কুলু থেকে মানালির পথে আমরা যতই এগিয়ে চলেছি, ততই বিপাশা হয়ে উঠছে প্রবল থেকে প্রবলতর। কদিন ধরে ক্রমাগত সেডার, চেনারে অভ্যস্ত চোখ, এবার যেন আহ্লাদে দিশাহারা হয়ে গেল। পথের দুপাশে কী গোলাপ! কী গোলাপ! ঈশ্বর যেন সহস্র সহস্র হাতে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন গোলাপের রাশি, মানালির পথের দুধারে। সেই সঙ্গে ফুটেছে লাল, হলুদ, সিঁদুরে, গোলাপি, বেগুনি– কত বিচিত্র রঙের ফুল। আমার কেবলি মনে হতে লাগল স্বর্গে কি এর চেয়েও বেশি সুন্দর পুষ্পায়ন করেছেন দেবতারা?
সন্ধ্যার কিছু আগে, কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা এসে পৌঁছোলাম বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে। মানালির অন্যতম উল্লেখযোগ্য জনপদ এই বশিষ্ঠ আশ্রম– সংক্ষেপে বশিষ্ঠ, এক অনতিউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির। একান্ত নির্জনে, অনাড়ম্বর এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতেই মন এক উদাস, নির্লিপ্ত, দিব্য ভাবে পূর্ণ হয়ে ওঠে। অপূর্ব কারুকার্য খচিত ছোটো কাঠের মন্দিরটির মধ্যে মহামুনি বশিষ্ঠের কালো কোষ্ঠী পাথরের মূর্তি। মন্দিরের একপাশে তাঁর যজ্ঞকুণ্ড, দেড় হাজার বছরের কালস্রোত বয়ে গেছে, তবু আজও দেখলে মনে হয় যেন আর কিছুক্ষণ পরেই মুনি ফিরে আসবেন কুটিরে, এখনই প্রজ্জ্বলিত হবে অগ্নিশিখা, এই হোম কুন্ডে। মহর্ষি আহুতি দেবেন বিশ্বের কল্যাণ কামনায়।
বশিষ্ঠ মন্দিরের এক পাশে একটি আয়তাকার কুণ্ড। তার জল দিবারাত্র টগবগ করে ফুটছে, সম্ভবত নীচে আছে কোনও উষ্ণ প্রস্রবণ। শত শত নরনারী সেই উষ্ণ কুণ্ডের জলে স্নান করছেন। বিচিত্র ভাষার আনন্দধবনিতে মুখর সেই শীতার্ত সন্ধ্যার আশ্রম প্রাঙ্গণ। শোনা গেল, এই কুণ্ডের জলে স্নান করলে বন্ধ্যানারীরা সন্তানবতী হন। পান করলে নিরাময় হয় অনেক দূরারোগ্য রোগ। অনেক বিদেশিনিকেও দেখলাম হাসিমুখে স্নান করছেন তপ্ত কুণ্ডের ফুটন্ত জলে। মহাতাপসের তপস্যার ফল হয়তো এইভাবেই ভোগ করে চলেছে বিশ্ববাসী, যুগযুগান্তর ধরে। সেদিন সন্ধ্যায় বশিষ্ঠ আশ্রমের কাছেই একটি হোটেলে আশ্রয় নিলাম আমরা।
মানালি নামটির উৎস হল মনু-আলয়। যে মনু ঋষি থেকে মানবজাতির উৎপত্তি বলে কল্পনা করা হয়, ইনি-ই সেই ঋষি। মনু সংহিতা-র রচয়িতাও মনু ঋষি। একশো বছর অন্তর যাঁর শাসন পরিবর্তিত হয় ‘মন্বন্তর’-এর মধ্যে দিয়ে, সেই মনু-ঋষিই একদা এসেছিলেন এই মানালিতেই। তাঁরই নামাঙ্কিত, স্মৃতিশোভিত মন্দির দেখতে গেলাম পরদিন। কিছুদূর গিয়েই ড্রাইভার বললেন, গাড়ি আর যাবে না। এরপর পুরোপুরি গ্রাম্য রাস্তা। ভাঙাচোরা, অপ্রশস্ত পথের দুপাশে কোথাও পড়ে আছে একটি গরুর গাড়ি, কোথাও চাকা ভাঙা টাটা সুমো, কোথাও জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে একপাল গরু-বাছুর। কোথাও গোয়ালারা দুধ নিয়ে চলেছে শহরের দিকে। কোথাও চাষিরা দল বেঁধে আগুন পোহাচ্ছে। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ হাঁটবার পর এসে পৌঁছোলাম মনু ঋষির আলয়ে। ‘মন্দির’ বলে, বলে না দিলে মনেই হবে না দেবস্থান। ঠিক যেন গ্রামের মাঝখানে একটা কাঠের আটচালা বা চণ্ডীমণ্ডপ। এখানেই একটা বড়ো কাঠের সরকারি বোর্ডে হিন্দি ও ইংরেজিতে লিখিত বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেল এই মন্দিরের ইতিহাস।
আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে, হঠাৎ একদিন সকালে এক সন্ন্যাসী এসে উপস্থিত হলেন এই গোয়ালাদের গাঁয়ে। গ্রামের এক গৃহস্থ বধূকে ডেকে বললেন, ‘মা, আমি খুব ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত। এখনি আমাকে একপাত্র সদ্য দোহন করা দুধ দিয়ে আমার তৃষ্ণা দূর করো।’ বধূটি অতিথিকে সবিনয়ে জানালেন যে, বাড়ির গাভিগুলি সবই এখন চরতে বেরিয়ে গেছে। তারা গোয়ালে ফিরে এলে প্রচুর দুধ পাওয়া যাবে। ততক্ষণ সন্ন্যাসী বিশ্রাম করুন এবং অন্য কিছু খাদ্য গ্রহণ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করুন।
কিন্তু অতিথি নাছোড়বান্দা। তাঁর দুধই চাই। ওই-তো, বাছুরটি বাঁধা আছে গোয়ালে। ওকেই দুয়ে দাও। বধূটি কী আর করেন? সন্ন্যাসীর বারংবার অনুরোধে এবং কিছুটা বা অভিশাপের ভয়ে দোহনপাত্র কোলে নিয়ে সেই বাছুরটিকেই দুইতে শুরু করলেন, আর কী আশ্চর্য! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর পাত্র ভরে উঠল সুস্বাদু, সফেন, গাঢ় দুধে। বিস্মিত, স্তম্ভিত গ্রামবাসী গোয়ালাদের সামনে সেই দুধ পান করে আগন্তুক সন্ন্যাসী বললেন– তিনিই হচ্ছেন মহর্ষি মনু। বহুযুগ পূর্বে এই গোয়াল ঘরটিই ছিল তাঁর আশ্রম। তাঁর তপঃ প্রভাবে আজও সেই স্থান অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন।
এরপর গ্রামবাসী গোয়ালাদের উদ্যোগেই নির্মিত হল এই মনু-আলয়। নিয়মিত পূজার্চনাও তারাই করে। দেখলাম মনু ঋষির একটি সুন্দর কাঠের পালকি, যাতে তাঁর মূর্তি চড়িয়ে উৎসবের দিন গ্রাম প্রদক্ষিণ করা হয়। বাজানো হয় ঢাকঢোল, শিঙা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র, সেই সঙ্গে চলে নানা লোকনৃত্য ও গীত। মন্দিরের এককোণে সযত্নে রাখা সেই সব বাদ্যযন্ত্র আর নানা মাপের জরির পোশাক দেখতে দেখতে মনে হল– বিশেষ প্রচারহীন মনু ঋষি এই নিরিবিলি মন্দিরে, সরল গোয়ালাদের পরিচর্যায়, বেশ আমোদেই আছেন।
মনু ঋষির আলয় দেখে হোটেলে ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম চারপাশে সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে গেছে, শুধু দূরে বিশাল বিশাল পর্বত শৃঙ্গের তুষার কিরীট জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলোয়। আর পায়ের নীচে রুপোলি জরির একটা ফিতের মতো পড়ে আছে, একা এক নদী। বড়োই কৃশাঙ্গী, বড়োই শান্ত। তার প্রশস্ত চড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ট্রাক। তাতে বোল্ডার তোলা হচ্ছে ভারে ভারে। আমাদের পূর্বপরিচিতা সেই রাজ্ঞীর মতো গরবিনি, দুর্দান্ত, দুর্বার, সফেন বিপাশার সঙ্গে এর কোনও মিল যেন কোথাও খুঁজে পেলাম না।
সেদিন রাত্রে, রুম হিটারের সৌজন্যে সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। ঝকঝকে রুপোলি আলোয় ভেসে যাচ্ছে পাহাড়, বন। অজস্র গোলাপ ফুটে আছে চারিদিকে। অল্পবয়সি টুরিস্টরা রোলার স্কেটিং নিয়ে হইহই করতে করতে গড়িয়ে চলেছে নীচের পাহাড়ে, দুরন্ত গতিতে, আর আমরা যারা ভীরু ভীরু চোখে তাদের ওই তীব্র বেগে গড়িয়ে যাওয়া দেখছি, তাদের দিকে করুণার দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছে। এখানে নামমাত্র টাকায় কয়েকঘন্টার জন্য স্কেটিং ভাড়া পাওয়া যায়। যখন বরফ পড়ে তখন স্কি করারও ধুম পড়ে যায়। আমরা ভেতো বাঙালির দল এই আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ যে পেয়েছি তাতেই ধন্য।
প্রাতরাশ সেরে, দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম– ডুংরী গ্রামের উদ্দেশ্যে। মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডব ভীমের রাক্ষসী পত্নী হিড়িম্বা নাকি বাস করতেন এই ডুংরী গ্রামেই। এখানেই ছিল তাঁর কুটির। সে কুটির নষ্ট হয়ে যাবার পর গ্রামবাসীরা বর্তমানের এই কাঠের মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছে। নিতান্ত সাদাসিধে আটচালা টাইপের একটা ছোটো ঘর, সেখানেই দুটো বড়ো বড়ো পাথরের উপর হিড়িম্বার পায়ের ছাপ। অন্য কোনও মূর্তি নেই। চারপাশে ঘন পাইনের বন। শন শন করে বয়ে চলেছে শীতল বাতাস। ইতিহাস তথা মহাকাব্যের পাঠকের কাছে হিড়িম্বা যেন এক কমিক ক্যারেক্টার। অথচ এই নির্জন অরণ্যের গম্ভীর পরিবেশে দাঁড়িয়ে সেই চিরদুখিনি, স্বজন পরিত্যক্তা, পতিসঙ্গ বঞ্চিতা, অনার্যা নারীর নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভেবে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। হিড়িম্বার মন্দির থেকে কিছুটা দূরেই ঘটোৎকচের মন্দির। তবে মন্দির নয়– একটা বাঁধানো গাছতলা। গাছের গায়ে বেশ বড়ো বড়ো কতকগুলো মহিষের শিং বাঁধা আছে। আর কোথাও কিছু নেই।
অথচ ঘটোৎকচ, মহাবীর ভীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র, স্বয়ং পবনদেবের নাতি। দেবরক্ত, আর্যরক্ত তাঁর ধমনিতে। শুধুমাত্র জননী তাঁর অনার্যা বলে সর্বপ্রকার কৌলীন্য থেকে বঞ্চিত হলেন তিনিও– কী জীবনে! কী মৃত্যুতে!
ফেরার পথে দেখি পথের দুপাশে পাহাড়ি তরুণীরা দাঁড়িয়ে আছে– কোলে তুলতুলে খরগোশ নিয়ে। ইসকি সাথ ফোটো খিঁচো জি – দশ রুপেয়া। বারংবার অনুরোধ আসায় এক জায়গায় রাজি হয়ে গেলাম। অপরূপা ওই পর্বত কন্যাদের কোলেই যেন ওই মিষ্টি সুন্দর জীবগুলি মানায়। আমাদের কোলে বেজায় বেমানান লাগে। তথাপি ফোটো নেওয়া হল। ডিজিটাল ক্যামেরায় সেই ছবি দেখে কী নির্মল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ। ‘মেরা রাজু বেটা’ বলে আদর করতে লাগল খরগোশটিকে। ‘ও কি খায়’ জানতে চাইলে জোব্বার পকেট থেকে বের করল সরুফালি করে কাটা শসা। রাজুর মুখে ধরতেই পরম তৃপ্তিতে খেতে লাগল রাজু। মনে হল নিঃসীম দারিদ্র্য সত্ত্বেও প্রকৃত সুখী বোধহয় এরাই।
এবার মানালি থেকে ফিরতে হবে। বাজারে গেলাম। চারিদিক থেকে দোকানিরা ডাকছে– ‘বিঙ্গু দেখে যান, বিঙ্গু দেখে যান।’ কৌতুহলী হয়ে ঢুকলাম একটা শো-রুমে, দেখলাম বিঙ্গু আসলে হল চারটি বস্তুর একটি সেট। একটি কার্পেট, একটি বেডশিট, একটি বেডকভার ও একটি শালের প্যাকেজ। দাম মাত্র ৬০০০। এখন অর্ধেক দিলেই হবে। বাকি– পার্সেল বাড়িতে পৌঁছুলে।
এই সব পার্সেল নিয়ে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার ভালোই ঠকেছি। তাই প্রলোভনের ফাঁদ থেকে পা গুটিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। সেদিন আর ঘোরাঘুরি হল না। শরীর ভালো নয় বলে বিছানায় আশ্রয় নিতে হল। মনটা কদিন ধরেই একমুঠো গরম ভাত, ডাল আর বাঙালি তরকারির জন্য হাহাকার করছিল। কিন্তু এই দূর প্রবাসে সে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এল রবীন্দ্রসংগীতের সুর– ফিরে এসো ঘরে পরবাসী…। নির্ঘাত কোনও বাঙালির হোটেল। গানের সুর অনুসরণ করে এসে ঢুকলাম। অনুমান ছিল নির্ভুল। ভদ্রলোকের বাড়ি নৈহাটি। আত্মীয়াধিক যত্নে খাওয়ালেন তিনি। গরম সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, আলু ভাজা, আলুপোস্ত আর টম্যাটোর চাটনি। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। বললেন ছয়মাস এখানে থাকেন, ছয় মাস দেশে। বললেন ‘ভাবছি, এবার পাকাপাকি ভাবে ফিরে যাব।’
– কি করবেন ওখানে গিয়ে? হোটেল?
– না, আশ্রম করব একটা। রাধা-শ্যামের মন্দির। আমরা তো বৈষ্ণব।
বুঝলাম পরম তাপস বশিষ্ঠদেবের সান্নিধ্যে এতকাল থাকাটা নিতান্ত বিফলে যায়নি ভদ্রলোকের।
মানালি পৌঁছানোর দু-দিন পর রোটাং যাবার জন্য তৈরি হলাম আমরা। ড্রাইভারজি বলে দিলেন, খুব সকাল সকাল বেরোতে হবে। তা না হলে টুরিস্টদের পায়ের জুতোয় লেগে থাকা কাদায় বরফাবৃত ধবল উপত্যকা একেবারে কাদায় কাদা হয়ে যাবে। শুভ্র সৌন্দর্যের চোখ ঝলসানো গরিমা একেবারেই ধুলোয় মলিন হয়ে যাবে, একটু বেলা হলেই। কাজেই ভোর পাঁচটায় উঠে স্নানের জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু বিধি বাম। কারেন্ট নেই। তখনই মনে হল তাইতো, চিন্তা কি? বশিষ্ঠ আশ্রমে তো দিব্যি উষ্ণপ্রস্রবণ আছে। অগত্যা ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে আশ্রমেই চলে আসা গেল। ওখানেই স্নানটান সেরে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রওনা হয়ে গেলাম রোটাং পাসের উদ্দেশে।
এবারেও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে দুষ্টু বালিকা বিয়াস। তার রূপ যেন আরও ফেটে পড়ছে পাথরে পাথরে আদরে আদরে। সূর্য তখনও ওঠেনি– উঠি উঠি ভাব, আকাশ আবিরে আবিরে ছয়লাপ– এমন সময় ড্রাইভারজি গাড়ি দাঁড় করালেন। কী সংবাদ? ঠান্ডার মোকাবিলা করার উপযুক্ত পোশাক ভাড়া নিতে হবে। সত্যিই ভয়ানক ঠান্ডা রোটাং-এ। হিমাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে রোটাং উপত্যকা। এই উপত্যকা পার হয়ে যাওয়া যায় চিন – তিব্বত। প্রাচীন কালে কত বিদেশি, ব্যাবসা কিংবা দিগ্বিজয়ের অভিলাশে এই পথ ধরেই পা রেখেছে ভারতবর্ষের মাটিতে।
এই উপত্যকা, এই পথ তাই ইতিহাসের পথ, সুদূর অতীতের গন্ধবাহী। মানালি আর কাশ্মীর দুদিক দিয়েই পৌঁছানো যায় রোটাংয়ে। শীতকালে প্রচুর বরফ পড়ে মানালির পথ যায় বন্ধ হয়ে। তখন ভ্রমণার্থীরা কাশ্মীর হয়ে রোটাং পৌঁছন।
যাই হোক, বেলা আটটা নাগাদ তুষারাবৃত সেই স্বপ্নময় আদিগন্ত শুভ্র উপত্যকার কাছে পৌঁছনো গেল। মাইল খানেক আগেই নামতে হল। গাড়ি আর যাবে না। অনেক যাত্রী এই পথটুকু ঘোড়ার পিঠে চেপে উঠছেন। কেউ কেউ আবার হুইলচেয়ারের মতো চেয়ারে চলেছেন। তবে বেশির ভাগই পায়ে হেঁটে চলেছেন এই খাড়াইটুকু।
আমরাও হাঁটতে লাগলাম। সে যে কী অভূতপূর্ব দৃশ্য ভাষায় তার বর্ণনা হয় না। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বিস্তৃত তুষার প্রান্তর। ঝকঝক করছে হিরের মতো, তরুণ সূর্যের সোনালি আলোয়। যেন এক স্বপ্নরাজ্য।
মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আর নীচে এই আদিগন্ত শুভ্র প্রান্তর। চারিদিকে শুধু তুষার আর তুষার। মিহি, সরু দানার বালির মতো ঝুরঝুরে। হঠাৎ করে মনে হবে যেন উত্তরমেরুর তুষারময় মহাপ্রান্তরে এসে পড়েছি। ভ্রমণার্থীরা আনন্দে যেন পাগল হয়ে গেছে। ছোটোরা চলেছে স্লেজগাড়ির মতো চেয়ার লাগানো ঠেলাগাড়িতে। বড়োরা যে যার মতো স্কি করে চরকিপাক খেয়ে চলেছেন ক্রমাগত সেই বিশাল তুষার প্রান্তর জুড়ে। কেউ বা স্কেটিং করছেন। কেউ বা শুধুই লোফালুফি করে চলেছেন মুঠো মুঠো বরফ। বয়স যার যাই হোক, সবাই এখানে যেন শিশু হয়ে গেছে। আনন্দে, চিৎকারে– আর কলকাকলিতে মনে হচ্ছিল যেন কোনও মেলার মাঠে এসে পড়েছি।
সবচেয়ে আশ্চর্য, ওই হাঁড়কাপানো ঠান্ডার মধ্যেও দিব্যি দোকান বসে গিয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে চা, কফি, ম্যাগি। দাম যদিও আকাশছোঁয়া। এক প্লেট ম্যাগি ৪০ টাকা। এক কাপ কফি ৩০। যে-কোনও মুহূর্তে ঝড় উঠতে পারে। চারিদিক ঢেকে যেতে পারে ঘন তুষারের পুরু আস্তরণে। তখনই দোকানিকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাতে হবে অনেক নীচের গ্রামে, নিরাপদ আশ্রয়ে। তাই দোকানটি একেবারেই অস্থায়ী। চারদিকে চারটি খুঁটি পুঁতে ত্রিপল টাঙিয়ে বানানো। তবু তারই সামনে পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারে ভ্রমণার্থীদের ভিড়। ওই ঠান্ডায় এক পেয়ালা কফি কিংবা এক প্লেট গরম ম্যাগি– তার কি দাম হয়? সে যে অমূল্য।
কিছুক্ষণ বরফে দাপাদাপি করবার পর হাঁফ ধরে গেল। আমরা এক কাপ করে কফি আর ম্যাগি খেয়ে নিয়ে হেঁটে ফিরে এলাম গাড়িতে। মন চাইছিল আরও আরও অনেক অনেকক্ষণ এই স্বপ্নভূমিতে বিচরণ করি। কিন্তু শরীর দিচ্ছিল না। পোশাকের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ছিল তুষার। সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে শীতল ঝোড়ো বাতাস। আমরা অতি দ্রুত নীচে নামতে লাগলাম।
হোটেলে পৌঁছোবার পরও দুচোখ জুড়ে লেগে রইল সেই তুষারময় স্বপ্নরাজ্যের মায়াঞ্জন। মানালির এই স্বপ্নের সফর মনের অ্যালবামে চিরতরে স্থান করে নিল।