সদ্য প্রসবের পর নতুন মায়ের মনে সদ্যজাতকে নিয়ে উৎসাহের অন্ত থাকে না। একটাই চিন্তা মায়ের মনে ঘোরাফেরা করতে থাকে, তার হূদয়ের টুকরোকে ভালো ভাবে সুস্থ উপায়ে বড়ো করে তোলা। নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয় তার জন্য, যে নতুন নতুন মা হয়েছে কিন্তু বাড়িতে বড়ো কেউ থাকলে এই চিন্তার অবসান ঘটে। কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ সুতরাং ছোটো পরিবারেই সুখী থাকার প্রচেষ্টা। বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করানো অনেক সময় নতুন মায়ের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। জরুরি কিছু তথ্য দেওয়া হল তাদের সুবিধার্থে।

বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার নিয়ম

সংযুক্তা দে কলকাতার একজন বিশিষ্ট গাইনিকোলজিস্ট। তাঁর মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন মায়েরা মনে করেন বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করানোর বদলে বাইরের দুধ খাওয়ালেই বেশি ভালো। অনেকে আবার শরীরের গঠন নিয়ে অতিরিক্ত কনশাস। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে, শরীরের সৌন্দর্য নষ্ট হবে এই ভয়ে ওই রাস্তা এড়িয়ে চলেন। অথচ মায়েদের এটা জেনে রাখা উচিত, বাচ্চাকে নিজের দুধ খাওয়ালে বাচ্চার যেমন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, তেমনি মায়ের নিজেরও শরীর সুস্থ থাকে। ব্রেস্ট মিল্ক বাচ্চার জন্য আদর্শ নিউট্রিশন। বাচ্চার বেড়ে ওঠার জন্য ভিটামিন, প্রোটিন এবং ফ্যাটের সঠিক মিশ্রন এতে রয়েছে। বাচ্চার জন্য কৌটোর দুধের থেকে মায়ের দুধ হজম করা অনেক সহজ। এতে উপস্থিত অ্যান্টিবডিস্ বাচ্চাকে বিভিন্ন ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়ার সঙ্গে যুঝতে শক্তি জোগায়। অ্যাজমা এবং অ্যালার্জি হওয়ারও ভয় থাকে না। কানের সংক্রমন, নিঃশ্বাসের কষ্ট, ডায়রিয়া হওয়ার ভয় থাকে না এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে আই কিউ লেভেলও বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া বাচ্চার ওজন অতিরিক্ত হয় না, যাকে ওভারওয়েট শিশু বলা হয়ে থাকে। অনেক ডাক্তারের মতে ব্রেস্ট ফিড করালে, বাচ্চা ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম’ অথবা এসআইডিএস-এর হাত থেকে বাঁচতে পারে।

বাচ্চাদের সঙ্গে মায়েরও উপকারই হয় বাচ্চাকে স্তনপান করালে। এটি, মায়ের প্রেগন্যান্সির দরুন বেড়ে যাওয়া ওজন কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ব্রেস্টফিডিং করাবার সময় মায়ের শরীরে হরমোন অক্সিটোসিন নির্গত হয়, ফলে ইউটেরাস প্রেগন্যান্সির পূর্বের আকারে ফিরে আসে। বাচ্চা মায়ের দুধ খেলে মায়ের মিল্ক ডাক্ট ক্লিয়ার থাকে এবং সেই কারণে ব্রেস্ট এবং ওভারিয়ান ক্যানসার হওয়ার ভয় থাকে না। ভবিষ্যতে এই মায়েদের অস্টিওপোরোসিস হওয়ার রিস্ক-ও কম হয়ে যায়।

শিশুর জন্মের প্রথম কয়েকদিন, শিশু মায়ের যে-দুধ পান করে তা হল, ‘ফার্স্ট মিল্ক’ অথবা কোলোস্ট্রাম। এটি ঘন, হলুদ রঙের এবং পরিমাণে কম হয় তবে নবজাত শিশুর পেট ভরার জন্যে যথেষ্ট এবং বাচ্চার যতটা পুষ্টি দরকার সবই তার মধ্যে থাকে। এটি নিউবর্ন-এর ডাইজেসটিভ ট্র্যাক্ট ডেভেলপ করতে সাহায্য করে। যাতে পরে মায়ের দুধ হজম করতে নবজাত শিশুটির কোনও অসুবিধা না হয়।

তবে ডাক্তারের মতে স্তনপান করানোর জন্যে শুধু শারীরিকই নয়, মায়ের মানসিক প্রস্তুতিরও দরকার আছে। এই দুই ধরনের প্রস্তুতি না থাকলে ব্রেস্টফিড করাতে গিয়ে মায়েরা কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।

প্রথমবার কখন

স্বাভাবিক প্রসবের (নর্মাল ডেলিভারি) ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি শিশুকে ব্রেস্টফিড করানো সম্ভব হয়। স্পাইনাল কর্ডে ইঞ্জেকশন দিয়ে মা-কে সিজার করলেও সেইদিন থেকে মা, সন্তানকে ব্রেস্টফিড করাতে পারেন। কিন্তু মা-কে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে সি-সেকশন করা হলে, অন্ততপক্ষে ২ দিন পর থেকে মা শিশুকে নিজের দুধ খাওয়াতে পারেন।

নিপল-এর আকার সঠিক না হলে

অনেক মহিলারই ব্রেস্ট-এর নিপল-এর আকার সঠিক হয় না। এতে বাচ্চাদের মায়ের দুধ পান করতে অসুবিধা হয়। এই জন্য মা-হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের যত্নেরও প্রয়োজন পড়ে। নিপল-এর আকার সঠিক না হলে রোজ দু’বেলা আঙুলের ডগায় অলিভ অয়েল নিয়ে ব্রেস্ট-এ মালিশ করতে হবে কারণ বাচ্চার সুবিধার জন্য নিপল-কে সঠিক আকার দেওয়া জরুরি। এই ধরনের সমস্যা হলে গাইনিকোলজিস্টের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে।

ক্র্যাকড নিপল-এর সমস্যা

অনেক মহিলা ক্র্যাকড নিপল-এর সমস্যায় অসুবিধার সম্মুখীন হন। কখনও ব্যথাও হয় এবং নিপল থেকে রক্তও পড়ে। এই ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অন্য স্তন থেকে দুধ বার করে ক্র্যাকড নিপল-এ লাগালে এটি ওষুধের কাজ করে। ক্র্যাকড নিপল থেকে বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করানো উচিত নয়।

মায়ের যে স্তনটিতে ক্র্যাকড নিপল-এর সমস্যা হয়ে থাকে, মিল্ক এক্সপ্রেস দিয়ে সেই স্তনটি থেকে দুধ বার করে চামচ দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানো যাবে। এক্সপ্রেস দিয়ে বার করা দুধ, ২৪ ঘন্টা ফ্রিজে রেখেও বাচ্চাকে খাওয়ানো যায়। তবে এর মধ্যে ফ্রিজ একবারও বন্ধ করা চলবে না। ক্র্যাক্-এর জন্য মেডিকেটেড ক্রিম ব্যবহার করুন। ক্রিম পরিষ্কার করে তবেই বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান।

দুধ খাওয়াবার সঠিক উপায়

বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার সময় মায়ের উচিত পায়ের নীচে বালিশের সাপোর্ট দিয়ে বাচ্চাকে কোলে শোয়ানো। বাচ্চার দুই পাশে ছোটো সাইড বালিশ রাখতে পারলে আরও ভালো হয়, কারণ বাচ্চা তাহলে আরাম অনুভব করতে পারে। দুধ খাওয়াবার সময় বাচ্চার মাথায় হাত বোলালে মায়ের স্পর্শ বাচ্চাকে ভালোবাসার অনুভূতি দেবে এবং মায়ের মনেও সন্তুষ্টি আসবে।

অনেক সময় বাচ্চা দুধ খেতে চায় না। এর অনেক কারণ হতে পারে। শিশুর কান, নাক বন্ধ হয়ে গেলে অথবা দুধ খাওয়ার সময় আরাম অনুভব না করলে, বাচ্চা দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এই অবস্থায় বাচ্চার অবস্থান, পরিবর্তন করে ট্রাই করা যেতে পারে। ভিড়ের মধ্যে বাচ্চাকে দুধ না খাইয়ে একলা ঘরে শিশুকে দুধ খাওয়াতে হয়।

কতবার ব্রেস্টফিড করাবার প্রয়োজন হয়

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, নবজাত শিশুকে রুটিন মেনে মাতৃদুগ্ধ পান করাবার দরকার পড়ে না। খিদে পেলেই বাচ্চা মায়ের দুধ পান করতে পারে। কিন্তু একবারে পুরো দুধ না খাইয়ে, বারবার অল্প অল্প করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো ভালো। কারণ নবজাত শিশুর হজমশক্তি খুব শক্তিশালী হয় না।

কম করে দিনে চার থেকে ছয়বার শিশুকে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে। নবজাত শিশু, রাত্রে দুই থেকে তিনবার দুধের জন্য ঘুমের থেকে জাগতে পারে। ছয় সপ্তাহ পর বাচ্চারা পাঁচ ঘন্টার বেশি ঘুমোয় না। তিন মাসের পর কোনও কোনও বাচ্চাকে বোতলের দুধও দিতে হতে পারে। তখন খিদেও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। কৌটোর দুধ, ফর্মুলার উপর নির্ভর করে তৈরি হয়। মায়ের দুধের তুলনায় বাইরের দুধ হজম করা একটু শক্ত হয়। হজম হতে সময়ও লাগে বেশি। এই সময়ে ৪ ঘন্টা বাদে বাদে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে। সারাদিনে পাঁচবার এবং রাত্রে দু’বার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালেই যথেষ্ট।

যদি প্রি-ম্যাচিওর শিশু হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে কিছুক্ষণ পর পর দুধ খাওয়ানো উচিত। এই বাচ্চারা সাধারণত অনেক বেশি ঘুমোয়। তাই ঘুমের মধ্যে মধ্যে দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।

দুধ খাওয়ার সময় বাচ্চার পেটে অনেক সময় হাওয়া চলে যায়। তাই দুধ খাওয়াবার পর বাচ্চাকে কাঁধের উপর শুইয়ে পিঠে আস্তে আস্তে থাবড়াতে হয় যাতে ঢেঁকুর রূপে পেটের হাওয়া বাইরে বেরিয়ে আসে। পেটে হাওয়া থেকে গেলে, বাচ্চার বমি হবে নয়তো বাচ্চার পেটে ব্যথা হয়।

কী করে বুঝবেন শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ

ডা. পল্লব চট্টোপাধ্যায়, শিশু বিশেষজ্ঞ জানালেন, বাচ্চা যদি ব্রেস্টফিড করাবার পর ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার পেট ভরে গেছে। সারাদিনে বাচ্চা কতবার ন্যাপি ভেজাচ্ছে সেটা মা-কে খেয়াল রাখতে হবে। ৮-১০ বার হলেই বুঝবেন বাচ্চা সুস্থ আছে। ৬ বারের কম হলে ডাক্তারকে বলুন।

যতদিন বাচ্চা ব্রেস্ট ফিড করে, ততদিন বাচ্চাকে জল খাওয়াবার প্রয়োজন হয় না। এমনকী মিছরির জলও দেওয়া চলবে না কারণ পেটে গ্যাস তৈরি হতে পারে। এমনও হতে পারে বাচ্চা সারাদিন ঘুমায় এবং রাত্রে জেগে থাকে। এটা অস্বাভাবিক ভেবে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটে।

মনে রাখবেন

দুধের বোতল মাইক্রোআভেনে গরম করা উচিত নয়। কারণ তাতে বোতল বাইরে থেকে খুব গরম হয় না কিন্তু বোতলের ভিতর দুধ প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়। সুতরাং বাচ্চাকে দুধের বোতল দেওয়ার আগে মায়ের উচিত নিজের হাতের উপরি অংশে সামান্য দুধ ঢেলে দেখে নেওয়া, যে দুধ কতটা গরম রয়েছে। দুধ খাওয়ানোর পর ভিজে তুলো বা কাপড় দিয়ে বাচ্চার মুখ ভালো করে মুছে দেওয়া উচিত, কারণ নয়তো মুখের বাইরে দুধ লেগে থাকলে র‍্যাশ বেরোবার সম্ভাবনা থাকে।

স্টেরিলাইজ করা জরুরি

স্টিম স্টেরিলাইজার অথবা মাইক্রোওভেন স্টেরিলাইজারের ব্যবহার করা যেতে পারে। স্টেরিলাইজার থাকলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। বাজারে স্টেরিলাইজার কেমিক্যাল অথবা স্টেরিলাইজিং টিকিয়া কিনতে পাওয়া যায়। টিকিয়া গলে যাওয়ার পর শিশুর ফিডিং উপকরণ (বোতল, নিপল) তাতে ডুবিয়ে অন্তত ৫ মিনিট ফোটাতে হবে। ফোটানোর প্রয়োজন এইজন্যই হয় যে, উচ্চ তাপমাত্রায় না পৌঁছোলে ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়ার বিনাশ হয় না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...