পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা নৈসর্গিক গ্রাম বলে শুধু নয়, ‘বালটি’ সংস্কৃতির অঙ্গ বলে তুরতুকের একটা ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্বও আছে। বিল মিটিয়ে মালপত্রসহ গাড়িতে উঠলাম। পরবর্তী রাত্রিবাস নুব্রা উপত্যকায় হলেও, হুন্দর অঞ্চলে নয়। শেয়োক অ্যাক্সিস ওয়ার মেমোরিয়াল।
রাস্তায় পড়ল ‘সিয়াচেন যুদ্ধ স্মারক’ (Siachen War Memorial) ফলকিত একটা ফটক। যুদ্ধসাজে দণ্ডায়মান ৫ সেনা জওয়ানের মূর্তি সাজানো। ৫০ টাকা করে টিকিট কেটে সেখান থেকে খানিক দূরে সামান্য চড়াই ধরে গিয়ে শেয়োক অ্যাক্সিস ওয়ার মেমোরিয়াল (Sheyok Axis War Memorial) হল দ্রষ্টব্য।
কয়েকজন সাইকেল চালাচ্ছিল। ফেরার ঢালু পথে আমার চোখের জিজ্ঞাসা পড়ে একজন আরোহী ‘চালাইয়ে চালাইয়ে’ বলে সাগ্রহে নিজের সাইকেল ধরিয়ে দিল। তার ভদ্রতায় আমি অভিভূত। অনভ্যাস নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় চালাতে নিজে সাহস পেলাম না। সেটা চালিয়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে ফিরে এসে ৫০ টাকা সাইকেল ভাড়া মেটালাম! ছেলেটাকে ধারে কাছে দেখা গেল না। যাইহোক, আমাদের গন্তব্য ছিল তুরতুক গ্রাম।
শেওক নদীকে পাশে নিয়ে ছুটে চলেছি। ভয়ানক রাস্তা। কোথাও ধস নেমেছে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ যানযটে দুই ঘণ্টার বেশি আটকে গেলাম। উঁচু নিচু খোঁচা খোঁচা পাথুরে রাস্তায় চলতে চলতে রিগজিনকে শুধোলাম, ‘স্টেপনি হ্যায় না সাথমে?’ ও হোহো করে হেসে বলল, ‘আজ তক কিসিনে পুছা নহী। চলিয়ে আপনে সোচ তো লিয়া।”
তুরতুক গ্রাম
কিছুদূর পরেই পিচরাস্তা পড়ল। কিন্তু গাড়ি যেখানে থামল সেখানে কোথায় গ্রাম, আর কোথায় নিসর্গ? পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর জুড়োব ভেবেছিলাম। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নদী, নদীর উপর সেতু, তার ওদিকে সিঁড়ি, আর সেই সিঁড়ি ভেঙে নাকি গ্রাম, যার নমুনাস্বরূপ ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর বিশেষ ধরনের পোশাক, গোঁফদাড়ি ও অভিব্যক্তির মানুষজন ছাড়া দর্শনীয় কিছু চোখে পড়ল না। এসেছি যখন গাড়ি থেকে নামতেই হল। সাঁকোও পেরোতে হল। তারপর দুইদিকে দুই সারি সিঁড়ি দেখে কোন দিকে যাই ভাবতেও হল। শেষে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় যেখানে কাছাকাছি, সেইদিকেই বাঁক নিলাম। তবে ব্যবস্থা দেখে বিয়োগবাসনায় ব্যাকুল জল ব্লাডার ছেড়ে মাথার দিকে ধাওয়া করল। শুভঙ্কর কাজ সারতে পারলেও আমরা মা-মেয়ে নাকমুখ মাস্কে ঢেকে ফিরে এলাম।
জায়গাটা আসলে বালটিস্তানের অঙ্গ, যা পাকিস্তানের দখলে ছিল। ভারতের বিস্তৃতি একদা আফগানিস্তান (গান্ধার) পর্যন্ত ছিল। ১৮৭৬ সাল ব্রিটিশ ভারত থেকে আফগানিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেই ইতিহাস বর্তমানে প্রাগৈতিহাসিক। একটি ভাঙাচোরা বাড়ি নাকি সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম। তার বাইরে তিনজন মহিলা মজাদার বাচ্চা কোলে। কী মজাদার দেখতে বাচ্চাগুলোকে! ছবি তুলতে যেতেই মেয়েরা বাচ্চা দিয়ে নিজেদের মুখ আড়াল করে ফেলছিল। এই ভগ্নকুটিরে প্রবেশের মূল্য ৫০ টাকা শুনে ফিরে আসব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু বাইরে বসা এক মিষ্টিমুখো মেয়ের মুখে নারী পরিচালিত সংগ্রহশালা শুনে টিকিট কেটে ঢুকেই পড়লাম।
নানা ধাতব গয়না, তৈজসপত্র, পোশাক থেকে ঘরসংসারের নানা জিনিস বেশ আগ্রহভরে দেখাল টিকিট বিক্রেতা তথা গাইড। একটা প্রাচীন বাড়িকেই মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। বাচ্চা রাখার স্থান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ওর মুখের কথাই হল ‘উন দিনো’ এমন হতো বা এমন ছিল না। কিন্তু সেইসব দিন বলতে কোনসব দিন, সেসব কিছু জানে না। পুরুষদের অমতে তুরতুকের মেয়েরা নিজেদের সংগ্রহে যার যা ছিল, তাই দিয়ে এই তথাকথিত মিউজিয়াম তৈরি করেছে। সম্ভবত সেইজন্য কোন ‘উন দিলোঁ’ হাজার খ্রিস্টাব্দের আর কোন “উন দিনোঁ’ নিজের শাশুড়ির আমলের, সেই বিষয়ে ধারণা নেই। বাড়ির যাবতীয় কাজের বর্ণনায় ‘শাশুমা’ হলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। পিতৃতন্ত্রে ‘শাশুমা’দের প্রায়ই খলনায়িকার ভূমিকায় দেখা গেলেও, ওই মেয়েটির বর্ণনায় শাশুড়িরা হলেন পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু।
ওই ভাঙাচোরা পথে আরেকটু এগিয়ে ‘রাগবো প্যালেস’। সেখানেও ৫০ টাকার টিকিট। ঈগলের কাষ্ঠ-মূর্তি বসানো দরজা দেখে কৌতূহল হলেও ঝরঝরে কাদার ‘রাজপ্রাসাদ’-কে আর সময় দেওয়া গেল না। প্রমিলা পরিচালিত সংগ্রহশালায় অনেকটা সময় গেছে, তলপেটে জলের চাপও প্রবল। কিছুটা ফিরে এবার উলটোদিকের সিঁড়ি ধরলাম। সিঁড়ির ধাপে ধাপে তথাকথিত ‘বালটি কুইজিন’-এর দোকান। ভেতো বাঙালিসহ বেশকিছু দেশি পর্যটক গোগ্রাসে গিলছে। আমরা বেশ দুর্গম স্থানে হলেও তুলনায় চলনসই শৌচালয় পেয়ে কাজ সেরে নিলাম। জল ত্যাগ করে দেহে বল পেয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে ওইদিকে আরও উঠে গ্রাম দেখতে ইচ্ছুক হলেও এবং কন্যারও আপত্তি না থাকলেও, আমার বর ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দেহে আর এক পাও এগোতে রাজি হল না। দুটো বেজে গেছে।
উপর থেকে ফিরতি পর্যটকদের জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও উপরে দর্শনীয় কী, জানা গেল না। কয়েকজন বাঙালিকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে জানলাম, সেখানেও নাকি ‘মিউজিয়াম’। গাড়িতে ফেরার পর রিগজিন-এর কাছে জানলাম, আরও কয়েকশো সিঁড়ি চড়লে নাকি পোলো গ্রাউন্ড ও কিছু নিসর্গ ছিল। তাই তো! পোলো খেলার উৎপত্তিই তো এই অঞ্চলে। কিন্তু এমন ঘিঞ্জি দুর্গম দুর্গন্ধময় পথে এগোতেই ইচ্ছা করছিল না। পোলো ময়দান দেখতে হলে হেলিকপ্টারে আসতে হয়।
(ক্র্মশ……)