এসেছি এক মেঘ-বৃষ্টি-পাহাড়ের দেশে। উঠেছি রাজধানী শহর শিলং-এ। মনে তো প্রশ্ন জাগবেই। সব ছেড়ে কেন বাবা মেঘালয়ে? আসলে, বৃষ্টি তো কলকাতার ফ্ল্যাটে বসেও দেখা যায়। কিন্তু মেঘের দেশে গিয়ে মেঘ-বৃষ্টির খেলা স্বচক্ষে দেখা– না ভাবাই যায় না। মজার ব্যাপার অঙ্কটা যাচ্ছে মিলেও। মেঘবালিকাদের মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিদিনই। এই ক’দিনে মগজস্থ হয়েছে এ তল্লাটের ম্যাপটাও। তবে প্রকৃতিরূপের পাঠ নিচ্ছি একজনের হাত ধরে। তিনি আর কেউ নন, ৪২ বছরের অভিজ্ঞ এক বাঙালি ড্রাইভার। নাম পরেশ মোদক। শিলং-এরই বাসিন্দা। আসলে এই ক’দিনে তিনি আপনজনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন, ভালোভাবে।
আজও শুরুর সকাল মেঘে ঢাকা। সময় মতো হাজির পরেশদা, তার বাহন নিয়ে। ‘আজ যাব ভূগোলের প্র্যাকটিক্যাল করাতে’– সদা হাস্যময় মুখে পরেশদার স্বঘোষিত উক্তি। তার মানে আজ মৌসিনরামের দিকে। পৃথিবীর সর্বাধিক বর্ষণপ্রবণ অঞ্চল। ভূগোলে পড়া সেই নামটাকে দেখব স্বচক্ষে। তার সাথে উপরি পাওনা বৃষ্টি। সত্যি, ছাত্রাবস্থায় যদি কেউ আনত– এই মেঘ-বৃষ্টির দেশে! মনকে বোঝালাম, তাতে কি হয়েছে, আজ তো যাচ্ছি। আসলে, চেরাপুঞ্জির মতো অত জনপ্রিয় নয়– এই মৌসিনরাম টুর। ফলে বেশিরভাগ টুরিস্টই এড়িয়ে চলেন এই পথ। আমার আবার অফ্-বিটই বেশি পছন্দ।
রাস্তা জ্যামের ঝক্বি নেই সাতসকালে। শহর সীমানায় পড়ল বায়ুসেনা ব্যারাক। এরপরই হাইরোড ছেড়ে শাখা রাস্তায়। বাঁদিকের এই শাখাপথ চেরাপুঞ্জি পথের মতো প্রশস্ত নয় তেমন। বিপরীত দিক থেকে চলে আসা গাড়িকে সাইড দিতে হচ্ছে তাই কায়দা করে। পরেশদা বললেন, এই তল্লাটের বিধায়ক তেমন তৎপর নন। মেঘালয়ে যেখানে অনেক ছোটো ছোটো স্থানেও রাস্তাঘাট ঝাঁ-চকচকে, সেখানে এই রুটের পথচিত্রের পরিবর্তন হয়নি এখনও। সামনের উপত্যকায় দেখি উপজাতি মানুষজনের ঘনবসতি। সবুজ বৃক্ষশৃঙ্খল পথ জুড়ে। যাত্রাপথে পরেশদা চেনালেন নাশপাতি, পিচ, আলুবোখরার মতো গাছ। সারি সারি গাছে ফলও ধরেছে অজস্র। চোখ আটকাচ্ছে রংবাহারি ফুলের প্রকৃতিজাত এক্সজিবিশনে। বিশেষত গোলাপ ও জবার যৌবন উপচে পড়ছে। সেই সঙ্গে স্কুলের পথে চলা খাসিয়া শিশুদের হাত নাড়া– অনবদ্য। মেঘের দেশে এসে এত উষ্ণ অভ্যর্থনা– ভাবা যায় না।
মিনিট পঁয়তাল্লিশ গাড়ির দৌড়ের পর পড়ল মানগাফ বাজার। পথপার্শ্বে পাহাড়ি ঢালে আর উপত্যকা জুড়ে নিবিড় সবজি চাষ। এর মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলো, গাজর, আলু ইত্যাদি। গাড়ির জানলা থেকে দেখছি খাসি পাহাড়ের রেঞ্জ। কখনও দিগন্তরেখা পর্যন্ত একাধিক পাহাড়ের সার-সার সহাবস্থান। কখনওবা গায়েপড়া ভাব জমাতে পাহাড়টাই ঝুঁকে পড়েছে রাস্তায়। দূরে-কাছের সবুজে জড়ানো ল্যান্ডস্কেপ দুর্দান্ত। হিমালয় যে একসময় টেথিস সাগরের তলায় ছিল, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মেলে এই পথে এলে।
আধভাঙা এক পাহাড়ের তলদেশে পরেশদা দাঁড় করালেন গাড়ি। দেখলাম, পাহাড়ের গায়েই পরিষ্ফুট ছোটো-ছোটো নুড়ি, বালি, কাঁকড়, চুনাপাথর, কয়লার স্তর। ভূবিদদের অনুমান যে সত্য ছিল স্বচক্ষে তা দেখে অভিভূত হলাম। শুনলাম, এই পাহাড়ি বালু দিয়েই এই এলাকার বাড়িঘর তৈরি হয়। তবে মনে হল, এই পাহাড় থেকে বালি বিভাজনের পদ্ধতিটা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি, পাহাড়ের খাঁজে-খাঁজে বাসা বাঁধছে ভবঘুরে মেঘের দল। চলতে চলতে হঠাৎই আবির্ভাব সেই ভবঘুরে মেঘের মিছিলের। পলক ফেলতে না ফেলতেই, তারা ঢেকে দিল সামনের পাহাড়ি পথ। আমাদের কাছে অস্বাভাবিক হলেও, এই পথযাত্রায় এটাই চিরকালের চেনা ছবি। ড্রাইভারও প্রস্তুত।
লাইট জ্বেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে গাড়ি। সমতলের ড্রাইভার হলে, স্টিয়ারিং-এ রাখা হাতদুটো হয়তো এতক্ষণে থরথর করে কাঁপত। তবে মানতেই হবে, মেঘের মধ্য দিয়ে চলার অনুভূতি অসাধারণ। ইন্দ্রজিৎ হয়ে মেঘের আড়ালে থাকলেও, সত্যি কথা বলতে, ঢিপ্ ঢিপ্ করছিল বুকের ভিতরটা। চাকা অথবা দৃষ্টি কোনও একটা বিশ্বাসঘাতকতা করলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অতলস্পর্শী খাদে পড়ে মেঘের রাজ্যেই চিরশয়ান। সত্য সত্যই ঘটলে, এই কাহিনি অবশ্য অন্য কেউ লিখত।
পাহাড়ি গ্রাম এল আর একটা। নাম টারসাড। পার হলাম ছোট্ট টারসাড বাজারও। পথ চলতি এইসব পাহাড়ি গ্রামের নাম বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা। কিন্তু উচ্চারণ করতে গেলেই বিপদ। হোঁচট খাবে যে কেউ। আদতে তো খাসি উচ্চারণ। এখানকার টিয়া সবুজ উপত্যকায় দেখি একটা ফুটবল মাঠ। স্থানীয় ছেলেরা বেশ দাপিয়ে খেলছে। উইলো গ্রামে আবার মেঘ এসে ঢেকে দিল পথ। লক্ষ্য করে দেখছি প্রতিটা গ্রামের শীর্ষেই চার্চ। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মতো যেন আকাশ ছুঁতে চায়।
ঔপনিবেশিক আমলের ধর্মান্তর করানোর কাজটা শুনলাম এখনও চলছে। অভাবের তাড়নায় মানুষজন বাধ্য হচ্ছে হয়তো। তবে মানতেই হবে সরকার যেখানে সর্বত্র শিক্ষার আলো জ্বালাতে অপারগ খ্রিস্টান পাদ্রিরা সেখানে গ্রামে-গ্রামে খুলে দিয়েছে, মিশনারি স্কুল। ফলে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে খাসিরা। হিন্দু খাসি এবং খ্রিস্টান খাসি। আজও খাসি সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। অগ্রাধিকার মেয়েদেরই। রাস্তাঘাট, দোকান-বাজার, কয়লাখাদান, চরানদার প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েরাই কর্মরত। মেয়েদের পদবিই এখানে আইনগত স্বীকৃত। পুরুষরা সমাজে যেন থাকতেও নেই। সমাজ বর্ণবিভক্ত হলেও, বৈবাহিক ব্যাপারে এদের ছুঁৎমার্গ সেরকম নেই। বিবাহ পরবর্তী পুরুষের অবস্থা ঘরজামাইয়ের মতো। পদবিও বদলে যায় পুরুষদের। বহুবিবাহ সমাজে স্বীকৃত। বাধা নেই পুরুষ অথবা মহিলার ক্ষেত্রে একাধিক সঙ্গিনী রাখার। তবে এই একাধিক বৈবাহিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই থাকে। পরেশদার জানা একটা ঘটনা ব্যক্ত করলেন আমাদের। সেটা আর কিছুই নয়– শিলং-এর এক খাসি ড্রাইভারের তিন স্ত্রীর মধ্যে টানাপোড়েনের মুখরোচক দাম্পত্য কলহকথা। তবে ভালোর মধ্যে পুরুষরা আগে শুধুই নেশাগ্রস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত, এখন নানা কাজে তারা হাত মেলাচ্ছে মহিলাদের সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলাম মাওজুমবুঁই স্থানের বিস্ময় গুহায়। মৌসিনরাম বাজার ঢোকার অনেক আগেই বাঁক নিয়েছে গুহার পথ। উপরের মূল সড়ক থেকে কেভের অবস্থান অনেকটাই নীচে। ফলে উৎরাই-এর পথে নামতে থাকে গাড়ি। আজ এই পথে টুরিস্ট নেই সেরকম। ফলে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যাপারটা সহজ হল। কেভ দর্শনের প্রবেশমূল্য মাত্র দশ টাকা। দেখি, কাউন্টারে বসে টিকিট কাটছে বছর দশেকের একটা বাচ্চা। শুনলাম খাসি মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পাশেই রাখা একটা পাঠ্য বই-এর খোলা পাতা। টিকিট কেটেই সে আবার মন দিল পড়ায়। হয়তো মেয়েটির মা অথবা বাবা কোনও কাজে ব্যস্ত। তাই এই কাজ সে হাসি মুখে সামলাচ্ছে। তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে এই জিনিস সহজে কল্পনাও করা যায় না।
এখন এই এলাকায় স্কুল সব খোলা। বেশি ছুটি থাকে শীতের দিনগুলোয়। বছরের অন্য ছুটি বলতে দুর্গাপুজো আর চরম গ্রীষ্মের কটা দিন। মজার ব্যাপার বর্ষায় কিন্তু এদের কোনও ছুটিই থাকে না। ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলাম। গুহা সম্মুখের শীর্ষ পাহাড় গাত্র থেকে অবিরাম পড়ে চলেছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ফলে গুহা সম্মুখের অংশ জলমগ্ন। সিক্ত পথে ক্যামেরা বাঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম। মিল পাচ্ছি চেরাপুঞ্জির মোসমাই, অন্ধ্রের বোরা কেভ বা ছত্তিশগড়ের কুটুমসর গুহার সঙ্গে। তবে কেভের আরও গভীরে ঢোকার চেষ্টা ব্যর্থ হল। কারণ ব্যবস্থা নেই কোনও লাইটের।
পরেশদা টর্চের আলোয় দেখালেন গুহার ভেতরে বয়ে চলা এক ক্ষীণকায়া নদীর স্রোতকে। গুহার সামনেই সেই এশিয়াখ্যাত শিবলিঙ্গ। আসলে চুনাপাথরের জল উপর থেকে টপ্ টপ্ করে অবিরাম পড়ে চলেছে। সেটাই দিনে দিনে তৈরি করেছে এক স্ট্যালাগমাইট পাথরের ঢিবি। বিশ্বাসী মানুষজন যা শিবলিঙ্গ হিসাবে মান্য করে। এই একইভাবে বরফজল দিয়ে তৈরি হয় অমরনাথ শিবলিঙ্গ। যদিও ফি-বছর তা সৃষ্টি হয় নতুন করে। শিবলিঙ্গের সামনে গিয়ে ভালোভাবে পরখ করলাম। শিবের মাথায় যেন ধারা দেওয়া হয়েছে। ঝুলে থাকা গুহার উপরের অংশটা যেন গরুর বাটের মতো দেখতে। যেন জল নয়, দুধ পড়ছে। বাস্তবিক অবশ্য দুধ, বেলপাতা, ধূপ ইত্যাদি এখানে চড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া স্ট্যালাগমাইট পাথর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্থানীয় মানুষজন অবশ্য এইসব বাধা ঠেলে শিবরাত্রির দিন হাজির হন। জুটে যায় বহু সাধু সন্ন্যাসীর দলও।
পরেশদা এবার ব্যক্ত করলেন এখানে প্রথম আসা সেই দিনের কথা, সালটা ১৯৭৪। এক মাড়োয়ারি ব্যক্তির কাছে গল্প শুনে ইচ্ছেটা আর চেপে রাখতে পারেননি। বন্ধুবান্ধব পরিবৃত্ত হয়ে চলেই এলেন একদিন। গুহায় আসার সড়কপথ তখন তৈরিই হয়নি। পায়ে চলা পাহাড়ি পথ ছিল দুর্গম। সেই পথে ট্রেকিং করে পৌঁছোলেন গুহায়। সেই অবাক হওয়া চোখে শিবলিঙ্গ ছিল খুবই ছোটো। এখন এত বছর পর উচ্চতায় তা বেড়েছে অনেকটাই।
আমার ইচ্ছেতেই পরেশদা ২ কিমি দূরে মৌসিনরাম বাজারে গাড়িটা নিয়ে গেলেন। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জমজমাট বাজার। সাপ্তাহিক বাজার বসেছে, পাহাড়ি ফালি পথের ধারে। সবজি ছাড়াও গিনিপিগ, খরগোশ, পায়রা, মুরগি ও শূকরের মাংস বিক্রি হচ্ছে অঢেল। এক চায়ের দোকানে ঢুকে সকলে মিলে চা খেলাম। লক্ষ্য করছিলাম মানুষজনের চলন-বলন, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা ইত্যাদি। মহিলাদের পোশাকে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করলাম। তাদের পোশাক তিনটি অংশে বিভক্ত। টপের মতো উপরের অংশ, নীচেরটা ঘাঘরা সদৃশ। তৃতীয়, একটা রঙিন উত্তরীয়। যা আমাদের পুরুতঠাকুরের নামাবলি জড়ানোর মতো। ডানদিকের কোমর ও বগলের তলা দিয়ে বাঁদিকের পিঠের উপর বাঁধা। পরেশদা বললেন এই পোশাকের নাম জিনিসা।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্বাধিক বর্ষণপ্রবণ অঞ্চলে বৃষ্টি নেই। তবে কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। মৌসিনরাম থেকে বার হয়েছে তিন-তিনটি পাহাড়ি সড়কপথ। রাণীগঞ্জ, বালাট ও বরচরা। কিন্তু তিনটি রাস্তাই ঘুরপথে শেষে পৌঁছেছে বাংলাদেশ সীমান্তে। ট্রেকার চলছে এইসব রুটে। কিন্তু এই সীমান্তে কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই। যানবাহনের অপ্রতুলতায় পাসপোর্ট ভিসা-সহ মানুষজনেরও যাতায়াত নেই। তবে বাধা নেই পণ্য চলাচলের। মূলত এই রুটেই কয়লা, পাথর, সিমেন্ট ইত্যাদি পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে ঢোকে।
আরও কিছুটা ঘোরাঘুরি করে গাড়িতে উঠলাম। চলতে থাকল গাড়ি। পিছনে পড়ে রইল বৃষ্টিখ্যাত পাহাড়ি গ্রাম মৌসিনরাম। ফেরার পথে দেখলাম পথ পার্শ্বস্থ এক জলপ্রপাত। জলপ্রপাতের সৌন্দর্যে যখন পাগলপারা, ঝেঁপে বৃষ্টিটা এল তখনই। আবার চলতে শুরু করল গাড়ি। থাকতে না পেরে, প্রশ্নটা করেই ফেললাম পরেশদাকে, ‘আচ্ছা কেন মৌসিনরামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি? চেরাপুঞ্জির সঙ্গে তফাতটা কোথায়?’ ওয়াইপারের ওঠা-নামার পাশাপাশি, ভিতরের অস্বচ্ছ কাচ কোডাস্টার দিয়ে মুছতে মুছতে পরেশদা বললেন, ‘চেরাপুঞ্জিতে এখন বড়ো গাছপালা নেই বললেই চলে। খনি অঞ্চল হওয়ায় যেটুকু ছিল তাও সাবাড়। তুলনায় মৌসিনরামে গাছপালার সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতো। তাই মৌসিনরামই শেষ হাসি হেসে ছিনিয়ে নিয়েছে সর্বাধিক বর্ষণপ্রবণ স্থানের তকমাটা।
উইলো-গ্রাম পর্যন্ত ফেরার রাস্তা একই। বামদিকে এবার শাখা রাস্তায় ছুটল গাড়ি। সামনের ১২ কিমি পাহাড়ি সড়ক একেবারেই নতুন। পথে চড়াই-উৎরাই-এর মোচড়। অতলস্পর্শী খাদ। কাছে-দূরে মাঝারি আকারের খাসি রেঞ্জ। দিগন্তজুড়ে বিভিন্ন সবুজের শেড। কিছুটা চলতেই সাক্ষাৎ এক নদীর সঙ্গে। নাম তার জাকরেম। শুনলাম এই নদী সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। সেই নদীর কাছাকাছি আসতে, নামছি উৎরাইয়ের পথে। নদীর পাশে পাহাড়ের গায়ে আছে আর-এক দ্রষ্টব্য। উষ্ণপ্রস্রবণ। নাম জাকরেম হটস্প্রিং। প্রধান সড়ক থেকে ডান দিকের পথে নামতে নামতেই পেলাম এক টেবিলল্যান্ড। এখানেই গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা। জনপ্রতি টিকিট এখানে ২০ টাকা। নামতে থাকলাম। পাথুরে সিঁড়িপথ। খুবই নির্জন। ঘন জঙ্গল দু’দিকেই। নাকে আসছে বনজ গন্ধ। দূর থেকেই কানে আসছে নদী স্রোতের উচ্ছল প্রতিধবনি। বয়ে চলা জাকরেম নদীর মাঝে কংক্রিটের সেতু। সেতুতে উঠতেই দেখি ওপারে বহু লোকের সমাগম। সাপ্তাহিক কাপড়-চোপড় বোধহয় কাচছে।
উষ্ণপ্রস্রবণ-এর জলকে পাইপ বাহিত করে সংলগ্ন বাথরুমগুলোয় আনা হয়েছে। স্নানের স্থান স্থানীয় ও টুরিস্টদের পৃথক। তবে মেঘালয় টুরিজমের তরফে এতটুকু পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা নেই। অপরিচ্ছন্নতার বাড়তি পারসেনটেজ জুগিয়েছে স্থানীয় মানুষজনের গণকাচাকাচি ও উদ্দাম স্নান। পুরুষদের বাথরুমগুলোর ভিতরে ঢুকে দেখলাম, অবস্থা নরককুণ্ড। তবে এইসবের বাইরে জায়গাটা কিন্তু চমৎকার। পাইপ থেকে অবিরাম ঝরে পড়া প্রস্রবণের জলে হাত রাখলাম। দেখি, সহনযোগ্য তাপমাত্রা। প্রকৃতি যেন এই পাহাড়ি মানুষদের জন্য পাহাড়ের গায়ে নিখরচায় গিজার বসিয়ে রেখেছে। অসাধারণ। জলে গন্ধক থাকায় চর্মরোগের উপশম হয় বলে মানুষজন মনে করে। মনে পড়ে গেল, ভারতের নানা প্রান্তে দেখা উষ্ণপ্রস্রবণের কথা। পাহাড়ের অন্য প্রান্তে পাইপ বাহিত জলকে ফেলে তৈরি করা হয়েছে এক সুইমিং পুল। স্নানের আনন্দে মেতেছে বহু স্থানীয় মানুষজন। আছে অনেক টুরিস্টও। মূলত নুড়ি-পাথরের জমিতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি, আর সেতু থেকে নদীর রূপমাধুর্য অবলোকন– এইসব মিলিয়েই জাকরেম।
ভাঙছি এবার চড়াই পথ। পথমধ্যে দেখা বহু মানুষজনের সঙ্গে। যথেষ্ট স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে ওরা। মেইন সড়কের দু’দিকে হাতে গোনা দু’একটা দোকান। তাতে আছে চিপস্, কোল্ডড্রিংকস্, বিস্কুট ইত্যাদি। কিন্তু ভাতের হোটেল মিলল না। পরেশদা বললেন, ‘চলুন এগিয়ে যাই।’ ছুটতে থাকে গাড়ি।
পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই-এ সকালের জলখাবার সব আগেই হজম হয়ে গেছে। কাহাতক কিশমিশ, বিস্কুট, চিপস্-এর উপর ভর করে চলা যায়। পরেশদা বললেন, ‘মুশকিল হল এই রুটে সে রকম ভালো খাবারের হোটেল মেলে না।’ বৃষ্টিটাও শুরু হল আকাশ ভেঙে। ওয়াইপারের ওঠা-নামা দেখছি আর পেট চুঁই চুঁই করছে আরও। ঝাপসা কাচের ভিতর দিয়ে প্রকৃতি দেখতে মন্দ লাগছে না। কিন্তু এতে তো খিদে মিটবে না। এক ‘লাইন হোটেলে’ গাড়ি দাঁড় করাল পরেশদা। খাসি হোটেলে ঢুকে খাসির মাংস নয়, মিলল ডিম ভাত। তবে তরকারিটা প্লেন করলার। আলুর নাম-গন্ধ নেই। পাঠক এই পথে গাড়ি ছোটালে পর্যাপ্ত ড্রাইফুড সঙ্গে রাখবেন।
আবার ছুটে চলেছে গাড়ি। এবার আজকের শেষ ডেস্টিনেশন– মাওফলং। ফিরে চলা শিলং-এর রাস্তা থেকেই মাওফলং-এর শাখা রাস্তা ভেঙেছে। বিভাজন যে বাজার এলাকা থেকে তার নাম মানগাফ। মাওফলং-এ আছে রিজার্ভ ফরেস্ট। দুষ্প্রাপ্য সব অর্কিড-এর দেখা মেলে এই জঙ্গলে। মেঘালয়ে যে তিনশো প্রজাতির অর্কিডের দেখা মেলে, তার অধিকাংশেরই সন্ধান মেলে এখানে। গাড়ি এসে দাঁড়ায় এক বিরাট উপত্যকার সামনে। টিয়া-সবুজ সে উপত্যকা পলকেই মুগ্ধ করে সকলকে। উপত্যকার একপ্রান্তে মঞ্চ বেঁধে বায়ুসেনাদের এক অনুষ্ঠান চলছে। বার্ষিক মিলন উৎসব হবে হয়তো। অন্য প্রান্তে চলছে ফুটবল খেলা। মহিলা ও পুরুষ খেলছে পৃথক-পৃথকভাবে। খাওয়াদাওয়ারও দেখি এলাহি ব্যাপার। যেন চড়ুইভাতির মেজাজ।
শুনলাম মাঠের বিপরীতে সবুজ সরলরেখাটাই রিজার্ভ ফরেস্ট। গাড়ি পার্কিং ও টিকিট মিলিয়ে দিতে হল ৫০ টাকা। গাইডও এসে হাজির। ১৫০ টাকায় ব্যক্তি প্রতি ১ ঘন্টা জঙ্গল ভ্রমণ। পরেশদা বললেন, ‘বর্ষায় বনপথ বেশ দুর্গম হয়ে ওঠে। জোঁক, সাপ, বিছা প্রতিপদে। গামবুট ছাড়া জংলি পথে যাওয়াও মুশকিল।’ গাইডের মুখে শুনলাম দুষ্প্রাপ্য কতকগুলো অর্কিডের নাম। আমি অর্কিড বিশেষজ্ঞ নই। কালিম্পং-এ কবে অর্কিড নার্সারি দেখেছি মনে নেই। তবু পায়ে-পায়ে গাইড ছাড়াই এগিয়ে গেলাম। গাইডবাবু স্থানীয় ভাষায় কী বললেন বুঝলাম না। তবে অনুধাবন করলাম, হয়তো বলতে চাইছে, পাগল নাকি! অর্কিড দেখবে আবার গাইড ছাড়া। জংলি পথে সত্যি বেশিদূর এগোতে পারলাম না। দেখি পরগাছার মতো অর্কিড ঝুলে আছে প্রচুর। মস, ফার্নও বাসা বেঁধেছে এখানে-ওখানে। রডোডেনড্রনের মতো কতকগুলো গাছ চেনার তালিকায় ছিল। গহিন বিপদসঙ্কুল পথে আর না গিয়ে পিছু হাঁটলাম।
ফেরার পথে একটা নৃত্যানুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য হল। আসর বসেছে, মওফলং গ্রামের এক ছোট্ট মাঠে। আসলে এটা হিন্দু খাসিদের বাৎসরিক উৎসব। হিন্দু খাসি পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে সমস্ত মাঠটা। পতাকার প্রতীক মুরগি। আগেই শুনেছিলাম, খাসিরা হিন্দু ও খ্রিস্টান দুই ভাগে বিভক্ত। উৎসবে শিশুরাই অংশ নিয়েছে বেশি। তবে মায়েরাও কম যান না। ঝলমলে পোশাকে উৎসব প্রাঙ্গণে নেমে পড়েছেন তারাও। মাঠের এক প্রান্তে বাঁশের মাচায় বসেছে বাজনদাররা। তখনও দলে দলে ছেলেমেয়েরা আসছে, বাবামায়ের হাত ধরে। বাড়ি থেকে বয়ে আনা পোশাক, মুকুট, ফুল, তরবারি, চামর ইত্যাদি সহ শিশুদের সজ্জিত করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন মাঠে।
নৃত্য চলছে মৃদুছন্দে। সঙ্গে কোরাস গান। ছন্দ মোটামুটি একই। আগে-পিছে, বামে মোড়, ডানে মোড়। তবে সব মিলিয়ে লাগছে চমৎকার। পরে শিলং পিক্ ও এলিফ্যান্ট ফলসে এই ধরনের পোশাকই ভাড়া দিতে দেখেছিলাম। টুরিস্টরা এই সমস্ত পোশাকে সজ্জিত হয়ে পটাপট ছবি তুলছে। শুনলাম প্রতিবছর মে-এর ৩০, ৩১ জুনের ১ তারিখ– মোট তিনদিন ধরে চলে এই উৎসব। খানাপিনারও ব্যবস্থা আছে মনে হল। উৎসবে নাচ, গান, বাজনা চলতে থাকে। ফিরে চলি আমরা। অমিত-লাবণ্যের চেনা শিলং শহরে। মেঘ বৃষ্টির দাপাদাপি শেষে আকাশে তখন সোনা রোদের ঝিলিক।
কীভাবে যাবেন – কলকাতা থেকে প্রথমে পৌঁছোতে হবে গুয়াহাটি। বিমান অথবা ট্রেন পথে চলুন। ট্রেন পাবেন সরাইঘাট এক্সপ্রেস, কামরূপ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনজঙঘা এক্সপ্রেস অথবা দ্বিসাপ্তাহিক কলকাতা গুয়াহাটি গরিবরথ এক্সপ্রেস। গুয়াহাটি স্টেশনের বিপরীত দিকেই পল্টন বাজার। এখান থেকে শেয়ার সুমো। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাড়ি ভাড়া করেও ১০০ কিমি দূরের শিলং শহরে পৌঁছোতে পারেন। শিলং থেকে গাড়ি বুকিং করেই মৌসিনরাম ও উল্লিখিত স্থানগুলি যেতে পারেন। মেঘালয় টুরিজমের পক্ষ থেকে সারাদিনের জন্য মৌসিনরাম প্যাকেজ টুরেরও আয়োজন করা হয়।
কোথায় থাকবেন – মৌসিনরামে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। শিলং থেকে দিনে-দিনেই ঘুরে আসা যায় মৌসিনরাম। শিলং শহরে থাকার জন্য আছে অসংখ্য হোটেল। এখানে
সিংহভাগ হোটেলের অবস্থানই পুলিশবাজার ও জি.এস. রোডের আশেপাশে।
সঙ্গে রাখুন – মৌসিনরামের রাস্তায় ভালো খাবারের হোটেল মিলবে না। তাই সঙ্গে পানীয় জলের সঙ্গে পর্যাপ্ত ড্রাইফুড রাখবেন। আর এখন-তখন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে অবশ্যই নেবেন ছাতা।
জরুরি তথ্য – মৌসিনরাম প্যাকেজ টুর ও অন্যান্য ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য যোগাযোগ করুন – টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার, মেঘালয় টুরিজম, পুলিশ বাজার।
কলকাতায় যোগাযোগের ঠিকানা – মেঘালয় টুরিজম, মেঘালয় হাউস, ১২০ শান্তিপল্লি, কলকাতা-৭০০১০৭ ।