কনসিভ করা বা সন্তানকে পৃথিবীতে আনা বস্তুত একটি কোলাবোরেটিভ প্রসেস। অর্থাৎ স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে বিষয়টিকে ঘিরে। এককভাবে তা সম্ভবপর নয়। শিশুর জন্মের আগে ও পরে মায়ের শরীরে ও মনে নানা সমস্যা তৈরি হয়। মায়ের প্রসবকালীন কষ্ট হয়তো কারও পক্ষেই লাঘব করা সম্ভব নয়, কিন্তু স্বামী এসময়ে পাশে থেকে তার মনোবল বাড়ালে অনেকটাই কষ্ট কমে। তাই আসন্ন প্রসবারা শুধু নয়, তাদের স্বামীদেরও জেনে রাখা দরকার– এসময়ে কী ধরনের শারীরিক কষ্টের সম্মুখীন হন স্ত্রী, ও তাকে কীভাবে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া সম্ভব।

মর্নিং সিকনেস

গর্ভধারণের শুরুর দিনগুলিতে মর্নিং সিকনেস একটি কমন সমস্যা। প্রেগন্যান্সির কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই, শুরু হয় মাতৃত্বের প্রথম লক্ষণ মর্নিং সিকনেস। প্রথম তিনমাস সকালের দিকে বুক ধড়ফড় করা, বমি হওয়া, নসিয়া, অকারণ টেনশন, গা ম্যাজম্যাজ করা– এগুলোই প্রেগন্যান্সির কমন সিনড্রোম। এগুলি শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অতিরিক্ত বমি হওয়া বা বুক ধড়ফড় করা শুরু হলে তা ‘হাইপারমেসিস গ্রেভিডেরম’ বলে চিহ্নিত হয়। তখন এটিকে প্রেগন্যান্সির স্বাভাবিক নসিয়া বলে গণ্য করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।

সাধারণভাবে সকালে খালিপেটে নব-গর্ভবতীর বমির সঙ্গে সামান্য জল বেরোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সকালে কয়েক ঘন্টা শরীরে এই অস্বস্তিভাব চলতে থাকে। অনেক সময় ডিহাইড্রেশন-ও হতে পারে বমির ফলস্বরূপ। খাবার তো বটেই এমনকী সাধারণ ওআরএস-ও তখন বমির সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক ইন্টারভেনাস পদ্ধতিতে জল ও লবণের মিশ্রণ গর্ভবতীর শরীরে প্রয়োগ করেন। মর্নিং সিকনেস-এ সাধারণত চিকিৎসক ডাক্সেলামিন, মেটাপ্রোপেমাইড, ডোমপেরিডোম প্রভৃতি ওষুধ দিয়ে থাকেন।

কী করবেন

১)  একসঙ্গে বেশি পরিমাণে না খেয়ে যখনই খিদে পাবে অল্প অল্প করে খাদ্যগ্রহণ করবেন

২)  উপযুক্ত মাত্রায় নুন-চিনির জল পান করুন

৩)  রাতের খাবার যতটা সম্ভব হালকা হওয়া বাঞ্ছনীয়

৪)  মর্নিং সিকনেস-এর সময়কালে, ফলের রস, ডাবের জল প্রভৃতি পানীয় গ্রহণ করুন

পিঠ ও কোমরে যন্ত্রণা

গর্ভস্থ ভ্রূণ যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, শরীর তার ওজন অনুভব করে। ফলত হাঁটা, বসা, চলার ভঙ্গি বদলাতে হয়। শিশুকে বহন করার ভার নিতে গিয়ে পিঠ ও কোমরে ব্যথা সহনীয় পর্যায় অতিক্রম করে যায়। সাধারণত দ্বিতীয়বার মা হওয়ার সময়, বা প্রসবার বয়স একটু বেশি হলে, এই ধরনের ব্যথা বেশি হয়। যাদের দৈহিক ওজন এমনিতেই বেশি– শিরদাঁড়া ও কোমরের ব্যথা তাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি হয়। অ্যানিমিয়া বা শরীরে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-র অভাবও এর কারণ হতে পারে। যারা বেশি ঝুঁকে কাজ করেন, বা ওজন তুলতে হয় গেরস্থালির কাজকর্ম করার সময়, কোমরের ব্যথা তাদের কমন সমস্যা।

যেহেতু কোমরে ব্যথা হওয়ার মূল কারণটি হল গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি পাওয়া, এর ফলে উদর স্ফীত হতে থাকে। শিরদাঁড়া সেই ভার বহন করতে গিয়ে খানিকটা বেঁকে যায়। এদিকে শরীরে নানা হরমোন সক্রিয় হওয়ার ফলে ও শরীরে জলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, কোমরের জয়েন্টসগুলি শিথিল হয়ে যায়। ভার্টিব্রাল স্পেস অর্থাৎ শিরদাঁড়ার মধ্যস্থ শিরা উপশিরাগুলি ফুলে ওঠে শরীরের বাড়তি ভার বহন করতে গিয়ে। ফলে শিরদাঁড়া ও কোমরের ব্যথা অনুভূত হয়।

কী করবেন

১)  শোওয়া, বসা, দাঁড়ানো ও কাজের সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন। সোজা না শুয়ে কাত হয়ে শুন। হাঁটুর মাঝে বালিশ যেন থাকে। বসার সময় অবশ্যই পিঠে যেন সাপোর্ট থাকে। দাঁড়ানোর সময় যতটা সম্ভব শরীর রিল্যাক্সড করে সোজা দাঁড়ান, হাত দুটি কোমরের কাছে সাপোর্ট দিয়ে।

২)  যদি অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়, তাহলে একটি পা সামান্য উঁচুতে রাখুন, ও খানিকক্ষণ পরে পা পরিবর্তন করে অন্য পা-টি ওভাবে তুলে রাখুন। কাঁধ সোজা রাখুন, হাঁটুর দিকে ঝুঁকে তাকাবেন না

৩)  হিল জুতো একেবারেই পরবেন না এসময়ে। ম্যাটারনিটি প্যান্টস পরতে পারেন। এতে লোয়ার অ্যাবডোমেন সাপোর্টার থাকে। প্রয়োজনে ম্যাটারনিটি সাপোর্ট বেল্ট ব্যবহার করুন।

৪)  যদি মাটি থেকে কিছু তোলার প্রয়োজন হয়, অল্প পা ফাঁক রেখে নীচু হয়ে কাজটি করুন, যাতে কোমরে বা পেটে পুরো চাপটা না পড়ে

৫)  হালকা ব্যায়াম বা সাঁতার কাটতে পারেন

৬)  ইন্সট্রাক্টরের সহযোগিতায় যোগ ব্যায়ামও চলতে পারে

৭)  ঠান্ডা বা গরম মাসাজ চলতে পারে ব্যথা লাঘবের জন্য

৮)  সুষম আহার গ্রহণ করুন। এতে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম থাকে। মিনিট দশেক সান বাথ নিতে পারেন প্রতিদিন, সূর্যের আলোর সাহায্যে ভিটামিন ডি গ্রহণের জন্য

৯)  পেইন কিলার খাবেন না

ওরাল হাইজিন

প্রসবার মুখের ভিতরের কোনও ইনফেকশনের প্রভাব পড়তে পারে নবজাতকের উপর। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে প্রেগন্যান্সির সময়ে শরীরে যে-সমস্ত হরমোন নিঃসৃত হয়, তা মাড়ির ইনফেকশনের কারণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে নবজাতকের দাঁতে ক্ষতির সম্ভাবনা নেহাত ফেলে দেওয়ার নয়।

প্রেগন্যান্সির সময় মুখের ভিতরের যে-কোনও ইনফেকশন হেলাফেলা করা উচিত নয়। মাউথ ইনফেকশনের কারণে শিশুর প্রিম্যাচিয়োর বার্থ, ওজন কম হওয়া প্রভৃতির সম্ভাবনা থাকে। এর ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে সেরিব্রাল পালসি, ক্রনিক ফুসফুসের ব্যাধি এমনকী অকালমৃত্যুর ঘটনাও ঘটা অসম্ভব নয়। বস্তুত মাড়ির সমস্যায় আক্রান্ত মায়েদের প্রিম্যাচিয়োর্ড শিশুর জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।

প্রেগন্যান্সির সময় দাঁতের গোড়া ফুলে উঠে ছোট্ট টিউমার সৃষ্টি হতে পারে। এটাকে প্রেগন্যান্সি টিউমার বলা হয় (পায়োজেনিক গ্র্যানুলোমা) ব্রাশ করার সময় রক্তও পড়তে পারে। সাধারণত প্রসবের পরে এই সমস্যা কমে যায়। তবে না কমলে অবহেলা করবেন না।

কী করবেন

১)  প্রতিদিন ভারী খাবারের পর ব্রাশ করুন

২)  সুতো দিয়ে দাঁতের ফাঁক পরিষ্কার করুন দিনে একবার

৩)  প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড-এ অন্তত একবার ডেন্টাল চেক-আপ করিয়ে নিন

মর্নিং সিকনেস-এর সময় বমি করার পর ভালোভাবে কুলকুচি করুন। প্রতিবার খাদ্যগ্রহণের পর, সুগার ফ্রি চুয়িং গাম চিবোন অন্তত দশ মিনিট। চিজ, ফ্রেশ ফল, সবজি বেশি করে খান। দানাশস্য, ফাইবার-যুক্ত খাবার, ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল প্রভৃতি খাদ্য-তালিকায় রাখুন। নরম টুথব্রাশ দিয়ে ব্রাশ করুন ও ফ্লোরাইড-যুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন।

চুলকানি ও র‍্যাশ

প্রেগন্যান্সির শেষের মাসগুলিতে অনেকেরই চুলকানি ও র‍্যাশের সমস্যা হয়। এই সময় লিভার অতিরিক্ত পিত্তক্ষরণ করে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম ইন্ট্রাহেপেটিক কোলেস্টেসিস অফ প্রেগন্যান্সি। পিত্ত-র অন্যতম উপাদান বাইল সল্ট ত্বকের নীচে জমা হয়। এর জন্যই ত্বকে চুলকানি বা প্রদাহ হতে পারে। এই সমস্যায় চিকিৎসকরা ওসোডিঅক্সিফলিক অ্যাসিড প্রতিরোধক ট্যাবলেট দেন, যা পিত্তনাশ করে।

আরও কিছু সমস্যা

প্রসবের পরের সময়টাতেও নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। হরমোনের প্রভাবে শারীরিক পরিবর্তন, ক্লান্তি, ডিপ্রেশন বা মুড সুইং অন্যতম সমস্যা। পিপিডি অর্থাৎ পোস্ট প্রেগন্যান্সি ডিপ্রেশন এড়াতে পেশাদার কোনও মনোবিদের সাহায্য নিন। এছাড়া পিপিই অর্থাৎ পোস্ট পার্টাম এক্সজর্শন বা প্রসব পরবর্তী ক্লান্তি একটি কমন সমস্যা। এর ফলে ঘুমের সময়ের পরিবর্তন, অবসন্ন ভাব নতুন মায়েদের হয়েই থাকে। এছাড়া আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকা, মন ভার হয়ে থাকা, অকারণে রাগ-বিরক্তি বা কান্নার উদ্রেক হওয়া– সবই পোস্ট প্রেগন্যান্সির স্বাভাবিক সমস্যা। তবে এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে বুঝতে হবে এটি হয় বংশগত সমস্যা না হলে লাইফস্টাইল জনিত সমস্যা। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

পিপিডি-র কারণে রাগ-বিরক্তি-দুঃখবোধের সঙ্গে অস্বাভাবিক ওয়েট লস বা গেন হতে পারে, যৌনতা বিমুখতা তৈরি হতে পারে, উৎকন্ঠা, হতাশা বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।

কী করবেন

১)  নতুন মাতৃত্ব উপভোগ করতে শুরু করুন। শিশুর প্রতি অপত্য স্নেহ আপনাকে নিজের প্রতি অতি মনোযোগী হওয়া থেকে দূরে রাখবে। ফলে হতাশা বা উৎকণ্ঠা আপনাকে স্পর্শ করবে না

২)  ব্যালেন্সড ডায়েট গ্রহণ করুন। খাদ্য-তালিকায় কোনও একটি তত্ত্বের অভাব থেকেও পিপিডি-র সমস্যা হতে পারে

৩)  স্বামীর সঙ্গে আবেগ ভাগ করে নিন। বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্বও দুজনে শেয়ার করুন

৪)  সুন্দর করে সাজুন, ভালো গান শুনুন, অবসরে বই পড়ুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোন, জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...