ঘরের বাইরে এসে পাপোশের উপর ডান পা রাখতেই পুরোনো পাপোশ প্রতিশোধ নিল। হড়হড় করে তিন হাত দূরে সরে যাওয়া আর ৮২ কিলো ওজনের ধপাস আওয়াজ। এ তো যে সে বউ নয় যে, ওই লাশ টেনে তোলার আয়োজন করবে! বদলে রান্নাঘর থেকে চিল চিৎকার– পই পই করে বলি মিনসেরে, অত নোকের চোকের জল সইবে না, সইবে না। ঠিক একদিন না একদিন প্রাশ্চিত্তি করতি হবেই হবে– তা আমার কতা শুনবে না। এখন হল তো! আমার কপাল খেল। ও মাগো রে, ও বাবা গো রে, এ আমার কোথায় থুয়ে তোমরা চলে গেলে! এই কম্পোজিশনে কড়াই-খুন্তির ঝনাৎকারও তখন প্রবল।

কালিশংকর সেই যে থেবড়ে বসে পড়েছে আর নট্ নড়নচড়ন। রান্নাঘরের ভয়ে আঃ ওঃ টুকুও করতে পারছে না। আজ তাড়াতাড়ি অফিস যাবার কথা, তাড়াতাড়ি চানে ঢুকেছিল আর আজই কি না যত বিপত্তি! বসে থেকে থেকেই কোমরে হাত দেয় সে। না, কোমর থেকে যন্ত্রণাটা আসছে না। ডান পায়ের মালাইচাকির পেছন দিকে যন্ত্রণায় টাটিয়ে যাচ্ছে। উঠতে পারছে না সে। কিছু একটা ধরতে পেলে হয়, একটু সাপোর্ট পেলে হয়তো ঠেলে উঠতে পারবে। মনে জোর আছে। কিন্তু কাছাকাছি সাপোর্ট নেবার মতো কিছুই তো চোখে পড়ছে না। বউ শান্তিবালা হারগিস হাত বাড়াবে না। চাই কি আর এক প্রস্থ আগুনে ঘরের জল-বাতাস ঝলসে দিতে পারে।

কালিশংকর ঘষটাতে ঘষটাতে অনেকখানি যেয়ে সোফার কাছাকাছি গেল। তারপর সোফায় হাতের ভর দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসল। বসতে বসতে নিজের বুদ্ধির একটা তারিফও করে ফেলল মনে মনে। বউয়ের নির্দেশ না মেনেই সে বাড়িতে হাফপ্যান্ট বা বার্মুডা চালু করে দিয়েছিল আগেই। চানঘর থেকে বার্মুডার বদলে যদি গামছা বা তোয়ালে পরে সে বের হতো, তবে তো ধিঙ্গি শিবের অবস্থাতে আরও কেলো!

যাই হোক সোফায় বসতে না বসতেই কালিশংকরের হাঁটুর ব্যথা ছাপিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আজ অফিস না যেতে পারলে নিবাস তো পুরোটাই ঝেড়ে দেবে। আজকে পেমেন্ট আছে। আজ পিওন থেকে, দরোয়ান থেকে, ক্লার্ক থেকে, ক্যাশিয়ার থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে শুরু করে ড্রাফট্সম্যান, ইঞ্জিনিয়ার, চিফ– সবাই হাজির থাকবে। আজ অফিস বসে পড়বে দশটা বাজতে না বাজতেই। অন্য দিন, যখন পেমেন্ট থাকে না তখন গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে দেড়টা দুটোতে সব বাবুরা আসেন। আজ পেমেন্ট আছে আর আজ কি না কালিশংকরের এই অবস্থা! উঠে গিয়ে যে আরনিকা থার্টি-র দু’ফোঁটা জিভে ফেলবে তারও উপায় নেই।

খুব যন্ত্রণা করছে। এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে গোটা শরীরই নাড়াচাড়া খেয়েছে। জ্বর আসতে পারে। ঘরে মুভ আছে। তা লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধেটেধে সে যাবে কোনওক্রমে। ট্যাক্সি নিয়ে হলেও যাবে। এমনিতেই আগের মতো অবস্থায় নেই কোম্পানি। বাজেট সেকশান কুঁতে কুঁতে ফান্ড দেয়। মাসে দুবার, তিনবার। নেই নেই করেও তা-ও চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখের পেমেন্ট হয়। সে গতকাল বিলটিল সব রেডি করে ক্যাশিয়ারের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু না গেলে তো সব চৌপাট! এমন দিনে এরকম হতে আছে! মাথা চাপড়াল। ছয় জনের পেমেন্ট আছে। সবাই একটা করে হাজার টাকার পাত্তি ছোঁয়াবে। সে স্টোরকিপার। মেজারমেন্ট বুক, এগ্রিমেন্টের কপি– এসব বের করে দিতে হয় তাকে। মুশকিলটা হল ওই নিবাস মুনশিকে নিয়ে। ব্যাটা পিওন– সবার সাথে লদকালদকি। ভান করে যেন সব কাজ জানে। অফিসে যখন বিড়ি ফোঁকে তখন মনে হয় লাটের বাট। কালিশংকর না গেলেই তো দখলদারি নিয়ে নেবে। আর এই ছয় হাজার টাকা ওর ট্যাঁকে। ভাবতেই গা জ্বলে যাচ্ছে।

এই সময় মেয়ে নিশার কথা মনে এল। মেয়ে বলেছিল– বাবা, বয়স বাড়ছে, একটা গাড়ি নিয়ে নাও। মাঝেমধ্যে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বা এদিকওদিক যাওয়া, একটু কাছাকাছি বেড়ানো, মার্কেটিং– খুব জরুরি একটা গাড়ি। মেয়ে বুঝিয়েছে, গাড়ি আজকাল আর বিলাসিতা নয়। জল, বিদ্যুৎ, বাজারহাটের মতো জরুরি একটা বিষয়। কালিশংকর গা করেনি। তার হাউজিং-এ একমাত্র কালিশংকরেরই গাড়ি নেই। আজ এখন গাড়িটা সত্যি খুব জরুরি মনে হচ্ছে কালিশংকরের।

টেলিফোনের এতখানি আর্তি! ঠিক টেলিফোনের নয়, টেলিফোনের মাধ্যমটি থেকে সে আর্তি ঝরে পড়ছে– আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ! অথচ এই দুজনেরই, মানে যে শুনছে আর যে শোনাচ্ছে, তাদের কারও কিছু দেবার বা নেবার নেই। তাহলে কেন মিসেস মুখার্জি, ওরকম সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী গৃহিণী, এমন আর্ততায় ভরিয়ে তুলবে রৌণকের কাজের দুপুর! মিসেস নিশা মুখার্জি তখনও বলে যাচ্ছেন– আমি তো তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনি রৌণক, কিচ্ছুটি না। শুধু তুমি আমার পাশে থাকো। আমার সাথে কথা বোলো। মাঝেমধ্যে সময় পেলে দেখা কোরো, ব্যাস!

রৌণক সেনগুপ্ত তরুণ সুরকার। মুম্বই ও বাংলায় কিছুটা নামডাক হয়েছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই গোটা তিরিশ ফিল্মের সুরকার সে। মিসেস মুখার্জিও ওর সুরে কয়েকটা ফিল্মে গান করেছেন। আর অফকোর্স সংগীত পরিচালক হিসেবে সে সব কটিতেই রৌণকের পছন্দ ছিলেন তিনি। আজকাল মুম্বইতেই বেশিটা সময় কাটে রৌণকের। নিশাও কলকাতায় স্বামী-সন্তান লালন করেও গানের জগতে পুরোপুরি ঢুকে পড়েছেন। চেনাজানা বেড়েছে তারও। টালিগঞ্জে একটা দুটো ডাকও পেয়েছেন। গানের অ্যালবাম হয়েছে। তবুও রৌণকের জন্য মন কেমন তার। রৌণক যেখানেই থাকুক প্রতিদিন কিছুক্ষণ কথা বলা চাই। তিনি টের পাচ্ছিলেন, আজকাল রৌণক তেমন আন্তরিকতায় কথা বলে না। কোথায় যেন প্রাণের অভাব। কী যেন এক ভুল তারে বেজে যায় রৌণকের স্বর। কিন্তু কেন এমন হল! গত বছরও তো এমন ছিল না! তাহলে কি সুমন ভরদ্বাজের সুরে গান গেয়ে তার একটু নাম হয়েছে বলে রৌণক ঈর্ষাতুর হয়েছে! কে জানে! কিন্তু ওরকম কোল্ড ব্যবহার নিশার সহ্য হচ্ছে না। ও ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে। কী করে যে রৌণক তার গোটা মনটা দখল করে বসে আছে! আজকাল ডিপ্রেশনও বেড়ে গেছে। রেকর্ডিং থাকলে বাড়ি থেকে হয়তো বের হল, কিন্তু না থাকলে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটায়। রৌণক নিজে থেকে ফোন করলে মনটা ফুরফুর করে, নচেৎ বিষাদের শ্রাবণে সারাদিনমান শুধু অশ্রুরই গান যেন।

কাল একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল বলে সকাল এগারোটাতেও ঘুম ভাঙেনি নিশার। ছয়-সাত পেগ তো হবেই। রবীন্দ্রসদনে একক অনুষ্ঠান ছিল তার। গান শেষ হবার পর শুভংকর মানে ওর অনুষ্ঠানের আয়োজক ক্যালকাটা ক্লাবে নিয়ে গেছিল। বেসামাল ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা একটা তো হয়েছেই। গাড়ির ভেতর শুভংকর কত কি কান্ড ঘটাচ্ছিল। ঘাড়ে চুমু খাচ্ছিল, মুখে চুমু খাচ্ছিল। নিশা ঠোঁট বাঁচিয়ে যাচ্ছিল লাস্য দিয়ে। শুভংকর কাল পুরো আউট ছিল মনে হয়। না হলে তো এমন করে না। গাড়িতে বুকেও হাত দিয়েছে। খুব জোরে একবার চটকে দিয়েছে। বেশ ব্যথা। নিশা রৌণক ছাড়া কাউকেই শরীর দিতে মন থেকে সাড়া পায় না। এমনকী স্বামীকেও। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রোগ্রাম করে মাঝে মাঝেই বেশি রাতে ফেরে নিশা। ফলে পরের দিন ওকে তেমন কেউ ডাকে না। আজ কলকাতায় ভোরের ফ্লাইটে এসেই দু-তিনবার বাজিয়েছে রৌণক। নিশা ফোন তোলেনি। সাইলেন্সে আছে। ঘুমও ভাঙেনি। রৌণক ভাবছে কী হল রে বাবা! ফোন ধরছে না কেন! অভিমান খুব বেশি কি জমে গেছে! তা না হলে ওর ফোনের জন্য তো মুখিয়ে থাকে নিশা!

ব্যাপারটা টের পায় নিশা বেলা দুটোর পর। দেড়টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে স্নানটান করে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। দু’পিস ব্রেড-বাটার গোলমরিচ দিয়ে নিয়েছে। হাফ আপেল। এটাই লাঞ্চ। আজকাল মদ্যপানের বহর যেভাবে বেড়ে গেছে মধ্যপ্রদেশে স্ফীতির একটা ভাব ধরা পড়ছে। নিশা জানে শরীর চলে গেলে অনেক কিছুই চলে যাবে। যেখানে যতটুকু নামডাক– তাও থাকবে না। তখনও থ্রি-স্টেপ চুল থেকে দু-এক ফোঁটা জলকণা উঁকি মেরে গ্রীবার চিকন লাবণ্যে ঝাঁপ খেলছিল। এরকম একটি ফোঁটা টেবিলে রাখা মোবাইলের উপর পড়তেই নিশা ওটা শাড়িতে মুছে দিতে গিয়ে দেখে অনেকগুলো মিস্ড কল। খুলতেই দেখে রৌণক বাজিয়েছে। আরে আজ এতগুলো ফোন করেছে রৌণক! আর ও কিনা ফোন ধরেনি! নিশ্চয়ই আহত হয়েছে। কিছু ভাবনা ভেবে নিয়েছে। তড়িঘড়ি রিং ব্যাক করে। দেখে সুইচ্ড অফ্।

বিকেলে রৌণকই ফোন করে আবার। কী হলো, ফোন ধরছ না যে নিশা? এনগেজ আছ?

আরে না না, ঘুমিয়ে ছিলাম, শুনতে পাইনি। তুমি তো জানো আমি একটু দেরি করে উঠি। আর গতকাল রবীন্দ্রসদনে আমার একক গানের অনুষ্ঠান ছিল। ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ রাত। তাই… তা তুমি কেমন আছ? ফোন করলে যে বড়ো!

কেন আমি ফোন করতে পারি না? গলায় একটু অভিমান লাগায় রৌণক।

না, আমি তা বলিনি! সচরাচর তুমি তো করো না। শরীর ঠিক আছে তো? খবরের কাগজে দেখলাম মুম্বই তো জলের তলায়। তুমি নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে বের হতে পারোনি। তাই আড্ডা মারার জন্য ফোন করেছ। বেশ বেশ। আমার ভালো লাগল।

আরে মুম্বই কেন, আমি তো তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে।

মানে?

মানে আমি এখন কলকাতায়। আর মোদ্দা কথাটি হল যদি তেমন ব্যস্ত না থাকো, গাড়ি বার করো, সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে হোটেল ব্রডওয়ে, মানে র্ব নং গনেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ-এর ব্রডওয়ে হোটেল, আমার রুম নম্বর চ্জ্ঝ। সেকেন্ড ফ্লোরে। চলে এসো।

নিশার শরীরে একটা আশ্চর্য কাঁপন। কতদিন হল রৌণক, তার রৌণককে সে চোখের দেখাটিও দেখতে পাচ্ছে না। বছর দেড়েক তো হবেই। মনে মনে একবারে আর্ত হয়ে আছে। কিন্তু নিজেকে ধরা না দেবার ঈপ্সায় নিশা বলে– আজ না এলে হয় না! কাল যদি দুপুর দুপুর আসি!

সশব্যস্ত হয়ে রৌণক বলে– একদম অন্যথা কোরো না। কাল বিকেলের ফ্লাইটে আমি ফিরে যাচ্ছি। আর শোনো তোমাকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাই। তোমার কেরিয়ারের জন্য দেখো খুব একটা বড়ো স্টেপিং হবে। চলে এসো।

রৌণক ফোন রাখতে না রাখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিশা। কতদিন বাদে রৌণকের সামনে যাবে। কী শাড়ি পরবে, কেমন করে সাজবে– হাতে তো মাত্র দেড়টি ঘণ্টা সময়। রৌণকের খুব পছন্দ সমুদ্র-নীল শাড়ি। ওই রঙের শাড়ি পরে যতদিন দেখা করেছে, ততদিনই আবেগে কলকল করেছে রৌণক। কত না গান শুনিয়েছে, ছোটো ছোটো মিড়ের কাজ, ঝিলিক দিয়েছে চোখের তারায়। নিশার একটা বিশেষ গুণ আছে, ও ঠোঁট ভালো করে প্রেজেন্ট করতে জানে। অর্থাৎ দিন-রাত্রি, সময়-টময় মেপে ঠোঁটের সীমানা কমিয়ে বাড়িয়ে তাতে আশ্চর্য আরোপ করা। এছাড়াও নিশা আজ ঠিক করল নীল আংটিটা পরবে।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মেক-আপ নিয়ে আয়নার সামনে একবার পাক খেয়ে নিজের সৌন্দর্যের উপর আস্থাশীল থাকল সুন্দরী। শাড়ির নীলাভ মায়ার আড়ালে নিজের নিক্তিমাপা বুকের আধখানা দেখে নিজেই কিছুটা যেন আসক্ত, পুলকিত। এখনও মনেই হয় না তার বিয়ে হয়েছে। তার একটা ছেলে আছে ক্লাস এইটে পড়ে। নিশার এখনও মনে হয় সে যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচারের ছাত্রী। আর সে মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুদের। এমনিতেই লাস্য ছড়ানোর একটা সাবলীল আবহ তার অধিগত। নিশা তার বিখ্যাত জুঁই ফুলের এসেন্স ছড়িয়ে কপালের উপর থেকে নেমে আসা একগুচ্ছ অলকচূর্ণকে একটু হাওয়ায় উড়িয়ে দেখে নিল পুনরায়। মনে মনে হাসল– আজ রৌণককে পাগল করে দেবে। আজ অবহেলার জবাব নেবে। নিশা দেখল আজ সব মিলিয়ে পারফেক্ট অ্যাপিয়ারেন্স তার।

পাকা গমের রং চকচক করে আছে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে। মুখ যেন গর্জনতেল মাখা দেবীপ্রতিমা। মাথায় ধবধবে সাদা একরাশ চুল, এলোমেলো। কালো জিনস্, কালো টি-শার্ট। উজ্জ্বল, গভীর কালো চোখে রিমলেস চশমা। রৌণক পাশেই বসে আছে, কিন্তু হোটেলের ঘরে ঢুকে বেশ খানিকটা সময় ধরে নিশার চোখ তাকে ফোকাস করতে পারেনি। রৌণক পরিচয় করাল– ইনি মিস্টার হিম্মতসিংকা, অসমের বিখ্যাত ব্যবসায়ী।

হিম্মতসিংকাও নিশার চোখে চোখ রেখে হাত জোড় করলেন। বেশ কিছুক্ষণ তিনজনই দাঁড়িয়ে ছিল। রৌণক বলল– বসো নিশা। ফোনে ওনার কথাই তোমাকে বলছিলাম। ওঁর জন্যই আমি মুম্বই থেকে কলকাতায় এসেছি। উনি এখানে সিনেমা প্রোডিউস করছেন একসঙ্গে অনেকগুলি। হিম্মতসিংকা থামিয়ে বলে– হ্যাঁ, ছ’খানা বাংলা ছবি আমি করব এ বছরই। আপনার কথা আমি শুনেছি মিসেস মুখার্জি, আপনি ভালো গান করেন। রৌণকবাবু তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আসুন না, আপনিও আমাদের সাথে কাজ করুন। কী রাজি তো!

নিশাকে কোনও কথা বলতে দেয় না হিম্মতসিংকা। এমনিতেই ওই প্রৌঢ়-র রূপ ও ব্যক্তিত্বের ছটায় ঘোর লেগে আছে নিশার চোখে। রৌণকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে নিশা কিন্তু এখনও রৌণককে ফোকাস করে উঠতে পারেনি। গাড়িতে আসতে আসতে একটা আন্দাজ করেছিল কিছু একটা সুযোগ-টুযোগ আসতে পারে। কিন্তু এত দ্রুততায় সেসব!

নিশা মাথা একদিকে কাত করে সম্মতির ইঙ্গিত দিতেই ভদ্রলোক ব্রিফকেস থেকে চেক বই বের করে অ্যাডভান্স করলেন। পাঁচ লাখ। প্রথম ছবির ফিমেল ভয়েস নিশারই। কী মিস্টার সেন, ঠিক আছে তো?

সার্টেনলি ও কে।

রৌণকের দিকে একটা ব্ল্যাংক চেক এগিয়ে দিয়ে হিম্মতসিংকা বললেন– আমার ছ’টা ছবিরই সুরকার, সংগীত পরিচালক আপনি। অ্যামাউন্ট বসিয়ে নিন। কাল সকালে আমার সেক্রেটারি কনট্র্যাক্ট সই করিয়ে নিয়ে যাবে।

তারপর নিশার দিকে তাকিয়ে বলল– আপনার কনট্র্যাক্ট ফর্মও কাল আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। হিম্মতসিংকাকে একপ্রকার থামিয়েই রৌণক বলে– ওকে আজই সই করিয়ে নিন। ওর বাড়ি তো আপনার হোটেলের রাস্তাতেই। বেহালায় থাকে। আপনি তো তাজ-এ উঠেছেন। ওই পথেই যাবে।

ব্রডওয়ের লবি পর্যন্ত নিশা ও হিম্মতসিংকাকে এগিয়ে দিল রৌণক। –গুড নাইট নিশা, পরে ফোনে কথা হবে। এই কনট্র্যাক্ট-টা সই করেই যাও।

নিশা তখনও ভেবে উঠতে পারছে না ঘটনার পরম্পরা। কী একটা টানে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। রৌণকের সাথেও একটু একান্তে কথা বলতে পারল না। অথচ কত কী ভেবেছিল। কত কী আদর করবে রৌণককে। বুকে মুখ ডুবিয়ে হাউহাউ কাঁদবে ভেবেছিল। কিন্তু তা না হয়ে এখন হিম্মতসিংকার গাড়িতে উঠতে হবে তাকে। তার গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে যাবে। নিশা দেখল রৌণক অন্যরকম হয়ে গেছে। অবলীলায় হিম্মতসিংকার সামনেই সই করা ব্ল্যাংক চেকে প্তঙ্ম লাখ বসিয়ে নিয়েছে। নিশার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। কেবল কত তাড়াতাড়ি হিম্মতসিংকার গাড়িতে তুলে দেবে তাই যেন ভাবছিল। নতুন কাজ পাবার আনন্দ তেমন করে লাগল না নিশার। বদলে কী এক শূন্যতা চোখের তারায় নিয়ে একবার মুখ ঘুরিয়ে চোখাচোখি করল রৌণকের।

অনেকখানি খরচা হয়ে গেল কালিশংকরের। গজগজ করতে লাগল। ফ্ল্যাটের নীচেই ওষুধের দোকান সন্তোষ মেডিকো। ফোন করে মেডিকেল শপের ছেলেটিকে দিয়ে নিয়ে এল ক্রেপ ব্যান্ডেজ, ব্যথা কমানোর জন্য ক্রোসিন অ্যডভান্স। ওতে দুরকম সুবিধা, জ্বর আসাটাও প্রোটেক্ট হবে। ডাক্তারখানার ছেলেটা তার উপর একটা স্প্রে ওষুধ দিল। সাড়ে চারশো টাকার ধাক্বা। তারপর আরও রচ্প্ত টাকা খরচ করে ট্যাক্সি করে অফিস আসতে হয়েছে তাকে। পায়ে ব্যান্ডেজ, খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসতে দেখে অফিসের লোকেরা তো হইচই বাধিয়ে চেয়ারে বসাল তাকে। তারপর সব বৃত্তান্ত শুনে নিবাসই বলে বসে– এলেন কেন, এই ভাঙা পা নিয়ে কেউ অফিসে আসে? যান, বাড়ি গিয়ে ভালো করে ডাক্তার দেখান, এক্সরে করান। কালিশংকর একবার নিবাসের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘ’ষে– তাহলে তোমার বিশেষ সুবিধা হয়। আমার ভাগটা পুরোটাই ঝেড়ে দেবার ধান্দা। মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট ওদের তিন জনের মধ্যে ভাগ হয়– রেকর্ডকিপার, পিওন আর ফ্রাঞ্চাইজির ছেলেটা, যে কম্পিউটারে বিল লোড করে। থ্রি পার্সেন্ট নেবে ক্যাশিয়ার। চিফ্ এগ্জিকিউটিভ সিক্স পার্সেন্ট। ওটা গত একবছর ধরে টেন পার্সেন্ট হয়েছে। অন্য এগ্জিকিউটিভ শাক্যদেবের ফোর পার্সেন্ট এই এগ্জিকিউটিভ নিয়ে নেয়। আর আড়ালে সবাই শাক্যদেবকে বোকা, গাধা বলে হাসে। শাক্যদেবও মাঝেমধ্যে হাসেন যখন গ্রুপ ডি ইউনিয়নের নেতা কর্মিরা বাবা-মা তুলে সবার সামনেই ক্লাস ওয়ান অফিসার চিফ্ এগ্জিকিউটিভকে ডাঁটে। ঘুসখোর, চোর বলে তাকে আটকে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

চিফ্ এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারও আজ এসেছেন। আজ ভরা অফিস। শ্যাম বারে বারে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে আসছে। অবশ্যই কন্ট্রাক্টরদের পয়সায়। চেক লেখা হচ্ছে আর হিসাব মতো অডিটর, ক্যাশিয়াররা টাকা পেয়ে যাচ্ছে। কালিশংকরদের হিসেব হবে সবার শেষে। তা সন্ধ্যা সাতটা তো হয়ে যাবেই। কিন্তু এখন তো সবে পাঁচটা। আর পারছে না তো সে। খুব যন্ত্রণা করছে পায়ে। বসে থাকা যাচ্ছে না। মাথাটা দপদপ করছে। জ্বর এল বলে। তবে কি ভেঙেছে! দুশ্চিন্তা হচ্ছে কালিশংকরের। বাড়ি ফিরবে কীভাবে! বাড়ি ফিরল না হয়, কিন্তু রাতে ডাক্তার পাবে কোথায়! বউ তো কোনও হেল্প করতে পারবে না। কেবল চ্যাঁচাবে। একমাত্র সন্তান মেয়ে, সেই বেহালায় থাকে, তাকে তো রাতবিরেতে এই সামান্য কারণে ডেকে পাঠানো যায় না! তারও তো ঘর গেরস্থালি আছে। তা-ছাড়াও তার মেয়ে যে গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তা-ও জানে কালিশংকর। বেহালা থেকে বালিগঞ্জ খুব একটা দূরের নয়। কিন্তু জামাইবাবাজি অত রাতে… কী ভাববে… সাত-পাঁচ কালিশংকরের সামনে সমাধান ধরা দিচ্ছে না। বরং সকাল থেকেই আজ সবকিছু প্রতিকূল। মেয়ে নিশার গাড়ি আছে, তাকে কি এখনই বলে দেবে একবার গাড়ি পাঠিয়ে একটু অফিস থেকে নিয়ে যেতে! কিন্তু এখন বললেও বিপদ– হয়তো এখনই গাড়ি পাঠিয়ে দিল। তার ভাগ-বাটোয়ারা তো সেই সাতটার পরে।

এক কাপ চা খাওয়াল শ্যাম। কিন্তু বিস্বাদ লাগছে। সেই থেকে ক্যাশিয়ারের ঘরের সামনেটায় বসে আছে। বিশেষ নড়াচড়া করতে পারছে না। কিন্তু এক একজন কন্ট্রাক্টরের নাম আর চেক অ্যামাউন্ট লিখে রাখছে একটা কাগজে। আজ মুখ বিকৃত হচ্ছে তার। একবার খেঁকিয়ে ওঠে ক্যাশিয়ারের উপরঃ আর কত সময় লাগাবি! একদিনও কি তাড়াতাড়ি শেষ করতে নেই! সাড়ে ছ’টার সময় আর পারছিল না কালিশংকর। মেয়েকে ফোন করে বলে দিতে হবে, না হলে আজই যন্ত্রণায় মরে যাবে সে। বাড়ির কাছেই রুবি হাসপাতাল। রাত্রে বরং ওখানেই ভর্তি করে দিক। ওরা ওষুধপত্র দিয়ে কিছু একটা করতে পারবে, যন্ত্রণা কমাতে পারবে। কিন্তু নিশাকে ফোন করে দেখল, ফোন সুইচড অফ। সন্ধ্যা সাতটায় সুইচড অফ কেন? দু-তিনবার ইলেকট্রনিক শীতল সুইচড অফ ঘোষণার পর বাড়িতে, ল্যান্ডলাইনে বউকে ফোন করে নিশাকে ফোন করতে বলল। নিশার শ্বশুড়বাড়িতে ল্যান্ডে ফোন করে তারপর বউ জানাল নিশা শুটিং-এ গেছে। আর তা-ই ফোন অফ্ রেখেছে।

রুবিতে নয়, অফিসের গাড়িতে ডিসানে নিয়ে এসেছে কলিগেরা। রাত সাড়ে আটটা। ডিসান ওদের রিকগনাইজড হসপিটাল। পয়সা লাগবে না। মেডিকেল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি করে দেওয়া গেল।

কালিশংকর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। সবাই যে যার মতো হিসেবনিকেশে ব্যস্ত থাকায় কেউই তেমন করে ওর মুখের দিকে চায়নি। না হলে যন্ত্রণা তো ফুটে উঠেছিল সেখানে। জ্ঞান হারিয়ে যখন চেয়ার থেকে সশব্দে পড়ে যায় তখনই সকলের চোখে পড়ে। ধরাধরি করে এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের গাড়িতে তুলে এখানে নিয়ে আসা গেছে। এমার্জেন্সির ডাক্তার দেখে তো খুব ধমকালেন। এরকম মেজর ফ্র্যাকচার এতক্ষণ রেখে দিতে আছে! এক্সরে-তে দেখা গেছে গোড়ালির হাড়ে অনেকগুলো টুকরো হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। তবে রাতে তো আর অর্থোপেডিক সার্জনকে পাওয়া যাবে না। ডাক্তার গুপ্ত কলকাতার বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন। কাল সকাল ন’টায় সময় দিয়েছেন। কালিশংকরকে ঘুমের ইনজেকশন, ব্যথার ওষুধ, আর একটু অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে ততক্ষণ ফেলে রাখা হবে।

মণিজিঞ্জির জায়গাটা একবার দেখে নিতে এসেছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে এপ্রিলের রোদ। দুপুর দুটো-আড়াইটে হবে। তাড়াহুড়োয় ঘড়ি পরে আসতে ভুলে গেছে। রেলের গুমটি থেকে খাকি হাফপ্যান্ট পরা এক মাঝবয়সি লোক পিটপিট করে তাকাচ্ছে। অদ্ভুত এই জায়গাটা। দুটো রেল স্টেশন আর একটা জাতীয় সড়ক লোকালয়ের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। একটা পাকদণ্ডি পথ ওই রেলগুমটির পাশ থেকেই নীচে নেমেছে। অটো ট্যাক্সিতে বড়ো রাস্তায় অনেকে নেমে ওই শর্টকাট অ্যাভেল করে। দিনের বেলায় কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই যে সন্ধ্যা থেকেই গুমটির চার পাশটা ছোঁক ছোঁক করে উঠবে চোলাই খদ্দেরদের আগমনে। দিন সাতেক আগেও বসের গাড়িতে লিফট্ নিয়ে এই পথেই রাত সাড়ে আটটায় বুক ঢিপঢিপ করতে করতে বাড়ি ফিরেছে। আজ ভয়ডর নেই, বা বলা চলে একটি ডেসপারেট অ্যাটেম্প নেবে বলে মণিজিঞ্জির মহড়া দিতে এসেছে এখন। সারদা স্ক্যামের সাথে তাদের কোম্পানি জড়িয়ে ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য, জড়িয়ে গেল এবং ছোবল এল তারই মস্তকে।

সারদাগোষ্ঠীর কাগজ সকালবেলা বন্ধ হয়ে গেছে। সকালবেলার একটি মেয়েকে চাকরি দেওয়ায় মণিজিঞ্জিরকে স্যাক্ করল কোম্পানি। মুখে সহানুভূতি বইয়ে দিয়ে বললঃ অত দূর থেকে আসো, এত কম স্যালারিতে তোমার পোষাবে না। তুমি বরং কাছাকাছি কিছু একটা দেখে নাও। এক কথায় খতম। কিন্তু বাবার পেনশনের টাকায় হার্টের অসুখের চিকিৎসা-সহ সংসার চালানো অসম্ভব ব্যাপার। গত চার-পাঁচ দিনে ঘুরে কিচ্ছুটি জোগাড় করতে পারেনি। প্লেন গ্রাজুয়েট, বাংলা ডিটিপি জানে, আর খবরের কাগজের অফিসে দুবছর ডেস্কে কাজ করেছে– এই। এতে কিছুই হবার নয়। নকরি ডট কমে দিয়ে রেখেছে সিভি। ডিপ্রেসড হয়ে যখন একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন আজ সকালবেলায় খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই মাথায় ঢুকে পড়ল এই মতলব। সরকার ঘোষণা করেছে ধর্ষিতদের এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই লক্ষের মধ্যে। বয়স অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ। যার বয়স যত কম সে তত বেশি ক্ষতিপূরণ পাবে। মণিজিঞ্জির গত ফেব্রুয়ারিতে চ্চ্ছ্র বছর পার করেছে। ফলে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী তার হক লক্ষাধিক টাকার। মণিজিঞ্জির ভাবল এটা কি সরকারি ঘুস! না ল-অ্যান্ড অর্ডারের বিকল্প এটি! সেদিন তো চ্যানেল দাপিয়ে এক বুদ্ধিজীবী বলে বেড়াচ্ছিলেনঃ ধর্ষণ থাকবেই, ধর্ষণ মানুষের ইনস্টিংক্ট, তাকে চাপা দেওয়া যাবে না।

সত্যি সত্যি একটা বোটকাগন্ধ নাকে লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। গুমটির পাশ দিয়ে নামতে নামতে তবু খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া মাটির পথ। পথের পাশে ভূতভৈরবীর ঘন ঝোপ। এমনিতে জায়গাটা নির্জন। এই পথে যেতে দু দুটো রেললাইন পেরোতে হয়। ফলে তেমন বিশেষ লোকজন হয় না এই ঝুঁকির রাস্তায়। রাতে আরও অন্য হয়ে যায় এই স্থান। মুখে কাপড়চাপা দিয়ে টেনে নিয়ে গেলে কেউ টেরটি পাবে না। কিন্তু, মণিজিঞ্জির ভাবে, যদি মেরে ফেলে তাকে, তবে তো বাবা-মাকে দেখার লোক নেই কেউ। আগে ধর্ষণ ছিল, কিন্তু ধর্ষণ করে খুন করে ফেলাটা আজকাল রেওয়াজ হয়ে গেছে। একটু বুক কাঁপে। যদি চার পাঁচজন মিলে লাইনে ফেলে ট্রেনে কাটা দেখিয়ে দেয়। শিয়ালদায় লাশকাটা ঘরে রেলপুলিশ অনুসন্ধান করতে যাবে না ধর্ষণ কি না। ফলে বাবা-মা টাকাটাও তো পাবে না। সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু ওখানে যারা থাকে সব চোলাই খেতে খেতে বুকের খাঁচা হারানো প্যাংলা লোকজন। ওদের সাধ্য হবে না, মানে মনে জোরও হবে না খুন করে ফেলার। নেশার ঝোঁকে বড়ো জোর রেপ করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে চার-পাঁচজনকে অ্যালাউ করতে হবে। দেখা যাক। একবারই তো। রং মেখে এসকর্ট সার্ভিসে যারা প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে তাদের অবস্থাটা একবার অনুমান করার চেষ্টা করল মণিজিঞ্জির। না না রোজ রোজ ওই মৃত্যু সে ডেকে আনতে পারবে না। একদিনের ঘটনা দুর্ঘটনা হিসেবেও মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গোটা জীবন শরীর ব্যাবসায় লাগিয়ে দিতে পারবে না।

মুখোমুখি ধাক্বা যাকে বলে তা-ই। লোকটার হাতের ফাইল ছিটকে গেছে। চশমা বাঁচাতে কোনওদিকে না তাকিয়ে লোকটা তরতর করে নেমে যাচ্ছে নীচে। মণিজিঞ্জির মাটিতে বসে পড়েছে, চোখে সরেষেফুল ফুটেছিল কয়েক সেকেন্ড। কপালে ব্যথা করছে। নিশ্চয়ই ফুলে ঢোল। ব্যথায় কান্না পাচ্ছে। লোকটার দোষ নয়। অন্যমনস্ক হয়ে নাকমুখ চাপা দিয়ে, হয়তো ওড়নায় চোখও ঢেকে গেছিল, এই জায়গাটা দ্রুত  পার হতে গিয়ে এই বিপত্তি। লোকটা চশমাটা বাঁচিয়ে ফেলেছে। দুপুরের রাস্তা ফাঁকা হলেও বালির লরি চলাচল করে। মণিজিঞ্জির একা একা উঠতে পারছে না, কারও হাত চাই টেনে তোলবার। এমনিতেই জায়গাটায় ঢাল। হাত পা কাঁপছে। লোকটা চশমা কুড়িয়ে ফের উঠে আসছে। ভালো করে তাকাতে পারছে না মণিজিঞ্জির। কপালে খুব যন্ত্রণা। ভাবে, কেন যে মরতে এসেছিলাম। লোকটা কি তাকে একটু উঠতে সাহায্য করবে, না কি গালাগাল দেবে! মুখের দিকে তাকাতেও সাহস হচ্ছে না। ওর ফাইলের কাগজপত্রও তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। খুব ভয় লাগছে, চড়-ফড়ও কষিয়ে দিতে পারে। এই গনগনে দুপুরে কেউ কোথাও নেই তল্লাটে। মণিজিঞ্জির দম বন্ধ করে, মাটির দিকে চেয়ে লোকটার উপরে উঠে আসা দুটো পা-কেই শুধু দেখতে পায়।

খুব লেগেছে ম্যাডাম? সো সরি। গলায় খুব স্নিগ্ধতা। কোত্থাও কোনও ঝাঁঝালো ভাব নেই। আসুন, আমার হাতটা ধরে ওঠার চেষ্টা করুন। গলাটা চেনা চেনা লাগছে মণিজিঞ্জিরের। কিন্তু তেমন করে চোখ খুলতে পারছে না। ডানদিকের ভ্রু-র উপর এমন ফুলে উঠেছে, চোখ মেলতে গিয়ে টনটন করছে। ওঠা দরকার। অনন্তকাল তো এখানে রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা যায় না! হাত বাড়িয়ে দিতে খুব যত্ন করে লোকটা তুলে দিল। তারপর বললঃ একটু দাঁড়ান, আমি কাগজপত্র তুলে নিই, আপনাকে বাসস্ট্যান্ড পেৌঁছে দিচ্ছি।

নীচে বাসস্ট্যান্ডে একটা চা-এর দোকানের বেঞ্চে বসাল তাকে। আপনার ব্যাগে রুমাল আছে? লোকটা জিজ্ঞাসা করে। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে দিতেই পাশের দোকান থেকে বরফের পেটি থেকে কয়েক টুকরো তাতে নিয়ে কপালে চাপা দিয়ে ফোলা ভাবটা কমাতে চায়। লোকটার হাতে কী যেন জাদু আছে। কপালে হাতের ছোঁয়া পেতেই কেমন আশ্চর্য ভালোলাগা এসে উপস্থিত হল সমস্ত অনুভূতিতে। মনে মনে সমর্পণের ভাব এল। গত কয়েকদিন ধরে চাকরি হারাবার পর পাগলের মতো নতুন চাকরি খোঁজা। বাবার অমন ভঙ্গুর দশা, দাদা-র বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতি– সব কিছু তার উপর অক্টোপাসের আকার নিয়ে ঘিরে ধরেছিল। সমস্ত স্নায়ুগুলো জট পাকিয়ে উত্তেজনায় টানটান ছিল। এই মুহূর্তে সে সব উধাও হতে চাইছে। যেন কোনও আশ্রয় এসে উপস্থিত। এই ভালোলাগা থেকে মণিজিঞ্জির শরীরের সমস্ত প্রতিরোধ ছেড়ে দিল আর ওই অচেনা লোকটির হাতের উপরেই সে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ল।

চোখ মেলে মণিজিঞ্জির নিজের বিপন্নতা খোঁজার চেষ্টা করল। আঃ সে বেঁচে আছে। ধর্ষণকারীরা তার গলা কেটে রেললাইনে ফেলে দেয়নি। সরকারের ঘোষিত ক্ষতিপূরণের টাকা কয়টা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। হাত-পা ছড়িয়ে বড়ো করে একটা শ্বাস নিতে গিয়ে দেখল হাতে স্যালাইনের সূচ টনটন করে উঠেছে। উলটো দিক থেকে নার্স হইহই করে উঠল– হাত-পা ছুড়ছেন কেন, স্যালাইনের পাইপ ছিঁড়ে যাবে যে! আর একটি কণ্ঠস্বর মাথার পেছন থেকে জেগে উঠলঃ যাক, জ্ঞান ফিরেছে। মণিজিঞ্জিরের চিত হওয়া চোখের মণি একটু ঊধর্বমুখী করতেই মনে হল, এই মুখ তো সে চেনে। লোকটির মুখের প্রসন্নতা থেকে আস্তে আস্তে মণিজিঞ্জির বুঝতে পারছে সে এখন কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের বেডে রয়েছে।

লোকটি জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে? খুব কষ্ট হচ্ছে না তো! মণিজিঞ্জির মাথা নেড়ে জানায়, তার কষ্ট হচ্ছে না। তার মনে পড়ে যায় কপালের আঘাতের কথা, দুপুরের ওই নিজেকে বিনিয়োগের অ্যাডভেঞ্চারের কথা। আর ভাবতেই ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠল। মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠল ফের। তাকে তো ফের যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে। এই সমাজ তো তাকে হিংস্র চিতার মতো তাড়া করে ফিরবে। তার অমন ব্রিলিয়ান্ট দাদা কোথায় আজ… কোথায়!

মণিজিঞ্জিরের এই মুখের ভাবের পরিবর্তনে শঙ্কিত ও ত্রস্ত হয়ে লোকটি মাথার কাছ থেকে ঘুরে এসে পাশে দাঁড়াল। কপালে হাত রাখলঃ খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার?

সন্ধ্যা সাড়ে ছটা সাতটা হবে। সেই দুপুর থেকেই লোকটা রয়েছে তার সঙ্গে। প্রথমদিকে মণিজিঞ্জির জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর লোকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সুন্দরী যুবতিকে একলা ফেলে রেখে যাবে– সে ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল, যদি রাস্তাঘাটের লোকজনেরা কিছু একটা অ্যালিগেশন দিয়ে তাকে চার্জ করে তবে! এই অঞ্চলে তার বিশেষ প্রভাব-ট্রভাবও নেই। যেটুকু ওই কর্মস্থলে। ওখানে খবর পেৌঁছানোর আগেই রাস্তার লোকজনেরা মেরেধরে তার সবটুকু কেড়ে নেবে তো বটেই উপরন্তু কোনও কথা না শুনেই মানুষজন তাদের বেসিক হিংস্রতার ইনস্টিংক্ট প্রকাশ করবে। আর গণপ্রহারে খুব দ্রুত জায়গা হবে পুলিশ মর্গে। আর যদি বেঁচেও যায় পুলিশে ছুঁলে তো এখন ছত্রিশ ঘা। উর্দিপরা মস্তান তারা। যা কিছুই হয়ে যেতে পারে। ফলে দুপুর বেলায় মণিজিঞ্জির জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর মাথা ঠান্ডা রেখে লোকটি চায়ের দোকানের লোকজনেরই সাহায্য নিয়েছিল নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে। শুধু চায়ের দোকানে নয়, নার্সিংহোমেও নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে হয়েছে। লোকটা ভাবছিল মণিজিঞ্জিরের জ্ঞান এলেই একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। না হলে যদি বেফাঁস কিছু বলে ফেলে! নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ তো পুলিশকে ডাকবে। সে বিস্তর হ্যাপা। মণিজিঞ্জির চোখ মেলতেই লোকটি নার্সকে রুমের বাইরে পাঠিয়েছে। এবার একটি টুল টেনে এনে পাশে বসে মাথায় হাত রাখল। আর ধীর স্বরে মণিজিঞ্জিরকে বললঃ দেখুন, আমি আপনার কপালে হাত  দিতে বাধ্য হচ্ছি, না-হলে ওরা বুঝবে না আমরা স্বামী-স্ত্রী।

মণিজিঞ্জির চোখ কপালে তুলে অস্ফুটে বলে, তার মানে!

দেখুন তেমন বিশেষ কোনও মানে নেই। আমি শাক্যদেব মুখোপাধ্যায়। আমি একটি কর্পোরেট সেক্টরে এগ্জিকিউটিভ। আপনাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েই এখানে আমি ভর্তি করেছি। আমার কোনও উপায় ছিল না। আপনার নাম দিয়েছি আলোকণা মুখোপাধ্যায়। ফর্ম ফিলাপ করতে হয় তো। যা মনে এসেছে তা-ই বসিয়ে দিয়েছি। আমার অপরাধ নেবেন না। প্লিজ!

এই প্রথম, কত বছর বাদে সে কাঁদতে পারল ঠিক মনে নেই। দুঃখ জমতে জমতে পাথর হয়ে গিয়েছিল। দাদা হারিয়ে যাবার পর একবার কেঁদেছিল অজানা ভবিষ্যতের ভয়ে, আর কাঁদেনি সে। মণিজিঞ্জির এবার নিজে লোকটির হাত চেপে ধরল। নিজের মুখের উপর চেপে ধরল। আর অনর্গল রচিত অশ্রুতে দুটি হাতই তখন ভিজে সপসপ। লোকটিও হঠাৎ এই কান্নায় আরও আকুল হয়ে গেল।

কাঁদবেন না প্লিজ। শারীরিক ভাবে তো দুপুরে আপনাকে আহত করেছিই কিন্তু মানসিক দিক থেকে আমি যদি আপনাকে আহত করে থাকি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

মণিজিঞ্জির এইবার চোখ মুছে খুব সংক্ষেপে দুপুরের দুর্ঘটনার আগের তার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বর্ণনা রাখল লোকটার কাছে। তার দাদার গৃহত্যাগের ঘটনার কথাও বলল। লোকটা মণিজিঞ্জিরের হাত শক্ত করে ধরে বললঃ আপনি সুন্দরী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে এভাবে নিজের জীবনকে নষ্ট করতে আছে! না না আপনাকে মানায় না। আর আপনার বাবা-মা-র কথা ভাবলেন না! আপনার অবর্তমানে তাঁরা কীভাবে বেঁচে থাকবেন! আপাতত আপনি আমাকে বন্ধু মানুন, ভালো বন্ধু। তারপর দেখছি কী করা যায়। কিন্তু আপনাদের ফেলে রেখে আপনার দাদার পালিয়ে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছি না।

দেখুন প্রথম প্রথম আমিও পারিনি। কিন্তু পরে বোঝার চেষ্টা করেছি কতটা নিজের ভেতরে ছিন্ন হয়ে গেলে শুধু তো পরিবার নয়, তার ভালোবাসার জগৎ– সাহিত্য জগৎ থেকেও সে মুখ ফিরিয়ে নিল। শুধু তো বাংলা সাহিত্য নয়, সারা পৃথিবীর সাহিত্য নিয়ে তার অগাধ জানাশোনা। গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ কতখানি একে-অপরের পরিপূরক যেমন ভেবেছে তেমনি পাকিস্তানের ছোটোগল্পের উজ্জীবনে দেশভাগের কী ভূমিকা, সে নিপুণ বর্ণনা করত। যাদবপুরে কম্পারেটিভের প্রতিটি পরীক্ষায় সে প্রথম। ভেবেছিল বিদেশে যাবে আরও আলো পেতে। প্রাচ্যের জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে পাশ্চাত্যের কোথায় সংঘাত তাকে দেখতে হবে। জানেন, একদিন দাদা আর নিশার ভেতর খুব তর্কাতর্কি হচ্ছিল। দাদা আমাকেই সাক্ষী মানতে ডেকে আনে। নিশা বলছিল, মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় প্রাপ্তি কম বলেই তাকে অসৎ উপায় অবলম্বন করতে হয়। নীতিবোধ খুব একটা কাজের বিষয় নয়। ওটা বোকা মানুষদের একধরনের আপ্তবাক্য, ঢাল।

না, একদম নয়। যুগে যুগে সমস্ত আলোর যাত্রীকে তার গন্তব্য গুলিয়ে দেবার জন্য এরকমই দোলাচলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে সমাজ। দাদা প্রতিরোধ করেছে।

জ্ঞান দেবার সুযোগ পেলে না তুমি গল্পের গরু একেবারে গাছে তুলে দাও। নিশা একটা বাঁকানো হাসির সাথে কথাগুলো ছুড়ে দেয়। আর দাদা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেঃ একদম ঠিক। ওই গল্পটুকু আছে বলেই জগৎসংসার চলছে। আমাদের এই চরম স্বার্থসিদ্ধির জগতেও নীতিবোধ একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যায়নি বলেই তরুণ-তরুণীরা শান্তির জন্য সংগ্রাম করছে, প্রকৃতি রক্ষার জন্য যুদ্ধরত, একজন পপস্টার গাইছে ইথিওপিয়ার মানুষদের জন্য। কেন, এসব তো এঁরা না করলেও পারেন। এ ধরনের অনেক উদাহরণই প্রমাণ করে যে এই বস্তু-অধ্যুষিত স্বার্থোন্মাদ জগতেও এথিক্স মরে শুকিয়ে যায়নি।

দাদা পায়চারি করতে করতে যখন দিশাহারার মতো দুচোখে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে, তখন নিশা দাদাকে আরও রাগিয়ে দেবার জন্য প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে, অথচ যাতে সবাই শুনতে পায় তেমন উচ্চারণে, কপালে জোড়া হাতের গুঁতো মেরে বলেঃ হে ভগবান, হে মা মঙ্গলচণ্ডী, এই বিশিষ্ট নির্বোধটিকে একটু দেখো। বাঁচিয়ে রেখো। তারপর শব্দ করে কফির কাপে চুমুক দিয়েছে।

দাদা এবার প্রচন্ড রেগে গেছে। রেগে গেলে গলার স্বর আশ্চর্য ঠান্ডা হয়ে যেত তার! ঠিক নিশা, এই বহুবিজ্ঞাপিত নীতিশূন্য যুগে তোমার ওই প্রণাম ভঙ্গিটির কথাই বলেছেন বিশিষ্ট দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল। বলেছেন, রাজনৈতিক নেতা জনমত কেনার জন্য অবলীলাক্রমে নীতিধারীর মুখোশ পরে, টেকস আ মরাল পসচার। এবং এই বহুবিজ্ঞাপিত নীতিশূন্য যুগে যখনই সে ওই নৈতিক ভঙ্গি গ্রহণ করে, তখনই সে বাহবা পায়। রাজনীতিবিদরা যা ইচ্ছে তাই করছে কিন্তু পসচার-টি ছাড়ছে না। কেন? কারণ তারা বিলক্ষণ জানে যে এই সমূহ ভ্যাকিউম-এর যুগে এই পসচার নিতান্তই লাভজনক, বিশেষ করে সংখ্যাধিক্যের কাছে যারা ভঙ্গির পশ্চাতে উপস্থিত অভিসন্ধির খবর রাখে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মরাল পসচার বিজয়ী, শনিপূজার ক্ষেত্রেও পূজারি বা সংগঠক সেই একই পসচার দেখিয়ে সফল। এক সার্বিক শূন্যতাবোধের কাছে এরা আবেদন রাখতে পেরেছে।

নার্স এসে ইতিমধ্যে বলে দিয়ে গেছে ভিজিটিং আওয়ার শেষ, পেশেন্ট পার্টি যেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। শাক্যদেব মণিজিঞ্জিরের কথা শুনতে শুনতেই হাতের ইশারায় আরও পাঁচটি মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে।

জানেন, আমাকে বন্ধুর মতো ট্রিট করত। মণিজিঞ্জির বলে। সব বলত। নতুন কিছু জানলে আমাকে না জানালে তার শান্তি ছিল না। সব তো ঠিকঠাকই চলছিল। ক্লাসে তো ওর অনুরাগিনীদের মধ্যে এমন অসূয়া জন্ম নিয়েছিল যে প্রত্যেকে দেখাতে ব্যস্ত থাকত সে কতটা সারদাপ্রসাদের কাছের। সারদাপ্রসাদ মানে আমার দাদা। অনেকেই আমাদের বাড়িতে এসেছে। সবথেকে বেশি যে আসত সে হল ওই নিশা। খুব সুন্দরী। ভালো গান করত। আর তার আর একটি পরিচয় ছিল সে কম্পারেটিভের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের আত্মীয়া। দাদার কোনও শত্রু ছিল না। ছিল স্বপ্ন, বিদেশে যাবার এবং ভারততত্ত্বের উপর গবেষণা করার স্বপ্ন।

আপনাকে একটুও বাড়িয়ে বলছি না। মণিজিঞ্জির তখনও নিজের হাতের ভেতর শাক্যদেবের হাত ধরে রেখেছে। কেটলির মুখ থেকে যেভাবে গমকে গমকে বাষ্প বেরিয়ে আসে সেভাবেই মণিজিঞ্জির ভেতরে জমে থাকা অসহায়তার উত্তাপ একটুখানি সমর্থনের আবহে ঝিঁকিয়ে উঠেছে। গল্প থামায় না সে বা শাক্যদেবকে যেতে দিতে চায় না। বলে চলেঃ ফাইনাল পরীক্ষার আগে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ওদের বসু স্যার একদিন দাদাকে ডেকে পাঠায় নিজের ঘরে। বসো সারদাপ্রসাদ। শোনো এই বিভাগের সবাই জানে তুমিই গোল্ড মেডেলিস্ট হবে। তোমাকে ডিঙানোর ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু তোমাকে একটা কথা রাখতে হবে, এবছর তুমি পরীক্ষা দেবে না। এবছর থেকেই জার্মানির একটা বৃত্তি চালু হয়েছে। আমাদের বিভাগের প্রথম যে হবে সেই চান্স পাবে জার্মানিতে দুবছরের স্কলারশিপের। তুমি এবছর পরীক্ষা দেবে না। আমি চাই নিশা ওই বৃত্তিটা এবার পাক।

আকাশ ভেঙে পড়েছিল। নিশা তো ওর বন্ধু, একটু বেশি বন্ধু-ই। দাদা নিজের হাতে কত নোট্স বানিয়ে দিয়েছে! সেই নিশার জন্য কি না এতবড়ো একটা নেপোটিজম-এর কথা শুনতে হবে প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের মুখে! দাদা শুধু সেবছর নয়, আর যাদবপুরের পথ মাড়ায়নি। আর বিদেশ থেকে ফিরে এসে কম্পারেটিভ-এর ওদের ব্যাচেরই অন্য এক বন্ধুকে যখন বিয়ে করল নিশা। খবরটা শোনার পর দাদা খুব বেশিদিন ঘরেও থাকেনি।

আপনারা খোঁজখবর করেননি? শাক্যদেবের গলায় আকুলতার সাথে মণিজিঞ্জিরের দাদা সম্পর্কে নিজের ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশ করে ফেলার বিড়ম্বিত বোধ কেমন একটা ধরা ধরা গলা হয়ে একসাথে উঠে এল।

অনেক খুঁজেছি। পাগলের মতো খুঁজেছি। প্রাইভেট ডিটেকটিভও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু খোঁজ মেলেনি। তবে আমরা এখনও আশা করি, বিশেষ করে মা ভাবেন হয়তো কোনওদিন ফিরে আসবে দাদা। এবার আপনিই বলুন তো সমাজ নানা ছকে দিনের পর দিন ব্যক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে না, ধবংস করে দিচ্ছে না! বলুন না!

শাক্যদেব নার্সিংহোমের বিছানার সাদায় চোখ রেখে মাথা নাড়ে। ওই সাদায় কী এক অনন্ত শূন্যতা। সে জানে সমাজ কীভাবে এক একটি সুন্দর মনের গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। সে তো নিজেও এর শিকার। তার অফিসে চূড়ান্ত কোরাপশন। একা একা প্রতিরোধ করতে করতে সে ক্লান্ত। তার চোখের সামনে কালিশংকর বাবু, নিবাস মুনসি, শ্যাম পুরকায়েত, ড্রাফট্সম্যান পাল, অডিটর ভৌমিক, চিফ্ ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাশিয়ার কীভাবে দিনের পর দিন কন্ট্র্যাক্টরদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানির স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। আর তাকে, শাক্যদেবকে নিজেদের পথে না আনতে পেরে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পথে ঠেলে দিয়েছে। স্রোতের বিরুদ্ধে গোটা অফিসে সে একা। কিন্তু সব সময় সে টের পায় একটা দৃপ্ত আত্মা তাকে ঘিরে আছে। বিপদে বুকে আগলে রাখছে। মণিজিঞ্জিরের গল্প শোনার পর শাক্যদেব ভাবল, এই পরিবারটির পাশে তাকে দাঁড়াতেই হবে।

আস্তে আস্তে মণিজিঞ্জিরের হাতের ভেতর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে নিতে শাক্যদেব বলেঃ ডাক্তার কাল সকালে আপনাকে ডিসচার্জ করবে বলেছে। আমি সকাল দশটার মধ্যেই চলে আসব। আপনি কিন্তু মনে করে একবার আপনার বাড়িতে ফোন করে দেবেন। না হলে ওরা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করবে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ উত্তাল ওই একটি কথায়। চুদুরবুদুর। শব্দটি কাঁটাতার ডিঙিয়ে এপারে অস্বস্তি গোপন করতে পারে না। সাগ্নিককে ওই শব্দটির জন্য গোটা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে সেদিন। বন্ধুদের ফিক্ফিক্ পায়ের ব্যথা চারগুণ বাড়িয়ে দিয়ে টপটপ করে চোখের কোণ থেকে জল ঝরিয়েছে। শরীরের ব্যথা সহ্য করা যায়, কিন্তু অপমান সহ্য করা যায় না। পুপু-ই উসকেছিল, যা জিজ্ঞাসা কর শব্দটার মানে। গোপনে ওরা চিঙ্কি ম্যাম বলে ডাকে বাংলার টিচারকে। চোখ দুটো ছোটো ছোটো বলে ওই নাম তাঁর। আর রেগে যাবার পর তা আরও ছোটো হয়ে যায়। কোর্টের অর্ডার আর স্কুল কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ থাকার ফলে পেটাতে পারেন না বলে মাঝে মাঝে টেবিলে নিজেই ঘুষি মেরে নিজে আহত হন, বিশেষ করে যখন হিন্দি টাঙে বাংলা উচ্চারণ করে বাঙালি ছেলেমেয়েরা। সাউথ পয়েন্ট, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দের হিসেবে রাখতে হয়েছে সরকারি অনুজ্ঞায়। না হলে বাংলা পড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই গোয়েঙ্কাদের। বাংলা ম্যামের ভাষা প্রীতি আবার নজর কাড়ার মতো। তাঁর ক্লাসে কড়া নির্দেশ আছে বাংলা খবরের কাগজ পড়তে হবে প্রতিদিন ছাত্রদের। আর ক্লাসে কিছুটা সময় র্যাপিড রিডিং-এ তা থাকবে। ফলে তিনি প্রতিদিনই একটি দৈনিক সংবাদপত্র সহ ক্লাসরুমে ঢোকেন। আর সাগ্নিকদের ক্লাসের সাতচল্লিশ জনের মধ্যে যাকে খুশি তিনি মানে জিজ্ঞাসা করেন কোনও শব্দের, সেই কাগজের লেখা থেকে।

আজ ম্যাম প্রশ্ন করেননি। বন্ধুদের উসকানিতে দ্বিতীয় রো-র কর্নারে বসা, অষ্টম শ্রেণির এই সাদাসিধে সাগ্নিক উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, ওই শব্দটির অর্থ কি?

অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে নতুন অন্তর্ভূক্ত হয়েছে মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা। ম্যাডাম তার কবিতা নিয়েই আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজেও কবিতা লেখেন। মাঝেমধ্যে এক নামি পত্রিকাতে তাঁর কবিতা দেখা যায়। কবিতাতে তাঁর একটু বিশেষ পক্ষপাতও আছে। সাগ্নিকের প্রশ্নে বেশ কিছুদিনের অসংগঠিত ভ্রূর অরণ্য প্রথমে কেঁপে উঠল। তখনও ওইদিনের খবরের কাগজ তিনি পড়ে উঠতে পারেননি। ফলে ওই আগন্তুক শব্দের ধাক্বার প্রস্তুতি সামলাতে তাকে কয়েকবার চুলে হাত চালাতে হল। নাক মোচড়াতে হল দু-তিনবার। সাহিত্য-বিচিত্রা বইটা দুম করে বন্ধ করে দিতে হল। সাগ্নিক অশুভ কিছু একটা টের পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলেঃ ম্যাম আজকের কাগজে আছে। আমরা কেউ শব্দটার মানে বুঝতে পারিনি। তা…ই।

নিজেকে সামলে নেবার জন্য শাড়ির অাঁচল ঠিক করার ম্যানারিজম আর একটু দেখালেন ম্যাম। তারপর অমোঘ সেই স্বর ধবনিত হল– এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মৃদুল দাশগুপ্ত। তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে গোলোযোগ শুরু করেছ। গোটা পিরিয়ড দাঁড়িয়ে থাকো।

যাঃ বাবা, প্রশ্ন করতে পারব না! নিজের মনে গজর গজর করতে করতে সাগ্নিক নিজেকেই বলে, ওদিকে মা-বাবা তো সারাক্ষণই বলে যায়, বুঝতে না পারলে ক্লাস টিচারদের কাছ থেকে জেনে নেবে। খুব খারাপ লাগছিল সাগ্নিকের। এই পানিশমেন্টটা তার সহ্য হচ্ছিল না। দোষ না করে কেন পানিশমেন্ট পেতে হবে! ও রোজ পড়া করে আসে। ক্লাসে গন্ডগোল করে না। কারও সঙ্গে মিসবিহেভ করে না। অথচ ওর বন্ধুরা তো সব এক একটা বিচ্ছু। ক্লাস এইট তো কী! সবকটাই লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট খায়। পুপুও খায়। ক্লাসের পরীক্ষার রেজাল্ট ট্যাম্পারিং করে বাড়িতে দেখায় পুপু। একদিন তো মোবাইলে নেকেড মেয়েদের ছবি ডাউনলোড করে নিয়ে এসেছিল পুপু। ধরাও পড়েছিল এই ম্যামের কাছে। কিন্তু ম্যাম তো কোনও শাস্তি দেননি তাকে।

স্কুলগাড়ি থেকে নামার পর নিশা দেখতে পায় ছেলে সাগ্নিকের মুখটা অন্যদিনের তুলনায় যথেষ্ট কালো। আজ কি পিটি ক্লাস ছিল? রোদে খুব পুড়েছিল?

সাগ্নিক মাথা নেড়ে জানায়– না। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে পায়ের জুতো ছুড়ে দেয়।

কী রে অমন করছিস কেন রে শমু? কিছু হয়েছে? বন্ধুদের সাথে গন্ডগোল? আজকাল গার্জিয়ানরা তটস্থ থাকে কোথায় কী হল! বাচ্চা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি থাকে না। নিশা শমুর মাথার চুল নেড়ে দিয়ে আদর জানায়। আজ নিশাই স্কুল-গাড়ি থেকে নামিয়েছে শমুকে।

রাত্রে জ্বর এল সাগ্নিকের। পরের দিন স্কুলে গেল না, এবং তার পরের দিনও। ডাক্তার ফ্লু বলে কোনও ওষুধ দিলেন না, কেবল ক্যালপল। জ্বর কমছে না, আবার টেস্ট হল– কিছু না। তবে! বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়িয়ে এরপর সাগ্নিক বেশ কিছুদিন বলতে থাকল পেট ব্যথা করছে। স্কুলে যাওয়াও হল না তা বেশ ছ-সাত দিন।

জ্বর কমেছে। ভিডিও গেমে মেতে আছে সাগ্নিক। আজ রবিবার। কাল থেকে আবার স্কুল যেতে হবে। বুক থেকে বড়ো একটা শ্বাস নেয়। ভিডিও গেমে ঢ্যাঁ ঢ্যাঁ করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে এগোয় সে। উলটো দিক থেকে একটার পর একটা দানব আসছে। সে মেরে ফেলছে, আবার আসছে। কিছুতেই তাকে সীমানায় পেৌঁছোতে দেবে না। এই নিয়ে তিনবার হল। স্কোর সাড়ে ছশো, সাতশোর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সাগ্নিকের হাজার চাই-ই চাই। কাজের পিসি জুনিয়র হরলিক্স দিয়ে গেছে, তা ঠান্ডা হচ্ছে। সাগ্নিক মনে মনে এই সেল্ফ-ইমপোজ্ড মিশনে স্কুল টিচারের কথা আওড়াল– ইট ইজ বেটার টু ট্রাই অ্যান্ড ফেইল দ্যান ফেইল টু ট্রাই।

সাগ্নিক একটা জিনিস দেখে অবাক হল। দানবগুলোকে আলাদা আলাদা না ভেবে যেই বাংলা ম্যাম হিসেবে চিহ্নিত করেছে অমনি ওর কিবোর্ড ছুঁয়ে ছেড়ে দেওয়া গুলি গুলো ঠিকঠিক টার্গেটে লাগতে লাগল। কম গুলি খরচ করে বেশি বাংলা ম্যাম নিকেশ করছে তখন। আর স্কোরও হু হু করে ঊধর্বমুখী। কখন যে হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দেড়হাজার, বাইশ শো। শেষে মা ঘরে ঢুকে ডাকতেই তাল কেটে গেল। একটু যেন খিঁচিয়ে উঠল ঠান্ডা স্বভাবের সাগ্নিকঃ কেন কী হয়েছে! সারাদিন পড়া পড়া কোরো না তো!

নিশা বিস্মিত হয়! সে তো কিছুই বলেনি। কোনও প্রশ্নও না। তাহলে! শমু এমন বস্তির ছেলেদের মতো চেঁচিয়ে উঠল! মাথায় হাত রাখল নিশা। অল্প গরম আছে। যাক জ্বরটা বাড়েনি। কিন্তু কোনও অ্যান্টিবায়োটিক তো পেটে পড়েনি শমুর। তাহলে এত রুক্ষতা কোথা থেকে এল!

শমু তোমার হরলিক্সটা টেবিলে পড়ে রয়েছে, ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটু গরম করে দেব?

না না খেতে ইচ্ছা করছে না।

নিশা ব্যস্ত হয়। ছেলের ভেতর একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। এত রুক্ষতা তো কখনও ছিল না! নিশা বলেঃ শমু আজ বিকেলে সাউথ সিটিতে তুমি আর আমি সিনেমা দেখতে যাব, জানলে। এই জানলে শব্দটি নিশার একটি অন্তরঙ্গতা জ্ঞাপক বিশেষ চিহ্ন।

শমু বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েও কেবল মাকে সরিয়ে দেবার জন্য মাথা নাড়েঃ ঠিক আছে। নিশা আবার বলেঃ কাজের পিসি একটু বাদে আসবে, তোমার মাথা ধুইয়ে হট্ স্পঞ্জ করে দেবে। একটু রেস্ট নাও। আজ আর পড়াশুনো করতে হবে না।

এই সফ্টনেস বা সিনেমার টোপটা তাকে দিতেই হতো। সাগ্নিকের থেকে সে যেন দূরে সরে না যায়। এমনিতেই তার একটা গিল্টি ফিলিং আছে। গান গান করে সংসারকে সময়ই দিতে পারে না। আর এখন তো সিনেমার প্লে ব্যাক করছে। হুটহাট করে রেকর্ডিং-এ যেতে হয়। হিম্মতসিংকা মাঝেমধ্যেই শুটিং-এর সময় তাকে ডেকে নেয়। কখনও কয়েকদিনের জন্য আউটডোরেও যায়। গুয়াহাটি, শিলং ঘুরে এসেছে গত মাসে। নিশা ভয় পায়, ছেলে কি তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে! কোথাও কি একটা চিড় ধরেছে মনে মনে! যদি তা-ই হয় দ্রুত মেরামতি করা দরকার। তাই নিশা সিনেমা দেখানোর প্রলোভন দিল সাগ্নিককে।

সাগ্নিকের ঘরে থাকতে থাকতেই নিশার মোবাইল বেজে ওঠে।  কে, মা? বলো।

আজ কাইল তুই তো খুবই ব্যস্ত থাকিস। তোর বাপটারে একবার শ্যাষ চোখের দ্যাখাটা দেইখ্যা আয়গা। কাল পাও ভাঙছে। অফিস থনে ডিসান হাসপাতালে ভর্তি কইরা দিয়া গেছে। অপারেশন হইব। অখনো জ্ঞান আয় নাই শুনছি। তুই সময় পাইলে একবার দেইখা আয়। কাইল সন্ধ্যাকালে তরে অনেকবার ফোন করছিল, কিন্তু পায় নাই।

সে কি, এতক্ষণ বলোনি কেন! কী করে ভাঙল! আচ্ছা আমি আর তোমার জামাই এখনি আসছি। ডিসান তো আমাদের বাড়ির কাছেই। বাবাকে দেখে আমি একবার বাড়ি ঘুরে যাব। তোমাকেও তো অনেকদিন দেখি না।

এতদিনে কুলোর বাতাস পেল কালিশংকর। মনে মনে নিবাস একথা বললেও মুখে আহা উঁহু করছে তখন থেকে। নিবাস মুনশি অনেকদিন ধরে চেয়েছে কালিশংকর বাগচির ট্রান্সফার। একে ওকে কানে বিষ ঢেলে দিয়েছে, লাগান-ভাগান দিয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেনি। এবার পার্মানেন্ট ট্রান্সফার হয়ে গেল কালিশংকরের। অনেকখানি রিলিভড। রোজ রোজ পার্সেন্টেজ নিয়ে খুচ্ খুচ্ ঝগড়াঝাঁটি আর করতে হবে না। তাই প্রাণের আনন্দেই যেন ফোন করে অফিসের সব লোকজন টেনে এনেছে এই ছুটির দিনেও। ফোন করে বলেছেঃ স্যার কেস বিলা। টেঁসে গেছে।

ধমক লাগিয়েছে শাক্যদেব।  চুপ করুন! একজন মারা গেছেন, আপনার কলিগ, আর আপনি তার সম্পর্কে এরকম কথা বলছেন! খুব মনখারাপ শাক্যদেবের। ঘুস খেলেও লোকটা সব সময় তার সাথে সাথে থাকত। অফিসের সব খবরাখবর দিত। সে একবার শেষ দেখা দেখতে এল। আর তাছাড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে তাকে পেশেন্ট আইডেন্টিফাই করতে হয়। সার্টিফিকেট দিতে হয়। নাহলে কোম্পানির হে্কেয়ার ইউনিট হাসপাতালকে পয়সা দেবে না। ফলে আসতেই হতো।

অফিসের পিওন শ্যাম এসে বললঃ নিবাসদা বাড়ির লোকজনকে তো দেখছি না!

ন্যাকামো করিস না। একটু আগের স্যারের ধমক এবার ও নীচের দিকে চালান করল। শ্যামের মুখ কাঁচুমাচু। বলেঃ বাড়ির লোক খবর পেয়েছে তো!

বড্ড ভ্যানতারা করিস তুই! এত লোককে ফোন করছি, আর আসল বাড়িতে করব না! ওই গতরখাকি বউ-এর কথা ছাড়। গজ গজ করে উঠল নিবাস মুনশি। সারাদিন মানুষটারে এতটুকু শান্তি দেত না। দাঁতের চাপানির তলায় রেখে দেত। বউ বলে পরিচয় দেবার জুগ্গি নাকি সে! আসপে না রে আসপে না। অত দপ্প বিধেতাপুরুষ সইবে কেন! তাই তো অকালে পেরাণটা গেল কালি-দার। নাইলে পা ভাঙলে কারুর পেরাণ যায়!

সকালে অপারেশন টেবিল পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। কালিশংকরের জ্ঞান সেই যে গিয়েছিল আর ফেরেনি। অপারেশনের আগে অ্যানিস্থেশিস্ট এসেছে। ছুরি-কাঁচি সহ অপারেশন থিয়েটারও প্রস্তুত। ডাক্তার গুপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। অফিসের নিবাস আর শ্যামও উপস্থিত। তখনই খবরটা জানা গেল। সিরিয়াস কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়েছিল। ভোর রাত্রে। কিচ্ছু করার ছিল না।

ডাক্তার সার্টিফিকেট দিতে দিতে তিনটে বাজিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে নিশারা বিধবস্ত হয়ে বসে আছে ডিসানের অফিসের সামনে। নিশার পাগল পাগল লাগছে। বাবা কাল তাকে ফোন করেছিল অথচ সে কথা বলতে পারেনি। কালকে এলে কি একবার কথা বলতে পারত! হিম্মতসিংকা তাকে প্রচার দিচ্ছে বটে কিন্তু প্রাইভেট লাইফের একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যখন তখন তাকে ডাকে দামি হোটেলে। ভালো ভালো মদ খাওয়ায় আর শরীর নেয়। সেদিনের পর থেকে রৌণকের উপর থেকেও টানটা উঠে গেছে নিশার। বাবা তাকে খুব ভালোবাসত। সে-ও বাবাকে। আর তো তেমন কেউ রইল না তার যার জন্য এই পৃথিবী সুন্দর লাগে। তেমন করে বেঁচে থাকা যায়। নিশা বেশ জানে ছেলে সাগ্নিক তাকে চায় না। তার স্বামীও চায় না। শুধু থাকে একসাথে। বার বার ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিশা। বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু এত লোকের সামনে ভালো করে কাঁদতেও পারছে না। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।

শ্যাম আর ক্লার্ক মানব সিংহ শাক্যদেবকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল। শ্যাম সকাল থেকেই খুঁজছে কালিদার বাড়ির লোকজনকে। কাল একবার রাতে নিবাসদার খোমা শুনেছে। মানে মুখ ঝামটা। নিবাস শ্যামকে খুব ঝেড়েছে, কেন সে কালিশংকরের ভাগের টাকা দিয়ে আসেনি কাল। শ্যাম যত বোঝায়ঃ কাকে দেব! কালিদার সেন্স ছিল না তো। হসপিটালে পকেট থেকে যদি কেউ টাকা তুলে নিয়ে যায়! শ্যাম এখন কী করবে! আবার অফিসে গিয়ে ঝাড় খেতে পারবে না।

আরে ওই তো কালিদার মেয়ে বসে আছে সোফায়। মানব সিংহ আঙুল তুলে দেখায়। মানব নিশাকে চেনে। নিশার বিয়েতে এসেছিল সে। ওই যে নীলচে রুমালে চোখ মুছছে বারবার এক সুন্দর দেখতে বউ, ও-ই নিশা, কালিদার মেয়ে। তখনও মৃতদেহ বের হয়নি, সবাই অপেক্ষা করছে। নিশা, তার বর। নিশার বর ফোন করে শববাহী গাড়ি ডেকে নিয়েছে। তা দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের পাশে। শ্যাম মাথা চুলকোতে চুলকোতে গিয়ে নিশার সামনে দাঁড়ায়। ম্যাডাম, আমরা কালিদা-র অফিসের কর্মচারী, কাল থেকেই আছি। তারপর নিশার বিহ্বলতার ভেতর, তাকে কোনও কথা বলতে না দিয়েই শ্যাম পকেট থেকে একটা বন্ধ খাম বের করে নিশার হাতে দিয়ে বললঃ এর মধ্যে ছ’হাজার আছে ম্যাডাম। এটা কালিদার শেয়ার।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...