প্লেনের জানলা দিয়ে সুরভি নীল আকাশের বুকে মেঘেদের ভেসে চলা দেখতে দেখতে, শরীরে শিহরণ অনুভব করছিল। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। দুবাইয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে একাই যাচ্ছে সুরভি, তাও অনেকদিন পর, সম্পূর্ণ একলা।
পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের ইতিউতি বিচরণ। সকালের রোদ এসে পড়াতে মনে হচ্ছে সোনা ঝরছে আকাশ থেকে। কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে সুরভি খেয়াল করেনি। এয়ার হোস্টেস-এর ডাকে তন্দ্রার ভাব কেটে যায় তার।
এয়ার হোস্টেস জানায়, খারাপ আবহাওয়ার কারণে প্লেন টারম্যাক-এ নামাতে হচ্ছে। যাত্রীদের অসুবিধার কারণে তারা দুঃখিত। আবহাওয়া ঠিক হলেই তারা দুবাইয়ের পথে আবার রওনা হবে। যাত্রীদের সিট বেল্ট বেঁধে নিজেদের সিটেই বসে থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
প্লেন টারম্যাক-এ ল্যান্ড করতেই সুরভি নিজের চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখে নিল। ওর ঠিক পাশেই যে-ছেলেটি বসে, তাকে দেখে সুরভির বেশ ভদ্র বলেই মনে হল। প্লেনের ভিতর কতক্ষণ বসতে হবে কারওরই জানা নেই।
ছেলেটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে কথা বলতে শুরু করল, হ্যালো… ম্যাডাম, আমি রাহুল। আপনি দুবাইতে থাকেন?
সুরভি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই ছেলেটি সামান্য লজ্জিত হয়ে বলে উঠল, প্লিজ অন্য ভাবে নেবেন না। আমাদের এখন প্লেনের মধ্যেই সময় কাটাতে হবে। আপনার হাতে বই দেখে মনে হল, আপনি পড়তে ভালোবাসেন। ভাবলাম আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় কেটে যাবে। আপনি কী করেন?
সুরভি একটু সময় নিল উত্তর দিতে। হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন। পড়তে ভালোবাসি৷ অল্পস্বল্প লেখালিখিও করি কিন্তু রং আমার ভীষণ পছন্দ। আঁকতেই সবচেয়ে ভালোবাসি আমি।
বাঃ! আমিও আগে একটু আধটু লিখতাম টিখতাম। এখন সেসব কোথায় হারিয়ে গেছে। সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়। প্রয়োজনও। রং নিয়ে খেলার নেশা এখন আমাকেও পেয়ে বসেছে। আপনার প্রিয় লেখক কে?
লেখক, বই, পেইন্টিং এইসব নিয়ে নানা আলোচনায় রাহুল আর সুরভি মগ্ন হয়ে রইল। কথায় কথায় দুজনেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একে অপরের সামনে খোলাপাতা হয়ে গেল। একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে লাগল। সুরভি সহজেই অপরের মন পড়তে পারে। ওর বুঝতে অসুবিধা হল না, রাহুলের মন ওর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করছে। একে অপরের প্রতি সম্মানের মনোভাব পরিষ্কার দুজনের চোখেই ফুটে উঠছিল। হয়তো দুজনেরই বন্ধুর প্রয়োজন ছিল।
কথা বলতে বলতে দুজনেই পরস্পরের এতটাই কাছাকাছি চলে এসেছিল যে, নিজেদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একে অপরের সামনে উন্মোচিত করতে দ্বিধা করল না। কথায় কথায় দুজনে মগ্ন হয়ে পড়েছিল, তাই কেউই খেয়াল করেনি, প্লেন কখন গন্তব্যে পেঁছে গেছে। এই সাত-আট ঘন্টায় দুজনের বন্ধুত্ব এতটাই গভীরে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা ফোন নম্বর আদান-প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বলা কথাও চোখের দৃষ্টিতে বিনিময় করে নিল।
বিদায় নেওয়ার সময় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। তখনই এয়ার হোস্টেসের গলার আওয়াজ ভেসে এল, যাত্রীদের সিট বেল্ট বেঁধে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিমান গন্তব্যে নামার অপেক্ষায়।
রাহুল জিজ্ঞেস করল, সুরভি তুমি কতদিন আছো দুবাইয়ে?
আমি চার দিনের জন্য এসেছি। তারপর দিল্লি ফিরে যাব। আপনি কতদিন আছেন?
সুরভি, প্লিজ আমাকে আপনি সম্বোধন করে দূরে সরিয়ে দিও না। আমি এখানে অফিসের কাজে এসেছি। দুদিন বাদে দিল্লি ফিরব, সেখান থেকে মুম্বই।
ওকে রাহুল। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। কীভাবে যে এতটা সময় পার করে ফেললাম, টেরই পেলাম না।
সত্যি সুরভি, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে আমারও খুব ভালো লেগেছে। এখন থেকে আমরা বন্ধু এবং ভবিষ্যতেও এই বন্ধুত্ব থাকবে। আর একটা কথা বলতে চাই, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সেটা যেন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। তাহলেই জীবনকে বোঝা বলে মনে হবে। আমরা সবাই নিজেদের কর্তব্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ। কাজকে প্রাথমিকতা দিতে আমরা বাধ্য হই। পরিস্থিতি অনুকূল না হলেও নিজের সুখানুভতিগুলো মনে করে মুখে হাসি রেখো। তোমার মুখের এই হাসি মিলিয়ে যেতে দিও না। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু পেলাম… এক নিঃশ্বাসে বলে যায় রাহুল।
হ্যাঁ রাহুল, তোমাকে আমি ভুলব না। তোমার কথাগুলো মনে রাখব। জানি না আর কোনও দিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা কিন্তু ফোনে অবশ্যই কথা হবে। ব্যথিত হয়ে ওঠে সুরভির কণ্ঠস্বর।
কথা শেষ করে দুজনেই বেরিয়ে আসে প্লেন থেকে। লাগেজ তুলে রাহুল অপেক্ষা করে সুরভির বাড়ির লোকেদের আসার জন্য। ওরা এসে গেলে আলাপপর্ব শেষ করে রাহুল নিজের গন্তব্যে পা বাড়ায়।
বাড়ির পথে যেতে যেতে সুরভির ভিতরটা তোলপাড় হতে থাকে যেন, কোনও ভীষণ প্রিয় একটা জিনিস ফেলে রেখে ওকে চলে যেতে হচ্ছে বলে। পথে দুবার রাহুলের ফোনও আসে, সে বাড়ি পৌঁছেছে কিনা জানতে। রাহুলের এই কেয়ারিং স্বভাব সুরভিকে ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চিত করে তোলে।
বাড়িতে এসে সকলকে দেখে, সবার সঙ্গে হাসি-কথায়, সুরভির মনটা আবার হালকা হয়ে উঠে। জীবনের অনেকটা পথ এখানে থেকেই পার করেছে। স্কুল, কলেজ সবই এখান থেকে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আশায় ওর মন আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সুরভি আসায় আনন্দে ওর ভাই সন্ধেবেলা বাড়িতে পার্টির আয়োজন করেছিল।
পার্টিতে সব পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়াতে, সুরভি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। হইচই আনন্দে পার্টি জমে উঠল। পার্টি যখন শেষ হল বেশ রাত হয়েছে তখন। সকলে বাড়ি চলে গেলে বাড়ির সবাই ঘুমোতে চলে গেল। কিন্তু সুরভির চোখে ঘুম এল না।
উঠে জানলায় দাঁড়াল সুরভি। আকাশের রং-টা লাল মনে হল। হঠাৎই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়তে লাগল ওর। আকাশের রং দেখে মনে হল বৃষ্টি পড়তে পারে। চারদিকে একটা গুমোট ভাব। ওকে ঘিরেই কি খালি মেঘেদের আনাগোনা। বিছানায় ফিরে এসে আবার ঘুমের চেষ্টা করল। না, ঘুম কিছুতেই এল না। এখানে পৌঁছেই দিল্লিতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, ভালো ভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে। কিন্তু বিনোদের কিছুতেই যেন কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। স্নেহের কাঙাল সুরভির মনটা মরুভমির মতোই খাঁ খাঁ করতে থাকে। বিনোদের ব্যবহার ভিতর থেকে সুরভিকে নাড়িয়ে দেয়। রাহুলের কথা মনে হয়। বিনোদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওর সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত সুরভিকে সজীব করে তোলে।
আধুনিক ভাবধারায় বিশ্বাসী সুরভির ঠিক বিপরীত স্বভাব হল বিনোদের। পেশায় উকিল বিনোদের ভাবনাচিন্তা বরাবরই খুব সংকীর্ণ। বিয়ের পরেই সুরভি বুঝতে পারে বিনোদের আকর্ষক ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে নীচ মানসিকতা। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলা ওর একেবারেই অপছন্দ। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বললেই সুরভির উপর রুদ্রমূর্তি ধারণ করত বিনোদ।
এমনকী রাস্তায় যেতে যেতে কোনও পুরুষ যদি সুরভির দিকে তাকাত, সঙ্গে সঙ্গে বিনোদের সন্দেহের তির সুরভিকে বিদ্ধ করতে ছাড়ত না। চোখে মুখে ফুটে উঠত হাজারো প্রশ্ন, যেন পুরো দোষটাই সুরভির। বিনোদ এমন ভাব করত যেন সুরভি আগে ছেলেটির দিকে তাকিয়েছে বলেই, ছেলেটি সুরভির দিকে তাকাবার সাহস পেয়েছে। বিয়ে পর থেকেই সুরভির বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা কমতে থেকেছে ক্রমশ। কাকে নিয়ে কখন কী ভেবে বসবে বিনোদ সেটা বোঝা খুবই মুশকিলের ছিল।
সুরভি ধীরে ধীরে নিজেকে বদলে বিনোদের পছন্দে নিজেকে গড়ে নিয়েছিল। কথায় আছে ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে তোলে। সুরভি বিনোদকে ভালোবেসেছিল কিন্তু বিনোদের ভালোবাসা ওকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছিল। ইচ্ছে হলে বিনোদ মেলামেশা করত কিন্তু যেই ওর মনে হতো সম্পর্কটা একটু বেশিই আপন হয়ে উঠছে, সঙ্গে সঙ্গে সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিত। রাগ হলে, মতের অমিল হলে কথা বলাই বন্ধ করে দিত বাড়ির যে-কারও সঙ্গে। এতে কেউই খুব একটা আশ্চর্য হতো না।
বাড়িতে চুপচাপ থাকার ফলে সুরভিও একাকিত্বে ভুগতে আরম্ভ করেছিল। বাড়ির দমচাপা পরিবেশে সুরভির দমবন্ধ হয়ে আসত। এমনকী শ্বশুর-শাশুড়ি,মামা-ভাগ্নি, শ্যালিকা-শ্যালিকার বর এই সম্পর্কগুলোও বিনোদের সন্দেহের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সবাই বিনোদের সঙ্গে কথা বলতে, মিশতে পর্যন্ত ভয় পেতে শুরু করেছিল।
এই সবকিছু দেখেও সুরভির কাছে সহ্য করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। বিনোদ যখন বাড়িতে থাকত না, তখন সবাই মন খুলে কথা বলত কারণ বিনোদের সামনে হাসি-ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার কারও সাহস ছিল না। বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই সুরভির জীবন বাঁধা পড়ে গিয়েছিল। ওর তষ্ণার্ত মন জলের আশায় ছটফট করে ফিরত। ভুলেও বিনোদ কোনও দিন সুরভির মনের কথা জানতে উত্সাহ দেখায়নি। সুরভির বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, প্রেম-ভালোবাসা খালি ছবির পর্দাতেই দেখানো হয়। বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। বিয়ের এত বছর পরেও বিনোদের ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন না আসাতে, সুরভি ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে স্বামীর থেকে অনেক দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। এটাই এখন সুরভির অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিনোদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেই মনের মধ্যে শান্তি অনুভব করত।
আজ রাহুলের সঙ্গে আলাপের পর রাহুলের মধ্যে আপন করে নেওয়ার গুণ সুরভির মনে একটা ঠান্ডা হাওয়ার প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছিল। মনটা অনেক হালকা বোধ হচ্ছিল। মনের মধ্যে একটা কান্না গুমরে গুমরে উঠছিল। বিনোদও যদি রাহুলের মতোই সুরভির জীবনসঙ্গী হয়ে উঠতে পারত! বিভিন্ন রঙের তুলির টানে নিজের জীবনটাকেও একই সঙ্গে রাঙিয়ে নিতে পারত সুরভি। ভাবতে ভাবতে কখন তার দুচোখে ঘুম নেমে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি।
সকালে সূর্যের মিঠে রোদে যখন সুরভির ঘুম ভাঙল, ওর দুই গালে রয়ে গেছে গত রাতের অশ্রুধারার হালকা দাগ। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে সুরভির ঠোঁটে হালকা একটা হাসি খেলে গেল। আজ অনেকদিন পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখল নিজেকে। পুরোনো সুরভির ছায়া দেখতে পেল, যে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ডানা ঝাপটাচ্ছে। নিজের প্রতি আলাদা করে একটা ভালোবাসার অনুভতি মনের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারল সুরভি।
কলেজ সময়ের যে-জীবনটাকে বহু পিছনে ছেড়ে এসেছিল সে, আজ সেটাই সুরভির জীবনে নতুন রং ভরতে উদ্যত হল। সুরভিও বিনা দ্বিধায় নিজেকে সঁপে দিল নতুন উদ্যমভরা ভবিষ্যতের হাতে। চারটে দিন নতুন পাখায় ভর দিয়ে কোথা দিয়ে কেটে গেল সুরভি বুঝতেই পারল না। সুরভির খালি মনে হচ্ছিল সে অনেকটাই বদলে গেছে।
দিল্লি পৌঁছোতে পৌঁছোতে পুরোনো সুরভি হয়ে উঠেছিল সে। রাহুলের প্রতিটা কথা ওর ঘুমন্ত আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছিল। সোনার কাঠির ছোঁয়ায় পুরোনো সুরভির মধ্যে আবার নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পুরোনো যা কিছু শখ তার কাছে অধরা রয়ে গিয়েছিল, সব আবার নতুন পাখায় ভর করে ওড়ার অপেক্ষায় ছিল। সুরভির এই পরিবর্তন বিনোদকেও আশ্চর্য করে তুলেছিল।
চা খেতে খেতে বিনোদ আর নিজেকে আটকাতে পারল না, সুরভিকে প্রশ্ন করেই ফেলল। কী ব্যাপার সুরভি? দুবাই থেকে ফেরার পর তোমার মধ্যে খুব পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে যে এত পুলকিত হয়ে আছো?
সব পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এককথায় বলতে পারো পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম ওখানে। তুমি আমাকে আমার আসল রূপে দেখেছই কোথায়? কতটা জানো তুমি আমার শখ-আহ্লাদ সম্পর্কে? সুরভির বলার ঢঙে আজ এমন কিছু ছিল যেটা বিনোদকেও সম্পূর্ণ চুপ করিয়ে দিল।
নদী নিজের গতিতে এগিয়ে চলে ঠিকই কিন্তু অনেক সময় পাথরে ধাক্কা খেয়ে নিজের গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। সেরকম সুরভিরও কোমল, সংবেদনশীল মন পাথরে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছিল সুরভি। আঁকা, লেখালেখি এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলল সে। জীবনে যে-শখগুলো তার অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, সেগুলোকেই প্রায়োরিটি দিতে সে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। নিজের একটা খোলা আকাশ তৈরি করে নিল সে, যেখানে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ইচ্ছেমতন ডানা মেলে ওড়ার অফুরন্ত স্বাধীনতা রয়েছে। বিনোদও মুখে কিছুই বলল না, চুপচাপ সুরভির এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে বাধ্য হল।
কাজ করতে করতে যখনই ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দটা বেজে উঠত, সুরভির চোখ ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা খুঁজত। মনের অতলে রাহুলের ডাক শোনার জন্য প্রাণটা ছটফট করত। অপেক্ষায় দিন গুনত। এক-দুবার মেসেজও পাঠিয়েছে কিন্তু কোনও উত্তর আসেনি।
রাহুল নিজের সীমা জানত। সেটা যে লঙ্ঘন করা উচিত নয় সেটা ওর আবেগসিক্ত মন ওকে সবসময় মনে করাত। মনে মনে জেনে নিয়েছিল, সুরভির বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার অর্থ হল সুরভির জীবনটাকে তছনছ করে দেওয়া। ওর মন এতে সায় দেয়নি। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছিল।
সুরভিরও অপেক্ষা সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে বছর পার করে ফেলল। রাহুলের কোনও ফোন, কোনও মেসেজ কিছুই এল না। রাহুলের সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্ত সুরভির ভিতরের আগুনকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল ঠিকই কিন্তু ওর প্রতি রাহুলের উপেক্ষা সুরভির মনটাকে পুরুষজাতির উপর বিতষ্ণায় ভরে তুলল।
সব পুরুষরা একই রকমের হয়। মেয়েদের প্রতি তাদের মানসিকতা কোনও দিনই বদলাবার নয়। পুরুষরা চায় মেয়েদের উপর একছত্র অধিকার ফলাতে। বাড়ির বাইরে মর্যাদার লক্ষণরেখা টেনে দিয়ে নিজেরা বাইরে ফুর্তিতে দিন কাটায়। মেয়েদের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার অধিকার পুরুষদের কে দিয়েছে? নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব স্বাভাবিক ভাবে নিতে কবে শিখবে পুরুষরা? দুজনেই আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাহলে পুরুষরা কেন একাই সব সিদ্ধান্ত নেবে? সুরভির অশান্ত মনের ভাব ওর লেখায় এবং আঁকায় আগলহীন স্বাধীনতা পেয়ে ঝরে পড়তে লাগল।
বড়ো একটা ঝড়ের পর যেমন পরিবেশ শান্ত হয়ে পড়ে, তেমনি সুরভিরও মন শান্ত হয়ে এসেছিল। বিনোদকে বোঝা এখন ওর পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। হয়তো সব পুরুষেরই চিন্তাধারা একইরকম। জীবনের টুকরো টুকরো অধ্যায়কে সাদা কাগজে জীবন্ত করে তুলতে লাগল সুরভি। সুপ্ত মনের ভাব আকার নিতে আরম্ভ করল। সুরভি নিজের জগতেই বিচরণ করার পূর্ণ আনন্দ গ্রহণ করতে শুরু করল। নিজের রং, অনুভতিতে ডুবে থেকে সুরভি নিজের এই প্রাকারেও সুখ খুঁজে পেল। হাওয়া ভরা শূন্য গেলাস যেমন জলের কণাকে আত্মসাৎ করে গেলাসটাকে শুকানোর চেষ্টা করতে থাকে, তেমনি সুরভিও জীবনের একাকিত্বকে আপ্রাণ প্রয়াসে জীবনের বাইরে ঠেলে সরিয়ে ফেলতে সফল হল।
সুরভি চোখ বুজে আরামকেদারায় গা-টা এলিয়ে দিয়ে বসল। মনের মধ্যে আজ আর কোথাও শূন্যতার স্থান নেই। সব দিক দিয়ে সে আজ পরিপূর্ণ। হাতে ধরা গরম চায়ের কাপে চুমুক মারতে মারতে লক্ষ্য করল, চায়ের কাপের ধোঁয়া বাতাসে নিজের অস্তিত্বের সংকেত রেখে তবেই ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে। চায়ে দেওয়া এলাচের সুগন্ধ সমস্ত পরিবেশকেই সুগন্ধিত করে তুলেছে।
সুরভিরও একাকী জীবনে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছিল। সেই ছোঁয়ায় নিজের মনকে রাঙিয়ে তুলতে দ্বিধা করেনি সুরভি। আজ অনেকদিন পর সুরভির মন রাহুলের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আকুল হল। মনে মনে রাহুলকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারল না। রাহুল নিজের অজান্তেই শুকনো গোলাপের পাপড়ির উপর কয়েক ফোঁটা সুগন্ধি কখন ছড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা সে নিজেও টের পায়নি।