটকদের জাহাজে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর সারাদিন ঘোরাঘুরি দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে।
চট করে ইচ্ছে হলেই কিন্তু লাক্ষাদ্বীপ যাওয়া যায় না। অনেক আগে থেকে সিট সংরক্ষণ ও অনুমতিপত্রের জন্য ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। যদিও ‘স্পোর্টস’-এর প্রধান অফিস কোচিতে, তবে কলকাতাতেও কয়েকটি ভ্রমণসংস্থার অফিসে লাক্ষাদ্বীপের যোগাযোগ ও বুকিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘ইন্ডিয়া টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর অনুমোদিত ‘অশোক ট্রাভেলস অ্যান্ড টুর’। এছাড়া রয়েছে ‘ডলফিন ট্রাভেলস’ ও আরও কয়েকটি অনুমোদিত সংস্থা। সফর নভেম্বর মাসে কিন্তু নাম নথিভুক্ত করতে হল জুন মাসে আর আগস্ট মাসেই প্রাথমিক বুকিং করে রাখতে হল। এরপর ট্রেন-প্লেনের টিকিট কাটা।
লাক্ষাদ্বীপে আছে মোট ৩৬টি দ্বীপ আর তার মধ্যে ১১টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এগুলি হল মিনিকয়, কালপেনি, কাভারাত্তি, অ্যানড্রট, আগাত্তি, আমিনি, কাদমাত, কিস্তান, বিত্রা, চেতলাট আর বাঙ্গারাম। এর মধ্যে বাঙ্গারাম দ্বীপ শুধুমাত্র বিদেশিদের মনোরঞ্জনের জন্য উন্মুক্ত, মাত্র শ’খানেক মানুষের বসতি এখানে। কোচি থেকে এই দ্বীপগুলির দূরত্ব ২৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে।
বিদেশিদের তো বটেই ভারতীয়দেরও কিন্তু লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়। এটা এই অঞ্চলে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক আকর্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন বহু পর্যটক, তাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে নীল সমুদ্র, সবুজ প্রবালদ্বীপ, সাদা বালির মসৃণ অসাধারণ সব সৈকত, বিভিন্ন জলক্রীড়ার ব্যবস্থা, সামুদ্রিক প্রাণী দেখার অতুলনীয় সুযোগ। আরও কত কি! আরব সাগরের বুকে ছোটো বড়ো এই ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে লাক্ষাদ্বীপ। এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রায় ৩২ বর্গকিলোমিটার।
লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস চতুর্থ শতক থেকে শুরু করা যায়। কেরলের রাজা পেরুমলের রাজত্বকালে কিছু দুঃসাহসী মানুষ জীবিকা ও বাসস্থানের আশায় কেরল উপকূল থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমিনি, কাভারাত্তি, অ্যানড্রট ও কালপেনি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। পরে তারা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দ্বীপগুলিতে। পেরুমল ছিলেন হিন্দু রাজা। কেরল থেকে আগত মানুষগুলিও ছিল হিন্দু। কিন্তু সপ্তম শতাব্দী থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন সন্ত উবাইদুল্লা। ক্রমে ক্রমে ইসলাম ধর্ম আরও বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে লাক্ষাদ্বীপের
জনসংখ্যার প্রায় ৯৪ শতাংশ মুসলমান, ৪ শতাংশ হিন্দু আর বাকি খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ। লাক্ষাদ্বীপ কেন্দ্রশাসিত এক জেলা বিশেষ। এই জেলার অন্তর্গত চারটি তহশিল। কাভারাত্তি দ্বীপ হল তার প্রধান প্রশাসনকেন্দ্র তথা রাজধানী, প্রশাসকই হল প্রশাসনের শীর্ষে।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস আকস্মিক আগ্নেয় উৎপাতের ফলেই এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রবালের ঘন বেষ্টনী ঘিরে রেখেছে এই দ্বীপগুলিকে। চার্লস ডারউইনের মতে সমুদ্রে সাধারণত মৃত আগ্নেয়গিরিকে ঘিরেই প্রবাল তথা কোরালের সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। ক্রান্তীয় জলবায়ু এই পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়। আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত হলে প্রবাল দিয়ে ঘেরা স্ল্যাটলের সৃষ্টি হয়। এই সব শর্ত মেনেই হয়তো লাক্ষাদ্বীপের প্রবাল দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম হল লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ, এর আগে এর পরিচিতি ছিল লাক্বাডিভ মিনিকয় ও আমিনদিভি দ্বীপপুঞ্জ।
কোচিন তথা কোচি শহর হল গেটওয়ে অব লাক্ষাদ্বীপ। আকাশপথে বা জলপথে, লাক্ষাদ্বীপ যেতে হলে এই কোচিতে আসতেই হবে। তবে কালিকট বা ম্যাঙ্গালোর (দুটিই সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর) থেকেও কখনও কখনও লাক্ষাদ্বীপের জাহাজ ছাড়ে। লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের নির্দিষ্ট তারিখের আগের দিন বিমানে পৌঁছে গেছি কোচি বিমানবন্দরে আর সেখান থেকে কোচির হোটেল মেরিনা রিজেন্সিতে। বিমানবন্দর থেকে এরনাকুলাম তথা কোচির এই হোটেলে পৌঁছোতে সময় লাগল প্রায় ঘন্টাখানেক। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রাস্তার অবস্থাও ভালো। কোচির হসপিটাল রোডের এই হোটেল নির্বাচনের প্রধান কারণ হল এখান থেকে কাল ভোরে আমাদের অভীষ্ট গন্তব্য ‘স্পোর্টস’ অফিস ও বোট জেটির অনেকটাই কাছে।
নভেম্বর মাস। কলকাতায় শীত না পড়লেও বর্ষা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কোচিতে এখনও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যাটা তাই হোটেলের ঘরেই বসে থাকতে হল বর্ষার কারণে। লাক্ষাদ্বীপের আবহাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মতো– শীত প্রায় নেই, তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০০ – ১৫০০ মিলিমিটার। লাক্ষাদ্বীপে কিন্তু বৃষ্টি যথেষ্ট হলেও বৃষ্টির জল খুব মূল্যবান। পানীয় জলের অভাব মেটানো হয় বিভিন্নভাবে সঞ্চিত বৃষ্টির জলে। লাক্ষাদ্বীপে পানীয় জলের এই অভাবের জন্যই বাকি দ্বীপে মানুষের বসতি গড়ে ওঠেনি।
শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে লাক্ষাদ্বীপের অন্তর্গত দ্বীপগুলি সব প্রবালদ্বীপ বা কোরাল আইল্যান্ড। কোরাল হচ্ছে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র জীব যায় নাম পলিপ। এই পলিপ বসবাস করে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের এক শক্ত খোলস, এপিথিকার মধ্যে। এই পলিপ ফটো-সিন্থেসিসের মাধ্যমে সমুদ্রের জল থেকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট সংগ্রহ করে আর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে খুব ছোটো ছোটো মাছ বা প্ল্যাংকটন। কোটি কোটি পলিপ একত্র হয়ে প্রবাল কলোনি গঠন করে। প্রবালের শক্ত কাঠামো পরস্পর জুড়ে গিয়ে কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীর তৈরি করে। পলিপগুলি মৃত হওয়ার পরও এই কাঠামো থেকেই যায় আর তার ওপরে আবার জন্ম নেয় নতুন পলিপ। এই মৃত পলিপের শক্ত কাঠামোকেই আমরা সাধারণত প্রবাল বলি। এই লাক্ষাদ্বীপে অনেক রকমের কোরালের অস্তিত্বের কথা জানা গেছে। আর প্রবাল প্রাচীরের প্রসঙ্গ উঠলেই মনে পড়ে যায়, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রবাল প্রাচীরের কথা– অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্ব তটরেখা বরাবর ‘দি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ’ যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার।
রাতে শুতে গেলাম উত্তেজনা নিয়ে কারণ কালকেই আমরা লাক্ষাদ্বীপ আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়ব। তার আগে লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস ভূগোল প্রকৃতি নিয়ে একটু পড়াশোনা করে নিয়েছি।
বেলা নটা নাগাদ পুরি-সবজি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। অটোওয়ালা ভুল করে আমাদের প্রথমে নিয়ে গিয়ে তুলল ‘স্পোর্টস’-এর প্রশাসনিক অফিসে। কিন্তু সেখান থেকে তো জাহাজ ছাড়বে না, রিপোর্ট করতে হবে উইলিংডন আইল্যান্ড ওয়ার্ফ (এফসিআই গোডাউনের কাছে) স্পোর্টস অফিসে। এই উইলিংডন আইল্যান্ড কিন্তু প্রাকৃতিক নয়। কোচিন বন্দর গভীর করার জন্য যে মাটি কাটা হয়েছিল, তা থেকেই সৃষ্ট এই দ্বীপ। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। এরনাকুলাম শহর থেকে একটি সেতু দিয়ে এই দ্বীপ যুক্ত। রাস্তার দুপাশে স্কুল, মেরিন ইউনিভার্সিটি, ফুড কর্পোরেশনের গুদাম, ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপো, হোটেল ইত্যাদি, বসতি অঞ্চল বোধহয় কিছু কম। পৌঁছে গেলাম স্পোর্টস-এর টুরিস্ট অফিসে। একতলার বিশাল হলঘরে দুটি কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। একই সঙ্গে লাইনে সামিল হয়েছে লাক্ষাদ্বীপের পর্যটক ও দ্বীপের অধিবাসীরা। ধীরে ধীরে লাইন এগোচ্ছে। লাইনের মুখে পৌঁছে আবার অপেক্ষা– নির্দেশ হল ওই বাড়িরই দোতলার অফিস ঘর থেকে বোর্ডিং পাস, মালপত্রের ট্যাগ, উপহার স্বরূপ টিশার্ট রসিদ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য। সে সব কাজ মিটিয়ে আবার মূল লাইনে ফিরে আসি। জাহাজে, বিমানের মতোই চেক-ইন ব্যবস্থা। লাগেজে ট্যাগ লাগিয়ে নাম-ধাম, কেবিন নম্বর লিখে, কর্তৃপক্ষের পরীক্ষান্তে জমা নিয়ে নিল।
এরপর দেহ ও ব্যাগ তল্লাশির পর কাউন্টারের ওপারে ঘর পেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। সেখানেই অপেক্ষা করছে বাস। এই বাসে চেপে আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম ‘সমুদ্রিকা’ জেটিতে– একেবারে আমাদের জাহাজ কাভারাত্তির সামনে। সাদা ধবধবে বিলাসবহুল প্ত-তলা জাহাজ– যেন বিশাল এক সাদা রাজহাঁস। এর রূপ মন্ত্রমুগ্ধ করবেই। সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম আমাদের পূর্বনির্ধারিত কেবিনে একেবারে পাঁচতলায়। লাগেজ ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে ঘরের সামনে। পুরো জাহাজ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। পাঁচতলা ও চারতলা ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট। চারতলায় কেবিন ছাড়াও রয়েছে এক বিশাল ডাইনিং হল ও বিনোদন কক্ষ। তিনতলায় রয়েছে সেকেন্ড ক্লাস কেবিন, ছোটো হাসপাতাল, রিসেপশন ও কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলায় সেকেন্ড ক্লাস কেবিন আর একতলায় বাংকার ক্লাস। প্রত্যেক তলাতেই একটি করে ডেক।
এই সব দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। বেলা দেড়টা বেজে গেছে– এখনও জাহাজ ছাড়ার কোনও উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। ক্ষুধার তাড়নায় এবার ছুটি চারতলায় ডাইনিং হলে। লাঞ্চের খোঁজখবর নিতে। একটু পরেই লাঞ্চ সার্ভ করা হল– ভাত, ডাল, স্যালাড, পকোড়া, টুনা মাছ ভাজা, চিকেনের ঝোল আর ফল। সবই সেল্ফ সার্ভিস ব্যবস্থা, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ে নিতে হবে।
আমাদের লাঞ্চ শেষ হবার পরই দেখি জাহাজ নোঙর তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। নানারকম কসরত করে বেলা আড়াইটা নাগাদ জাহাজ ছাড়ল। লাঞ্চের পরেই মাইকে ঘোষণা হল বেলা চারটের সময় এই সফরের টুর ম্যানেজার আমাদের এই পাঁচদিনের লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের সফরসূচী ও নিয়মাবলী নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করবেন। যথা সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম জাহাজের চ্ছ্র-তলার রিক্রিয়েশন রুমে। টুর ম্যানেজার শুরু করে দিলেন তাঁর বক্তব্য। –‘আমরা চলেছি প্ত দিনের সমুদ্রম প্যাকেজে, আজকে প্রথম দিন। কালকে আমরা পৌঁছে যাব প্রথম দ্বীপে। এই সফরে আমরা তিনটি দ্বীপ ভ্রমণ করব– কাভারাত্তি, মিনিকয় আর কালপেনি। দ্বিতীয় দিনে কাভারাত্তি, তৃতীয় দিনে মিনিকয় আর চতুর্থ দিনে কালপেনি দ্বীপ আমাদের ভ্রমণ সূচীতে পড়ে। পঞ্চম দিনে আমরা ফিরে যাব কোচির জেটিতে। দ্বিতীয় দিন থেকে জাহাজে ভোরের চা, ব্রেকফাস্ট ও ডিনার দেওয়া হবে আর লাঞ্চ সার্ভ করা হবে যে-দ্বীপে সফর সেখানে। সকলকে যে ফোটো আইডেনটিটি কার্ড দেওয়া হয়েছে তা যেন সফরকালে অবশ্যই পরে থাকে প্রত্যেকে।’ এরপর তিনি বুঝিয়ে দিলেন দ্বীপে যাওয়া আসার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে। জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকবে দ্বীপের তীরভূমি থেকে অনেকটা দূরে, ছোটো ছোটো বোট, জাহাজ থেকে দ্বীপে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে দেবে জাহাজে। সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ থেকে বোটে আবার বোট থেকে জাহাজে ওঠার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এই ব্যাপারে দক্ষ কর্মীরা থাকবে– এদের বলা হয় ক্যাচার।’ আধঘন্টার মধ্যেই আলোচনা শেষ।
এবার কেবিনের দিকে একটু নজর দিই। একটা কেবিনে দুজনের বাস। টু-টায়ার বিছানা সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা। রাইটিং টেবিল, আলমারি, সংলগ্ন স্নানাগার (ঠান্ডা ও গরম জল) নিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা। কেবিন থেকে ছোট্ট জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে ফিরে আসি আপার ডেকে। আকাশে রোদ ঝলমল করছে, আকাশও মেঘমুক্ত নীল। তবে রোদের তেজ খুব বেশি, গরমও লাগছে। জাহাজ কাভারাত্তি এখন জলের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। ডেকে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিয়েছি সুদূরে। ক্রমে ঝাপসা হয়ে এল তীরের গাছপালা, ঘরবাড়ি।
আমরা চলেছি ভেম্বানদ লেকের মধ্যে দিয়ে। লেকের দুপাশে বিশাল বিশাল হোটেল, জলে নানা ধরনের জলযান– জাহাজ ট্রলার, নৌকা, জেলে ডিঙি। তীরে দেখা গেল লাইন দিয়ে টাঙানো চাইনিজ ফিশিং নেট। এই অঞ্চলেই কেবলমাত্র এই প্রাচীন পদ্ধতিতে এখনও মাছ ধরা হয়। মোহনা ছাড়িয়ে জাহাজ এবার অসীম সমুদ্রে ভেসে পড়ল। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ছে– দিনের শেষের রবির কিরণ এখন ছড়িয়ে পড়ছে জলে। এখন আর সূর্যের সেই প্রখর তেজ নেই। ডেকে যেন এখন পুরো ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষ এসে জুটেছে। ছবি তোলার মহা ধূম।
ইতিমধ্যে টকটকে লাল সূর্য বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রের জল এখন সোনালি। সেই সোনালি জলের প্রেক্ষাপটে সাদা পাখির দল নীড়ে ফিরছে স্থলভূমির দিকে। সূর্যদেব ডুব দিলেন সাগরে। আকাশে লাল আলোর আলপনা আর একটু পরেই হঠাৎই যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এল প্রকৃতিতে। মোবাইলে আর টাওয়ার নেই– সব সংযোগ ছিন্ন– এখন শুধু প্রকৃতিকেই জড়িয়ে ধরতে হবে। জলের রং এখন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ আকাশে তারার উৎসব। জাহাজের দুপাশে সাদা জলের ফেনা তুলে এই অন্ধকারেও যেন ঝলমল করছে। ডেকে এখনও ভিড় জমে রয়েছে– ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছে।
চা-পানের ডাক পড়েছে। গুটিগুটি ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়ালাম। জাহাজ নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। শুধু একটা হালকা দুলুনি পায়ের নীচে অনুভব করছি। সেই দোলা যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে– এখন আমি আর স্থলে নেই সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছি অচেনা দ্বীপের সন্ধানে। রাত আটটায় ডিনার শেষ করে আর কিছু করার নেই। রাত ন’টাতেই বিছানায়।
১৯৫৬ সালে দ্বীপপুঞ্জের ভারতভুক্তি এবং ১৯৭৩ সালে লাক্ষাদ্বীপের নামকরণ। তবে লাক্ষার সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের কোনও সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ মনে করেন জলের নীচে আরও অসংখ্য দ্বীপ আছে। হয়তো লক্ষ দ্বীপ থেকে লাক্ষাদ্বীপ নামকরণ হয়েছে। এবার আসি লাক্ষাদ্বীপের জলবায়ু ও আবহাওয়া সম্পর্কে। গ্রীষ্মপ্রধান এই অঞ্চলে দক্ষিণপশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ফলে জুন থেকে অক্টোবর বর্ষাকাল। অক্টোবরের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ভ্রমণের পক্ষে অনুকূল যদিও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-ই শ্রেষ্ঠ সময়। সারা দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ফসল হল নারকেল। ব্রেডফ্রুট হল জাতীয় গাছ। আর জলের নীচের জীবজন্তু ছাড়াও আকাশে সামুদ্রিক পাখিদের মধ্যে তারাতালি বিখ্যাত। মাছধরা আর নারকেল চাষ এই দ্বীপের মানুষের প্রধান জীবিকা। টুনা মাছ টিনজাত করা, নারকেল ছোবড়া, নারকেলমালার নানা শিল্পদ্রব্য ইত্যাদিতে এখানের মানুষদের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে কাভারাত্তি দ্বীপের কাছাকাছি হলেও গভীর সমুদ্রে। চোখে পড়ছে কাভারাত্তি দ্বীপের আলো। আস্তে আস্তে আকাশে আলো ফুটছে– সূর্য উঠে নতুন দিনের সূচনা করছে। তা হলে পৌঁছে গেলাম কাভারাত্তি! কোচি থেকে ৪০৪ কিমি দূরে লাক্ষাদ্বীপের প্রধান শহর তথা রাজধানীর দোরগোড়ায় আমরা উপস্থিত। ভোর ছ’টা প্রাতঃকালীন চায়ের সময়– তাই চা-তৃষ্ণা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ডাইনিং হলে। চা-কফির সঙ্গে নানাধরনের কেক ও বিস্কিটেরও ব্যবস্থা রয়েছে। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা হয়েছে সকাল আট-টার সময় সমস্ত পর্যটকেরা ব্রেকফাস্ট সেরে লাইফ জ্যাকেট পরে যেন জাহাজের প্রবেশ-নির্গমনের দ্বার-এ হাজির হন।
প্রতি ঘরের খাটের নীচে এই জ্যাকেট রাখা আছে। যথাসময়ে ব্রেকফাস্ট সেরে প্রস্তুত হয়ে গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে জাহাজের নির্গমন পথে পৌঁছে গেছি। জাহাজ তো দাঁড়িয়ে আছে গভীর জলে কারণ দ্বীপের আরও কাছে গেলে প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্বা লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। ছোটো ছোটো স্পিড বোট জাহাজের খোলের কাছে এসে যাত্রীদের তুলে নিয়ে দ্বীপের জেটিতে নামিয়ে দেবে। তবে উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ থেকে বোটে ওঠা তত সহজ নয়। এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ রয়েছে। আগে জাহাজ থেকে আইল্যান্ডার তথা স্থানীয় যাত্রীদের বোটে তোলা হচ্ছে। তারপরই পর্যটকদের পালা।
নীল জলের মধ্যে অদূরে কাভারাত্তি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। আমাদের বোট ছেড়ে দিল। জলের রঙের কি বৈচিত্র্য– নেভি ব্লু, ফিরোজা, আকাশি নীল, তুঁতে সব রং যেন পরতে পরতে মিশে রয়েছে এই সমুদ্রে! বোট যতই এগোচ্ছে ততই দ্বীপের সীমানা স্পষ্ট হচ্ছে। দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম জেটিতে। কাভারাত্তির জেটি বেশ বড়ো ও প্রশস্ত। অনেক জেলে নৌকো আর ছোটো জাহাজ অপেক্ষা করছে জেটির আশেপাশে। সাদা নরম বালির সৈকত ছুঁয়ে আছে দ্বীপটিকে। জেটি থেকে সামান্য হেঁটেই সৈকতের ধারেই কাভারাত্তি রিসর্ট। মোলায়েম ঢেউ চুমু খেয়ে যাচ্ছে সাদা বালির তটভূমিকে। সমস্ত ভ্রমণার্থীকে দেওয়া হচ্ছে ‘ওয়েলকাম ড্রিংক’ আর কিছু নয় মিষ্টি ডাবের জল। জল খেয়েই যার শেষ নয় খোলা ছাড়িয়ে তার ভেতর মিষ্টি শাঁসও উপভোগ করা যাবে।
ডাব খেয়ে এবার দ্বীপের অন্যান্য প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরাই। এখানে প্রধান দুটি রং নীল ও সবুজ। নীল হল সমুদ্রের রং আর সবুজ হল দ্বীপের অসংখ্য নারকেল গাছের রং। অনেকেই সৈকতের নরম বালিতে নেমে সমুদ্র স্নানে মগ্ন হয়ে পড়েছে। জল এখানে উত্তাল নয়, নরম মোলায়েম স্রোত যেন বার বার স্পর্শ করে যাচ্ছে তার শীতল পরশ দিয়ে। ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হচ্ছে সারাদিনের প্রোগ্রাম। প্রথমে গ্লাসবটম বোটে সমুদ্র সফর। এই সফরের জন্য প্রত্যেককে কুপন দেওয়া হল। এর জন্য আলাদা কোনও মূল্য দিতে হবে না। ঘোষণা হওয়া মাত্র লাইন পড়ে গেছে। বিতরণ করা হচ্ছে নতুন লাইফ জ্যাকেট আগের জ্যাকেট জমা দিয়ে নতুন জ্যাকেট পরতে হল। বেশ কড়া রোদ।
ঘন্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই গ্লাসবটম বোটে চড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। এই ধরনের বোটের মেঝেতে কাঠের ফ্রেমে স্বচ্ছ মোটা কাঁচ লাগানো থাকে। যার ফলে বোটের নীচের জল প্রায় পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। আর জলের সঙ্গে দেখা যাবে জলের নীচে আশ্চর্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সম্পদকে। স্বচ্ছ জলের নীচে মায়াবী এক জগৎ। বোট এগিয়ে চলেছে তীর থেকে গভীরতায়। প্রথমে স্বচ্ছ জলের নীচে দেখতে পেলাম মাটি, ঢিবি, বালি তারপর একটু গভীরে প্রবেশ করি প্রাণী জগতে! ছোটো বড়ো কচ্ছপ, নানা ধরনের রঙিন ও সাদা-কালো মাছ, মৃত ও জীবিত কোরাল, নানা ধরনের সামুদ্রিক উদ্ভিদ, সি কিউকাম্বার, ইল মাছ। প্রবাল প্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের দল। রয়েছে কাঁটাওয়ালা সি-আর্চিন নানা বর্ণের নানা আকৃতির মাছ। মাছের মধ্যে ব্লু-ব্ল্যাক ইয়েলো সার্জেন্ট, টাইগার ফিশ চিনতে পারলাম।
সমুদ্রের তলদেশের গভীরতা চার-পাঁচ ফুট থেকে কুড়ি-পঁচিশ ফুটের মধ্যেই আমাদের ঘোরাঘুরি, তলদেশ কখনও বালি কখনও সবুজ শ্যাওলা বা কখনও বা ঘাসে ঢাকা। কোরালের নানা ধরনের গঠনও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সত্যিই নীল জলের নীচে এক অপরূপ রঙিন সাম্রাজ্য। মাঝে মাঝে বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে বোট স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে ফলে আরও ভালোভাবে এই জলের নীচের রঙিন চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হচ্ছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট গ্লাসবটম বোটে ভ্রমণ শেষে বোট এবার তীরের দিকে মুখ ফেরাল। মাঝ সমুদ্রের ঘন নীল জল তীরের দিকে আসতে আসতে রং বদল করছে– নীলের নানা শেডে।
এবার সাঁতার কাটা, সমুদ্রস্নান। কেউ কেউ বিশেষ ধরনের নৌকায় কায়াকিং করছে। সরু প্লাস্টিকের নৌকায় এক-দুই জন বসে একটা চ্যাপটা পাত লাগানো দাঁড় (দু-দিকেই) দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নৌকা চালনা এক নতুন অভিজ্ঞতা। উলটে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকলেও, নতুনদের অগভীর জলে বেশ মজাই লাগবে। তাছাড়া রয়েছে স্নরকেলিং ও স্কুবা ডাইভিংয়ের ব্যবস্থা। এই দুটি জলক্রীড়ার জন্য অবশ্য আলাদা অর্থমূল্য দিতে হবে (স্নরকেলিং তিন’শ টাকা, স্কুবা ডাইভিং কুড়ি মিনিট দু হাজার টাকা)। সৈকতের পিছনেই কাভারাত্তি রিসর্ট। সেখানে পাকা বাড়ি, নারকেল গাছের উদ্যান আর সামনেই নরম বালি ও সবুজ লনের মধ্যে রঙিন চাঁদোয়া লাগিয়ে চেয়ার পেতে খাওয়াদাওয়া অর্থাৎ লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। দূরেই রয়েছে ‘গ্রিন টয়লেট’ ব্যবহারের অপেক্ষায়। লাঞ্চের পর সামান্য বিশ্রাম, তারপরে বাসে চড়ে দ্বীপ পরিক্রমা ও মিউজিয়াম সফর।
কাভারাত্তিতে নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। রাস্তার দু-পাশেই নারকেল গাছ, পাতা ও ফলের যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে। এই প্রথম লক্ষ করলাম নারকেলের রঙের নানা বৈচিত্র্য– সবুজ হলুদ বাদামি। নারকেল ছাড়াও বাদাম, কৃষ্ণচূড়া ও কলাগাছের দেখা মেলে। তবে নারকেলেরই প্রাধান্য। রাস্তায় মোটর গাড়ির সংখ্যা নগণ্য। কাভারাত্তি থেকে দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসন পরিচালিত হয়। শহরে সাধারণ সুযোগ সুবিধা রয়েছে– দোকান, বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, মসজিদ। তবে সিনেমা হল চোখে পড়েনি। সমুদ্রের কিনারা ধরে বা ভেতরেও রয়েছে বসতি অঞ্চল। সব বাড়িই একতলা ইটের দেয়াল, টালির ছাদ, পাকা ছাদও রয়েছে। গাড়ি থামল আমাদের গন্তব্য অ্যাকোয়ারিয়াম তথা মেরিন মিউজিয়ামের সামনে।
মিউজিয়ামের সামনে এক খোলা চৌবাচ্চায় এক হাঙরের মুক্ত বিচরণের দৃশ্য খুব আশ্চর্য লাগে। প্রকৃতপক্ষে এখানে মিউজিয়াম একটি নয়, দুটি। মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আর নবতম সংযোজন নিউমেরিন মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। মিউজিয়াম দুটিতে প্রদর্শিত হয়েছে কিছু দুর্লভ সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, দুর্লভ কোরাল, ইল, অক্টোপাস, স্টোন ফিশ ইত্যাদির জীবন্ত সংগ্রহ। এছাড়া স্পার্ম হোয়েলের বিশাল কঙ্কাল, নানা ম্যাপ – মডেল, ফটো, পেন্টিং, মৎসজীবিদের ব্যবহূত নৌকা (কাভারাত্তি) ও মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়েছে। আধঘন্টার মধ্যেই মিউজিয়ামের সবকিছু দেখা হয়ে যায়। গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এল সমুদ্রের ধারে রিসর্টে।
বিকেলের চা-পর্বের শেষে টুর ম্যানেজারের নির্দেশে ফিরে চলি জেটির দিকে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে তারই প্রতিফলন হচ্ছে সমুদ্রের জলে। নারকেল গাছের সারিতে এই বিকেলে হাওয়ার দোলা লেগেছে তারা যেন বলছে আবার এসো। জেটি থেকে কয়েকটি ট্রিপে ফিরে এলাম জাহাজে। একই রুটিনে রাত ৪-টায় ডিনার সেরে কিছুক্ষণ ডেকে কাটালাম। জাহাজ ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, অন্ধকারে জল কেটে চলেছে, চলার গতিতে সাদা ফেনার মতো ঢেউ উঠছে। কালকে ভোরে আমরা পৌঁছে যাব মিনিকয় দ্বীপে। এবার বিছানায়, আবার ভোরে উঠতে হবে তো!
ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ডেকে বেরিয়ে দেখি আকাশ মেঘে ঢাকা, বৃষ্টি পড়ছে না তবে রাতে বৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ পৌঁছে গেছে মিনিকয় দ্বীপে তবে আজ দ্বীপ থেকে অনেকটা দূরে জাহাজ নোঙর ফেলেছে। বহুদূর থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বীপ একেবারে সবুজে ঢাকা অর্থাৎ নারকেল গাছের জঙ্গল। প্রাতঃকালীন চা, একটু পরে ব্রেকফাস্ট সেরে নিতে হল তাড়াতাড়ি কারণ বেরোতে হবে সাড়ে সাতটায়। আবার জ্যাকেটে সজ্জিত হয়ে জাহাজের বাহির পথে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আজ সমুদ্র বেশ অশান্ত, উত্তাল। অনেকগুলি বোট আজ নিয়োগ করেছে কর্তৃপক্ষ যেহেতু তীরভূমি অনেকটা দূরে, তাই বোট ঘুরে এসে আবার ট্রিপ দিতে অনেক বেশি সময় লাগবে। বিশেষজ্ঞ ক্যাচারদের সাহায্যে তরঙ্গায়িত সমুদ্রের মধ্যে দোদুল্যমান বোটে ওঠা হল।
হঠাৎই যেন মেঘ ঘনিয়ে এল। মাথার ওপর তো কোনও ছাদ নেই, বৃষ্টি হলে ভিজতে হবে। ঝিরঝির করে একটু বৃষ্টি হয়ে গেল। অবশ্য বেশিক্ষণ নয়, বৃষ্টি থেমে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা শুরু হয়ে গেল আকাশে। প্রায় আধঘন্টা বোটজার্নি করে পৌঁছে গেলাম মিনিকয় দ্বীপের জেটিতে। মিনিকয় হল লাক্ষাদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। দ্বীপটি লম্বায় প্রায় রচ্ কিলোমিটার আর আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকার। এই দ্বীপের অবস্থিতি একেবারে দক্ষিণে। এই দ্বীপ মালদ্বীপের বেশ কাছে বলেই হয়তো এখানের মানুষের সংস্কৃতিতে মালদ্বীপের প্রভাব যথেষ্ট। ভাষাও এখানে মাল, যদিও লাক্ষাদ্বীপের অন্যান্য দ্বীপে মলয়ালম।
আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে মিনিকয়ের প্রকৃতি। জেটি থেকে এবারে হাঁটাপথ নয়, অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে পড়লাম। নারকেল গাছে ঘেরা সবুজ দ্বীপের বুক চিরে গাড়ি ছুটল। পেরিয়ে এলাম বেশ বড়ো সরকারি হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর আর নারকেল জঙ্গল যেন ঘিরে রেখেছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে এক একটি বাড়ি, সেখানেও গাছগাছালি কম নয়– নারকেল ছাড়াও রয়েছে আম, কাঁঠাল, কলা গাছ। কাজু গাছেরও সারি নজরে আসে। বাড়িঘর বেশ খোলামেলা, মোটেও ঘিঞ্জি নয়। প্রায় আধ ঘন্টা সড়ক পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মিনিকয়ের রিসর্টের সামনে।
নামার সঙ্গে সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিল ওয়েলকাম ড্রিংক নারিয়েল-পানি। বেশ বড়ো রিসর্ট। সামনেই সাদাবালির সৈকত যেন নরম কার্পেট বিছানো আর সমুদ্রের অনন্য নীল জল মৃদু তরঙ্গের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে সৈকতে। সৈকতের ওপর কাঠের ইজিচেয়ার– তার ওপরে খড়ের ছাউনি বা ছাতা। প্রচুর নারকেল গাছ ছড়ানো ছিটানো। আর সমুদ্রের রং তো শিল্পীর ইজেলে যত রকমের নীল রং হয় তারই যেন এক প্রদর্শনী। বিচে পাতা রয়েছে রংবেরঙের চেয়ার, মাথায় সামিয়ানা– এটাই আমাদের বিশ্রামস্থল, রিসর্টের ঘরে নয়। রিসর্টের বাড়ির সামনে সবুজ লন তারই এক পাশে বিচ-ভলিবলের নেট খাটানো। সমুদ্রে ভাসছে রঙিন নৌকা। ছবি তোলার আদর্শ পরিস্থিতি। তবে ছবি তোলার আর সময় পাওয়া গেল না, মাইকে ঘোষণা হল গাড়িতে চলে আসার জন্য– এখন লাইটহাউসে নিয়ে যাওয়া হবে।
গাড়ি চলল লাইটহাউস অভিমুখে। রাস্তাঘাট ভালো, নারকেল-আম-কাঁঠালের বাগান ছাড়াও এবার চোখে পড়ল কলা, আমলকী, ব্রেডফ্রুট গাছ, কাজুবাদামের সারি ঝুঁকে পড়েছে রাস্তায়। বাড়িঘর অধিকাংশ পাকা, তবে টালির ছাদ। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাইটহাউস চত্বরে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাতিঘর যেন দ্বীপের শাসনকর্তা। লাইটহাউস ঘিরে রেখেছে বাগান, লন আর নারকেল বীথি। বাতিঘরের চূড়া যেন ফিসফিস করে আকাশ মেঘের সঙ্গে কথা বলছে। ১৮৮৫ সালে নির্মিত এই লাইটহাউস নয় তলা উঁচু। একসঙ্গে ৫০ জন ওপরে উঠতে পারবে। তারা নেমে এলে বাকিরা যাবে। এই সাদা রঙের লাইটহাউসে উঠতে শুরু করি, প্রথমে ১৮০টি সাধারণ সিঁড়ি তারপর খাড়াই ২৬টি ধাপ, এরপর একেবারে খাড়া শেষ ধাপ পেরিয়ে এবারে শীর্ষে। মাঝে মাঝে জানালা রয়েছে ওঠার পথে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি অবলোকনের সঙ্গে দমও নিয়ে নিয়েছি। একদম ওপরে ঘেরা রেলিং দেওয়া বারান্দা। সেখান থেকে এক অসাধারণ প্রেক্ষাপটে সমুদ্র দর্শন। দুধারে যেন দুরকমের সমুদ্র। একদিকে সমুদ্রের রং সাদা-ঘোলাটে। মাঝখানে সাদা বালির সৈকত পেরিয়ে অনেকটা এলাকা জুড়ে সবুজ নারকেল গাছের জঙ্গল। তারই মাঝে দেখা যাচ্ছে একটি হ্রদ সম্ভবত লোনা জলেরই। আর এক ধারে লেগুনের দিকে নীল-সবুজ সমুদ্র। চিত্রকরের ইজেলেই যেন এর তুলনা মেলে।
অনেকক্ষণ ধরে প্রকৃতির এই রূপ সুধা পান করে মনে ও যান্ত্রিক ক্যামেরায় তার ছবি তুলে নেমে আসি বাতিঘরের চূড়া থেকে। ফিরে আসি রিসর্টে। এই নীল জলের লেগুনটি লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বৃহৎ লেগুন যা প্রবাল প্রাচীর পেরিয়ে মিশেছে গভীর সমুদ্রে। এবার নরম বালির সৈকত পেরিয়ে জলে নেমে পড়েছি। হালকা ঢেউ-এ সাঁতার বা শুধু গলা ডুবিয়ে থাকলেও কি আরাম! আকাশ মেঘলা, কায়াকিং চলল কিছুক্ষণ তবে অগভীর জলে, গভীর জলে যেতে ভরসা হল না। স্নরকেলিং এখানে করলে আলাদা অর্থ দিতে হবে তাই বাদ কারণ কালকেই কালপেনি দ্বীপে বিনামূল্যে কায়াকিং ও স্নরকেলিং করা যাবে। স্কুবা ডাইভিং করার ভরসা নেই। মিনিকয় দ্বীপে ডাইভিং সেন্টার রয়েছে সেখানে জলের নীচের প্রাণী ও গাছপালা, প্রবালের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ও রূপদর্শনের সুযোগ আছে।
সমুদ্র-স্নানের পর সৈকতে বসেই প্রকৃতির রূপমাধুরীতে সম্মোহিত ছিলাম। এবার এল দুটি ডাক– প্রথমটি মধ্যাহ্নভোজের ঘোষণা আর একটি হল হঠাৎই তুমুল বৃষ্টির সূচনা। সামিয়ানার নীচেই খাবার আয়োজন সেখানেই ছুটে ঢুকে পড়ি। আজকের মেনু সেই ভাত, ডাল, চিকেন, টুনা মাছ ভাজা, পাঁপড় ভাজা ও চাটনি। তবে বৃষ্টির দাপটে এই উন্মুক্ত প্রান্তর যেন ভেসে যাচ্ছে।
ঘন্টাখানেক এরকম বৃষ্টি চলল। বৃষ্টির পর আকাশে হালকা রামধনু দেখা গেল আর সমুদ্রের রং, বৃষ্টি-মেঘ-সূর্যের আসা যাওয়ার মধ্যে পরিবর্তন হতে থাকল সবুজ, তুঁতে, ফিরোজা, হালকা ও গাঢ় নীলের নানা শেডে। মেঘলা দিনে বেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। রিসর্টের ঢাকা বারান্দায় শুরু হল স্থানীয়দের লোকনৃত্য। নৃত্যশিল্পীরা স্থানীয় গান ছাড়াও নাচছে জনপ্রিয় হিন্দি গানের সঙ্গে। তবে যে-বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল, এই নৃত্যশিল্পীদের দলে কোনও মহিলা শিল্পী ছিল না। নাচগানের পর আবার বাসে ওঠা।
না এখনই জেটিতে নয়, গাড়ি চলল গ্রাম ঘুরিয়ে দ্বীপের একটি কমিউনিটি সেন্টারে। মিনিকয় দ্বীপে এরকম ১০টি সেন্টার রয়েছে। সাধারণত এগুলি মহিলারাই পরিচালনা করেন। কমিউনিটি সেন্টারে বিভিন্ন পরিবারের নানা সামাজিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। মিনিকয় দ্বীপে শিক্ষিতের হার প্রায় ৯৭ শতাংশ। তাতেই বোঝা যায় মহিলারাও এখানে যথেষ্ট শিক্ষিত। দ্বীপে প্রাইভেট হোটেল বা রিসর্ট না থাকলেও, কয়েকটি হোম-স্টে বা গেস্টহাউস চোখে পড়ল। বিকেলে আমাদের চা-পান হবে এই কমিউনিটি সেন্টারে। শুধু চা-নয় সেন্টারের মেয়েরা স্থানীয় পোশাক পরে (কালো ঢোলা জামা ও সাদা স্কার্ফ) পরিবেশন করল চা, ডালের বড়া আর পাতায় মোড়া পিঠে। সেন্টারে নজর টেনে নেয় এক বিশাল বোটের উপস্থিতি। দু-দিন পরে এই বোটের রেসের ছচ্তম বার্ষিকী উদ্যাপনের তোড়জোড় চলছে। তবে যা ছিল বার্ষিক অনুষ্ঠান তা অর্থের অভাবে এই সেন্টারগুলি আর নিয়মিত ভাবে সংগঠিত করতে পারছে না।
এই সেন্টার থেকে হাঁটাপথে বোট জেটি। তবে এই জেটি সকালে যেখানে নেমেছিলাম সেই জেটি নয়। লাইফ জ্যাকেট পরে আবার বোটে উঠে পড়লাম। তবে এবারের বোটজার্নি এত নির্বিঘ্নে শেষ হল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুরু হল তুমুল ঝড়বৃষ্টি। সমুদ্রও অশান্ত। বড়ো বড়ো ঢেউয়ের ধাক্বায় বোট যেন মোচার খোলের মতো লাফাচ্ছে। আর যেহেতু বোটে কোনও মাথার আচ্ছাদন নেই তাই বসে বসে এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে। ছাতা খুলেও কোনও লাভ হল না। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার দাপটে মুচড়ে ভেঙে গেল। নিজে ভিজলেও ক্যামেরা বাঁচাতে সচেষ্ট হতে হল। আধঘন্টা এই ভাবে বৃষ্টির মধ্যে বোট চলল, অবশেষে কাভারাত্তি জাহাজের সামনে। তবুও উত্তাল সমুদ্রে বোট থেকে জাহাজে প্রবেশ করাও সহজ নয়। তবু বিশেষজ্ঞ ক্যাচারদের সহায়তায় নির্বিঘ্নে তা সম্পন্ন হল, যদিও এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন মনে থাকবে।
সেই একই রুটিন মেনে আজকে কালপেনি দ্বীপভ্রমণ। গতকাল সারারাত ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, ডেক জলে ভেসে যাচ্ছে। সকালে চা-ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে সেই সাড়ে সাতটায় জ্যাকেট পরে জাহাজের দরজায় আমরা প্রস্তুত। এখনও আকাশ মেঘে ঢাকা, সমুদ্রে উদ্দামতা রয়েছে। তবু যেতে তো হবেই। আজ জাহাজ নোঙর করেছে কালপেনি দ্বীপের অনেকটাই কাছে। জাহাজ থেকে বেশ স্পষ্টভাবে নারকেল গাছে ঢাকা দ্বীপটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কোচিন থেকে এখানে সরাসরি এলে পাড়ি দিতে হতো ৬২ কিলোমিটার। জাহাজ থেকে বোটে করে কালপেনি দ্বীপে পৌঁছোতে লাগল সাত-আট মিনিট। তবে সমুদ্র বেশ অশান্ত। জেটিতে নেমে আবার গাড়িতে চড়ে পৌঁছে গেলাম কুমেল বিচ রিসর্ট। পথটি বড়োই সুন্দর– সবুজ নারকেল গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালো পিচ রাস্তা পৌঁছে দিল রিসর্টের দোরগোড়ায়।
প্রবেশ করেই প্রথামতো ওয়েলকাম ড্রিংক– মিষ্টি ডাবের জল ও শাঁস। এই দ্বীপও নারকেল গাছে ছাওয়া আর নীল জল আছড়ে পড়ছে সৈকতে। তবে কুমেল রিসর্টের বিচ তত প্রশস্ত নয়। নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অদূরে এক লাইটহাউস, রং তার সাদাকালো। তবে এই লাইটহাউস দর্শন বা ওঠার কোনও প্রোগ্রাম আমাদের সূচীতে নেই। এটি কুমেল সৈকত, স্পোর্টস বিচ নামেও পরিচিত কারণ এখানে ‘স্পোর্টস’ সংস্থার অফিস রয়েছে। একটু পরেই ঘোষণা হল এখনই পোশাক পরিবর্তন করে (অর্থাৎ স্নানের পোশাক পরে) গাড়িতে বসতে, কারণ যাওয়া হবে নর্থ টিপ বিচে। সেই সৈকতে সাঁতার সহ অন্যান্য জলক্রীড়ার ব্যবস্থা রয়েছে, অসুবিধা হল যেহেতু নর্থ টিপ বিচে মাত্র একটি চেঞ্জিং রুম বা শাওয়ার রুম রয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা। কুমেল রিসর্টে অনেকগুলি চেঞ্জিং রুম রয়েছে।
অচিরেই পৌঁছে গেলাম নর্থ টিপ বিচে। এটাই লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বড়ো লেগুন। এখানে আজকে সাঁতার ছাড়াও স্নরকেলিং আর কায়াকিং করা হবে। আর তার জন্য অতিরিক্ত অর্থমূল্য দিতে হবে না। তাই প্রায় সকলেই অংশগ্রহণে আগ্রহী। মুখে নল লাগিয়ে জলে মুখ ডুবিয়ে জলের নীচের অতুলনীয় সব সম্পদ কোরাল, রঙিন মাছ, উদ্ভিদ ইত্যাদি দেখার সুযোগ রয়েছে স্নরকেলিংয়ের মাধ্যমে। তবে সমুদ্রের একটু গভীরে যেতে হবে। আর কায়াকিং-এ এখানে নতুন শিক্ষানবিশিকে ট্রেনার সঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে আনছেন। শিখিয়ে দিচ্ছেন বোট চালনার কায়দাকানুন।
এখানে সমুদ্রের অসাধারণ রূপ। সাদা-রুপোলি বালির সৈকত তবে মাঝে মাঝে পাথরের নুড়ি ও বোল্ডার রয়েছে। সমুদ্র একদিকে নীল সবুজ ফিরোজা রঙের অতুলনীয় রূপ– সেদিকেই চলছে জলক্রীড়া আবার আর এক পাশে প্রবল ঢেউ নিয়ে উপস্থিত আর-এক সমুদ্র– এ সমুদ্রের রং সাদা-ঘোলাটে। এ এক অনন্য রূপ। ঘন্টাখানেকের বেশি সময় কেটে গেছে এই টিপি সৈকতে। জলক্রীড়া স্নানপর্ব প্রায় সকলেরই মিটে গেছে। হঠাৎই নজরে পড়ল আকাশের দিকে। আকাশের রং কুচকুচে কালো, মেঘে ঢাকা– একেবারে বৃষ্টির অপেক্ষায় রয়েছে প্রকৃতি। সত্যিই তাই আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছুট লাগাই চেঞ্জিং রুমের উদ্দেশ্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলল এই বৃষ্টি। ছাদের নীচে থেকেও ভিজে একশা। কফি শপে এক কাপ কফি পান করে, বৃষ্টি একটু কমলেই গাড়িতে চেপে রিসর্টে।
মূল কালপেনি দ্বীপের সামান্য দূরত্বে সমুদ্রের মধ্যে রয়েছে দুটি বসতিহীন দ্বীপ টিলাক্বম ও পিট্টি। তবে নারকেল গাছের জঙ্গল রয়েছে এই দুটি দ্বীপেও। এখানকার বাসিন্দারা ওই দুটি দ্বীপে গিয়ে নারকেল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। টিপ-টিপ করে বৃষ্টির মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজ শুরু হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পরই শুরু হল লোকনৃত্য। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা আর আশ্চর্য এখানেও নাচের দলে কোনও মহিলা সদস্য নেই।
লাক্ষাদ্বীপের মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে একটু জানিয়ে রাখি। ঐতিহ্যগত পোশাক হিসাবে লাক্ষাদ্বীপবাসীরা কেরালাকেই অনুসরণ করে তবে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এখানে চোখে পড়ে। মেয়েরা ‘কাচি’ পরে কোমর থেকে বাঁধা হয় সোনা-রুপোর বন্ধনী দিয়ে কোমরে। শরীরের ওপরের অংশে রংবেরঙের অলংকৃত (এমব্রয়ডারি) করা আঁটোসাঁটো জ্যাকেট আর মাথায় রঙিন স্কার্ফ। ছেলেরা সাধারণত লুঙ্গিতে অভ্যস্ত তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সবাই এখন ঝুঁকে পড়েছে জিন্স কালচারের দিকে।
একটু বিশ্রামের পর আমরা গাড়ি করে চলেছি নারকেল প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ও গেঞ্জি কারখানা দেখতে। শুকনো নারকেল থেকে দুটো আলাদা মেশিনে তেল ও নারকেলের পাউডার তৈরি হচ্ছে। কাউন্টার থেকে এগুলির বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে। প্যাকেট করে নারকেল নাড়ুও বিক্রি হচ্ছে। নারকেলের পর হোসিয়ারি ফ্যাক্টরি। এখানে গেঞ্জি তৈরি করে বিক্রি হচ্ছে। এদের উৎসাহদানের জন্য কয়েকটি গেঞ্জি কিনলাম, উপহারও তো দেওয়া যাবে। এই কারখানার কর্মী সবাই মহিলা। বোরখা পরে কাজ করছে।
ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে দ্বীপের বুকে। জেটিতে আলো জ্বলে উঠেছে। জেটি থেকে আমাদের জাহাজ-বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেখানেও জ্বলে উঠেছে আলো। তবে সমুদ্র বেশ অশান্ত, তাই বোট থেকে জাহাজে উঠতে বেশ অসুবিধা হল। আজকেই জাহাজে শেষ রাত। কাল সকাল আটটার মধ্যে কোচি-র জেটিতে পৌঁছে যাবে জাহাজ। জিনিসপত্র গোছগাছ করি, জাহাজি সংসারের কালকেই ইতি।
প্রয়োজনীয় তথ্য
১) লাক্ষাদ্বীপের দ্বীপগুলিতে কোচিন ও ম্যাঙ্গালোর থেকে জাহাজে যাওয়া যায়। কোচিন থেকে বিমানে একমাত্র আগাত্তি দ্বীপে যাওয়া যায় কারণ ওখানে একমাত্র বিমানবন্দর আছে। কলকাতা থেকে সরাসরি কোচিন পৌঁছোবার ট্রেন শালিমার-ত্রিবান্দ্রম এক্সপ্রেস রবিবার ও মঙ্গলবার চলে। আবার চেন্নাই পৌঁছে আলেপ্পি এক্সপ্রেস ধরে কোচি পৌঁছোনো যায়। কলকাতা থেকে কোচির কোনও সরাসরি উড়ান নেই। চেন্নাই অথবা বেঙ্গালুরু হয়ে যেতে হবে।
২) লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য ভারতীয়দেরও আগাম অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ ভ্রমণার্থী ‘স্পোর্টস’ আয়োজিত প্যাকেজ টুরে যেতে পছন্দ করেন। অনুমতিপত্রের দায়িত্ব তখন ‘স্পোর্টস’ সংস্থার।
যোগাযোগঃ ৪৮৪২৬৬৮৩৮৭