সফরনামা টুকরো আলোর হাতছানি দেয়, ভ্রমণরসিক মন উস্কানি দেয়, পর্যটন আনুগত্যে কাছেপিঠেই কোথাও দে-ছুট পাড়ি জমাতে। মুম্বইয়ে বছর কয়েক যাবৎ থাকার সুবাদে, ছোট্ট ছুটিছাটায় প্রায়শই বেরিয়ে পড়ি কাছেপিঠে কোথাও। উইক-এন্ড-এ ছুটিছাটায় ঘরের বাইরে আয়েশি অবসরের ঠেক মুম্বই মহানগর ও নগরতলির নাগালেই কত আছে। দূরত্বও তেমন বেশি কিছু নয়। পকেটে খানিক লক্ষ্মী আর পয়মন্ত সুযোগসুবিধা মতো বেরিয়ে পড়লেই হল।
অকপটে ঝুঁকে আসা ওই পশ্চিমঘাট। বৃষ্টির মরসুম শেষ হয়েও খানিক যেন থেকে গেছে। ভেজা সড়ক, খামখেয়ালি বৃষ্টি ও সোহাগি মেঘের যাতায়াত। দৃষ্টি খিদে মন নিয়ে এবার গন্তব্য সাজাই লোনাভালা-খান্ডালা। সহ্যাদ্রি পাহাড়ের কোলে মনোরম হারিয়ে যাওয়ার হদিশ এখন ওটাই।
জাতীয় সড়ক ৪ ধরে চলেছি। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে পশ্চিমঘাটকে। কখনও সে সামান্য দূরেও সরে যাচ্ছে। আবার নাগালে ফিরে আসছে। সড়কপথটি ভারি মসৃণ আর লাবণ্য ভরা। যাত্রাপথটায় একটা ঘোরের মধ্যে প্রায় তলিয়ে যাচ্ছিলাম। টের পাচ্ছি ক্রমশ ফিরে আসছে প্রপাত গিরিখাত উপত্যকা আর ওই গাঢ় হয়ে আসা পশ্চিমঘাট। একটা পশলা মেঘ থমকে মাথার ওপর। ভাড়া গাড়ির বন্দোবস্ত করাই ছিল মুম্বই থেকে পাড়ি দিয়েই পৌঁছে যাই লোনাভলা।
মাঝেমধ্যেই পথ আগলাচ্ছে ক্ষণিক বৃষ্টি। কখনও বৃষ্টি তো পরক্ষণেই মেঘ সরিয়ে সামান্য রোদের ঝিলিক। ফলত গাড়ির জানালার কাচ একবার নামাচ্ছি, বৃষ্টির ছাঁটে আবার বন্ধ করছি। কখনও বৃষ্টির ছাঁট ঘিরে ফেলছে তো কখনও হাওয়ার ঝাপটা। ও তেমন কিছু না। বৃষ্টির মরসুমে এতো জানাই।
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎই একটা ঘোরতর লম্বা সুরঙ্গপথের ভেতর সটান গলে গেল গাড়ি। সমস্ত সুড়ঙ্গপথের ভেতর আলো রয়েছে। দীর্ঘ সে পথ পেরোতেই চোখের সামনে পশ্চিমঘাট আর ঝকঝকে একখানা আকাশ। খানিকপরই আবারও একটা সুড়ঙ্গ। আবার খোলা আকাশ। এমনতর যাত্রাপথ বিশুদ্ধতার মোড়কে ক্রমশ ভাব জমাচ্ছে। মনে মনে গুনগুন করছি ‘গুলাম’ ছবির জনপ্রিয় সেই গানটি ‘আতি ক্যায়া খান্ডালা… আরে ঘুমেঙ্গে ফিরেঙ্গে নাচেঙ্গে গায়েঙ্গে, অ্যায়াশ করেঙ্গে, আওর ক্যায়া?’।
রমণীয় প্রকৃতির মাঝে ছোট্ট জনপদ খান্ডালা। যেন কতকালের চেনা। এখানকার ‘চিক্বি’ খুব জনপ্রিয়। খান্ডালার প্রায় সমস্ত বাজার জুড়েই ছোটো-বড়ো-মাঝারি চিক্বির দোকান। গুড়-বাদাম-কাজু-সাদা তিল-চিনি সহযোগে তৈরি চিক্বি নামক জনপ্রিয় মিঠাইটির চাহিদা প্রচুর। লোনাভলা-খান্ডালা বেড়াতে এসে স্মারক হিসেবে কিনে নিই কয়েক বাক্স ‘চিক্বি’। দিতে-থুতেও হবে।
বৃষ্টিজলে ভাব জমানো দরাজ বাতাবরণ নিয়ে খান্ডালা জনপদ। এখানে বেশ কয়েকটা দ্রষ্টব্য স্থান একে একে দেখা হয়ে গেল। চারপাশে ঘুম ভাঙা সবুজ পাহাড়। এর মধ্যে একটি পাহাড়চূড়ার নাম ‘ডিউক’স্ নোজ’। ডিউক অফ ওয়েলিংটন এর নামানুসারে ওই পাহাড়চূড়ার অদ্ভুত গড়নের জন্য এমন নাম। মুম্বই ও নগরতলির প্রচুর পর্যটক সপ্তাহান্তে ছুটিছাটায় ভিড় জমান এসব অঞ্চলে। আরও একটা জায়গা ‘টাইগার’স লিপ’(Leap)। একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নীচের আদিগন্ত উপত্যকাভূমির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ করেই ভ্রম হতে পারে যে কোনও বাঘ বুঝি বা লাফ মেরে পেরিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যই এই স্থানটির নাম টাইগার’স লিপ’। এখান থেকে কথা বললে সে কথা প্রতিধবনিত হয়ে ফিরে আসে ক্ষনিক পরই। বর্ষার খান্ডালার রূপই অন্যরকম। বর্ষাজলপুষ্ট ফেনায়িত প্রপাত অঝোরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কয়েকশো ফুট নীচে।
কাছেই রাজমছি, সুইসাইড পয়েন্ট, সানসেট পয়েন্টেরও খ্যাতি আছে। খানিক আরও এগিয়ে ভুসি জলাধার। ভালভন জলাধার। বৃষ্টিদিনে এই সব এলাকায় বেড়াতে হাজির হন মুম্বই পুনের তামাম পর্যটক। সবাই খুব হুল্লোড়ের মেজাজে। যেখানে কেবল উপভোগ করে নেওয়া প্রকৃতির লাবণ্যকে। সেখানে একপাশে আলগোছে পড়ে থাকে তাদের পেশা, তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন। বর্ষার সময়েই খান্ডালা-লোনাভলার রূপ খোলতাই হয় বেশি।
প্রকৃতিকে নিবিড় কাছ থেকে একান্তে নাগাল পেতেই তো চলে আসা লোনাভলার জলসাঘরে। খান্ডালা-লোনাভলাকে বলা হয় যমজ শৈলশহর। সাগরতল থেকে ২,০৪১ ফুট উচ্চতায় এদের বিস্তার। এককালে যাদব সাম্রাজ্য ছিল। পরে মোঘল সাম্রাজ্য আয়ত্বে আনে। ১৮৭১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ অধিকর্তা লর্ড এলভিন্সন্ পুনরায় আবিষ্কার করেন যমজ পাহাড়ি অঞ্চল দুটি। সহ্যাদ্রি পাহাড়শ্রেণির পশ্চিম ঢালে পুনে জেলার ‘লোনাভলা’ নামটি এসেছে প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ ‘লোনেলি’ থেকে। যার অর্থ ‘গুহার শহর’।
মায়াবিনী মনে হচ্ছে এখন লোনাভলাকে। থোকা থোকা ভেজা মেঘ গায়ের ওপর দিয়েও উড়ে চলে যাচ্ছে। মেঘের সাথেই লুটোপুটি খেতে থাকি অপরূপ অভিজ্ঞতা ও হিমেল পরশ মেখে। এখানে পরিচয় হয় ব্যারোমিটার হিল, টুঙ্গারলি হ্রদ, কারলা ও ভাজা গুহা, দেদসা গুহার সাথে। টাটা হাইডেল পাওয়ারের বিশাল জলাধার পেরিয়ে ‘টাইগার’স্ লিপ’ পাহাড়। চোখের নাগালে সহ্যাদ্রির ঢেউ খেলানো শোভা। প্রচুর পর্যটকের ভিড়ে গমগম করছে লোনাভলা। ফোটো তোলা দেদার হচ্ছে না। ক্যামেরাকে আগলে রাখতে হচ্ছে, বৃষ্টির ছাঁট সামলিয়ে। গাড়ি চলছে মুম্বই-পুনে হাইওয়ে থেকে তিন কিমি দূরত্বে ভাজা গুহা অভিমুখে। এখানে প্রাচীন হীনযানপন্থী বৌদ্ধ গুহা রয়েছে। প্রবেশপথের বাম পার্শ্বে চতুঅর্শচালিত রথ এবং ইন্দ্র ও সূর্যের মূর্তি। মোট ১৮টি গুহা আছে। তার মধ্যে কিছু গুহার ভাস্কর্য ভেস্তে গেছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে। বহু দূরে শিবাজি রাজ ভোঁসলের বিজাপুর দুর্গ দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আরও প্রায় ২ কিমি গেলে কারলা গুহা। এটিও হীনযান বৌদ্ধ গুহা। ভারত সরকার স্মারক স্তুপ হিসাবে গুহাটিকে সংরক্ষিত করে রেখেছেন।
ইতিহাস জানায় প্রাচীন বৈজয়ন্তী নগরীর শ্রেষ্ঠী ভূতপালের তৈরি এই বৌদ্ধ চৈত্য গুহাটি। ভারতের অন্যান্য বৌদ্ধ চৈত্যগুলির মধ্যে বৃহত্তম এটি। এর মধ্যে অষ্টম গুহাটি আবার সবচেয়ে বিশাল। অপরূপ বাঁক আর চমৎকার কারুকাজ শোভিত। মোট ৩৭টি স্তম্ভ এবং হাতির মস্তকের মতো মূর্তি রয়েছে। সেখানে একসময় খাঁটি হাতির দাঁতের কারুকাজও করা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৮০ সালে নির্মিত সেগুন কাঠের কারুকার্য ছাতটিও দেখার মতো। গুহার কাছেই একবিশ্বদেবীর মন্দির। স্থানীয় মারাঠি কোলি উপজাতিদের আরাধ্যা পবিত্র মন্দিরটি ধীবরদের কাছে একবিরা মন্দির নামেও সমাধিক পরিচিত। একটি পাত্রে দেবীর পদচিহ্ন রাখা। স্থানীয়দের বিশ্বাস একবিরা দেবীর শিরস্থানে গোটা একটি সুপারি রেখে ভক্ত যদি ব্যক্তিগত প্রশ্ন রাখেন মনে মনে, সুপারিটি ডাইনে গড়িয়ে পড়লে তা নাকি সদর্থক ও বাঁদিকে গড়িয়ে পড়লে সেটি নঞর্থক। ওপাশে দ্বিতল, ত্রিতল আরও কিছু বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। এই কারলা পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং কোর্সের ব্যবস্থা করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। অদূরেই মুম্বই-পুনে সড়কের ওপর এমটিডিসি হলিডে রিসর্ট। ঘোড়ার ক্ষুরের আদলে একটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে যেটি কারলা হ্রদ নামেই পরিচিত। নৌবিহারে মাতোয়ারা অনেকেই বৃষ্টির জল গায়ে মেখেই।
বর্ষার লোনাভলা। বৃষ্টি থেকে তুলে নেওয়া সকাল-দুপুর গড়ানো বিকেল এর মায়াবী চিত্রকথার সৌকর্ষ মনে রেখে দিই। যা ফিরেই তো লিখে রাখতে হবে ডায়ারির পাতায়। প্রকৃতির জলজ মাধুর্যে এখন খান্ডালা লোনাভলা আরও রম্যতায় পর্যটকদের জন্য প্রতীক্ষমান।
যাওয়া-আসা –
মুম্বই থেকে লোনাভলা ১২৮ কিমি। মুম্বই থেকে অনেক ট্রেন যায় লোনাভলা। সড়কপথে মুম্বই-পুনে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে, পরে এনএইচ৪ হয়ে লোনাভলা যাওয়া যায়। সময় কমবেশি দেড়ঘন্টা। পুনে-লোনাভলা লোকাল ট্রেনও আছে।
খাওয়াদাওয়া –
শাকাহারি রেস্তোরাঁই বেশি এই অঞ্চলে। তবে কিছু রেস্তোরাঁয় কন্টিনেন্টাল-চাইনিজ-মোগলাই মেনুও পাওয়া যায়। এখানকার নানা ধরনের ‘চিক্বি’ খুবই বিখ্যাত। পর্যটকদের অবশ্য সংগ্রহযোগ্য এই ‘চিক্বি’র বাক্স।
যাওয়ার সময় –
অপরূপ জলবায়ুর জন্য খান্ডালা-লোনাভলা যে-কোনও সময়েই যাওয়া যায়। তবে বর্ষায় সৌন্দর্য যেন আরও খোলতাই হয়। মেঘেরা নেমে আসে আরও নীচে, শরীরে লেপটে যায়। সারা বছরই ভিড় থাকে পর্যটকদের। হালকা শীতবস্ত্র জরুরি।