পরিচিত এক গানের সুরে কলিংবেল-টা বেজে উঠতেই সংবিৎ ফিরে পায় নীপা। গত দু’দিন যাবৎ সে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। দুপুরে এই অসময়ে কে আসতে পারে? ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে লিলির রাত হয়ে যায়। আর ও তো সাড়ে দশটা– এগারোটার আগে কোনও দিন…
ফের বেজে ওঠে বেলটা, তবে এবারে ভিন্ন সুরে।
বাধ্য হয়ে নীপা বিছানা ছেড়ে ওঠে। কাজের মেয়েটি দেশে গেছে তো গেছেই, ফেরার নাম নেই। বেল বাজলে দরজা খুলতে যাবার বিষয়টা তার বিরক্তিকর লাগে। নাইটিটা পাতলা, হাত বাড়িয়ে হাউসকোট টেনে নেয় নীপা। সেটা গায়ে চাপিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলে একটি অচেনা মুখ নজরে পড়ে। ছেলেটির হাতে একগোছা কাগজপত্র।
নীপা নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে, ‘কে? কাকে চাই?’
‘কুরিয়ার। চিঠি আছে,’ উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে।
দরজা খুলে চিঠি হাতে নেয় নীপা। নির্দিষ্ট কাগজে সই করে ফেরত দেয়। ভেবেছিল, স্বামীরই কোনও চিঠিপত্র হবে। কিন্তু খামের উপর জ্বলজ্বল করছে তার নাম। চিঠি নিয়ে দরজা বন্ধ করে নীপা। প্রেরকের নাম নেই, আশ্চর্য! তবে কী? ধক করে ওঠে বুক।
দারুণ উত্তেজিত লাগে নিজেকে। হাতের লেখাটা চেনা-চেনা ঠেকছে। খামের একটি দিক ছিঁড়ে সে চিঠিটি বের করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে, ‘প্রিয় নীপা’। উত্তেজনা দমন করতে পারে না সে, দ্রুত চিঠির নীচে চোখ বোলায়– ‘উফ্, যা ভেবেছি, আঁতকে ওঠে নীপা, তলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘তোমার আর্যদা’। অজানা আতঙ্কে বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় নীপার, চিঠিটি আর পড়ে না। সামনের জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাড়িয়ে দেয় দূরে– আশ্বিনের মিষ্টি রোদে ভাসা আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ যেন অন্যমনস্ক একটি ঈগল পাক খাচ্ছে মন্থর গতিতে।
নীপার মনটা পিছিয়ে যায় একুশ বছর। ভবানীপুরে নীপাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। সে বাড়িতে নীপার বাবা তার দুই ভাই এবং তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন। নীপারা ছিল দু’ভাই, এক বোন। কাকার দুই মেয়ে, এক ছেলে। আর জেঠুর ছিল দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সবার ওপরে ছিলেন ঠাকুমা। এতগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে গোটা বাড়িটা সব সময় গমগম করত। হইহুল্লোড় লেগেই থাকত।
নীপার বাবা ছিলেন সংগীত পাগল মানুষ। শনি-রোববার হলে বাড়িতে গানের আসর বসত। কত যে লোকজন আসত, আসত ভাই-বোনদের বন্ধুবান্ধবরা। নির্ভেজাল আড্ডা জমত ছুটির দিনগুলিতে। উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। আজ এর জন্মদিন তো কাল ওর।
এরকমই একদিন খুড়তুতো দাদা নীল বলল, ‘এই নীপা, এদিকে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হল আমার বন্ধু, আর্য। আর্য কাশ্যপ। দুর্দান্ত ছবি আঁকে।’
নীপা কোনও মতে হাতজোড় করে বলেছিল, ‘নমস্কার’।
মৃদু হেসে আর্য বলেছিল, ‘তোর বোন যতটা লাজুক ঠিক ততটাই মিষ্টি।’
নীপার চোখমুখ এক অপার্থিব মায়াবী আলোয় ভরে উঠেছিল সেদিন। ‘আমি যাই’, বলে দ্রুত পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
কিন্তু এর দিন কয়েক পর কলেজ যাবার সময় আচমকা সিগারেট হাতে এগিয়ে এসেছিল আর্যদা, ‘কী নীপা চিনতে পারছ?’
নীপার বুক ঢিপঢিপ শুরু হল। আশেপাশে সামান্য তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, ‘কেউ দেখতে পাবে। এখানে না, কলেজে।’
ফিক করে হেসে সরে গিয়েছিল আর্যদা। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পায়ে পায়ে আশুতোষ কলেজ আর কতটুকু? দু’জনের প্রেম জমে উঠতে দেরি হয়নি।
তারপর কলেজ বাংক করে অসংখ্য দিন সিনেমা, রেস্টুরেন্ট, গঙ্গার পাড়, ভিক্টোরিয়া, সদন– দিনগুলোর কথা ভাবলে নীপার বুকটা হুহু করে ওঠে আজও। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত দু’জনের কথা বলে।
নীপা প্রায়ই বলত, ‘তুমি আমাকে কী দেখে ভালোবাসলে আর্যদা? তোমার কাছে আমি যে কিছুই না।’
উত্তরে আর্যদা হেসে বলত, ‘তুমি জানোই না তুমি কতটা সুন্দর। জানলে এ কথা বলতে না।’
বাস্তবিকই কন্দর্পের মতন রূপবান ছিল আর্য। উজ্জ্বল ফর্সা রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ। লম্বা সুঠাম চেহারার যুবকটির চমকপ্রদ কথাবার্তায় চুম্বকীয় আকর্ষণ। তার কাছে নীপা নিজেকে বড়ো অসহায়বোধ করত। পক্ষান্তরে নীপা মোটের ওপর সুশ্রী হলেও তাকে সুন্দরী বলা চলে না। থাকার মধ্যে ছিল কেবল সুগঠিত নারীসুলভ দেহ, আর মার্জিত ব্যবহার।
প্রতিদিনই শরীর চাইত আর্য। আর তা না পেলেই তার মুখ ভার হয়ে উঠত। অবশ্য সেই রাগ নীপাকেই ভাঙাতে হতো ফের শরীর দিয়েই। আর আদর করতেও জানে বটে ছেলেটা। কোথায়, কখন, কীভাবে ছুঁলে যে নারীদেহ অবশ হয়ে আসে, এলিয়ে পড়ে প্রতিরোধ বিহীন হয়ে, ভেসে যায় অনন্ত স্রোতে– তা বুঝি কেবল ওরই জানা। অমন করে আর ছুঁতে পারল কে? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নীপার বুক থেকে।
চিঠি হাতে ধরাই থাকে, পড়া হয় না। নীপা ভাবতে থাকে, কী লেখা থাকতে পারে এতে? আজ একুশ বছর পর আমার কাছ থেকে আর কী পাওয়ার আছে আর্যদার? বয়স তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। এ চিঠি আমার স্বামী কিংবা লিলির হাতে পড়লে কী সর্বনাশ হতো! শিউরে ওঠে সে। এরকম একটা ঘটনা যে আর্যদা ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কাই হচ্ছিল। গত পরশু দিন পার্টিতে যখন মি. চাওলা আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড আর্য কাশ্যপ। দ্য মোস্ট ডিসকাস্ড পেইন্টার অফ দিস আওয়ার। অ্যান্ড হিয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ড মি. চ্যাটার্জী অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, মুহূর্তের জন্য পায়ের তলা থেকে মাটি বুঝি সরে গিয়েছিল নীপার, ‘আ-র্য-দা’, অস্ফুটে উচ্চারণ করতে পেরেছিল কেবল।
জুলফিতে পাক ধরেছে ভালোই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও কী অপূর্ব সুন্দর মানুষটি! কিছু কিছু মানুষকে বুঝি বয়স তেমন ভাবে ছুঁতে পারে না। কত বয়স হবে আর্যদার? আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়ো ছিল, তার মানে ফিফটি প্লাস। আশ্চর্য! এক মাথা ঝাঁকড়াচুল, রিমলেস চশমা, পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর চমৎকার একটি শাল কাঁধে ভাঁজ করে ফেলা। প্রাথমিক নমস্কার সেরে ওদেরকে কথা বলতে দিয়ে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সরে এসেছিল নীপা। পার্টিতে ওদের আর কথাবার্তা হয়নি।
গত দুদিন যাবৎ বারবারই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল নীপার। বুঝতে পারে না, আর্যদার সামনে নিজেকে এত অসহায় লাগে কেন? মনে হয় বুঝি পায়ের তলায় মাটি নেই, কেবল বালি, তাও দ্রুত সরে যাচ্ছে। অথচ ওই মানুষটি এক দিন আমাকে চরম সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও কেঁপে ওঠে শরীর–
আর্যদার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল মিলি, জ্যাঠতুতো বোন। বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও ওরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। একদিন মিলি ওকে ডেকে বলল, ‘শোন নীপা, তোকে একটা কথা বলার ছিল।’
‘কী বলবি বল না।’
‘কথাটা শুনতে তোর একটুও ভালো লাগবে না, মন খারাপ হয়ে যাবে। হয়তো আমাকে ভুল বুঝবি’, বলল মিলি।
‘যা বোঝার বুঝব, তুই আর ঢং না করে বলেই ফেল কথাটা।’
‘না, মানে কথাটা আর্যদার সম্বন্ধে,’ ইতস্তত করে মিলি।
‘কী হয়েছে আর্যদার?’ উৎকণ্ঠা জাগে ওর গলায়।
‘না ওর খারাপ কিছু হয়নি’, মিলি বলে, ‘দ্যাখ আমার কানে ওর সম্বন্ধে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য এসেছে যার অর্থ ছেলেটি মোটেও সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে আরও একাধিক মেয়ের সম্পর্ক আছে। তুই সাবধানে থাকিস।’
‘তোর কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই প্রশ্ন করে নীপা।
‘না, আমার কাছে ওসব থাকবে কী করে? কানে এল, তাই তোকে সাবধান করলাম, এই আর কী।’
রাগে সেদিন ধুপধাপ করে হেঁটে নীপা চলে এসেছিল মিলির ঘর ছেড়ে। তবে কথাটা যে কতদূর সত্যি তা জানা গেল মাস ছয়েক পরই। নীপার প্রেমের বয়স তখন দু’বছর। সে তখন পার্ট টু দিয়েছে।
একদিন আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় বাড়িতে ডাক্তার এল। মুহূর্তে মারাত্মক সংবাদটা পৌঁছে গেল বাবা-দাদাদের কানে। প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠতে খানিকটা সময় লাগল সকলের। তারপরই সকলে হামলে পড়ল, ‘এ কর্মটি কার?’ উত্তর পেতে দেরি হল না। বড়দা ফোন করল আর্যদের বাড়ি।
আর্য-র মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগেই। বাবা বেঙ্গালুরুতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন উঁচু পোস্টে। বাড়ির কাজের লোক জানাল, ‘আর্ট এগ্জিবিশন উপলক্ষ্যে আর্য ফ্রান্স গেছে, কবে ফিরবে জানা নেই।’
নীপা অবাক। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও তো দেখা হল আর্যদার সঙ্গে, একটিবার জানাল না যে ও ফ্রান্স যাচ্ছে। আমাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে গেল আর্যদা! শরীরী গল্পে যদিও ওরা যথেষ্ট সাবধানতা নিত, তবে মাঝে মাঝে বড়ো বেপরোয়া হয়ে উঠত আর্যদা। কিন্তু তার পরিণাম যে এমন বিষময় হয়ে উঠতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। দুশ্চিন্তায় মা-বাবার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা পাচ্ছিল না নীপা। কানাকানিতে গোটা বাড়ি জেনে ফেলল ঘটনা। মা-বাবা-দাদাদের মুখ ভার। কেউ কোনও কথা বলছে না, বললেও একটা দুটো। দিনরাত ফিসফাস, গুজগুজ, ছিঃ ছিঃ-তে কান পাতা দায়। উফ্, কী ভাবে যে সে দিনগুলো কেটেছে!
সে যাত্রা উদ্ধার করেছিলেন কাকা। কাকার পরামর্শ অনুযায়ী বাবা-জ্যাঠা দু’জনেই মত দিয়েছিলেন উপযুক্ত পাত্র দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীপার বিয়ে দিতে হবে। তবে তার আগে একবার নার্সিংহোম ঘুরিয়ে আনতে হবে ওকে।
কিন্তু নীপার কপালে আরও কষ্ট লেখা ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন, মাত্র দু’মাস বয়স হলেও কী এক জটিল কারণে এক্ষেত্রে নীপার উদ্ধার পাওয়া কঠিন। তা করতে গেলে পেশেন্ট জীবনে আর মা হতে পারবে না। একেই বুঝি বলে, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।
তড়িঘড়ি খোঁজা হতে লাগল পাত্র। আশ্চর্যজনক ভাবে জুটেও গেল একজন। পাত্র বিদেশে চাকরি করে এক নামি কোম্পানিতে। বাড়ি বালিগঞ্জে। মা-বাবা এখানে থাকলেও তাকে বরাবর বাইরেই থাকতে হবে। মাত্র এক মাসের ছুটিতে এসেছে দেশে বিয়ে করবে বলে। তার জন্য পাত্রী ঠিক করাই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাত্রী জানিয়েছে যে তার অমতে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে এবং যেহেতু সে একজনকে ভালোবাসে তাই তার পক্ষে তাকে বিয়ে করা সম্ভব হবে না।
কী করে কে জানে যোগাযোগ ঘটে গেল দু’পক্ষে! দু-চারদিনের মধ্যে কথাবার্তা পাকা। পাত্র অবিনাশ বলল, ‘আমি একবার পাত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।’
প্রস্তাব শুনে প্রমাদ গুনল সকলে, এই বুঝি কেঁচিয়ে যায় বিয়ে। ততদিনে নীপা অনেকটাই পরিণত। সেও চাইছিল এমন একটা কিছু হোক। নির্দিষ্ট দিনে সে আর মিলি এসে দেখা করল অবিনাশের সঙ্গে। ওর সঙ্গেও ছিল এক বন্ধু। প্রাথমিক পরিচয় সেরে এসপ্ল্যানেডে এক রেস্তোরাঁতে ঢুকে রিজার্ভড সিটে বসে অবিনাশ বলল, ‘বলুন ম্যাডাম, স্বামী হিসাবে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবেন? অনেক বদগুণ আছে কিন্তু আমার।’
অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নীপা জবাব দিয়েছিল, ‘তার আগে আপনার জানা উচিত স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে গ্রহণ করতে পারবেন কি না?’
‘কী ব্যাপার, এনি প্রবলেম?’ কপাল কুঁচকে ওঠে অবিনাশের।
ভনিতা না করে নীপা সরাসরি বলে, ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’
‘এখন ভালোবাসেন না?’
‘না, সম্ভবত না,’ একটু থেমে থেমে জবাব দেয় নীপা।
‘ব্যস, তা হলে তো প্রবলেম মিটেই গেল। এখন আমাদের লাইফ পার্টনার হতে বাধা কোথায়?’ সহজ কণ্ঠে বলে অবিনাশ।
মাথা নীচু করে থাকে নীপা, উত্তর দেয় না। হঠাৎ হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। অবিনাশ ঘাবড়ে যায়, উঠে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে শান্ত করতে চেষ্টা করে, ‘রিল্যাক্স, রিল্যাক্স নীপা, কাঁদছ কেন? এভাবে কাঁদার কোনও মানে হয়? কী হয়েছে খুলেই বলো না আমাকে।’
‘পারব না, কিছুতেই পারব না। একজন আমাকে ঠকিয়েছে, তাই বলে আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না,’ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় নীপা।
‘এখানে ঠকাবার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? দ্যাখো, ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। তুমি যাকে ভালোবেসেছ হয়তো সে তোমাকে তার মর্যাদা দেয়নি। সব কথা তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে, এরপরও ঠকাবার প্রশ্ন থাকছে কোথায়?’
‘থাকছে। এরপরও থাকছে, বিকজ…’
‘বিকজ?’
‘বিকজ, আয়াম ক্যারিং’, রুমালে মুখ চাপা দেয় নীপা। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় অবিনাশ দারুণ আহত হয়। বুঝে উঠতে পারে না এক্ষেত্রে তার কী বলা উচিত। কেবল নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।
খানিক পর বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার রাখতে মাথা তোলে নীপা। চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। অবিনাশ ওর প্লেটে খানিক খাবার তুলে দেয়। বলে, ‘নাও, খেতে শুরু করো।’
নীপা আঙুলে চামচ ধরে নাড়াচাড়া করে, খেতে মন চায় না তার। মুখ থেকে কোনও কথা বেরোয় না। দু’চোখে ভরা জল। মিলি ওর পিঠে হাত বোলায়।
অবিনাশ বলে, ‘ব্যাপারটা মেডিক্যালি কিছু করা যায় না?’
নীপা বুঝতে পারে ও কী মিন করছে। বলে, ‘সম্ভব নয়। ডাক্তার বলেছেন, সেক্ষেত্রে ইন ফিউচার আমার মা হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলে অবিনাশ। ওর বন্ধুর দিকে তাকায়। তাকেও অসম্ভব বিস্মিত দেখায়। এরপর ওরা অসম্ভব ব্যস্ততায় কাঁটাচামচ হাতে খাবারে মনঃসংযোগ করে। একটাও কথা বলে না। একসময় খাওয়া শেষ হয়। তারপর অবিনাশ হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘নীপা, আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি– আমি তোমাকে বিয়ে করব।’
নীপা অবাক চোখে তাকায়, ‘কী বলছেন! এত সব জানার পরও আপনি!’
‘এসব আমাকে না জানালেও পারতে তুমি, সেক্ষেত্রে আমি চিটেড হলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু তা তুমি করোনি, বিকজ ইয়্যু আর অনেস্ট। অ্যান্ড অনেস্টি ইজ দ্য রেয়ারেস্ট কোয়ালিটি, ইয়্যু নো? তোমার সততাকে সম্মান জানাতেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই আমি, অবশ্য তুমি যদি আমাকে পছন্দ করে থাক।’
নীপার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অন্ধকার। সেখানে অবিনাশ একমাত্র আশার তরি। তাতে চড়ে বসা ছাড়া তার আর উপায় কী? যত শিগগির সম্ভব রেজিস্ট্রি ম্যারেজ সেরে অবিনাশ ওকে নিয়ে উড়ে গেল কানাডা। সেখানেই জন্ম হল লিলির। বছর দশেক কানাডায় থাকার পর ওদের ফিরতে হল দেশে। কারণ অবিনাশের কোম্পানি কলকাতায় ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছে। অবিনাশ উদার মনের মানুষ। আপন মহত্ত্বে সে লিলিকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছে। লিলি তো বাবা বলতে অজ্ঞান। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এতদিন। নীপা আর কোনও দিন কারও কাছে আর্য সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো এড়িয়ে থেকেছে বরাবর। আর ভাবতে পর্যন্ত চায়নি এব্যাপারে। সেদিন পার্টিতে দেখা মাত্র এড়িয়ে গেছে, প্রশ্রয় দেয়নি দুর্বলতাকে। কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক তীব্র আবেগের উৎরোল। আজ এই চিঠি, কী লিখেছে দেখাই যাক–
‘প্রিয় নীপা,
নিশ্চয়ই অনেক মান-অভিমান বুকে জমে আছে। অনেক অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু বলি, আমারও বলার কিছু ছিল। সব শোনার পর আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণা বদলাবে কী না জানি না, তবে আমার মধ্যে যে অপরাধবোধ নিয়ত কাজ করে তা কিছুটা হালকা হবে। দীর্ঘকাল ধরে যে যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি তা থেকে মুক্তি পাবার একটা সুযোগ অন্তত দাও। চিঠির তলায় আমার মোবাইল নাম্বার আছে, ফোনে জানিও, কোথায় কীভাবে দেখা হওয়া সম্ভব। প্লিজ নীপা, একটি বার, মাত্র একটি বার মাত্র কিছু সময়ের জন্য দেখা কোরো তুমি।
তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি,
তোমার আর্য ’
পড়া শেষ হলে চিঠিটা হাতের মুঠোতে মুচড়ে ধরে নীপা। অস্ফুটে বলে, ‘না না, কখনওই না। আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা নেই। কোনও কথা থাকতে পারে না। আর কোনও সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। একদিন আমার সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে ভালোবেসেছিলাম, উজাড় করে দিয়েছিলাম আমার অনাঘ্রাতা শরীর। দস্যুর মতো লুঠ করেছ তুমি আমাকে, যা খুশি করেছ, প্রতিবাদ করিনি। সেই তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, অমর্যাদা করলে আমার ভালোবাসার? তোমাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন। না না, কিছুতেই দেখা করব না আমি তোমার সঙ্গে।’
আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। ঘড়ির দিকে তাকায় নীপা, সাড়ে চারটে। মানুর মা এল বোধহয়। ‘যা-ই’, বলে সাড়া দেয়। বিছানা ছেড়ে উঠে যায় দরজা খুলতে।
মানুর মা ঘরে ঢুকলে নীপা বলে, ‘আগে ভালো করে একটু চা করো তো, তারপর বাসনপত্র মেজো।’
ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে নীপা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে মোটেও আর্যদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে না। কারণ আর্যদার মুখোমুখি হলেই সে ফের দুর্বল হয়ে পড়বে। তার ভরাট সংসার ছারখার হয়ে যাবে।
সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে হঠাৎ একটা কোকিল ডেকে ওঠে, কু…হু।
নীপা গাছটির দিকে তাকায়। অজান্তেই ভালো লাগার একটা আবেশ তাকে জড়িয়ে ধরে।
দিনতিনেক পর দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছিল নীপা। খানিক চোখও লেগে গিয়েছিল। এমন অসময়ে হঠাৎই বেলটা বেজে উঠতে এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে নীপার।
এই ক’দিন নীপা মনে মনে কামনা করছিল আর্যদা এ বাড়িতে আসুক। না না, অতটা সাহস হবে না নিশ্চয়ই। গায়ে একটা ওড়না দিয়ে এসে দরজা খোলে নীপা।
‘আর্যদা!’ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। হাত-পা বুঝি অবশ হয়ে আসে, মুখ থেকে কথা বেরোয় না।
‘ভিতরে আসতে বলবে না?’ মুখে সেই দেবদূতের মতো হাসি।
‘এসো’, বলে দরজা ছেড়ে এগিয়ে যায় নীপা বসার ঘরের দিকে। একসময় সোফায় দুজন মুখোমুখি বসে দুদিকে।
আর্যর চোখ যায় টেবিলে একটা ফোটোস্ট্যান্ডের দিকে, চোখে প্রশ্নচিহ্ন জাগে।
নীপা বলে, ‘আমার মেয়ে।’
‘শুধুই তোমার?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আর্য।
নীপা উত্তর দেয় না, মাথা নীচু করে।
‘আমার চিঠি পেয়েছিলে নিশ্চয়ই?’
ইতিবাচক মাথা নাড়ে নীপা।
‘তাহলে ফোন করোনি কেন? বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে আসতে হল আমাকে। অবশ্য আমি জেনেই এসেছি যে তোমার হাজব্যান্ড এখন অফিসে।’
‘কী করে জানলে?’
‘কেন, ওর অফিসে ফোন করে দু’চারটে কথাবার্তা বললাম, তারপর সোজা চলে এলাম এখানে।’
‘এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে? চিঠি পাঠালে কী করে?’
‘সেদিন পার্টিতে আলাপের সময় আমার কার্ডটা দিতে সৌজন্য বশত মি. চ্যাটার্জিও ওর কার্ডখানা আমাকে দেন। তাতে ওর ফোন নাম্বার, অফিস, বাড়ি ইত্যাদির অ্যাড্রেস ছিল। ছিল না কেবল রেসিডেন্সের ফোন নাম্বার।’ জবাব দিল আর্য।
‘থাকলে ফোন করতে বাড়িতে?’ প্রশ্ন করে নীপা
‘হয়তো করতাম।’
‘কী লাভ? আর কী চাও তুমি আমার কাছে?’
‘কিছুই না, শুধু ক’টা কথা বলতে আসা। বুকটা বড়ো ভারী হয়ে আছে,’ বলে আর্য।
‘কী বলতে চাও তুমি বলো,’ নীপার কণ্ঠস্বর নিস্পৃহ শোনায়।
‘বলার হয়তো অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না,’ বলল আর্য। ‘ঠিক মতো বলতে পারব কি না, তাও জানি না। মাত্র তিন দিনের নোটিশে ছবি নিয়ে ফ্রান্সে যেতে হয়েছিল আমাকে প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে। সে যে কী ঝকমারির ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না। তাড়াহুড়োয় তোমাকে খবর দিতে পারিনি। ফ্রান্সে আমাদের পনেরো দিনের প্রোগ্রাম ছিল। এগ্জিবিশনটা আমার জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছিল, বলতে পারো আমার শিল্পী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম শক্ত সোপান। ওই পনেরো দিনেই বহু ইলাস্ট্রেটার, পেইন্টারদের সঙ্গে আলাপ হয়। আমার ছবি ওদের ভালো লেগেছিল। এক ছবি ব্যবসায়ী আমার ছবিগুলি ভাড়া নিতে চায় ছ’মাসের জন্য। সে ওগুলি পারীর বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শন করতে চায়। প্রচুর টাকা অফার দেয়। চুক্তি ছিল, ছবি বিক্রির লাভ ফিফটি – ফিফটি, তবে আমাকে ওই ছ’মাস ওদেশেই থাকতে হবে। সব ব্যবস্থা ওরাই করবে।
আমি রাজি হয়ে যাই ওদের প্রস্তাবে। ছ’মাসে আমার প্রায় সব ছবিই বিক্রি হয়ে যায় চড়া দামে। কাগজে কাগজে আমার নামে লেখা হয় ফলাও করে। ছবির প্রতি প্যাশন তো আমার ছিলই, অর্থ আর খ্যাতির মোহে ডুবে রইলাম আরও ছ’মাস। তারপর ফিরে এলাম দেশে। ততদিনে আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। চড়া দামে বিকোয় আমার ছবি।’
আর্য থামে কিছু সময়ের জন্য, বোঝার চেষ্টা করে নীপার হাবভাব। তারপর ফের বলতে থাকে, ‘কলকাতা ফিরেই আমি তোমার খোঁজ করি। জানতে পারি, আমি চলে যাবার পরই নাকি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি পাড়ি দিয়েছ কানাডা। ফ্রান্স থেকে বার কয়েক তোমাদের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কথা শুনে বুঝেছিলাম তোমাদের বাড়ির কেউই চায় না আমি ফোন করি তোমাকে। একদিন মিলির সঙ্গে দেখা করে তোমার সম্পর্কে জানতে পারি সব কথা। বুঝতে পারি, কী চরম দুর্যোগের মধ্যে তোমাকে ফেলে সেদিন চলে গেছিলাম আমি। আমার জন্য কত ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তোমাকে। নীপা বিশ্বাস করো তুমি,’ আর্য উঠে আসে সোফা থেকে, নীপার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, ‘সেদিনের সে ভুলের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত আমি। আমাকে ক্ষমা করো তুমি, প্লিজ ক্ষমা করো নীপা।’
নীপার চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে। কোনও অভিযোগ সে করতে পারে না আর্যকে।
‘কেঁদো না নীপা, প্লিজ কেঁদো না, আমাকে ক্ষমা করো তুমি’, সোফায় উঠে বসে আর্য।
হাত ছাড়িয়ে নেয় নীপা, নিজের দু’হাতের তালুতে মুখ ঢাকে। এত বছরের জমাটবাঁধা বরফ বুঝি আজ গলে জল হয়ে নেমে আসছে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো, নীপা বারবার চোখ মোছে। আর্য ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ সব ভুলে নীপা দু’হাতে আর্যর বুকে দুমদুম করে কিল মারতে থাকে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ডাকাত, ডাকাত একটা। আমার সব লুটেপুটে ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছে। শয়তান, আর কী চাও? আর কী নিতে এসেছ এখানে?’ সে পাগলের মতন আঘাত করতে থাকে আর্যকে।
‘শান্ত হও নীপা, প্লিজ শান্ত হও’, ওকে কোনও মতে নিরস্ত করার চেষ্টা করে আর্য। একহাতে নীপাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ওর ওড়না দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুমু খায় ওর কপালে বারবার।
ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে নীপা। চোখের জল থামে। প্রশ্রয় প্রাপ্ত চুম্বনেরা অবাধ্য হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে। নীপা অসহায় ভাবে কেবল বলে, ‘আর্যদা, না না, এভাবে আমার সব ভাসিয়ে দিও না।’
কিন্তু ততক্ষণে দুটি শরীর জেগে গেছে…
দীর্ঘ সময় পর উঠে দাঁড়ায় আর্য। নীপা তার বিশ্রস্ত বেশবাস ঠিক করে। কিন্তু এরপরই এক তীব্র অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে নীপাকে। কোনও কথা না বলে সে উঠে চলে যায় টয়লেটের দিকে।
কফি নিয়ে নীপা যখন ঘরে ঢোকে দেখতে পায়, আর্য টেবিল থেকে লিলির ফোটোস্ট্যান্ডটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নীপার পায়ের শব্দে বলে, ‘কত বড়ো হল ও?’
‘এমএ পড়ছে’, মৃদু স্বরে জবাব দেয় নীপা, ট্রে থেকে একটা কাপ আর্যর দিকে এগিয়ে দেয়। অপর কাপটি নিজে নিয়ে বিস্কিট সমেত ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখে।
‘এখন কেমন হয়েছে দেখতে?’
‘ভালো’, সংক্ষেপে উত্তর দেয় নীপা।
‘এ কী গো দিদিমণি, দরজা খোলা কেন?’ বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে মানুর মা।
চমকে ওঠে নীপা, ‘সে কী! সদর দরজা এতক্ষণ খোলা ছিল!’
নীপাদের বসার ঘরটা একতলার কোণার দিকে, বাকি তিনটে ঘর সাধারণত বন্ধই থাকে।
নীপা ভাবে, যদি কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ত, আর ওই অবস্থায় দেখে ফেলত? সর্বনাশ ঘটে যেত। নীপা বলে, ‘তুই দরজা বন্ধ করে আয়।’
প্রকৃতপক্ষে সর্বনাশ যা ঘটার তা আগেই ঘটে গেছিল।
মানুর-মা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে রান্নাঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেক পর সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘লিলিদি বেরোচ্ছ? কিছু খেয়েছ?’
‘সে কী! লিলি ঘরে? সর্বনাশ! কখন এল ও? ওর তো এখন ফেরার কথা নয়!’ নীপার মাথায় বুঝি বাজ পড়ে। মনে হয় মাথাটা ঘুরছে। ওদিকে দুমদাম শব্দে লিলির পদক্ষেপ এগিয়ে আসছে। ওকে এভাবে যেতে দেওয়া যাবে না, ভাবে নীপা। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নীপা ওকে আটকায়, ‘দাঁড়া লিলি, কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
হিংস্র মার্জারিনির মতো ফুঁসে ওঠে লিলি, তীব্র ঘৃণা ওর দু’চোখে। বলে, ‘ছিঃ! এই তোমার পরিচয়? হঠাৎ বাড়ি ফিরে না আসলে জানতেই পারতাম না। অমন দেবতার মতো স্বামীকে এভাবে চিট করছ তুমি, তোমার লজ্জা করে না?’
নীপা বলে, ‘শোন লিলি, তোকে সব খুলে বলছি আমি। ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ ওর হাত দুটি ধরে মিনতি জানায় নীপা।
ততক্ষণে আর্য এগিয়ে এসেছে, ‘লিলি, বি কাম লিলি। শান্ত হও।’
‘শাট আপ ইয়্যু স্কাউন্ড্রেল,’ চেঁচিয়ে ওঠে লিলি। ‘এ বাড়িটা আমার হলে আপনাকে আমি জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।’
আর্যর মুখে বুঝি সপাটে থাপ্পড় মারে কেউ, এভাবে জীবনে তাকে অপমান করেনি কোনও মানুষ। লেডিকিলার হিসাবে নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তার। আজ তারই সন্তান কী না… মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে ওর।
লিলির কথাবার্তায় দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে নীপা, চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘লিলি! তুই কাকে কী বলছিস, জানিস, ও তোর কে হয়?’
দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস শব্দে লিলি বলে, ‘আজই জানতে পারলাম। এরকম দুশ্চরিত্র লম্পট পুরুষ আমার ‘বাবা’ জেনে লজ্জা হচ্ছে। আর তোমার মতো অসংযমী নোংরা মহিলাও ‘মা’ সম্বোধনের পক্ষে অযোগ্যা। আই হেট ইউ, ইয়েস, বোথ অফ ইউ।’
‘বাবা’ যদি বলতেই হয় তো বলব অবিনাশ চ্যাটার্জিকে। যিনি সব কিছু জানার পরও আমাকে নিজের সন্তান হিসাবে বুকে তুলে নিয়েছেন, উজাড় করে ভালোবেসেছেন, তোমার প্রতি স্বামীর সমস্ত কর্তব্য করেছেন।’
আর্য বলে, ‘শোন মা শোন, তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর…’
‘চুপ, একদম চুপ, আমাকে একদম ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। আই অ্যাম নট আ সেন্টিমেন্টাল ফুল লাইক নীপা, আন্ডারস্ট্যান্ড?’ জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে লিলি সরাসরি তাকায় আর্য কাশ্যপের দিকে।
সেই আগুনঝরা দৃষ্টির সামনে কেমন কুঁকড়ে যায় আর্য। এই প্রথম বুঝি সে সত্যের মুখোমুখি হয়। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নেয়, অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, কোনও কথা বেরোয় না তার মুখ থেকে।
ঠকঠক ঠকঠক দ্রুত শব্দ তুলে হেঁটে এগিয়ে গেল লিলি, দরজা খোলার আওয়াজ হল সজোরে।
——-