হাতে মাত্র দুটো দিন ছুটি। ছুটব যে বহুদূর সেটা সম্ভব নয়। তাহলে কোথায় যাই? এই ভাবনাতেই ভর করল কপিলাস। শুধু কপিলাস নয়, দেখে নেওয়া যেতে পারে আশপাশের দু’একটা অল্পচেনা গন্তব্যও। এই অফবিটের কথা শুনেছি অনেকের কাছে। কিন্তু তা সময়াভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার তারই বাস্তবায়ন। তবে এ পথে শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়, আছে অনাবিল প্রকৃতির রূপও। তাছাড়া বেআক্বেলে পর্যটকদের হইহুল্লোড় এড়িয়ে নিজেদের মতো করে ঘোরা যাবে। আমরা চারজনের ছোট্ট টিম। টিকিট ছিল ফলকনামায়। নির্ধারিত সময়েই ছাড়ল গাড়ি। আর তারপরই আমাদের মনের কোণে খুশির পারদ চড়তে লাগল।

ওড়িশার পুরাতন রাজধানী কটকে নামলাম প্রাক-দুপুর নাগাদ। ফলে স্টেশনের ফুডপ্লাজায় অ্যাডভান্স লাঞ্চটা সেরে নিলাম। এবার গাড়ি খোঁজার পালা। কথা হল আমরা ধবলেশ্বর দেখে ঢেঙ্কানল যাব। কটক থেকে কিছুটা দূরে ধবলেশ্বর। পাঁচ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ছুটছে গাড়ি। শহরের সীমানা ছাড়তেই ছলকানো সবুজ। রাস্তার দু’দিকের সবুজের ব্যাপ্তি চোখ বন্ধ করতে দিচ্ছে না এক মুহূর্তের জন্যও। পথচলতি ছোটো-বড়ো জনপদের দেখা মিলছে। চোখে পড়ছে ঢেঙ্কানলগামী যাত্রীবাহী দু’একটা বাস আর বাদুড়ঝোলা স্থানীয় রুটের ট্রেকার। মেইন রাস্তা ছেড়ে গাড়ি এবার ঢুকল বাঁহাতি শাখাপথে।

মাত্র ১১ কিমি পথ ভাঙতেই মঞ্চেশ্বর। এখানেই এই রাস্তার শেষ। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল বহমান মহানদী। ঘাটজুড়ে কালারফুল নৌকো সার-সার অপেক্ষমান। ওপারের দীপভূমিই ধবলেশ্বর। ধবলেশ্বর মন্দিরের ধবজাসহ শ্বেতশুভ্র চুড়ো– এপার থেকেও দৃষ্টিতে ধরা দিল। ওপারে পৌঁছোতে দুটো অপশন। নৌকায় চড়ে অথবা ব্রিজ ধরে হন্টন। আমরা ব্রিজ পথ ধরি। মহানদীর উপর হ্যাঙ্গিং ব্রিজটা দেখে হৃষিকেশের লক্ষ্মণ বা রামঝোলার স্মৃতিটা মনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল।

শৈবতীর্থ ধবলেশ্বরের প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। উৎকল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মন্দির গড়ে ওঠে। স্থানীয় বিশ্বাসে জাগ্রত এই দেবতাকে দর্শন ও পূজার্চনা করতে সারা দিন ধরেই মানুষজনের যাতায়াত। তবে জানা গেল কার্তিক ও বৈশাখে ভক্ত সমাবেশ হয় সবচেয়ে বেশি। এইসময় মন্দিরকে কেন্দ্র করে বড়ো মেলাও বসে। সিঁড়ির মুখ জুড়ে দেখি পুজোর উপচারের বহু দোকান। জুতো খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ওড়িশার নিজস্ব শৈলীতে গড়া ধবলেশ্বর মন্দির। এখানে পাণ্ডার দল থাকলেও, সেভাবে এদের দৌরাত্ম্য নেই। অনেকটাই মিল পাচ্ছি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পরিবেশের সঙ্গে। গর্ভগৃহ এখানে অনেকটা নীচুতে। ফাঁকা মন্দিরে পুজো দিতে কোনও অসুবিধা হল না। বাইরে বেরিয়ে দ্বীপটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দ্বীপজুড়ে গাছগাছালির সবুজ বিন্যাস। এই দ্বীপে রাতবাসের জন্য রয়েছে ওটিডিসি’র পান্থনিবাস। আমাদের অনেকের ইচ্ছা ছিল নৌবিহারের। কিন্তু আমাদের হাতে অত সময় ছিল না। ফলে ঝোলাপুলে অঙ্গ দুলিয়ে পুনরায় মঞ্চেশ্বর ফেরা। বয়স্ক বিকালের আকাশে তখন রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। তারই প্রতিবিম্ব মহানদীর জলে। অসাধারণ লাগছিল এই সিচুয়েশনটা। নদীপাড়ে চায়ের দোকানে বসে টি-ব্রেকের ফাঁকে উপভোগ করছিলাম এই প্রকৃতিরূপ। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে আলাপচারিতাও বেশ জমে গিয়েছিল। কিন্তু অচেনা রাস্তার কথা ভেবে উঠতে বাধ্য হলাম।

পুনরায় জাতীয় সড়কে উঠতেই হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকে গাড়ি। ঢেঙ্কানল পৌঁছোতে সন্ধ্যা হল। ঢেঙ্কানল শহরে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল। কিন্তু অফবিট বলে লোকজনের ভিড় সেভাবে থাকে না। ফলে হোটেল পেতে অসুবিধা হল না।

পরদিন চা-পর্ব মিটিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই কপিলাস মন্দির অভিমুখে। ঢেঙ্কানল ছাড়তেই ছলকানো সবুজে মন ছুঁয়ে গেল। পেলব সবুজকে সঙ্গে নিয়েই ছুটে চলে গাড়ি। কীছুটা দূরেই শৈবতীর্থ কপিলাস। ড্রাইভারের পরামর্শেই ব্রেকফাস্ট-টা সারা হল কাইটি নামক স্থানে। এখানে অক্ষয় দেউড়ির মিষ্টির দোকানে বিখ্যাত কাকড়া (গুড়পিঠের মতো একধরনের মিষ্টি) আর বড়াভাজার স্বাদ অসাধারণ। সঙ্গে ঘনদুধের স্পেশাল চা। বিগ-ব্রেকফাস্টের পরই গাড়ি ছুটল রুদ্ধশ্বাসে। পথে পড়ল দত্তাত্রেয় সাঁইবাবার শাখা আশ্রম। এই নিরিবিলি আশ্রমে ঢুকে সকলেরই মন ভরে গেল।

ওড়িশার কৈলাস নামে খ্যাত কপিলাস। সমতল ছেড়ে একটু পরেই গাড়ি উঠল পাকদণ্ডি পাহাড়ি পথে। এই পাহাড়শীর্ষেই আছে কপিলাস মন্দির। গোটা পাহাড়টা ঢেকে আছে শাল, সেগুন, আমলকী, আকাশমণি, কেন্দু, মহুয়া, পলাশের জঙ্গলে। যত উপরে উঠছি, দূর-প্রকৃতি তত মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। গাড়ি পার্কিং করে, ছায়া সুনিবিড় পথ ধরে এগিয়ে চলি। সামনেই মন্দির ফটক। ম্যাক্সিমাম তীর্থযাত্রীরা অবশ্য খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে ওঠে। সবুজ বনানীর মাঝে দেখি শ্বেতশুভ্র একাধিক ছোটো-বড়ো মন্দির। এর মধ্যে সুউচ্চ ওড়িশি শৈলীর মন্দিরটাই মেইন মন্দির।

পাহাড়ের গায়ে একাধিক মন্দিরের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রশেখর, বিশ্বনাথ, গণেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লোকবিশ্বাস, মহাভারতের যুগে পঞ্চপাণ্ডবরা নাকি এখানে এসেছিলেন। গর্ভগৃহে লিঙ্গরাজকে দেখতে কয়েকটা পিচ্ছিল ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হল। বাইরে দেখি ভোগের প্রসাদ বিক্রি হচ্ছে। ভক্তরা কিনছেও লাইন দিয়ে। তবে এই মন্দিরে পাণ্ডার তুলনায় হনুমানবাহিনীর দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য শৈবতীর্থের মতো এখানেও শ্রাবণে ভক্তরা বাবার মাথায় জল ঢালে। আর শিবরাত্রিতে পাহাড়গুলি জুড়ে বসে মেলা। গাড়ি নিয়ে এবার চলে এলাম পাহাড়তলির পাদদেশে। এখানে রাস্তার ধারেই রয়েছে কপিলাস চিড়িয়াখানা ও সায়েন্সপার্ক। চিড়িয়াখানাটা বেশ বড়ো। সম্বর, বাইসন, ভালুক, বাজ, ময়ূর, হাতি, বদরির উপস্থিতি মন ভরিয়ে দিল। আছে ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্র। তবে চিতল হরিণের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। পাশেই বিজ্ঞানের শিক্ষামূলক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো সায়েন্স পার্কটাও মন ভরিয়ে দিল।

গাড়ি এবার ছুটল জোরান্ডায়। এখানে আছে মহিমাশ্রম। অনেকে একে কৌপিনধারী সাধুদের আশ্রম বলেও উল্লেখ করে। গাড়ি থেকে নেমে সামনেই দেখলাম বিশাল তোরণদ্বার। খুবই জেল্লাদার সে তোরণ পেরিয়ে এগিয়ে যাই। সামনে গাছপালার মাঝে পায়ে চলা ফালি পথ। এখানে-ওখানে লম্বা বারান্দাওয়ালা স্কুলবাড়ির মতো কয়েকটা বিল্ডিং। কৌপিনধারী সাধুরা সব গাছপালা পরিচর্চায় ব্যস্ত। চলছে অনেকটা জমিজুড়ে চাষবাসের কাজও। ফুল-ফলের গাছও চোখে পড়ার মতো। আরও এক তোরণদ্বার পেরিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। যে মন্দির দেখি বিগ্রহহীণ, শূণ্য। পর-পর দেখে নিলাম মহিমাস্বামীর সমাধি, ধুনিমন্দির এবং গদি মন্দির ইত্যাদি। এখানকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অসাধারণ। মন্দির চত্বরে ময়ূরের অবাধ বিচরণ। এই ধর্ম সম্বন্ধে বিশদ জানতে তোরণদ্বারের কাছে বুকস্টল থেকে একটা পুস্তকও কিনলাম। তবে বল্কলধারী মহান্তদের সাক্ষাৎ পেতে মূল আখড়ায় প্রবেশ করতে হবে। বলে-কয়ে সাক্ষাৎও হল। জানলাম অনেক কথাই। শুনলাম এখানে প্রতি বছর মহিমাস্বামীর আবির্ভাব তিথিকে স্মরণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে বিরাট উৎসব চলে।

এবার গাড়ি নিয়ে ঢেঙ্কানলের হোটেলে ফিরে এলাম। স্নানপর্বের পর মধ্যাহ্নভোজন সারা হল। তারপর চেক আউট করে, ব্যাগপত্তর ডিকিতে তোলা হল। আজই আমরা কটকে ফিরব, তবে সপ্তশয্যা দেখে। ঢেঙ্কানলের দক্ষিণ-পূর্বে রর কিমি দূরে সপ্তশয্যা। জঙ্গল মাঝে গাড়ি যেখানে পার্কিং করল, তারপরও র কিমি মতো চড়াইপথ। সে বনপথ জুড়ে পাখির গান, হনুমানদের এগাছ-ওগাছ, রংবেরঙের প্রজাপতি, বিচিত্র ধরনের মাকড়সার সমাবেশ।

রোমাঞ্চকর অনুভূতিপূর্ণ জঙ্গল ট্রেকিং লাগল অসাধারণ। শেষে সিঁড়িপথও ভাঙতে হল বেশ খানিকটা। পথ শেষে পৌঁছোলাম এক সাদামাটা মন্দিরে। পাহাড়শীর্ষে এই রামসীতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, ঢেঙ্কানলের রানি রত্নপ্রভা। এই পাহাড়েই সাতজন ঋষি সাতটি গুহায় বসে তপস্যা করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু জঙ্গল গহিনে ঝরনাও ছিল নাকি, খোঁজাখুঁজি করতে হবে। তবে আদৌ এসব এখন পাওয়া যাবে কিনা বলা শক্ত। তাছাড়া এত সময়ও নেই আমাদের হাতে। তবে পৌরাণিক পটভূমির প্লেসটা কিন্তু লাগল অসাধারণ। সপ্তর্ষির স্মরণে মূর্তিও বানানো হয়েছে এখানে। জনশ্রুতি এই যে শ্রীরামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণসহ সাতদিন এখানে কাটিয়েছিলেন। পুরোহিত জানাল, এখানে রামনবমীতে বেশ বড়োসড়ো উৎসব হয়। তবে ইচ্ছা থাকলেও বেশিক্ষণ থাকা গেল না। কারণ আবার র কিমি জংলি উৎরাই পথ নামতে হবে। ফিরে গাড়িতে উঠতেই ছুটতে শুরু করল গাড়ি। মনে মনে ভাবছি সাতকোশিয়ার গর্জ বা লবঙ্গীর জঙ্গল এ যাত্রায় আর হল না। আবার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে অন্য কোনও লম্বা ছুটির জন্য।

কীভাবে যাবেনঃ

হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে পুরী, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ বা বেঙ্গালুরুগামী যে-কোনও ট্রেনে কটক নামুন। কটক রেল স্টেশন থেকে অটো বা রিকশায় চ্ কিমি দূরে বাদামবাড়ি বাসস্ট্যান্ড। বাস বা ট্রেকারে মঞ্চেশ্বরে নেমে ধবলেশ্বর দেখুন। আবার ঢেঙ্কানলগামী বাস ধরে ঢেঙ্কানল আসতে হবে। এসব ঝামেলা এড়াতে সবচেয়ে ভালো হয় একটা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া। পরদিনও গাড়ি ভাড়া করেই সমস্ত স্থানগুলি দেখে নিতে হবে।

কোথায় থাকবেনঃ

ধবলেশ্বরে একমাত্র থাকার জায়গা সরকারি পান্থশালা।  ঢেঙ্কানলেও রয়েছে সরকারি পান্থনিবাস। ইচ্ছা হলে কপিলাসেও থাকতে পারেন। আছে ওড়িশা পর্যটন দফতরের পান্থশালা ও মন্দির কমিটির অতিথিশালা।

কখন যাবেনঃ

অক্টোবর থেকে মার্চ উপযুক্ত সময়।

মনে রাখবেনঃ

ঢেঙ্কানল ম্যালেরিয়া উপদ্রুত এলাকা। অতএব মশা প্রতিরোধক সমস্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। অফবিট-এর ফলে পরিবহণ ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো পাবেন না। তাই সঙ্গে গাড়ি আর ঝোলায় শুকনো খাবার রাখলেই ভালো।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...