অফিসের মহিলা কলিগদের থেকে সৌহার্দ্য একটু ডিসটেন্স রেখেই চলে। অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া তেমনভাবে কারওর সাথে মেশে না। এর পিছনে যে কোনও কারণ রয়েছে, তেমনটা নয় বা তাকে দেখতে-শুনতে খারাপ তেমনও নয় বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, মিষ্টি স্বভাবের। হাইটও তেমনি, প্রায় ছ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা– মেয়েরা ঠিক যেমনটা চায় আর কি। তাকে দেখলে যে-কোনও মহিলার হূদয়ে কম্পন অনুভূত হবে, এমনটা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু হয় না– অনেকেই নিজের মতো করে ভেবে নেয়, সৌহার্দ্যও অফিসের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে এক করতে চায় না। তাই ছুটির পর এক মুহূর্তও ওয়েস্ট না করে সোজা বাইক ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। তবে মাঝেমধ্যে কাজের জন্য আটকেও পড়তে হয়। এরকমই একদিন একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য শ্রেয়া আর তাকে ছুটির পরেও থেকে যেতে হল। প্রেজেন্টেশন জমা করতে করতে রাত প্রায় সোয়া দশটা হয়ে গেল। যাবার সময় বসের ফরমায়েশ, ‘সৌহার্দ্য, শ্রেয়ার ফেরার ব্যাপারটা একটু দেখে নিও।’

‘ওকে স্যার। আপনি না বললেও এত রাতে ওনাকে…।’

‘আরে না না। আমাকে নিয়ে এত ভাববেন না। আমার সঙ্গে স্কুটি রয়েছে। আমি চলে যেতে পারব,’ কথার মাঝেই বলে বসে শ্রেয়া।

পার্কিং জোনে শ্রেয়ার স্কুটি স্টার্ট করার বিফল চেষ্টা দেখে, সৌহার্দ্য বলে– ‘স্টার্ট যখন নিচ্ছেই না, ওটা এখানে ছেড়ে যান। কাল মেকানিক ডেকে দেখিয়ে নেবেন। চেষ্টা করলে স্টার্ট হয়তো নিয়ে নেবে, কিন্তু মাঝপথে যদি আবার বিগড়োয় প্রবলেমে পড়বেন।’

‘ঠিক বলেছেন। বরং সৌরভকে বলি পিক করে নিতে।’ ব্যাগ থেকে ফোন বার করতে করতে কথাটা শেষ করে শ্রেয়া, ‘আশা করি মিনিট পনেরোর মধ্যে ও চলে আসবে।’

‘কিন্তু ততক্ষণ এখানে দাঁড়ানোটাও তো নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বরং আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার বাড়ি তো আপনার বাড়ির ঠিক উলটো পথে, শুধু শুধু আবার অতটা পথ…’ বলতে বলতে থেমে যায় শ্রেয়া।

‘আপনাকে বিপদের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়ার মতো পাত্র তো আমি নই, আশা করি এতক্ষণে সেটা বুঝে গেছেন। তাছাড়া বসের হুকুম বলে কথা। না মানলে কী আর চলে বলুন? তাই বলছি দেরি না করে গাড়িতে বসে পড়ুন।’ ঈষৎ মজা করেই বলে সৌহার্দ্য।

শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় তারা।

‘চলুন, ভিতরে চলুন।’ বলতে বলতে কলিংবেলটা বাজায় শ্রেয়া।

‘অন্য আর এক দিন, শ্রেয়া।’ বলে গাড়িটা ঘোরাতে যাবে এমন সময় শ্রেয়ার মা উমাদেবী আর যমজ ভাই সৌরভ বেরিয়ে আসে। ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়াতে হয় সৌহার্দ্যকে।

মা-ভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় শ্রেয়া।

‘তা বাবা কষ্ট করে এতদূর যখন মেয়েটাকে ছাড়তে এলেই… অন্তত একটু চা যদি…’

‘শুধু চা কেন আন্টি অন্য একদিন পাত পেড়ে খেয়ে যাব’খন। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাবা-মা না খেয়ে বসে থাকবেন।’

এমন সময় ভিতর থেকে কাঁপা গলায় শ্রেয়ার বাবা নীরেন্দ্রবাবুর আওয়াজ ভেসে আসে, ‘শ্রেয়া বাড়ি ফিরেছিস? সঙ্গে কে? ভিতরে আসতে বল।’

‘আসলে বাবার কাল থেকে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে-চলতেও পারছেন না। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা লোকজন খুব ভালোবাসেন। যদি একবার দেখা করে যেতেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চলুন ওনার সাথে আলাপ করে আসি।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘরে ঢুকে যায়।

ঘরে ঢুকেই নীরেন্দ্রবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সৌহার্দ্য। ‘আরে বোসো বোসো। এখন আর এসব কেউ মানে নাকি। তা বুঝেছ বাবা কাল থেকে বাতের ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে। পা বাড়াতে গেলেই একেবারে বাবা-মা সকলকে টেনে আনতে হচ্ছে।’ বলে খানিক থেমে যান, তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেখেছ কাণ্ড, নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার নামটাও তো জিজ্ঞেস করা হয়নি! তোমার নাম যেন কী?’

‘সৌহার্দ্য।’

‘মানে অন্তরঙ্গ। বাহ্ বেশ মিষ্টি নাম তো।’ বলেই উমাদেবীকে ডাকতে শুরু করেন। ‘উমা, উমা। বলি ছেলেটাকে কিছু খেতে তো দেবে নাকি। সারাদিন খেটে মুখটা একেবারে আমসি হয়ে গেছে।’ ভাবটা এমন যেন কতদিনের পরিচিত। অবশ্য মানুষটাই এইরকম। নীরেন্দ্রবাবুর ডাকাডাকিতে উমাদেবী ইতস্ততবোধ করতে থাকেন।

‘না না আঙ্কল, আন্টি বলেছিলেন। আমিই না বলেছি। রাত হয়েছে তো।’

‘বলি বিয়ে করেছ?’

‘আজ্ঞে!’

‘বিয়ে করেছ কি?’

‘না-না।’

‘ব্যাচেলার। তাহলে আবার দেরি কিসের হে। না খেয়ে তোমার যাওয়া হবে না।’

‘আসলে বাবা চিন্তা করবেন তো তাই।’

‘বাবা খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় সৌহার্দ্য।

‘জানিয়ে দাও। আজ তুমি খেয়েদেয়ে ফিরবে।’ বেগতিক দেখে বাড়িতে জানাতেই হয় সৌহার্দ্যকে।

খেতে বসে এদিক-ওদিকের নানারকম কথা চলতে থাকে। আড্ডা বেশ জমে ওঠে।

‘কাল ম্যাচটা দেখলেন?’ প্রশ্ন করে সৌরভ।

কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই নীরেন্দ্রবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘ওই তোর এক দোষ বাবু, শুধু খেলা আর খেলা। তার চেয়ে বরং খবরটা শোন কাজে দেবে।’

‘সত্যি বাবা পারো বটে। খেলার নাম শুনলেই তোমার যে কী হয়!’ শুরু হয়ে যায় বাপ-ছেলের কথা কাটাকাটি।

‘তোমাদেরও বলিহারি যাই, ছেলেটা একদিন এসেছে কোথায় ওর সাথে চারটে কথা বলবে তা নয়, বাপ-ছেলে মিলে শুরু করে দিলে। ছাড়ো ওদের কথা। তুমি তোমার কথা বলো, বাবা।’ উমাদেবী পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করেন।

‘আমার কথা। আলাদা করে কী বলব! পরিবার বলতে বাবা-মা আর আমি। বাবা-মা দুজনেই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ছিলেন। বেশ কয়েকদিন হল রিটায়ার করেছেন। এখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং চালাচ্ছেন।’

‘তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভীষণ ভালো লাগল বাবা। সময় পেলেই চলে এসো।’

‘আরে আসবেই তো। কী হে, এই সেকেলে বুড়োটার সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসবে তো?’

‘অবশ্যই আঙ্কল। তবে আজ উঠতে হবে। অনেক রাত হল। ওহ্… আঙ্কল আপনার বাতের ব্যথার জন্য একটা ওষুধ পাঠিয়ে দেব, ব্যবহার করে দেখবেন।’

দিন পাঁচেক পরেই শ্রেয়ার হাত দিয়ে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছিল সৌহার্দ্য। সঙ্গে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে ব্যবহারবিধি লিখে পাঠিয়েছিল সে।

তারপর আরও দিন দশেক কেটে গেছে। শ্রেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন না এগোলেও নীরেন্দ্রবাবু আর উমাদেবীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে সৌহার্দ্য। সময় পেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একে-অপরকে ফোন করে খবর নেওয়া। কিছু স্পেশাল রান্না করলেই উমাদেবী নয় তো নীরেন্দ্রবাবুর ফোন। শ্রেয়ার হাত দিয়ে খাবারও পাঠিয়েছে বার দুয়েক। ওনাদের এই আন্তরিকতা সৌহার্দ্য-র মনকেও ছুঁয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে বেশ এনজয়ই করে।

একদিন সৌহার্দ্য সবেমাত্র লাঞ্চবক্স নিয়ে বসেছে, ঠিক সেই সময়েই নীরেন্দ্রবাবুর ফোন, ‘বলি ব্যাপার কী হে! বুড়োটার খবর কী শুধু ফোন মার়ফত-ই নেবে নাকি দর্শনও দেবে?’

‘না না আঙ্কল, কী বলছেন, সময় পেলেই চলে যাব।’

‘না না ওসব সময়-টময় বুঝি না বাপু। তুমি বরং রবিবার দিনই চলে এসো। জমিয়ে আড্ডাও দেওয়া যাবে আর একসাথে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। তোমার মাসিমা কী সব হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বানাবে। তোমার খুব ভালো লাগবে।’

‘বিরিয়ানি, ওয়াও। বাবা – আমি দুজনেই ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু রবিবার তো হবে না আঙ্কল। ওই একটা দিনই তো বাড়ির সকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়।’

‘তাহলে, বাবা-মাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে এসো। ওনার ফোন নম্বর দাও। আমি নিজে ওনাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাব। ওই দ্যাখো তোমার মাসিমাও বলছে আসার জন্য।’

‘আরে না-না আঙ্কল, অত ফর্মালিটির প্রয়োজন নেই, বাবাকে আমি বললেই হবে। মা হয়তো আসতে পারবে না। ওই দিন মায়ের, মাসির বাড়ি যাবার কথা।’

‘ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল।’

কথামতো রবিবার সন্ধেবেলা সৌহার্দ্য তার বাবা অসীমবাবুকে নিয়ে শ্রেয়াদের বাড়িতে উপস্থিত হল। বাবা-ছেলের হূদ্যতা সত্যিই প্রভাবিত করার মতো। হাসিঠাট্টা, আলাপচারিতার পর, খাওয়ার টেবিলে উমাদেবীর রান্নার তারিফ না করে পারলেন না অসীমবাবুও।

‘বাহ্ দিদিভাই। লাজবাব। বিশ্বাস করুন বহু বড়ো বড়ো রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। কিন্তু এই স্বাদ…জাস্ট অতুলনীয়! তবে হ্যাঁ আপনি যেমন বিরিয়ানিতে এক্সপার্ট, আমার গিন্নি তেমনি হিংয়ের কচুরি। না খেলে বুঝবেন না।’ তারিফের বহরে খানিক কুন্ঠাবোধ করেন উমাদেবী।

‘সামনের রবিবার আমাদের ওখানে চলে আসুন। গীতার সঙ্গে আলাপও হয়ে যাবে আর ছুটিটা উপভোগও করা যাবে। কী বলিস বাবা?’

‘আরে হ্যাঁ সে আর বলতে। চলে আসুন সামনের রবিবার। সৌরভ ওইদিন কোনও কাজ রাখিস না কিন্তু। শ্রেয়া, আঙ্কল-আন্টির সঙ্গে তুমিও আসছ কিন্তু।’ শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে সৌহার্দ্য।

ঠোটের কোণায় ঈষৎ হাসি খেলে যায় শ্রেয়ার। মুখের দু-পাশ রাঙা হয়ে ওঠে। মাথা নীচু করে সম্মতি প্রকাশ করে সে।

পরের রবিবার শ্রেয়া, সৌরভ বাবা-মায়ের সঙ্গে টাইম মতোই পৌঁছে যায় সৌহার্দ্য-দের বাড়িতে। গীতাদেবীও বাপ-ছেলের মতোই মিশুকে। সহজ সরল। কাজেই দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। গীতাদেবীর সঙ্গে উমাদেবীও কিচেনে ওনার হাতে হাতে খানিক সামলে নিলেন। খাওয়ার সময়তেও খাবার পরিবেশন করার ব্যাপারেও হেল্প করলেন। অসীমবাবুও খাতিরে কোনও ত্রুটি রাখেননি। যাবার সময় বরং সকলে মিলে বারবার অনুরোধ করেছে আবার আসার জন্য। ‘নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু তার আগে গীতাদিকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।’ প্রত্যুত্তরে উমাদেবী বললেন।

‘আপনি না বললেও আমি আমার মিসেসকে নিয়ে আসতাম আপনাদের বাড়িতে। কি বলো গিন্নি?’ গীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন অসীমবাবু।

পরের দিন অফিসে শ্রেয়ার মোবাইলে একটা এসএমএস। প্রেরক সৌহার্দ্য। দু-চার কথায় লেখা রয়েছে– অফিসের পরে ওয়েট কোরো। কথা আছে।

শ্রেয়া বেশ অবাকই হয়েছিল। চোখের সামনেই তো রয়েছে মানুষটা, তাহলে কী এমন কথা যে এখানে বলা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল শ্রেয়াকে। তারপর থেকে কাজে মন বসাতে পারেনি একটুও।

অফিসের পরে গেটের সামনে এগোতেই সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে হাজির।

‘বোসো।’ সৌহার্দ্যের হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমি বলাতে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া। ভাবার শক্তি যেন কে ছিনিয়ে নিয়েছে। সম্বিত ফেরে সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বরে, ‘কী হল বোসো।’

‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ বসছি। কোথায় যাব? আ…আপনি যে বললেন কথা…’ মাঝখানেই থামিয়ে দেয় সৌহার্দ্য, ‘কেন বিশ্বাস নেই আমার উপর?’

‘এবাবা আমি এভাবে বলতে চাইনি’, হঠাৎ এই পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া।

‘তাহলে?’ আর একটাও কথা বলে না শ্রেয়া। গাড়ি ছুটতে থাকে। মিনিট পনেরো পরে একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় সৌহার্দ্য। ভিতরে টেবিল আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেখানে গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয় সে।

‘দ্যাখো আমি ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। স্পষ্টই বলছি, বাবা-মা কাল তোমাদের বাড়িতে যাবেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে।’ কথা সরে না শ্রেয়ার। কেবল শুনতে থাকে। এতটাও আশা করেনি শ্রেয়া। বলে যায় সৌহার্দ্য। ‘তুমিও খুব ভালো করে জানো যে তোমার বাবা-মা এই বিয়েতে অমত করবেন না। তবে তোমার হ্যাঁ বলার আগে, আমার মনে হয় তোমাকে কিছু কথা জানানো উচিত। অবশ্যই আমার পরিবারের কথা। আমার জীবনে আমার বাবার স্থান সবার উপরে। আমার জন্য ওনার অবদান ভোলার নয়। সত্যিই আমি ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনি আমার জন্মদাতা নন। আমার জন্মের কয়েকমাস পরেই আমার বাবা মারা যান।

মা যে-কলেজে পড়াতেন বাবাও সেই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে মামার বন্ধুও। মামার সূত্রে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে আসতেন আর আমার সঙ্গে আমার মতো করেই মিশতেন, খেলা করতেন। সেই সময় বাড়িতে মায়ের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। উনি আমাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে শুনেই মামাকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘তাহলে সৌহার্দ্যর কী হবে? নতুন মানুষটি সৌহার্দ্যকে মেনে নেবে এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারে? এই সব সম্পর্কে সবসময়ই একটা রিস্ক থেকে যায়। সৌহার্দ্যর ব্যাপারে আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তোদের যদি অমত না থাকে আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন ওকে বুঝতেই দেব না যে, আমার সঙ্গে ওর রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই।’ বলতে বলতে চোখে জল ভরে আসে সৌহার্দ্যর। বাবার প্রতি তার আবেগ একটু বেশিই।

সামলাতে সৌহার্দ্যের হাতটা চেপে ধরে শ্রেয়া। নিজেকে সামলে নেয় সৌহার্দ্য। অপলক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার বলতে শুরু করে সে।

‘মামার বাড়ি থেকে মেনে নিলেও বাবার বাড়িতে মানে ঠাকুরদা ব্যাপারটা একেবারেই ভালো চোখে নেননি। শুধুমাত্র আমার জন্য সেদিন বাবা নিজের বাবা-মা, বিশাল সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছিল। এখানেই শেষ নয়, সেইসময় বাবা আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরীক্ষার সময়তেই এমারজেন্সি পিরিয়ডে মায়ের ইউটেরাসের অপারেশন করাতে হল। মায়ের বেড রেস্ট। বাবা পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি, কেরিয়ার ভুলে আমার আর মায়ের দেখাশোনা করে গেছে।’

সৌহার্দ্য আবেগতাড়িত হয়ে বলে যাচ্ছিল। বাবার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা প্রতিটা কথায় ঝরে পড়ছিল।

‘এটা বললেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাবা নিজের সর্বস্ব আমার উপর সমর্পিত করে দিয়েছিল। এখন বাবাকে বাকি জীবনটা সুখে রাখাই হল আমার একমাত্র কর্তব্য। আমার বউকেও এটা মেনে চলতে হবে। দায়িত্বটা আমার বউয়ের উপরও বর্তাবে। জানি শ্রেয়া, শুধুই পরিবারের লোকজনই নয়, আমরাও একে-অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। হয়তো বা ভালোও বেসে ফেলেছি। তবুও হ্যাঁ বলার আগে ভালো করে ভেবে নাও। সারাজীবন তোমাকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানে বাবা-মাকে নিয়েই থাকতে হবে।’ উত্তরের আশায় বসে থাকে সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যর হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরে শ্রেয়া। বলে, ‘মেসোমশাই আর মাসিমার মতো সহূদয় মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার কেন কারওরই কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হলেও কথা দিচ্ছি কোনওদিন কোনওরকম অভিযোগ করব না তোমাকে।’

শুনে খানিক আশ্বস্ত বোধ করে সৌহার্দ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শ্রেয়ার হাতটা মুঠোর মধ্যে ভরে নেয়।

‘বিশ্বাস করো আমি জানতাম তুমি পারবে।’

মাস দেড়েক পরে চার-হাত এক হয়ে গেল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী এক অফিসে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করতে পারে না। সেই কারণে চাকরি ছাড়তে দ্বিধাবোধ করেনি শ্রেয়া। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর শ্বশুর-শাশুড়ির কোচিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে অসীমবাবুর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রেয়া। কাজের সূত্রে দিনের বেশিরভাগ সময়টা একসঙ্গে কাটানোর জন্য শ্বশুর-বউমার সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। অসীমবাবু স্নেহও করতেন তেমনভাবেই।

‘ভাগ্যিস অফিসের দায়িত্বটা নিয়েছিলে শ্রেয়া। সারাদিন কোচিং ক্লাস করানোর পর আর পেরে উঠছিলাম না।’ শ্রেয়া মমতা অনুভব করে শ্বশুরের প্রতি।

‘ঠিক আছে বাবা, নতুন অফিসে জয়েন করলেও তোমার এই অফিসের কাজগুলো ছুটির দিনে বসে আমিই করে দেব।’

‘খানিক স্বস্তি পেলাম। সত্যিই আর পারছি না, হাঁফিয়ে উঠছি। আর কতদিন পারব তাও জানি না। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছি।’ শ্বশুরের কথাগুলো কেমন আর্তনাদের মতো মনে হল শ্রেয়ার।

অবাক হয়ে শ্রেয়া বলে, ‘কী বলছ বাবা! মনের সাথে যুদ্ধ মানে!’

‘সৌহার্দ্য বা গীতাকে একথা বলা যায় না। তাছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে ওরা আমাকে বার করতে পারবে না।’

‘তাহলে কে পারবে?’

‘তুমি, কেবলমাত্র তুমি।’ অসীমবাবুর চোখেমুখে তখন বিমর্ষতার স্পষ্ট ছাপ।

‘আমি! আমি কীভাবে?’ প্রহেলিকার থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না শ্রেয়া।

‘আমার করুণ কাহিনি শুনবে?’

‘অবশ্যই। আমায় বলে যদি একটু হালকা হতে পারো, তা বলো না বাবা।’

‘এখানে নয়, চলো একটু খোলা হাওয়ায় বেরোই।’

দারোয়ানকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে একটা বিশাল জমিদারবাড়ির সামনে থামল গাড়িটা।

‘এই বাড়িটা দেখছ। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। গীতা আর আমার বিয়েটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের বিয়ের পর বাবা একটাই শর্ত রেখেছিলেন, এই বিশাল সম্পত্তির মালিক শুধুমাত্র তার রক্তের সম্পর্কের নাতি বা নাতনি অর্থাৎ আমার নিজের সন্তানই পাবে। সৌহার্দ্য নয়। সৌহার্দ্যের জন্যই তো গীতাকে বিয়ে করা, আর বাবা বলে কিনা সে-ই…। রক্ত চড়ে গেল মাথায়, ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। এমনিতেই গীতার গর্ভাশয়ে ফ্রাইব্রয়েডের সমস্যা ছিলই, হাতিয়ার করলাম সেটাকেই। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে গীতার জরায়ুটাই শরীর থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। তারপর আর কখনও এ-বাড়ির পথ মাড়াইনি।’ মিনিট খানেক স্থির হয়ে বসে রইলেন অসীমবাবু।

‘তারপর? তারপর কী হল?’

‘মাস আষ্টেক হল বাবা মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে উনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, ওনার দাহ-সংস্কার যেন আমার হাতেই হয়। সেইমতো ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমস্ত সম্পত্তি আমার নামেই করে গেছেন, কারণ তিনি কখনও চাননি জায়গা-জমি-টাকাপয়সা বংশের বাইরে অন্য কারওর কাছে যাক। সঙ্গে রেখে গেছেন একটা চিঠিও। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই আত্মগ্লানিতে তিল তিল করে মরছি।’

‘কেন, কী এমন লেখা ছিল সেই চিঠিতে?’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন অসীমবাবু। তারপর বলতে শুরু করেন ‘ওনার বংশ নিঃশেষ করার জন্য কেবলমাত্র আমিই দায়ী, এমন অভিযোগের পাশাপাশি একটা তীব্র আর্তি… ‘পারলে নিজের বংশজকে পৃথিবীতে নিয়ে এস। বংশরক্ষা কোরো নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। বেঁচে থাকতে তো বাবার ইচ্ছের দাম দিলে না, অন্তত মারা যাওয়ার পর যদি বাবাকে একটু সম্মান দাও।’

অসীমবাবুর সারা মুখে একটা ভেঙে পড়া বিষণ্ণতার ছাপ।

‘তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগছি। কোথাও একটা মনে হচ্ছে, বাবার কথাটা বোধহয় কিছুটা হলেও সত্যি। যদি আমার আর একটা সন্তান এই পৃথিবীতে আসত তাতে তো সৌহার্দ্য-র প্রতি ভালোবাসা কমে যেত না। ছেলে বা মেয়ে যাই হতো দুজনে একসাথে বড়ো হতো। এতে আমার বাবাও শান্তি পেতেন আর বংশরক্ষাও হতো। এখন ভাবি সেদিন অতটা কঠিন সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতাম। অন্তত একটা বাচ্চার পরেও তো গীতার অপারেশনটা করাতে পারতাম।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অসীমবাবু।

‘আমি তোমার ফিলিংসটা বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু এখন সবই তো হাতের বাইরে।’

‘না, একটা রাস্তা এখনও আছে, তুমি, একমাত্র তুমি আমায় সাহায্য করলে এখনও সম্ভব শ্রেয়া। অবশ্যই যদি তুমি চাও।’

‘এক্ষেত্রে আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শ্রেয়া।

শ্রেয়ার হাতটা চেপে ধরে অসীমবাবু। ‘কেউ জানতে পারবে না শ্রেয়া। সবাই জানবে সৌহার্দ্য-র সন্তান। শুধু তুমি আর আমি…’ তড়িতাহত হয়ে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় শ্রেয়া। শ্বশুরের কথা শুনে আঁতকে ওঠে সে।

বউমার প্রতিক্রিয়া দেখে অসীমবাবু বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘না-না শ্রেয়া তুমি ভুল বুঝছ। আমি কোনওরকম অশ্লীল বা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বলছি না তোমাকে! স্পার্ম ট্রান্সপ্ল্যান্ট মানে আইভিএফ-এর কথা তো নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে। প্লিজ শ্রেয়া যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়াও, তাহলে আমিও শান্তি পাই, আর বাবার আত্মাও খানিক স্বস্তি পায়।’

পরমপূজ্য শ্বশুরের আত্মতুষ্টির কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে পড়ে শ্রেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে, এমন জঘন্য কথাটা বলল কীভাবে বাবা? একবারও বাধল না! ছিঃ ছিঃ ছেলের বউয়ের সম্পর্কে এমনটা ভাবতে পারে কোনও শ্বশুর? সৌহার্দ্য-র বিশ্বাস, ভালোবাসার এই দাম দিল মানুষটা! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সৌহার্দ্যর কাছে কখনও এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না আর বিশ্বাস করলেও এই আঘাত সহ্য করতে পারবে না। পায়ের নীচ থেকে যেন অযাচিত ভাবে খানিকটা মাটি সরে গেছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে অভিশপ্ত সেই বাড়ি থেকে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে আসে শ্রেয়া। কোথায় যাবে সে, কাকে বলবে, তার এই লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা। সৌহার্দ্যও কী করে করতে পারবে তার এই দুঃস্বপ্নের অবসান?

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...