উইল নিয়ে বিস্তর গল্প আমরা ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি। বিষয়টা মানুষের মন এতটাই ছুঁয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষের আমল থেকে যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে গল্প লিখেছিলেন ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’।
সম্পত্তির মালিক বেঁচে থাকতে যদি সম্পত্তি ঠিকভাবে উইলের মাধ্যমে ভাগ করে দিয়ে যান, তবে তার অনুপস্থিতিতে একাধিক সিভিল সুট-এর উৎপত্তি হবে না।
অবশ্য কেউ যদি ‘দানপত্র’ করেন তো আরও ভালো। ‘দানপত্র’ আর ‘ইচ্ছাপত্র’ বা উইল কিন্তু এক জিনিস নয়।
উইল কাজে আসে দাতার মৃত্যুর পর এবং আদালত কর্তৃক অধিকারপত্র পাওয়ার পর, কিন্তু দানপত্র রেজিস্ট্রি হওয়ার পরমুহূর্তেই গ্রহীতাকে সম্পূর্ণ মালিকানা দেয়।
ঘটনা-১
সৌরেনবাবু মারা যাবার পর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওনার দুই ছেলে বাসুদেব এবং অনুদেবের মধ্যে সমানভাগে ভাগ হওয়ার জন্য, মোটামুটি সব ঠিকঠাকই হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সবটাই মৌখিক ভাবে। এমনকী দুইভাই সেই অনুযায়ী বন্টননামাও তৈরি করে রেজিস্ট্রি করবার দিন ঠিক করে ফেলেছিল। মাঝে বাধ সাধল এক আশ্রম। এই আশ্রমের শিষ্য ছিলেন সৌরেনবাবু। আর মারা যাবার আগে সৌরেনবাবু ওনার স্থাবর-আস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি নাকি লিখিতভাবে উইল করে এই আশ্রমকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রথমে কথাবার্তা তারপর বাকবিতণ্ডা… অবশেষে ব্যাপারটা আদালত অবধি গড়াল। আর সৌরেনবাবুর, নিজের হাতে সই করা ‘উইল’ বা ‘ইচ্ছাপত্র’-কে গুরুত্ব দিলেন মহামান্য আদালত।
ঘটনা-২
শ্রীযুক্ত রঞ্জন সান্যাল মহাশয় চুঁচুড়ার অত্যন্ত ধনী ব্যাবসাদার। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে প্রায় কোটি-দশেকের মালিক। ভদ্রলোকের আট ছেলেমেয়ে এবং বিধবা স্ত্রী’র মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগির বচসা গড়িয়েছিল আদালতের দোরগোড়া অবধি।
হিসেব মতো সম্পত্তি ন’ভাগ হবার কথা এবং তা সমানভাগে। কিন্তু আদালত মৃত রঞ্জনবাবুর বিশ্বস্ত ম্যানেজারের সাক্ষ্য মেনে, ওনার স্থাবর এবং অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর বিধবা স্ত্রী এবং ছোটো ছেলের হাতে সমর্পণ করেন। কারণ ম্যানেজার আদালতকে জানিয়েছিলেন যে, মারা যাবার আগে রঞ্জনবাবু সম্পত্তির পরবর্তী মালিকানাস্বত্ত্ব মৌখিকভাবে, কেবল ওনার স্ত্রী এবং ছোটোছেলেকে সমানভাবে বন্টনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন । তাই আদালত সেই মৌখিক ইচ্ছে বা ‘উইল’-কেই আইনি ইচ্ছার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
ঘটনা-৩
হরিচরণবাবুর মৃত্যুর পর আদালতে ‘প্রবেট’ বা সম্পত্তির আইনি অধিকারপত্র নিতে গিয়ে ওনার ছোটো ছেলের তো নাস্তানাবুদ অবস্থা। আদালতে তিন-তিনটে রেজিস্টার্ড উইল আগে থেকেই দাখিল হয়ে আছে। আর এদিকে ছোটো ছেলের ‘উইল’-টি সাদা কাগজে লেখা যদিও সেটা হরিচরণবাবুর নিজের হাতে লেখা এবং দস্তখত করা।
আদালত তবু সেই সাদা কাগজে লেখা নন-রেজিস্টার্ড কাগজটাকেই হরিচরণবাবুর উইল মেনে অধিকারপত্র বা ‘প্রবেট’ দিলেন এবং কারণ হল তারিখ অনুসারে ওইটিই হরিচরণবাবুর শেষ ‘ইচ্ছাপত্র’। আর ‘ইচ্ছাপত্র’ বা ‘উইল’-এর ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়।
প্রসঙ্গ সম্পত্তি
উপরোক্ত এমন নানা ঘটনা আমাদের সমাজে প্রতিদিন ঘটে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিকে ঘিরে৷ কীভাবে নিজের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীর হাতে বা কোনও নির্বাচিত ব্যাক্তির হাতে দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে অনেকেই অবগত নন৷ তাই প্রথমেই কয়েকটি বিষয়ে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করে নিন৷
‘উইল’ বা ‘ইচ্ছাপত্র’ কী ?
‘উইল’ বা ‘ইচ্ছাপত্র’ হল মানুষের স্বউপার্জিত সম্পত্তির মরণোত্তর হস্তান্তরকরণ। অর্থাৎ মানুষের নিজের অর্জন করা স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির পরবর্তী মালিক ঠিক করে যাওয়া৷ অর্থাৎ বেঁচে থাকা অবস্থায় জানিয়ে যাওয়া, বা তার ইচ্ছে প্রকাশ করা।
‘ইচ্ছাপত্র’ কে করতে পারেন?
যে-কোনও সুস্থ স্বাভাবিক ভারতীয় নাগরিক ‘উইল’ বা ‘ইচ্ছাপত্র’ করতে পারেন ইন্ডিয়ান সাকসেশন অ্যাক্ট ১৯২৫এবং হিন্দু উইলস অ্যাক্ট (Act XXI, ১৮৭০)-এর ১২৬ নং ধারা অনুসারে। তবে সেক্ষেত্রে আইনজ্ঞের পরামর্শ বাঞ্ছনীয়।
‘উইলে’-এর অধিকার
প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, উইলের কার্যকারিতা ‘উইল’-কারকের মৃত্যুর পর শুরু হয়। বেঁচে থাকাকালীন কখনোই নয়। দ্বিতীয়ত উইলের বলে গ্রাহক কখনই সম্পত্তির মালিকানা উইলকারকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পায় না। এক্ষেত্রে গ্রাহককে আদালতের কাছে অধিকারপত্র বা ‘প্রবেটে’র জন্য আবেদন করতে হয়। সেই প্রবেট কোর্টে প্রদর্শন করা মাত্র গ্রাহক সেই সম্পত্তির সম্পূর্ণ মালিক হয় সম্পূর্ণ অধিকারের সঙ্গে।
‘উইল’- এর খুঁটিনাটি
- একজন মানুষ তার জীবনে একাধিকবার উইল করতেই পারেন কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার শেষতম উইল বা ইচ্ছাপত্রটিই আইনের চোখে গ্রাহ্য।
- প্রত্যেক উইলেই একজন এগজিকিউটর-এর নাম থাকা আবশ্যক। এই এগজিকিউটর সাধারণত উইলকারকের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন কেউ একজন হয়ে থাকেন। কারণ এই এগজিকিউটর-এর সাক্ষ্যর উপরেই প্রাপকের অধিকারপত্র পাওয়া না পাওয়া নির্ভরশীল।
- উইল রেজিস্ট্রিকৃত বা সাদা কাগজে লিখে যে-কোনওভাবে করা যায়। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
- উইল মৌখিকভাবেও গ্রাহ্য হয় তবে তা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এবং সেক্ষেত্রে অধিকারপত্র বা প্রবেট পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।
- যে-কোনও ভারতীয় নাগরিক ইন্ডিয়ান সাকসেশন অ্যাক্ট ১৯২৫ এবং হিন্দু উইলস অ্যাক্ট (Act XXI, ১৮৭০)-এর ১৮৮২ নং ধারা অনুসারে উইল বা ইচ্ছাপত্র করতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে তার বয়স রজ্জ্ব বছরের অধিক হতে হবে এবং তাকে মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে।