‘বাবা এ বাবা দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

‘দেখছিস মাপ লিচ্ছি তবু কানের গড়াটায় সেই ঘ্যেনের ঘ্যেনের কচ্চিস। টুকু দাঁড়া ন, মাপটা লিয়েলি।’

‘বাবা এ বাবা…’ এবার ঘুমটা ভেঙে যায় দুলালের। এখন ঘরময় অন্ধকার, দাঁত বিছিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিছানা থেকে উঠে লাইটটা জ্বালায় দুলাল। অন্ধকারের দাঁতগুলো যে যার মতো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে দুলালের। মাটির কলশি থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢক-ঢক শব্দে জলটা গিলে নেয় দুলাল। বাতাসি আলুথালু শরীর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাতাসির চুপসে যাওয়া বুকদুটো বেরিয়ে পড়েছে বাতাসের খোঁজে। বালিশের তলা থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাইটা নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় দুলাল। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটা আরও গুমোট হয়। দুলালের কানে স্বপ্নে শোনা কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে…

১)

ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি থেকেই কাজের চাপ বাড়তে থাকে দুলালের। এই দুটো মাস নিঃশ্বাসটাও গুনে-গুনে নিতে হয় ওকে। বাতাসি কাজে তেমন পটু না হলেও দুলালকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুখোশগুলোকে সময় মতো রোদে দেওয়া, পরিমাণমতো রোদ পাওয়ার পর সেগুলোকে তুলে ঘরে রাখা। দোকানে দোকানে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসা। সময় মতো অর্ডারের মাল দোকানে দিয়ে আসা। বাতাসি না থাকলে দুলালের একার পক্ষে সবদিক সামলানো সম্ভব হতো না।

পুরুলিয়ার মাহাত পাড়ায় গিয়ে দুলাল মাহাতোর নাম বললে যে কেউ ওর ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে দুলাল। সেবছর দুর্গা পূজার সময় বাথানির মাঠে মরা মহিষ বানিয়ে শকুন নামিয়ে দিয়েছিল দুলাল। সেদিনের পর থেকে ছেলেবুড়ো সবাই ওকে এক নামে চেনে। তবে দুলাল মাটির কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ছৌনাচের মুখোশ বানাতেই ও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর ধরেই মুখোশ বানাতে হয় ওকে। দুর্গা পূজার আগের কটা মাস খুব কাজের চাপ পড়ে যায়। নানান জায়গা থেকে অর্ডার আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও দুলাল সকাল সকাল নিজের কাজ নিয়ে বসেছিল। আপন মনে রং করছিল একটা মুখোশ। বাতাসি মুখোশের সাইজ অনুযায়ী পেপার কাটছিল দুলালের পাশে বসেই। ঠিক এমন সময় একটা লোক ঢুকল ঘরের ভেতর। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। পরনে আলখাল্লা ধরনের একটা পাঞ্জাবি। দুলাল কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল লোকটাকে, তারপর বলল, ‘পূজার আগে আর লতুন অডার লিব লাই।’ লোকটা কিছুই বলল না। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল একটা মুখোশের দিকে। কথাটা বলার পর দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো কিছু বলবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুলাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মুখশ চাই?’

এবার উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি মুখোশ কিনতে আসিনি।’

‘তাহলে কী জন্যে আইচেন?’ জিজ্ঞেস করল দুলাল।

‘এমনি।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দুলাল। আর কথা না বাড়িয়ে বাতাসিকে চোখের ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বলে, আবার নিজের কাজে মন দিল। বাতাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দুলালের দিকে। তারপর চুপচাপ ঘরের ভেতরে চলে গেল। হাতে ধরে থাকা মুখোশটায় রং দেওয়া হলে দুলাল তাকিয়ে দেখে লোকটা নেই। কখন বেরিয়ে গেছে। লোকটার মতিগতি বোধগম্য হল না দুলালের। এমন তো কত লোকেই আসে-যায় ওসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় হয় না দুলালের। আজকের এই লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল ওর।

হাতের রং করা মুখোশটাকে উঠোনের রোদে নামাতে গিয়ে দুলাল খেয়াল করল সদর দরজার কোণায় একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা কুড়িয়ে থমকে গেল দুলাল। একবান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট রাখা আছে প্যাকেটটার ভেতর। বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল দুলালের। কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো লোকটা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল কয়েকবার। কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে লোকাল থানায় দিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত সাহস হল না দুলালের। পুলিশের চক্বরে পড়লে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রেখে দিল একটা মুখোশের ভেতর। যদি লোকটা আবার আসে তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেবে…

২)

নানান কাজের চাপে টাকার প্যাকেটটার কথা মাথাতেই ছিল না দুলালের। মনে পড়ল মুখোশটা বিক্রি করতে গিয়ে। মুখোশটা হাতে নিয়েও টাঙিয়েই রেখে দিল দেয়ালে। বেশ কিছুদিন হল পূজা পেরিয়ে গেছে। এখন কাজের তেমন চাপ নেই বললে চলে। দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো আবার কিছু দিনের ভেতর কোনও কুপ্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা সেই যে গেল আজও এল না। প্যাকেটটার কথা দুলাল বাতাসিকেও বলেনি। দুলাল জানে বাতাসি টাকার গন্ধ পেলে সেটা শেষ না করে শান্তিতে বসবে না।

দিন দিন কাজের পরিমাণ যতই কমছিল ততই বেশি মনে পড়ছিল টাকার প্যাকেটটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুলাল যখন নিশ্চিত হল লোকটা আর আসবে না তখন হাত দিল টাকার প্যাকেটটায়। ওই টাকা খরচা করে ঘরের চাল-ডাল যেমন এল, ঠিক তেমন ভাবেই মুখোশের রং তুলিও এল। বিনা পরিশ্রমের টাকা খরচা করতে বিশেষ সময় লাগল না। মাস দুয়েকের ভেতরেই দুলাল শেষ করে ফেলল টাকাগুলো। টাকাটা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আবার হাজির হল লোকটা। লোকটা যে আবার কোনও দিন আসতে পারে সেটা কল্পনা করেও দেখেনি দুলাল। লোকটাকে দেখামাত্রই দুলাল মনে মনে ঠিক করে নিল লোকটা টাকার কথা বললে টাকাটার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা টাকার কোনও কথাই বলল না। সেদিন যেমন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেল আজকেও। তবে আজকে আর কোনও টাকা রেখে গেল না লোকটা।

এবার বেশ চিন্তায় পড়ল দুলাল। কে এই লোকটা? কেন আসে ওর কাছে? কী করাতে চায় ওকে দিয়ে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দুলাল। কিন্তু উত্তরগুলো কিছুতেই ধরা দিল না ওর হাতে। শেষ পর্যন্ত বাতাসিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল দুলাল। ওর একার পক্ষে আর চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তবে বাতাসিকে বলেও বিশেষ কিছুই লাভ হল না দুলালের। বাতাসি এমন কোনও পথ বলতে পারল না যে পথে ভাবলে মানসিক শান্তি পায় দুলাল।

৩)

আজকে আর রাতজেগে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না দুলালের। বেশ কিছুদিন হল শরীরটাও সাথ দিচ্ছে না ওর। বাতাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভাঙল আবার সেই স্বপ্নটা দেখে। অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুম এল না ওর। শেষ পর্যন্ত ঘরের কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল ওকে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল ঘরের বারান্দায়। আজকে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা মুখোশগুলো। ঘরের পিছন দিকের বাঁশ বাগান থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এমন রাত মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। দুলালের ভেতরটাও আপন খেয়ালে গুনগুন করে ওঠে,

‘আইজ চাঁদ চইল্যেছে আকাশ গায়ে জোছনা বিছ্যায়ে

আইজ বুকের ভেতর প্রেমের খেলা দুবুক লাচ্যাইয়ে।

তুই ঘর ভিতরে ঘুমাই আছিস আমি বেকার বাজাই বাঁশি

আর কবে বুঝবি লো তুই আমি কীসের লাইগ্যে আসি?’

দুলাল গানটা থামিয়ে দিতেই দরজার বাইরে থেকে গানের পরের লাইন দুটো ভেসে আসে,

‘ওলো সখী তুই উঠার আগেই ভোর হইয়্যে যায় পাছে

আয়-না-গো তুই বাতাস হইয়্যে আমার বুকের কাছে।’

গানের শেষ দুটো লাইন শুনে দুলাল অবাক হয়ে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে এই গান গায়? এই গান তো দুলালের বানানো গান। এই গান অন্য কারুর জানার কথা নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা খুলল দুলাল। দরজাটা খুলেই দেখল সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুলাল পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটা হাসছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল দুলাল, ‘এতো রাইত্যে কী জন্যে আইচেন?’

‘একটা মুখোশ চাই আমার।’

‘না আমি আপনারে কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ভয়ংকর শোনায় সেই হাসির শব্দ। দুলাল নিজের কান দুটোকে প্রাণপণে চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দিব লাই মুখশ। কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসি মুখেই বলে, ‘মুখোশটা বানিয়ে ফ্যাল্। ওই মুখোশটা তোকে বানাতেই হবে।’ কথাগুলো বলেই লোকটা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুলাল কান দুটোকে চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাট কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে আর দেখা যায় না। বাতাসি দুলালকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কপাট বন্ধ করে দেয়।

৪)

পরের দিন সকাল সকাল বাতাসি কয়েকটা মুখোশ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। এই মুখোশগুলো রমেন গাঙ্গুলি অর্ডার দিয়েছিল। মুখোশগুলো কলকাতায় যাবে। আজকে বাজারে আরও একটা কাজ আছে বাতাসির। দুটো কাজ সেরেই ও ফিরবে। বাতাসি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ভাঙা আলমারিটা থেকে দুলাল একটা মুখোশ বের করে আনে। আজ অনেক বছর পর দুলাল আবার বের করেছে মুখোশটা। সেদিন সারারাত কাজ করেও মুখোশটা শেষ করতে পারেনি দুলাল। সেই রাতের পর আর হাত দেওয়া হয়নি মুখোশটায়। আজকে যে ভাবেই হোক মুখোশটার অসমাপ্ত কাজটা ওকে শেষ করতে হবে। গতকাল রাতেই দুলাল বুঝতে পেরেছিল লোকটা কোন মুখোশটা নিতে চায়। আজ থেকে সাত বছর আগে একজন লোক এসেছিল দুলালের কাছে। একটা শয়তানের মুখোশ বানাতে বলেছিল দুলালকে। কাজটা নিয়েছিল দুলাল। কিন্তু শেষ আর করতে পারেনি।

মুখোশটায় রং করতে করতে দুলাল শুনতে পায়, ‘বাবা এ দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

মাঝে মাঝে রং তুলি ফেলে কান দুটোকে চাপা দেয় দুলাল। কয়েক মিনিট পর কান ছেড়ে আবার কাজে মন দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পর মুখোশটার কাজ শেষ হয়। একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দুলালের ভেতর। এর আগে কোনও মুখোশ বানিয়ে এতটা আনন্দ হয়নি ওর। যেমন বানাতে চেয়েছিল অবিকল তেমনই মুখোশ বানিয়েছে দুলাল।

মুখোশটা দুহাতে নিয়ে দুলাল ওটাই ভাবছিল কতক্ষণে লোকটা আসে। ও এলেই ওর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করবে ওকে। মুখোশটা কমপ্লিট হওয়ার পর সেই লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসি মুখে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে?’

‘হইচ্যে। কিন্তু এই মুখশটা লিয়ে যাবার পর আর আসা চইলব্যেক লাই আমার বাড়ি।’ দুলাল বলে।

লোকটা কোনও কথা না বলে মুচকি হেসে দুলালের কাছে এগিয়ে আসে। দুলাল শক্ত করে ধরে রাখে মুখোশটা। কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে দূরের থেকেই মুখোশটা দেখায় লোকটাকে। লোকটার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারে দুলাল।

লোকটা হাসি মুখে অস্ফুট সুরে বলে, ‘শয়তানের মুখোশ।’

যখন বাতাসি ঘরে ঢোকে তখনও দুলাল লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। আজকে বাতাসির সঙ্গে আরও একজন এসেছে।

পুলিশ?

না পুলিশ নয়, মনের ডাক্তার। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুবিমল সরকার। ডাক্তারকে বাতাসি আঙুল বাড়িয়ে দেখায় দুলাল কেমন ভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প করছে। শুধু তাই নয় দুলাল গল্প করছে সম্পূর্ণ দুরকম ভাবে। একটা ওর নিজের ভাষা। অন্যটা শহরের। বাতাসি দুলালের কাছে যেতে চাইলে সুবিমল বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ওকে মুখোশটা দিতে দাও।’

দুলালের কল্পনায় তৈরি লোকটা যখন কথা দেয় ও আর আসবে না, তখন দুলাল মুখোশটা শূন্যে তুলে ধরে। তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাতাসি আর সুবিমল সরকার মিলে দুলালকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে। সুবিমল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই। আশা করি আজকের পর আর এই সমস্যা হবে না। তবে ওই মুখোশটা যেন ওর চোখে আর না পড়ে। পারলে ওটাকে পুড়িয়ে দিও।’

৫)

বাতাসি উঠোনে গিয়ে মুখোশটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। অবিকল নিজের মুখোশ বানিয়েছে দুলাল। কাঁচাপাকা চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। মুখোশ হাতে নিয়ে বাতাসি ডাক্তারের সামনে তুলে ধরে। মুখোশটাকে দেখার পর কয়েক মিনিট চিন্তা করে সুবিমল। কোনও একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সুবিমল বাতাসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দুলাল নিজের মুখোশ বানাল কেন? তোমার কী মনে হয়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতাসি বলে, ‘যেদিন রাইত্যে আমাদের ছেল্যাডারে সাপে কাইট্যে ছিল সেদিন একটা লোক আছিল একটা অডার লিয়ে। একটা শয়তানের মুখশের অডার। সেই অডারের কাইজটাই রাইত্যের বেলায় কচ্চিল দুলাল। আমি ঘুমোচ্চিলাম। তাতাই আমাকেও তুইল্যেছিল, উঠি লাই। উয়ার বাপও কাইজ ছ্যাইড়ে উঠে লাই। যখন জাইনত্যে পাইল্লম তাতাইকে সাপে কাইট্যাছে, তখন সব শেষ। সেদিন থ্যেইক্যেই তাতাই-এর বাপ ক্যেমন যেন হইয়ে গেছ্যে।’

‘আচ্ছা সেদিন তুমি টাকার বান্ডিলটা কোথায় রেখেছিলে?’

‘ওই কপাট কুনট্যায়।’ আঙুল বাড়িয়ে দেখায় বাতাসি।

‘দুলাল টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রেখেছিল বলতে পারবে?’

‘একটা মুখশের ভিতর‍্। দাঁড়ান লিয়ে আসচি।’

বাতাসি মুখোশটা নিয়ে এসে সুবিমলের হাতে দেয়। সুবিমল মুখোশটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর বলে, ‘আচ্ছা এই মুখোশটার ভেতর আরেকটা ছোট্ট মুখোশ কেন আছে?’

এবার চুপ করে যায় বাতাসি। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পু্রোনো ব্যথাটা চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাতাসিকে চুপ করে থাকতে দেখে সু্বিমল বলে, ‘আমাকে মুখোশ রাখার ঘরটায় একবার নিয়ে চলুন।’

না বলতে পারে না বাতাসি। মুখোশ ঘরে নিয়ে আসে সুবিমল ডাক্তারকে। ঘরটায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় ডাক্তার। সারা ঘরটা জুড়ে কয়েক’শ মুখোশ রাখা আছে। দেব-দেবীদের মুখোশ থেকে শুরু করে পশু-পাখি কিছুই বাদ নেই। কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ঝুলছে অদ্ভুত কিছু মুখোশ। প্রতিটা মুখোশের ভেতর একটা করে ছোটো মুখোশ আছে। একটা মুখোশ হাতে নিয়ে ভেতরের ছোটো মুখোশটাকে বের করার চেষ্টা করে ডাক্তার। পারে না। বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটো মুখোশটাকে এমন ভাবেই ঢোকানো আছে যে, দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুবিমল অবাক চোখে বাতাসিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেন বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটোটাকে লুকিয়ে রেখেছে দুলাল?’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বাতাসি বলে, ‘তাতাইকে সাপে কামড়্যায় নায়, ডাক্তারবাবু।’

‘তাহলে?’

‘সাত বছর আগে সেদিন যে লোকটা আইছিল, সে বইল্যেছিল…’

‘শয়তানের মুখোশ বানাতে। তারপর?’

‘মুখশটা মাপে ঠিক হচ্যিল লাই। তাতাই-এর বাপ তাই তাতাইকে মুখশটা পরাই মাপটা ঠিক করত্যে গ্যেইছিল…’ কান্নায় বাতাসির কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরের কান্নাটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বাতাসি বলে, ‘তাতাই বারবার বইল্যেছিল, দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। উয়ার বাপ কথাগুল্যান কানেই নিল লাই। আর খুলত্যে পারে নাই মুখশটা। মাছের মতো ছটপট্যাই ছটপট্যাই মইরে ছিল তাতাই…’ নিজেকে আটকাতে পারে না বাতাসি। সাত বছর ধরে জমিয়ে রাখা চোখের জল আজ আর কোনও বাধা মানতে চাইছে না।

সুবিমল একটা মুখোশকে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। পারে না। প্রতিটা কাগজের মুখোশের ভেতর টিনের পাত দেওয়া আছে। সুবিমল খেয়াল করে দেখে সব মুখোশগুলোর গঠন এক নয়। অধিকাংশ মুখোশের পিছন দিকটায় কিছু নেই, ফাঁকা। গোটা কুড়ি-পঁচিশ মুখোশ আছে যেগুলোর পিছনটাও সুন্দর ভাবে বানানো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই কুড়ি-পঁচিশটা মুখোশ শয়তানের মুখোশ।

সুবিমল সরকার আগে তো একজন মানুষ, পরে ডাক্তার। ওর বাড়িতেও বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে আছে। তাই ওর পক্ষে দুলাল কিংবা বাতাসির যন্ত্রণার জায়গাটা বোঝা কঠিন নয়। এতক্ষণে সুবিমল বুঝতে পারে, কেন দুলাল শয়তানের মুখোশে নিজের রূপ এঁকেছে। কেন শয়তানের মুখোশের ভেতর একটা করে ছোট্ট মুখোশ ঢোকানো রয়েছে।

দুলাল এখনও অচেতন ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সুবিমল দুলালের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না নিঃশ্বাস স্বাভাবিক। এখন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে না দুলাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুবিমল বাতাসিকে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। দুলাল ওই বাজে স্বপ্নটা বা ওই লোকটাকে আর কখনওই দেখবে না। তবে হাঁ জ্ঞান ফেরার পর যদি কাঁদে তো ওকে মন খুলে কাঁদতে দিও।’ কথাটা বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েও আবার একবার ফিরে আসে সুবিমল, ‘আরেকটা কথা। শয়তানের ওই মুখোশটা, যেটা দুলালের নিজের মুখের আকৃতি, সেটা যেন আর দুলালের চোখে না পড়ে। ওটাকে দূরে কোথাও পুড়িয়ে দিও কিংবা মাটি চাপা দিয়ে দিও।’

সুবিমল চলে যাওয়ার পর বাতাসি দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দুলালের মুখটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর মুখোশটা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কোনওদিন দুলালের চোখে পড়বে না শয়তানের মুখোশটা।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...