নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ধানিজমি, গ্রাম, অরণ্য নিয়ে একদিকে সিমলিপাল অন্যদিকে কুলডিহা। সিমলিপাল যদি আলগা চটক হয়, তবে কুলডিহা এক হরিণ চোখের ফড়িং মেয়ের সরলতা ও সাজ নিয়ে সমগ্রটা।

সিমলিপাল থেকে কুলডিহাকে আলাদা করেছে সুখুয়াপোতা আর পাগুয়া নামের দুই পাহাড়। যে-ভাগটায় ছোটো বড়ো মিলিয়ে মেলা কাঠবিড়ালী– সেটাই ‘কুলডিহা’। ক’জন মিলে ক’দিন ধরে কষে মেখেছি কুলডিহার সাতশো রঙা সবুজ ও জঙ্গলের আনাচ-কানাচের ভয়। এখানে পৌঁছানো সহজ ছিল না, বাধা ছিল প্রায় নীলগিরি পাহাড়ের মাপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলাম। এমনিতেই কুলডিহার কাঁকনে ঘন ঘন বাঁক– বিপুল বনানী পেরোনো জঙ্গলে রোদ ঢোকে না। তায় এই বিবরণ বাদ দিলে আঁধার পেরিয়ে প্রবেশ আরও শক্ত হবে বৈকি। আসলে আপাত সহযোগী মানুষটির কোনও রাখঢাক নেই, দু-হাট খোলা মনোভাব। অনেক চেষ্টায় ফোনে তো পেলাম কিন্তু কিছু শোনার আগেই তাঁর প্রস্তুত রাখা প্রশ্নমালার সামনে পড়তে হল। প্রায় ‘হ্যালো’ শব্দটির গায়ে গায়ে জুড়ে এক নিঃশ্বাসে তার প্রশ্ন– কোথায় যেতে চাই– চাঁদিপুর, ভিতরকণিকা, কপিলাস, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, সিমলিপাল…

বাপরে– উত্তর দেব কি, মাথার মধ্যে ভীমরুলের ভোঁ ভোঁ। যেন বাসে উঠেছি, কনডাক্টর হাঁকছে– বেলেঘাটা, কাদাপাড়া,

চিংড়িঘাটা, মেট্রোপলিটন… কোনওমতে ওই ছেদহীন নামমালার মাঝখানে নিজের চাওয়াটুকু সিঁধিয়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম– ‘কুলডিহা, কুলডিহা’। ফোনের ওপারের মানুষটি নিলাজ ধাতুতে গড়া– দিব্যি নির্ভার। দয়ার দান দিচ্ছেন ভঙ্গিমায় একটি নৈর্ব্যক্তিক আওয়াজ শুধু ছুড়ে দিলেন। কী যে মানে আওয়াজটির… বুঝতে পারিনি বলেই খেজুরে আলাপে গেলাম, কেন-না বুকিং পেতে আমাকে হবেই। উনিও অনড়। বলতে থাকলেন যে কুলডিহার যেহেতু চাহিদা প্রচুর সেহেতু হবে না-টা ধরেই নেওয়া যায়। আশ্চর্য, উনি কিন্তু এখনও ডেট জানেন না। তাতেও ‘না’ বলছেন মানেই আগাম ভেবে রাখা।

আশা নিয়ে বহুক্ষণ বাজে বকেছি– চূড়ান্ত হিউমিলিয়েটিং দশায় দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ আমার তীক্ষ্ণ হল। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডেট দু’টো জানালাম– তিনিও কম নন, অনায়াসে ডিসেম্বরের সব ডেট বুকড্ বলে জানিয়ে দিলেন। সিগার চিবোতে-চিবোতে কথা বললে যেমন কটকট শব্দ ওঠে, মানুষটি কথা বলছিলেন সেই ঢঙে। আমি বুঝে যাচ্ছিলাম, ওটা আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিমায় অন্যপ্রান্তের মানুষটিকে রেয়াত না করার স্টাইল যা বহু ব্যবহারে ক্লিশে। বেশ, সে থাক তার জায়গায়– আমি আমার।

মোষে-মোষে যুদ্ধ হলে যেমন শিঙে শিঙ বাধিয়ে দু’টোই দাঁড়িয়ে থাকে ও ফের ঝটকা মেরে খুলে নিয়ে ঢুঁসোয়– আমাদের অবস্থা খানিক তেমন। হারাতে চলেছি আন্দাজ পেতেই জেদ চড়ল। অসম্ভবকে সম্ভাবনায় বদলানো আমার স্পেশাল এবিলিটি, হেরে যাচ্ছি খালি কুলডিহায়।

বুকিং এখনও চালু হল না অথচ বুকড্… পষ্টাপষ্টি ভদ্রলোকের কাছে অবিশ্বাসী মনোভাব পৌঁছে দিলাম। তিনি এ ধরনের বার্তালাপ শোনেন না বরং হাত কচলানি পেতেই অভ্যস্ত। এত সহজে অচেনার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া… ইগো তেঁনার টাল খাচ্ছে বুঝলাম। ঠান্ডা পাথুরে গলায় জানিয়ে দিলেন– সরকারি অফিস থেকে যেহেতু বুকিং হয়, সেহেতু আমি যেন ওখানেই যোগাযোগ করি।

হাঃ। বাণ ছুড়ল ও’পক্ষ, একদম শব্দভেদী বাণ। চ্যালেঞ্জ-ঋদ্ধ অ্যাটিটিউডে বিঁধে এবার আমার মুখে কুলুপ। ‘কুলডিহা-কুলডিহা’ করে কতবার টাল খেয়েছে আস্থা– তবু যে কেন… আমার গোঁয়ার্তুমির ফাঁক গলে এটাও বুঝি যায়। একসময় বালেশ্বরের অফিসে ফোন করে শুনেছি যে ফোনে বুকিং হবে না সরাসরি করতে হবে। তার মানে ভাবলাম হয় মানি অর্ডার নয় থ্রু অনলাইন পেমেন্ট। কিন্তু নাহ্, অফিস জানাল হবে না। অগত্যা? বুঝে পাচ্ছি না কি করি। কলকাতা থেকে বালেশ্বরে গিয়ে বুকিং? সম্ভব, না এমন হয় কখনও? ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত কেন প্রশ্ন করে জানতে পারলাম এটাই নাকি নিয়ম।

‘নিয়ম? কোনও বনেই এমন শুনিনি। যারা হিল্লি-দিল্লি-হায়দরাবাদ থেকে আসবে?’ উত্তর তো দূর, ফোন কেটে গেল তৎক্ষণাৎ। ভুল আমারই– কথার ভিতরের কথাটা বুঝতে চাইনি বলে। ওদিকে এজেন্টের চ্যালেঞ্জ ভেতরে ধোঁয়াচ্ছে। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাস দেখি বাঁকা পথের খুঁটিতে মজবুতিতে গাড়া– এবার নুইতে হল আমাকে। স্পষ্ট জানালেন যে আগে কন্ট্যাক্ট করা পাবলিকের প্রেফারেন্স আগে ও তারপরেও আছে উপরির একটা হিসেব। ওসব ঠিকঠাক পেয়ে গেলে তবেই বুকিং মেলা না মেলার প্রশ্ন।

আমি যে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিকে টাকায় না মেপে ইচ্ছেগুলোকেই প্রায়োরিটি দিই– এই খবর কি মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল? সাধারণত বেড়াতে বেড়িয়ে কোনও আকস্মিক সিচুয়েশনে পড়া ও তাকে কাটিয়ে ওঠাও এক ধরনের এনজয়মেন্ট। অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে আর পরিপাটি চৌহদ্দি ছেড়ে পথে বেড়ানো কেন? এখানের প্রকৃতিতে যত আয়োজন– সমস্যাও তত। প্রত্যেক জায়গার মতো কুলডিহারও একটা বিশেষত্ব আছে– তা হল প্রতি পদে ঘুসঘাস, অন্যান্য ডিলিং যা প্রকৃতির প্রণোদনাকেও ছাপিয়ে গেছে।

আমি জানতাম যে কুলডিহা ছাড়িয়ে দশ কিলোমিটার ভিতরে আর একটি জায়গা আছে নাম– যোধাচুয়া। কপাল ঠুকে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। আমার জানার বহরে এবার এজেন্ট মানুষটি চমকালেন। জানালেন যে, যে-দলে আট থেকে আটষট্টি বছরের মানুষজন আছে তাদের জন্য যোধাচুয়া সুবিধেজনক নয়। ফেসেলিটিস প্রায় নেই বললেই হয়। তোলা জলে স্নান-পান তায় থাকার জন্য দু’টি মোটে ঘর। এ’ছাড়া নির্জনতা ছাড়া অ্যাস সাচ কিছু নেই। দোষ দিই না তাঁকে– এমনটা তিনি ভাবতেই পারেন। বেড়ানোর ধাঁচধরণ আজকাল এত শৌখিনতায় জড়িয়েছে যে অসমবয়সিরা একসঙ্গে থাকার আনন্দেই যে আনন্দ পেতে পারে তা তাঁর বোধে ঢুকছে না।

অনেকগুলো জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতায় জানি, অরণ্য গভীর থেকে গভীরতম হলে প্রাপ্তির কোটা ভরবেই। তায় যদি উপরি হিসেবে জোটে নির্জনতা তবে তো সোনায় সোহাগা। বিনা বাক্যব্যয়ে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। ভদ্রলোক এবার খাতির নেওয়ার বদলে কিছুটা খাতির দিলেন। জানালেন প্রথমদিন আমাদের ‘যোধাচুয়া’-য় থাকতে হলেও পরদিন উনি ‘কুলডিহা’-য় ব্যবস্থা করে দেবেন। হঠাৎই দেখি দয়ার সাগর… আসলে কোথাও দিয়ে আমাদের বোধহয় আসলি ভ্রামণিক বলে মনে হচ্ছে ওঁনার। তাই ছেলে-ছোকরার যে-দল পরপর দু’দিন বুকিং নিয়ে রেখেছে, তাদের উনি একদিন ‘কুলডিহা’য় ও পরদিন ‘যোধাচুয়া’-য় পাঠিয়ে দেবেন বলে জানালেন। আমি অবাক হলাম, বুকিং দিয়ে রাখা মানুষকে কীভাবে… জিজ্ঞাসা করাতে গলায় সেই পুরোনো আস্থার আওয়াজ উঠে এল ফের। ওঁনার ওপরেই ছাড়তে বললেন ব্যাপারটা।

কী বলব, আমি তো আপ্লুত। এবার খুব দূর থেকে হলেও তীর দেখা যাচ্ছে– তরি এই ভিড়ল বলে। উল্লসিত আমি ফের প্রশংসার খাতা খুললাম, ‘সো কাইন্ড অফ ইউ।’ ভদ্রলোক ব্যারিটোন ভয়েসে দয়াটয়া ডিসকার্ড করে জানালেন যে এখনও সবটাই চলছে হাওয়ায়। এরপরের অগ্রগতি নির্ভর করছে ঠিকঠাক সময়ে ঠিকঠাক প্রাপ্তির ওপর। সঙ্গে এটাও বলে দিলেন– ইমিডিয়েটলি শুধু বুকিং-এর টাকা পাঠালেই হবে, বাকি পেমেন্ট বালেশ্বরের অফিসে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর এন্ট্রি ফি, ক্যামেরা, ড্রাইভার, জ্বালানী, বাংলো সব মুখে-মুখে হিসেব করে জানালেন কোন অ্যামাউন্টটি সরকারি, কোনটি উনি নেবেন ও ফরেস্ট অফিসারের জন্য কত টাকা। একই সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে গেলে আগামী দশ দিনের মধ্যে আসল কাগজ পেয়ে যাব। বাঁকা পয়সার এই কনফিডেন্স দেখে আমি থ। মিনমিন করে ক্ষীণ স্বরে তবু জানতে চেয়েছিলাম যে বিট অফিসার সরকারি চেয়ারে বসে এমনটা করে কি করে? ভদ্রলোক থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ওঁর থেকেও অনেক রহিস পার্টি আছে, তবু ওপরওয়ালারা ওঁনাকেই গুরুত্ব দেন।

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাবার একটা প্লাস পয়েন্ট আছে। আমার আগ্রহী মনোভাব যেমন পৌঁছে যায় মানুষটির কাছে তেমনি বিশ্বাসটাও। তাই কথা প্রসঙ্গে আমার বলতে অসুবিধে হল না যে টাকা শুধু উনি দেন না, ‘রহিস পাবলিকে’ও দেয়। তবে ওপরওয়ালা কেন ওঁনাকেই প্রেফার করেন… আসলে ওঁনার স্পেশালিটি ঠিক কোথায় একটু বুঝতে চাই, এই আর কি। ভদ্রলোক জানালেন– ওখানে পৌঁছে চোখের ওপর ঘটনা পরম্পরা দেখলে নিজেই সবটা বুঝতে পারব। তাছাড়া কুলডিহার জাংগল-ক্যাম্পটি নাকি উনিই চালান। এ ব্যাপারে গভর্নমেন্ট-এর উৎসাহ অনন্ত। এটা দেখে উনি ব্যাপারটাকে দু’ভাবে ভেবেছেন। এক– পর্যটকের কাছে নিজেকে পরিচিত করে তোলা, দুই– অবস্থার সুযোগ নিয়ে উপার্জনের পন্থা খুঁজে বার করা। এসব ক্ষেত্রে চোখের চামড়া পাতলা হলেই প্রাপ্তি। সুতরাং… যেমন জঙ্গলে আগে জলের অসুবিধে ছিল, উনি ইনিশিয়েটিভ নিয়ে দু’টো টিউবওয়েল বসিয়েছেন। তাছাড়া গ্যাস, সোলার লাইট, পানীয় জল নিয়ে কুলডিহা এখন রানি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে এল– তাহলে যোধাচুয়ায়? নাঃ, পরিষ্কার জানালেন সেখানে কিছু করেননি। কেন না বেশিরভাগ মানুষই কুলডিহায় এলে যোধাচুয়ায় যাবেই– যেহেতু ভরপুর সবুজ, গভীর অরণ্য। কিন্তু ফেসিলিটিস্ তেমন নেই বলে থাকার কথা খুব একটা কেউ ভাবেন না।

আমার যা বোঝার ছিল বুঝেছি, অনর্থক কথা না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে গেলাম। জানালাম দু-একদিনের মধ্যেই ওঁনার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি, বুকিং আমার চাই-ই। এবার যে অ্যামাউন্ট উনি বলেছেন, তার সঙ্গে যেন একস্ট্রা পঁচিশ টাকা জুড়ে পাঠাই, তা উনি মনে করালেন। ওটা নাকি ক্যাশ ট্রান্সফারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কেটে নেবে। ভদ্রলোকের একদিকে অনায্যতার ডিলিং, অন্যদিকে পেশাদারিত্ব। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা মিটিয়ে অপেক্ষায় রইলাম– নাঃ, কোনও হেরফের নেই, কথা তো কথাই। দশ দিনের মধ্যে পাকা কাগজ হাতে এল।

জঙ্গলে যাচ্ছি, সঙ্গে চাল-ডাল-জল… হাতি থেকে আলপিন বাদ নেই কিছুই। সবাই মিলে বোঁচকা টেনে কোনওমতে কোচে পৌঁছোলাম। গাড়ি স্পিড নিতেই এবার ভাবনপথে হাজির পরের সিন। নেমে কা’কে ফোন করব, নীলগিরিতে বিসলেরি ওয়াটার পাব কিনা, কাঠের জ্বালে খাবারে ধোঁয়া গন্ধ ছাড়বে কিনা… ভাবতে-ভাবতে পৌঁছে গেলাম ‘বালেশ্বর’। কতটুকু আর– সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি। প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরোতেই শুনতে পেলাম ডাক– ‘স্বপ্নমগন?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ‘স্বপ্নমগন’, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা ধরলাম। ঝাঁ চকচকে বোলেরোর গায়ে ঠেসানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই প্রশ্নকর্তা। আগাম ব্যবস্থা করে রাখা এই গাড়িটির ড্রাইভার উনি, নাম দীপ্তিময়।

আমাদের দলের নাম ‘স্বপ্নমগন’। ড্রাইভার দীপ্তিময়ের ব্যবহারে ছিল এমন এক দীপ্তি যা না থাকলেই মুশকিল। যতই হোক ক’দিন এর সঙ্গেই কাটবে। এন্ট্রি পারমিটের জন্য আমাদের বিট-অফিসে নিয়ে গেল দীপ্তিময়। অফিসার ওড়িয়া মহিলা। তিনি হ্যালাফ্যালার একটা কাগজে হিসেব লিখে হাতে ধরিয়ে বললেন– ‘কিছু বলার আছে?’ আমার বিস্ময় চরমে। বলার থাকলেই বা কে শুনবে, নিয়ম তো নিয়মই। হঠাৎ এজেন্ট ভদ্রলোকের কথাটা মনে পড়ল– ‘এখানে এলে নিজেই দু’চোখে দেখবেন ম্যাম…’ না, অফিসারের ইঙ্গিতটা নজর এড়ায়নি বরং নিজেই উনি হেল্প করলেন। জানালেন, সঙ্গে ক্যামেরা থাকলেও উনি পেপারে লিখবেন না, ছোটো ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে পাঁচবছরের কম দেখানোয় আপত্তি নেই। বদলে যে টাকাটা উনি নেবেন, রসিদে তার উল্লেখ থাকবে না। আমি ভাবলাম, অসুবিধে কি, যেমনি ঠাকুর, তেমনি তার নৈবেদ্য। জেনেবুঝেই এসেছি যখন। আধঘণ্টায় কাজ মিটিয়ে ‘নীলগিরি’ থেকে মাছ-বাজার-বিসলেরি কিনে ছুট। আমরা পৌঁছোলে রান্না হবে, তারপর খাওয়া, তারপর… কি জানি কি তারপর, আগে তো পৌঁছোই।

কুয়াশা অভেদ্য রোদের চাপা তাপ গায়ে মেখে- তাল, সুপারি, জংলি লতাপাতার সখ্যতা দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেলাম শেষ জনপদ নীলগিরি। বনের সরু পথ, পথের দু’ধারে সারিবদ্ধ গাছ, ফাঁক দিয়ে তার রোদ্দুর পড়ে আলো-ছায়ার আলপনা আর অদূরে নদীর পটচিত্র। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি ভাবতে-ভাবতেই ঝুপ্পুস আওয়াজ ও দু’পাশে ফোয়ারার মতো স্রোত। দেখি গাড়িটি কেন্দুনদীতে নেমে পড়েছে আর অ্যাক্সিলেটর দাবিয়ে জেদি নদী পেরিয়ে যাচ্ছে দীপ্তি, চাকার চারপাশে সেই আক্ষেপেরই জোয়ার। হঠাৎই গাড়ির নীচে বোল্ডার পড়ে ভেতরে বিপুল উথাল-পাতাল। আনাজপাতি, বিশ-লিটারি বিসলেরি, মানুষজন সব একধারসে গড়াগড়ি। জঙ্গলের প্রতিটি বাঁকে সে এক নতুনকে আবিষ্কার। এতই বদল ছবি এই জঙ্গল দেখিয়েছে যে আগের রূপ মুছতে না মুছতেই চোখে অন্য অপরূপ এসে দাঁড়াচ্ছিল।

বেলা দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম যোধাচুয়ায়। বাজার-দোকান কেয়ারটেকারের জিম্মায় দিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে পড়লাম। যদিও ঠান্ডা তবু আস্তানা জুটতেই শরীরে ক্লান্তি নেমেছে ঝাঁপিয়ে। ছেলেরা বিছানা জুটতেই কেউ কম্বল-বালিশের নীচে, কেউ প্রকৃতির সঙ্গে আড্ডায়। কাঠের জ্বালে ফোটানো গরম জল হাজির হল তক্ষুনি।

মুলোশাকের ক্যাশমেমো-র মতোই দেখি বুনো বাথরুমে আবার টালির বাহার। ওদিকে দরজার দক্ষিণ কোণে মৌমাছি বাসা বেঁধেছে, সিলিং-এ উইয়ের আঁকিবুকি। তবু মনের মধ্যে কী যে ছন্দময় গান। আসলে বুনো জায়গার বন্যতাটাই আসল– যেন এটাই চাইছিলাম, ঠিক এমনই অগোছালো উদভ্রান্তি। নিজের ঘরে অথচ একটা মথ উড়ে গেলেও অশান্তি। অভ্যাস-মুক্তির এই আনন্দকে ছুঁয়ে যে আরাম উড়ছে আকাশে তা শিকড়ের টান বলে চিনতে পারলাম।

ইতিমধ্যে কাঠের জ্বালে রান্নাবাড়ি সারা, খিচুড়ি-ডিম-পাঁপড়-ভাজায় লাঞ্চ সেরে বেরোলাম। ঘণ্টাখানেক জঙ্গল চষে যখন সন্ধ্যা নামছে, তখন দীপ্তি বলল ও পুকুরিয়ার দিকে গাড়ি ঘোরাচ্ছে। কিছুটা আন্দাজ করলেও বুঝে পেলাম না এমন কি আছে সেটা দেখবার। ধন্ধ কাটাতে দীপ্তি জানাল ওটা একটা বড়ো পুকুর যেখানে জন্তু-জানোয়ার জল খেতে আসে। বলেই ফেললাম, একে অন্ধকার তায় কৃষ্ণপক্ষ…

দীপ্তি ভারি দৃপ্ত। বলল, আমি তো আছি। ভয়ের ভার আমাদেরও কম না। প্রায় সাথেসাথেই বলে ফেললাম, ওরা তোমায় চেনে বুঝি? শ্লেষের শব্দকে ঠাট্টায় নেবার মতো শিক্ষা আছে দীপ্তির। তাই মৃদু হেসে গাড়িতে উঠল, পিছুপিছু আমরাও পৌঁছে গেলাম পুকুরিয়া। বেশ বড়োসড়ো পুকুর যার মাঝদরিয়ায় আর্টিস্টিক কেতায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝুপড়ি মতন গাছ। ও’পারে দৃষ্টি-অগম্য। আঁধারে কুুচি-কুচি জোনাকি আর চূড়ান্ত নিস্তব্ধতার থম বাড়িয়ে চতুর্দিকে ঝিঁঝিঁর ঝুমঝুম। এমনই সময় খুব কাছ থেকে জল পড়ার শব্দ শুনে দুদ্দাড়িয়ে দলের একজন দৌড়ে গিয়ে উঠল গাড়িতে। আকস্মিক এই ঘটনায় একেই ঘাবড়েছি, তায় মারাত্মক চমকে দিয়ে কোথা থেকে যেন তীব্র আলো পড়ল ঝোপে। দেখি দীপ্তি স্পটলাইট ফোকাস করেছে… এবং যেদিকে-সেদিকে আলোয় ভাসতে-ভাসতে দেখি আমাদেরই এক দলের সদস্য কড়ে আঙুল তুলে জানান দিচ্ছে জল বিয়োগের কথা। তিনি যে কখন টুকটুক করে ঝোপের আড়ালে তা যেমন জানা ছিল না, তেমনি জানা ছিল না দীপ্তির সঙ্গে স্পটলাইট আছে। জোড়া আকস্মিকতার ধাক্বায় তখন ‘স্বপ্নমগন’-এর স্বপ্ন ভেঙে খানখান।

খুব হয়েছে, গাড়িতে ফিরলাম, কাচ তুলে দিয়ে চুপচাপ বসলাম। দীপ্তি আশাবাদী। বলল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে হাতি একসময় পাবই। মশা কামড়াচ্ছে তবু চড়-চাপটা মুলতুবি রেখেছি পাছে হাতি পালায়। এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটেছে কি কাটেনি, হঠাৎই স্তব্ধ চরাচরে ফোঁসর-ফোঁসর শব্দ। দীপ্তি সঙ্গে সঙ্গে স্পটলাইট তাক করল। কিন্তু কোথায় কি! আওয়াজ তো গাড়ির ব্যাকসিট থেকে আসছে। যিনি চেম্বার খালি করেছেন তিনি এখন নিশ্চিন্তির নিদ্রায়। তাঁরই নাসিকা গর্জন।

আঃ, আমরা আবার ঠকলাম, আবার হাসলাম পা কাঁপিয়ে অথচ টুঁ-শব্দটুকু না করে- পাছে হাতি পালায়। হায় বেচারি দীপ্তি ও তার স্পটলাইট– এক আধটা হরিণ পেলেও হতো। পুরো অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। অগত্যা গাড়ি ছুটল বাংলোর দিকে। আমাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে দীপ্তির স্পটলাইট এমন অজায়গা-বেজায়গায় জ্বলে উঠল যে ও নিজেই চমকে-টমকে একশা।

জলে-জঙ্গলে অন্ধকার নামলে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। তাই ফিরেই সবাই ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ছাদে উঠলাম। একতলা বাংলোর দোতলায় ছাদ, ঘন আঁধারে হাত-পাও ঠাওর হচ্ছে না। মোবাইলের আলোয় ধাপি খুঁজে নিয়ে বসলাম। আড্ডায় মেতে থাকলাম কিছুক্ষণ ও হিম পড়া শুরু হতেই নামলাম।

ভোরে বাইরে বেরিয়ে দেখি গাছের পাতা-মাটি-উঠোন সব ভিজে, টুপটাপ শব্দও হচ্ছে অথচ আমাদের পা ভিজছে না। তবে? বড়ো বড়ো গাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায় শিশির জমা জল পড়ে চলেছে অবিরাম আর তারই শব্দ টুপটাপ।

ব্রেকফাস্ট সেরেই দুদ্দাড়িয়ে উঠলাম গাড়িতে– গন্তব্য কুলডিহা। পথে পড়ল ঋষিয়া ড্যাম। বিশাল নদী, নদীতে ফুরফুরে নৌকো, গ্রাম্য দিকপাশ, ন্যাংটা ছেলেপিলে, ধান আছড়ানো পাছাড়ে মগ্ন কৃষক, খড়-ছাউনির চালের মাথায় সারে-বাহারে টুনটুনিদের কিচিমিচি। এমনই উন্মনা হলাম যে শেষে দীপ্তিকেই ডাকতে হল। জানাল বেলা হয়েছে ঢের। কুলডিহা পৌঁছে রান্না হলে তবে খাওয়াদাওয়া তারপরে জঙ্গলে ঘোরা। ব্যস, আর বলতে হল না- ইঙ্গিতেই কাম ফতে। দৌড়ে সেঁধিয়ে গেলাম গাড়িতে। আবার বনতলের ছায়া মেখে জার্নি।

গাড়ির ঠিক আগেই পাইলট কারের মতো একটি হলুদ বুলবুলি চলেছে। তার উড়ালের সঙ্গে চলতে-চলতে পৌঁছে গেলাম কুলডিহা। এখানে টেন্টে উঠলাম নতুনের স্বাদ নিতে। ‘স্বপ্নমগন’-এর মনজমিতে তাঁবুর ছায়া পড়তেই সব বাক্যিহারা। ঘুলঘুলি জানালা, দড়ির ফাঁসকল-আঁটা দরজা, কাঠি-পর্দা ভেদ করে ভেতরে রোদের আঁকিবুকি। ত্রিপলের তাঁবুটি যেন আপ্যায়ন নিয়ে সেজেগুজেই বসে।

এবার নজর গেল দূরে। গাছের গায়ে ঠেসানে রাখা ইয়াব্বড়ো হাতির মাথার খুলি। কুল, বাঁদরলাঠি, গোলঞ্চর গাছ দিয়ে ঘেরা বাগানে পাখি আর অঢেল প্রজাপতি। বাংলোটি পরিখা দিয়ে ঘেরা। কি জানি কেন, হয়তে জন্তুর ভয়। সামনে সরু পথ, মাটি-মাটি উইঢিবি, অদূরে সল্টলিক। একটা তীব্র আবেশে জাপটে গেল মন। কাটতেও সময় লাগল না– কেন-না এজেন্ট মানুষটি দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে জনা কুড়ির দল নিয়ে। দলটি একেবারে বেয়ারা টাইপের, বনের প্রাপ্য মর্যাদাই দেয় না। হট্টগোল, চিল্লামেল্লি, ব্যাডমিন্টন– যেন পার্কের মাঠে চড়ুইভাতিতে এসেছে। এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জায়গা- বারণের কেউ নেই, করলেও বোঝার মন নেই। এল, খেল, খেলল, জন্তু কেন দেখল না-র অনুযোগে ধুন্ধুমার চ্যাঁচাল ও পাতা মাড়িয়ে খচরমচর শব্দ তুলে চলেও গেল। এজেন্টটির পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে হোটেল আছে। ওখানকার টুরিস্টদেরই এই ট্রিপে আনে। প্রায় রোজই নাকি সারাদিনের জন্য ঢোকে আর সন্ধ্যার মুখে বেরিয়ে যায়। কি পায় এভাবে মানুষ? জঙ্গল কি কারুর ঘুঙুর বাঁধা পা যে নাচতে বললেই নাচবে? আসলে একজনের পয়সার প্রয়োজন আর অন্যজনের কম সময়ে প্রাপ্তির। ব্যস, মিলে গেল হিসেব।

ওরা চলে গেল, ঠান্ডা হল কুলডিহা। এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। ঘণ্টাখানেক সময়ের শুশ্রূষা পেতেই অস্তিত্ব মাড়ানো গানহারা কুলডিহা ফের ছন্দে হেসে উঠল, তার গালের পড়া টোলে মুখ দেখতে দেখলাম ভিজে আকাশকে। হঠাৎই এক ধাড়ি স্ক্যুইরাল পুচ্ছ নাচিয়ে দৌড়ে গেল এক গাছ থেকে অন্যয়। শুধু প্রকৃতিবিক্ষণ। এরই মধ্যে তার রান্নাবান্না সারা হয়ে গেছে। কুলডিহায় গ্যাস আছে। চাইলে কেয়ারটেকারও রেঁধে দেয়। খেয়েদেয়ে কাছের ওয়াচটাওয়ারে উঠলাম, নজর সল্টলিকে। কিন্তু ঝাড়া দু’-ঘণ্টা কাটিয়েও কোথায়? মশায় অতিষ্ট হয়ে ঘরে ফিরলাম।

মিনিট পনেরো বাদেই দরজায় ধাক্বাধাক্বি- দেখি কেয়ারটেকার ও ড্রাইভার দীপ্তি স্পটলাইট নিয়ে রেডি। একটা হাতি নাকি পরিখার আশপাশে ঘুরছে। নিজের মতো যাবার উপায় নেই, একটা পার্টিকুলার পয়েন্ট অবধি ওদের সঙ্গে গেলাম। কৃষ্ণপক্ষের রাত জানান দিচ্ছে আঁধারের নিশ্ছিদ্রতা। কিছুটা পরেই ফস্ করে আলো জ্বলল। সেই স্পটলাইট। কাঠকুটো মড়মড়িয়ে ভাঙার আওয়াজ পেলাম, গাছপালার দোলাচল দেখলাম, কিন্তু তিনি কোথায়? হয়তো অন্ধকার গায়ে মেখে ধূসর তিনি কাছেই।

পরদিন ভোরে ভাগ্যিস ক’টা নাচুনে হরিণকে নুন চাটতে দেখেছিলাম। কুলডিহা বনের সার্থকতা এই বনের মধ্যেই স্থিত। প্রাণীকুল তার সম্পদ ঠিকই কিন্তু তাদের জন্য যাওয়া মুখ্য হলেই মুশকিল। এক এক জঙ্গল এক এক ভাবে তার সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। এই জংলি ঘেরাটোপ এত ঘন-এত মজবুত যে আমি চাইলেও চোখ দিয়ে সবুজের নিশ্ছিদ্রতা ডিঙোনো যাবে না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...