মিউকরমাইকোসিস (আগে যাকে বলা হত জাইগোমাইকোসিস) বা কালো ছত্রাক, একটি ফাঙ্গাস রোগ যা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামে পরিচিত।এটি মারাত্মক তবে বিরল সংক্রমণ।বর্তমানে দেখা যাচ্ছে কোভিড -১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর বা কোভিড -১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর, অনেকের শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এর আক্রমণ শুরু হচ্ছে।এটি একটি বিরলতম রোগ হিসেবেই মনে করছেন চিকিৎসক মহল।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি একটি প্রাণঘাতী রোগ।রিকভারি রেট ৩০-৫০ শতাংশ।৫০-৭০ শতাংশ আক্রান্ত রোগী মারা যেতে পারে বলে চিকিৎসক মহলের অনুমান।
এটি সাধারণত মিউকর নামক ছত্রাকের সংস্পর্শে আসার কারণে হয়ে থাকে।মিউকর সাধারণত পাওয়া যায় মাটি,গাছ,পচে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া শাক-সবজি ও ফল এ। এছাড়াও ভেজা স্যাঁতসেঁতে জায়গা, বাতাসে, সুস্থ মানুষের নাকে ও শ্লেষা ঝিল্লীতে থাকতে পারে।যেভাবে ছাড়িয়ে পড়ে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস–পরিবেশ থেকে মানুষের শরীরে,মানুষ থেকে মানুষের শরীরে,পশু থেকে মানুষের শরীরে।
শরীরের কাটা অংশ,পোড়া অংশ ও চামড়ার ছড়ে যাওয়া অংশ দিয়েও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রবেশ করতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রথমে মুখমণ্ডলের সাইনাসগুলোকে আক্রমণ করে৷মুখের ভেতর, নাক, চোখ,দাঁতের মাড়ি আক্রান্ত হয়।ধীরে ধীরে তা লাংস বা ফুসফুস,ব্রেন ও সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রমণ করে।বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন উচ্চ ব্লাড সুগার যুক্ত রোগী,ক্যানসার,এডস বা এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে, ও যে যে রোগীর ওপর স্টেরয়েড চিকিৎসা বেশি হয়েছে– সেই সব রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।যাদের অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট ,স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে এবং নিউট্রোপেনিয়া রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল।
আবার কোভিড -১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের সুস্থ করে তুলতে যে-সমস্ত রোগীদের বেশি পরিমাণে স্টেরয়েড চিকিৎসা হয়েছে– তাদের ক্ষেত্রেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস-এর অতিমাত্রায় সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে।দীর্ঘদিন ধরে নাকে অক্সিজেন নল লাগানো রোগীদের ক্ষেত্রেও সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে চিকিৎসকরা দাবি করছেন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ হল জ্বর,মাথাব্যথা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া,নাকের চারিদিক ফুলে যাওয়া,যন্ত্রণা,ত্বকে লালচে ভাব। নাক,চোখ ও মুখমন্ডলের যন্ত্রণা হতে পারে। এছাড়া কাশি,বুকে হাঁফ ধরা, ফুসফুসে কফ জমা ও কখনও কখনও কাশির পর ঘন বা রক্ত-যুক্ত কফ উঠতে থাকাও, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ।
উপসর্গ হিসেবে , নাক থেকে লাল ও কালচে রক্ত পড়া, চোখ ফুলে যাওয়া, সেই সঙ্গে চোখে যন্ত্রণা, চোখের পাতা সহজেই বন্ধ হয়ে যাওয়া, দৃষ্টি শক্তি কমতে থাকা বেশ কমন।শেষ পর্যন্ত রোগী অন্ধ হয়ে যেতে পারে এই রোগে।নাকের চারিদিকে কালচে কালচে দাগ দেখা দিতে পারে।দাঁতে যন্ত্রণা,মাড়ি ফোলা,কয়েক দিনের মধ্যেই দাঁত নড়তে থাকা, মুখমন্ডলের উপরি অংশে কালচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে।এগুলো মাঝে মধ্যেই লক্ষ রাখা উচিত।
অনেক সময় এমনও দেখা গেছে, যাতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ব্রেনে না পৌঁছোতে পারে, তার জন্য চোখ অপারেশন করতে হয়েছে।কখনও সংক্রমণ রুখতে দাঁতের মাড়ির কিছু অংশ অপারেশন করে বাদ দিতে হয়েছে।তবে সার্জারি বিরলতম ঘটনা।যখন মেডিসিনাল চিকিৎসা কাজ করে না তখনই কিছু কিছু চিকিৎসক রোগীর জীবন রক্ষা করতে সার্জারির কথা ভেবেছেন।
রক্ষা পাওয়ার পথ
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে যেমন,হাসপাতালের কোভিড -১৯ রোগীদের কক্ষে, ICU গুলোতে যাতে মিউকরের স্পোর না থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা।
- রোগীদের অক্সিজেন দেওয়া কিটস নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর স্যানিটাইজ করা।
- উচ্চ ব্লাড সুগার রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে,কারণ রক্তে যত বেশি মাত্রায় শর্করা উপস্থিত থাকবে, তত বেশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের তীব্রতা দেখা দেবে।
- কোভিড -১৯ থেকে সেরে ওঠা যে -সমস্ত রোগীদের স্টেরয়েড থেরাপি হয়েছে, তাদের বাড়িতে আসার পর কিছু দিন বাড়ির ভেতরে থাকতে হবে, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
- জানালা খোলা রাখতে হবে,এসি বন্ধ রাখাই ভালো।অন্যান্য যে-কোনও পুরাতন ও জটিল রোগে ভোগা রোগীদের রোগের চিকিৎসা করতে হবে।
- রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার ও ফল শাক-সবজি খেতে হবে।দু-চারটে তুলসীপাতা লিকার চায়ে ফেলে খাওয়া যেতে পারে। আদা,রসুন,কাঁচা পেঁয়াজ,ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন লেবু,মুসম্বি, আমলকী,কাঁচা লঙ্কা খেতে হবে।ডিম-মাছ-মাংসও প্রয়োজনমতো খেতে হবে।
চিকিৎসা
আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ও মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন।নিজে নিজে ঔষধ সেবন না করাই ভালো।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা মতে রোগের লক্ষণ, রোগের স্থান ও রোগের তীব্রতা অনুযায়ী কিছু হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে– যেমন,আর্সেনিকাম এলবাম,ফেরাম ফস, মার্কসল, মার্ক-বিন-আয়োড, মার্ক-প্রোটো-আয়োড,ক্যালি বাইক্রোম, বেলেডোনা,একোনাইট, আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম, ইউফ্রেসিয়া, ফসফরাস,রাসটক্স, নাট্র্যাম মিউর, ল্যাকেসিস ইত্যাদি।তবে আবার বলা, একজন চিকিৎসক-ই পারেন তাঁর অভিজ্ঞতা ও রোগের লক্ষণ মিলিয়ে সঠিক ঔষধ,সঠিক পোটেন্সি,সঠিক ডোজ নির্বাচন করতে।তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলার চেষ্টা করাই ভালো।