মা-বাবা, পরিবারের অন্যান্য স্বজনেরা আজ অনুতাপ করছেন যে তাদেরই বাড়ির ছেলে গিয়ে সহপাঠীর সঙ্গে সামান্য তর্কাতর্কি হওয়াতে, সহপাঠীকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। কোথাও বা ভালো উপদেশ দেওয়ার অপরাধে কোনও বাচ্চার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে অপর আর একটি বাচ্চা। কোনও কোনও বাচ্চা আবার পুলিশের রোলে অভিনয় করতে ভালোবাসে। কারও কাছে ভালো জিনিস দেখলে অথবা কেউ ভালো খাবার কিনলে তার জিনিস চুরি করে নেওয়া অথবা ভাঙচুর করা পুলিশের কাজ এই ধারণায় অণুপ্রাণিত হয়ে বাচ্চারা আবার এই ধরনের অন্যায়ের রাস্তাও বেছে নেয়। এই সব রকমের ঘটনাই আমরা আশেপাশে প্রায়শই দেখতে অথবা শুনতে পাই। কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে এই অপরাধপ্রবণতা কেন বাড়ছে সেটা অবশ্যই চিন্তনীয়।

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে আজকাল বাচ্চারা অতিরিক্ত কম্পিউটার, টিভি এবং ভিডিও গেম্স দ্বারা প্রভাবিত। এই গ্যাজেট্স-এ তারা যা দেখছে তাই শিখছে এবং হুবহু তাই করায়ত্ত করার চেষ্টাও করছে। বাড়িই  তার চলাফেরার গণ্ডি এবং নিজেদের বীরত্ব জাহির করার এর থেকে ভালো জায়গা তারা আর খুঁজে পায় না। বীরত্ব প্রকাশের ইচ্ছাই তাকে অজান্তে করে তোলে নৃশংস।

ভিডিও গেম্স-এর চরিত্রগুলি এবং কার্টুন চরিত্রগুলির সঙ্গে বাচ্চারা নিজেদের রিলেট করতে ভালোবাসে। কল্পনার পরিবেশে তারা বিচরণ করতে চায়। গেম্স এবং কার্টুন স্টোরিগুলি এমন ভাবেই বানানো হয় যেখানে তাদের সাধারণ ব্যবহারের মধ্যেই হিংসাত্মক মনোবৃত্তির ঝলক দেখতে পাওয়া যায়। বাচ্চারা সেই ব্যবহারই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। দোষের কিছু আছে বলেই তাদের মনে হয় না। মা-বাবারা যতক্ষণে সন্তানের এই নৃশংস মনোভাবের পরিচয় পায় ততক্ষণে বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় যে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক সময় তো দেখা যায় মা-বাবারাই সন্তানের এই দোষ ঢাকবার চেষ্টা করছেন।

আমার প্রতিবেশীর একটি চ্ছ্র বছরের মেয়ে রয়েছে যে সারাদিন ভিডিও গেম্স খেলতে থাকে নয়তো টিভি চালিয়ে সামনে বসে দেখতে থাকে। অন্য কেউ খবর অথবা অন্য চ্যানেল দেখতে চাইলে কান্নাকাটি করে কাউকেই ও কিছু দেখতে দেয় না। একবার আমার বাড়িতে টিভি খারাপ হয়ে যাওয়াতে একটা জরুরি খবর শোনার জন্য আমাকে ওদের বাড়ি যেতে হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাটি কান্নাকাটি করে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে বাধ্য হয়ে খবর না শুনেই আমাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল।

অনেক সময় অভিভাবকেরা মনে করেন যে যেহেতু আধুনিক গ্যাজেট্স সম্পর্কে তাদের বাচ্চারা অত্যন্ত ইন্টারেস্ট নিচ্ছে সুতরাং বাচ্চারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং আশেপাশের সবকিছু সম্পর্কে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

অথচ গ্যাজেট্স-এর প্রভাবে এর উলটোটাই ঘটছে। বাচ্চাদের মনের সহজ, স্বাভাবিক সংবেদনশীল মনোবৃত্তি হারিয়ে যাচ্ছে। অপরকে কষ্ট দিয়ে তারা বেশি আনন্দ পাচ্ছে। নিজের ছাড়া অপরকে নিয়ে তারা ভাবে না। নিজের কষ্ট নিজের আনন্দটুকুই তারা বোঝে। ফলে নিজের উপর থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে এবং হিংসাত্মক মনোবৃত্তি তাদের গ্রাস করতে থাকে।

টিভি, ভিডিও গেম্স ইত্যাদি যত বেশি নেগেটিভ কার্যকলাপে ভরা হয়, বাচ্চাদের আকর্ষণও তত বৃদ্ধি পায়। ভিডিও গেম্স বা কার্টুন দেখতে বসে বাচ্চারা শুধু দর্শকই থাকে না, নিজেরাও ওই শো-এর এক একটি চরিত্র কল্পনা করে নেয় তারা। শো-এর নঞ্চর্থক প্রভাব বাচ্চাদের প্রথমে ধীরে ধীরে এবং পরে দুরন্ত গতিতে হিংসার কবলে বশ করতে আরম্ভ করে।

আমেরিকার মনোবৈজ্ঞানিকরা বাচ্চাদের উপর টিভি, কম্পিউটার এবং ভিডিও গেম্স-এর প্রভাব কতখানি তাই নিয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা চালিয়েছেন। অ্যাকশনে ভরা এবং দেখে সত্যি মনে হওয়া এই গেম্স এবং শো-গুলি বাচ্চাদের মস্তিষ্কে এমন ভাবে হিংসার মনোভাব ঢুকিয়ে দিতে থাকে, যেন এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।

এই রকম একটি পরীক্ষা চলাকালীন ছ-জ্জ বছরের কিছু বাচ্চাদের খেলার জন্য পুতুল দিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমদিন ওই পুতুলগুলো নিয়ে বাচ্চারা এমন ভাবে খেলতে থাকে যেন ওগুলো ওদের সত্যিকারের বন্ধু।

পরের দিন ওই বাচ্চাদের একটি ভিডিও ফুটেজ দ্যাখানো হয় যেখানে একটি বাচ্চা নৃশংস ভাবে নিজের পুতুলকে মারছে। ফুটেজটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে অপর বাচ্চাগুলোও নিজের নিজের পুতুলদের মারতে শুরু করে। চড়-থাপ্পড়, লাথি, পা ধরে মেঝেতে আছড়ানো কিছুই বাদ পড়ে না।

আমরা সাধারণত যা কিছু দেখি তা হুবহু ব্রেনে স্টিমিউলেশন হয়ে যায়। বাচ্চাদেরই বিশেষত এটি বশীভূত করে নেয়। ভিডিও গেম খেলার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুরা হিংসাত্মক কার্যকলাপ করা শুরু করে না। ধীরে ধীরে দেখতে দেখতে, নিজে জেতার ইচ্ছে মনের মধ্যে হতে থাকে। এর পরের স্টেপে ইচ্ছেটা আরও জোরদার হয়। এরপর ইচ্ছেটা জেদে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ‘যেনতেনপ্রকারেণ’ জিততেই হবে, এইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন।

বাচ্চাদের মধে হিংসাত্মক মনোবৃত্তি রোধ করতে হলে প্রথমেই দরকার, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার, তাদেরকে ভালোবাসবার। তাদের মধ্যে হিংসা দানা বাঁধছে কিনা সেটা খেয়াল রাখাটা খুব দরকার এবং অবশ্যই এটা বাচ্চাকে না জানিয়ে। জানতে পারলে বাচ্চা সাবধান হয়ে যাবে। বাড়িতে বসে গ্যাজেট্স-এ মনোনিবেশ না করে উচিত হচ্ছে বাচ্চাকে বাইরে খেলতে পাঠানো। মাঠে গিয়ে খেলাধুলো করলে অন্যান্য বাচ্চার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ঘটবে উপরন্তু সকলকেই হারতে অথবা জিততে দেখলে নিজের হার-জিত নিয়ে সম্মান হারাবারও ভয় থাকবে না।

মেয়েদের উপর ভিডিও গেম্স-এর প্রভাব অতটা পড়ে না কারণ নানা ধরনের শিল্পকলায় তাদের ব্যস্ত রাখা হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রেও এমনটাই হওয়া উচিত। তাদের মধ্যে গঠণমূলক গুণ থাকলে, তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। প্রশংসা এবং ভালোবাসার অভাব রাখা উচিত নয়। সময় থাকতে থাকতে চেষ্টা করলে বাচ্চাদের হিংসার রাস্তা থেকে স্বাভাবিক জগতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

বাচ্চাদের মন যাতে হিংসার দিকে না যায়, তার জন্য ভিডিও গেম্স-এর সঙ্গে দরকার শিক্ষার। বাড়ির পরিবেশও শিক্ষার উপযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভিডিও গেম্স বেছে বেছে বাচ্চাকে দেখতে দেওয়া হল অথচ বাড়িতে ঝগড়া, মারধোরের পরিবেশ বজায় থাকল, এমন অবস্থাতেও কিন্তু বাচ্চার মনে বিরূপ প্রভাবই পড়বে সন্দেহ নেই। নানারকম অ্যাকটিভিটিতে বাচ্চাকে ব্যস্ত রেখেও ভিডিও গেম্স খেলা থেকে বাচ্চাদের বিরত করা যেতে পারে।

তবে সব ভিডিও গেম্স হিংসাত্মক হয় না। একটু খেয়াল করলেই সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। বাচ্চার আনন্দের সব রাস্তা বন্ধ করে শুধু পড়াশোনা করে যাওয়ার প্রেশার দেওয়াটা অন্যায়। তাই সে যেটা ভালোবাসে সেদিকে তার ইনটারেস্ট বাড়াতে সাহায্য করা উচিত।

আসল কথা হল বড়োরাই নিজেদের সুবিধার জন্য বাচ্চাদের ভিডিও গেম্স, টিভি, কম্পিউটারের অভ্যাস করান যাতে বাচ্চারা ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বড়োদের বিরক্ত না করে। বড়োরা ভাবে এতে বাচ্চা নতুন কিছু শিখছে, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে অথচ এই ভাবনা একেবারেই সঠিক নয়। বরঞ্চ তারা আধুনিকতার করাল গ্রাসে নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার পথে চালিত হচ্ছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...