সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি আর গরম হাওয়ার প্রভাব, ত্বকের মতো সরাসরি চুলের উপরেও পড়ে। সেই কারণেই গ্রীষ্মে এক্সট্রা পরিচর্যার দরকার হয়ে পড়ে। যদি মরশুম অনুযায়ী চুলের যথাযথ যত্ন নেওয়া যায়, তাহলে সব ঋতুতেই চুল থাকবে ঝলমলে।

ক্লোরিন থেকে বাঁচান – কিছুক্ষণের জন্য হলেও গরমের হাত থেকে বাঁচতে সুইমিং পুলের থেকে ভালো অপশন আর কী-ই বা হতে পারে? কিন্তু পুলের জলে থাকা ক্লোরিন মারাত্মক ভাবে চুলের ক্ষতি করে। তাই পুলে নামার আগে অবশ্যই চুলে তেল লাগিয়ে সুইমিং ক্যাপ পরে নিন। পুল থেকে ওঠার পর সাথে সাথে শ্যাম্পু না করে প্রথমে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভালো ভাবে চুল ধুয়ে নিন। তারপর চুলের টেক্সচার অনুযায়ী যথাযথ শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। যদি রেগুলার সুইমিং পুলে যাওয়ার অভ্যাস থেকে থাকে, তাহলে কোনও ভালো পার্লার থেকে মাসে অন্তত একটা করে হেয়ার স্পা করান, এতে আপনার চুল স্বাস্থ্যোজ্জ্বল থাকবে।

তৈলাক্ত স্ক্যাল্প হলে – আপনার মাথার ত্বক যদি অয়েলি হয়, তাহলে কন্ডিশনার ব্যবহার করবেন না। কারণ অয়েলি ত্বকে কন্ডিশনার ব্যবহার করলে চুল আরও তৈলাক্ত হয়ে যাবে। কন্ডিশনার যদি লাগাতেই হয়, সেক্ষেত্রে ওয়াটার বেস্ড কন্ডিশনার-ই বাছুন। মাথার ত্বকের অয়েলি ভাব কমাতে এক মগ জলে খানিকটা লেবুর রস দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। অ্যাস্ট্রিনজেন্ট স্প্রে করে চুল আঁচড়ান। এতে আলাদা একটা লুক চলে আসবে।

শুষ্ক চুল – শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ত্বক এবং চুল রুক্ষ হয়ে যায় তবে চুলের ক্ষেত্রে গরমকালে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হল ‘এসি’। গরমের হাত থেকে বাঁচতে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কাটাই। ফলস্বরূপ আর্দ্রতা হারিয়ে চুল হয়ে পড়ে রুক্ষ, নিষ্প্রাণ। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে লিভ-অন সিরাম স্প্রে করে তারপর চুল আঁচড়ান। এছাড়া সপ্তাহে অন্তত একদিন স্ক্যাল্প এবং পুরো চুলে অয়েল মাসাজ করুন। হট অয়েল থেরাপি-ও ভালো ঘরোয়া উপায়। পাকা কলাও ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

নিষ্প্রাণ চুল – নিষ্প্রাণ চুল কারওরই কাঙিক্ষত নয়। এটি আপনার লুকের উপরে মারাত্মক এফেক্ট করে। কাজেই এই সমস্যা থেকে বাঁচতে নিয়ম করে নারকেল তেল লাগান। প্রয়োজনে হেয়ার এক্সপার্ট-কে দিয়ে চুলের ট্রিটমেন্ট-ও করাতে পারেন। বাজারে এখন বিভিন্ন কোম্পানির হেয়ার প্রোডাক্ট পাওয়া যাচ্ছে। নিজের প্রয়োজনানুসারে সঠিক প্রোডাক্ট-টি বেছে নিতে পারেন।

কালার করা চুলের জন্য – গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচতে ঘরের বাইরে বেরোবেন না এমনটা তো সম্ভব নয়। কর্মসূত্রে হোক বা অন্য কোনও প্রয়োজনে বেরোনোর আগে মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে নিন। যদি দিনের বেশিরভাগ সময়টা বাইরে কাটাতে হয়, সেক্ষেত্রে বাড়ি ফিরে একটা শাওয়ার নিয়ে নিন। মনে রাখবেন জলটা কিন্তু ঠান্ডা হতে হবে, কারণ ঠান্ডা জলে কালারের ক্ষতি হয় না।ঠান্ডা জল চুলের কিউটিক্যাল-কে লক করে দেয়, ফলে চুল ঝকঝক করে।

চিটচিটে চুল – চিটচিটে চুল ধোওয়ার জন্য ড্রাই শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। ঘরোয়া রেমিডি হিসাবে ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে পুরো চুলে লাগিয়ে রাখুন। মিনিট পঁয়তাল্লিশ রেখে শ্যাম্পু করে নিন। সপ্তাহে দুদিন ব্যবহার করে দেখুন। তফাতটা বুঝে যাবেন। গ্রীষ্মে শিকাকাই-ও ভালো রেমিডি।

পাতলা চুল – পলিউশনের কারণে চুল ঝরে পড়াটা এখন স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। খেয়াল করে দেখবেন অনেকেরই চুল পাতলা হয়ে গেছে, চুল ভেদ করে মাথার ত্বক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুবই দৃষ্টিকটু। তাই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হবার আগেই ব্যবস্থা নিন। চুলের দেখভাল শুরু করে দিন। নিয়ম করে ছোটো পেঁয়াজের রস লাগান। কেশুথ পাতাও লাগাতে পারেন। আর রেডি রেমিডি পেতে হলে বাজারে বহু নামিদামি কোম্পানির হেয়ার গ্রোথ অয়েল অথবা লোশন পাওয়া যায়। যে-কোনও একটি নিজের জন্য বেছে নিন।

দু-মুখো চুল – সূর্যের ইউভি রশ্মির কারণে ত্বক যেমন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি চুলের উপরও এর প্রভাব চোখে পড়ার মতো। কর্মব্যস্ততার কারণে সময়াভাবে সবসময় সেভাবে নিয়ম মেনে যত্ন নেওয়াটা সম্ভব হয় না। ফলস্বরূপ দু-মুখো চুলের সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ট্রিমিং করানো ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা থাকে না। তাই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই চুলের দেখভাল করতে শুরু করুন। নিয়ম করে বছরে অন্তত তিন বার ট্রিমিং করিয়ে নিন। এতে দু-মুখো চুলের সমস্যা থাকবে না। দেখতেও ভালো লাগবে।

র‍্যাশের কু-প্রভাব থেকে বাঁচতে – এই সময়ে ঘাম বসার কারণে মাথার ত্বকে র‍্যাশ হতেও দেখা যায়। এমনকী মাঝেমধ্যে ফুসকুড়ি-র কারণে অনেকেই মাথায় চিরুনি পর্যন্ত ঠেকাতে পারেন না। এই র‍্যাশ থেকে বাঁচতে কেমিক্যাল-ফ্রি নারকেল তেলের মধ্যে কয়েকটা নিমপাতা থেঁতো করে ফুটিয়ে নিন। তারপর মাথায় ভালো ভাবে মেখে ঘন্টাখানেক রেখে শ্যাম্পু করুন। নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত দুদিন এটি ব্যবহার করুন। দেখবেন র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি যাই হোক না কেন, সেরে যাবে। যদি তেল অ্যাভয়েড করতে চান, সেক্ষেত্রে সরাসরি নিমপাতা থেঁতো করে স্ক্যাল্পে ভালো করে লাগিয়ে নিন। ঘন্টাখানেক রেখে ধুয়ে ফেলুন। পরের দিনও শ্যাম্পু করতে পারেন। অ্যালোভেরা জেলও চুলের জন্য ভীষণ ভালো, এটি যেমন কোমলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে তেমনি এই গরমে মাথাও ঠান্ডা রাখে।

রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি – বারবার চুল আঁচড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। এর ফলে চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। চুলে গ্রোথ আসবে। তবে একটা কথা খেয়াল রাখবেন চিরুনি যেন কখনওই সরু দাঁড়ার না হয়। সরু দাঁড়ার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালে চিরুনির ধারে চুলের ফলিকল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং মোটা দাঁড়ার চিরুনিই চুলের স্বাস্থ্যের জন্য যথাযথ। কাঠের চিরুনি হলে সবথেকে ভালো হয়। এতে চুলের জেল্লাও বজায় থাকবে।

হেয়ার সানস্ক্রিন – এই গ্রীষ্মে ত্বকের মতো চুলেরও এক্সট্রা প্রোটেকশনের প্রয়োজন। তাই রোদে বেরোনোর আগে ত্বকের মতো চুলেও হেয়ার সানস্ক্রিন অবশ্যই লাগিয়ে নেবেন। যদি এই হেয়ার সানস্ক্রিনের সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা না থাকে সেক্ষেত্রে পাশাপাশি কোনও স্টোরে গিয়ে পরামর্শ নিন। তারা বাতলে দেবে আপনার চুলের টেক্সচার অনুযায়ী পারফেক্ট হেয়ার সানস্ক্রিন কোনটা।

হেয়ার ড্রায়ার এড়িয়ে চলুন – স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে শুধু এই মরশুমেই কেন সব ঋতুতেই সমানভাবে চুলের ক্ষতিসাধন করে হেয়ার ড্রায়ার। এর নিয়মিত ব্যবহারে চুল গ্লো-হীন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় চুলের আর্দ্রতা হারিয়ে গিয়ে চুল ঝরতে শুরু করে। এমনকী দু-মুখো চুলের সমস্যাও দেখা দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সুতরাং যতই ব্যস্ত হোন না কেন, ফ্যানের হাওয়াতেই চুল শুকোনোর চেষ্টা করুন। চুল প্রেস করা (অর্থাৎ স্ট্রেটনিং) আরও ক্ষতিকারক। কাজেই সম্ভব হলে এগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

কালারের পরিবর্তে মেহেন্দি – ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে চুল রং করতে বা সাদা চুল ঢাকতে কালারের পরিবর্তে মেহেন্দি ব্যবহার করুন। দেখবেন কয়েকবার ব্যবহারের পরে চুলে একটা অদ্ভুত ব্রাউনিশ ভাব চলে আসবে। চুল ঝকঝকে হয়ে উঠবে। আগের রাত্রে একটা লোহার কন্টেনারে চায়ের লিকার দিয়ে হেনা গুলে রাখুন। পরদিন সকালে ডিম সহযোগে পরিষ্কার শ্যাম্পু করা চুলে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত ভালোভাবে লাগিয়ে নিন। অন্তত ৪৫ মিনিট রাখার চেষ্টা করুন। তারপর ভালো ভাবে ধুয়ে শ্যাম্পু করে নিন। চাইলে এই মিশ্রণে আমলা, শিকাকাই পাউডারও মেশাতে পারেন। কয়েকদিনের ব্যবহারেই ঝলমলে চুল অপেক্ষা করবে আপনার জন্য।

স্পা – ইউভি রে আর পলিউশনের কথা মাথায় রেখে মাসে অন্তত একটা করে স্পা করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। চুলের যত্ন নিতে এর থেকে ভালো সলিউশন আর হয় না। স্পা-এর বিভিন্ন ধরন রয়েছে। চুল ঝরে পড়ার জন্য একরকম স্পা, চুল সিল্কি করার জন্য একরকম আবার নিষ্প্রাণ চুলকে প্রাণবন্ত করে তুলতে আর একরকম স্পা। কালার করা চুলের জন্য যত্ন নিতে রয়েছে বিশেষ ধরনের স্পা। সুতরাং চুল খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে, এই ধরনের সমস্যায় মন খারাপ না করে অবিলম্বে কোনও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

খাদ্যতালিকা – গরমের কারণে সকলেরই বেশ হাঁসফাঁস অবস্থা। তাই এই সময়ে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু সংযম রাখা উচিত। ভাজাভুজি, তেল মশলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। খাবারের তালিকায় যোগ করুন রসালো ধরনের ফল। যেমন – তরমুজ, ফুটি, শসা, আঙুর। আর প্রচুর পরিমাণে জল খান। তবে ফ্রিজ থেকে বার করে সরাসরি কখনওই খাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুমও জরুরি।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...