তখন প্রায় বারোটা। অতিথি-অভ্যাগত, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব সকলেই জয় আর নিশার রিসেপশন পার্টি অ্যাটেন্ড করার পর, যে -যার বাড়ির পথে। বাড়িতে শুধুমাত্র বাইরের বলতে জয়ের ছোটোমাসি। সেই অর্থে বাড়িতে কেউ না থাকায় তিনিই নতুন বউকে ফুলসজ্জার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
ফুলসজ্জার এই বিশেষ দিনটি নিয়ে সকলেই স্বপ্ন সাজিয়ে রাখে। জয়ও তার বাইরে নয়। এই মধুযামিনী নিয়ে তারও অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই আমন্ত্রিতরা যাওয়া মাত্রই বাড়ির সকলের থেকে নজর বাঁচিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল জয়।
তবে হ্যাঁ অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে একটা প্রবলেম আছে বটে, পূর্ব-পরিচিত না হওয়ায় বিয়ের প্রথম রাতে একটা অচেনা মানুষকে ফেস করা বেশ অস্বস্তিকর৷ যদিও নিশা এখন তার অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী, তবুও কেমন যেন একটা অপ্রতিভতা কাজ করে। কীভাবে শুরু করবে? কী বলবে? এইরকমই কিছু ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকতেই, নিশাকে অবিন্যস্ত অবস্থায় দেখে একেবারে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে জয়। বিয়ের শাড়ি, গয়না সমস্তকিছু সারা বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, আর নিশা কোনওমতে একটা শাড়ি জড়িয়ে ঘরের কোণে একটা চেয়ারে হাত-পা গুটিয়ে বসে দরজার দিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করে রয়েছে।
জয় ঘরে ঢোকা মাত্রই তার দিকে ক্রূর দৃষ্টি নিয়ে বলে ওঠে নিশা, ‘এবার কি আমার পালা? আমাকেও মেরে ফেলবে তুমি?’
একে তো ফুলসজ্জার রঙিন স্বপ্নভঙ্গ, তার ওপর নিশার এরকম আশ্চর্য কথাবার্তায় জয় চমকে ওঠে।
‘কী যা-তা বলছ ! কী হয়েছে তোমার? এরকম আচরণ কেন করছ?’ যতটা সম্ভব সপ্রতিভ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে জয়। ‘দ্যাখো আজ আমাদের ফুলসজ্জা। একে-অপরকে ভালো করে জেনে নেওয়ার দিন। প্লিজ, এই দিনটাকে নষ্ট কোরো না। যে-কোনও নববিবাহিতই এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।’ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নিশাকে নানারকম ভাবে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে জয়।
‘এসব ছাড়ো! আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে চার-পাঁচজন মহিলা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, আমি সব শুনেছি।’
‘কী? কী শুনেছ তুমি?’ উত্তেজিত হয়ে ওঠে জয়।
‘তারা বলছিল একজনের মৃত্যুর ছ’ সাত মাসও পূর্ণ হল না, আর একজন মরার জন্য হাজির।’
নিশার কথা শোনা মাত্রই জয়ের কাছে ছবিটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। নিশার দিকে খানিক এগিয়ে যায়। বলে, ‘আচ্ছা একথা যিনি বলছিলেন, তিনি কি খুব মোটা আর কালো? পান খান, তাই তো?’
‘হ্যাঁ, উনিই তো বলছিলেন।’
‘দ্যাখো উনি আমাদের পাড়াতেই থাকেন। আমাদের দূর-সম্পর্কের কাকি হন। কারওর ঘরের সুখশান্তিই ওনার একেবারেই সহ্য হয় না, তাই লোকের ঘরে আগুন লাগিয়ে বেড়ান। প্লিজ ট্রাস্ট মি। ওঁর কথায় কান দিও না।’
‘ঠিক আছে এটা না হয় মানলাম যে, উনি কারও সুখশান্তি দেখতে পারেন না। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে তো আর এত বড়ো মিথ্যে বলতে পারেন না যে, তোমরা কোনও মহিলাকে মেরে ফেলেছ। ঝেড়ে কাশো তো সে কে?’ নিশা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না জয়কে।
‘সে আর কেউ নয়, আমার বড়দার বউ। অনিতা বউদি। অনেক দিন ধরে বউদি ক্যানসারে ভুগছিল। আমরা বউদির চিকিৎসার ব্যাপারে কোনওদিন বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি। কিন্তু কেন জানি না হঠাৎই একদিন বউদি, দাদা আর নিজের মেয়ে তিন্নির কথা ভুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।’ বউদির কথা বলতে বলতে বেশ আনমনা হয়ে পড়ে জয়। মনটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে ওর।
‘কোনও কিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছোলে কেউ আত্মহননের কথা ভাবে না। সুইসাইড করা এত সহজ নয়। তোমরাই এমন কিছু করেছ যাতে উনি সুইসাইড করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো তোমরাই তাকে মেরে ফেলেছ। আমাকে এত বোকা ভেবো না যে, যা বোঝাবে তাই বুঝব।’ নিশার গলায় রাগ ঝড়ে পড়ল।
বারবার বোঝানো সত্ত্বেও নিশা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না– চেষ্টা করেও বিরক্তি চাপতে পারল না জয়।
‘সমস্ত কিছু কি তোমার আজই ,এখনই জানতে হবে? পরে শুনলে হবে না? আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না! কোথায় নতুন জীবনের শুরুটা ভালো হবে। তা না…’
কিন্তু হায়! কথায় আছে না…
অবুঝে বোঝাব কত, বুঝ নাহি মানে।
ঢেঁকিকে বোঝাবে কত নিত্য ধান ভানে।।
কে কার কথা শোনে। নিশা তার জায়গায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে তার ভাবনাচিন্তা থেকে এক পা-ও নড়বে না। অবশ্য শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পা রেখেই কেউ যদি এমন কথা শোনে, তাহলে নিশার কেন, যে-কোনও মেয়ের মনেই ভীতির সঞ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর জন্য নিশাকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। জয়ের কথা একপ্রকার উড়িয়ে দিয়েই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে নিশা। জয়ও তার বিয়ের প্রথম রাতের তিক্ত অনুভূতি নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে, সে হয়তো নিজেও টের পায় না।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও নিশা সেই একই ছন্দে। পরনে একটা সাদামাটা শাড়ি, গায়ে গয়না নেই। কোথায় নতুন বউ গয়নাগাটি পরে পরিপাটি হয়ে থাকবে, তা নয় চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
নিশার এই আচরণ দেখে বাড়ির সকলেই কিছু না কিছু বলেছে। কিন্তু ওই! কারও কথা শোনা বোধহয় তার অভ্যেস নেই। সে তার নিজের মতো খবরের কাগজটা নিয়ে টেবিলে বসে পড়ল। পড়তে পড়তেও ফ্রন্ট পেজ-এ পণ না দিতে পারার জন্য বধূ হত্যার ঘটনা পড়া মাত্রই জয়কে দেখে কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, ‘দ্যাখো দ্যাখো, তোমাদেরই মতো সব পাত্রপক্ষই নিজেদের নির্দোষ বলে জাহির করে। আদপে যে তোমরা কী…!’
নিশার কথা শুনে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জয় জবাব দেয়, ‘পৃথিবীতে না জানি এমন কত ঘটনাই না ঘটে, সব ঘটনার ভিত্তি তো আর এক নয়। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলি, অনিতা বউদির সুইসাইডের ব্যাপারে আমরা নিরপরাধ… এব্যাপারে সত্যিই আমাদের কোনও প্ররোচনা ছিল না।’
‘এখন তো তিনি আর এসে বলতে যাবেন না যে দোষ কার!’ নিশার তীর্যক মন্তব্য চলতেই থাকে।
নিশার ব্যবহারে ফেড-আপ হয়ে ওঠে জয়, ‘পুষ্পকাকি তোমার মনের মধ্যে এমন সন্দেহের বিষ ঢেলেছেন যে, আমি কেন, স্বয়ং ভগবানও তা দূর করতে পারবেন না।’
বসার ঘরেই জয় আর নিশার মধ্যে এই সমস্ত কথাবার্তা চলছিল। ঠিক সেই সময়েই জয়ের মা কোনও কারণে ঘরে ঢুকতেই তাদের কথাবার্তার কিছু অংশ শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন– ‘ছাড়ো না বউমা, খবরের কাগজে কী বেরোল না বেরোল সেই নিয়ে শুধু শুধু নিজের মাথাখারাপ করা কেন বাপু। আর এসবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কীসের!’
নিশা একেবারে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘সম্পর্ক কেন নেই? অবশ্যই আছে! কয়েকদিন আগেই তো এবাড়িতে বধূহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অস্বীকার করতে পারেন? এখন আমাকে অনেক কিছুই ভাবনাচিন্তা করতে হবে।’
সম্ভ্রমের বদলে শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের প্রতি নববধূর এহেন বিরূপ আচরণ, জয়ের মা তুলিকাদেবীকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলল।
মায়ের কালো মুখ দেখেই জয় বুঝে গিয়েছিল তিনি কতটা চিন্তান্বিত। ঠিক সেই মুহূর্তে মাকে খানিক আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে জয় বলে ওঠে ‘শোনো মা, ও এবাড়িতে আসতে না আসতেই পুষ্পকাকি তার কাজ সেরে দিয়ে গেছে। না জানি ওর মনে কী কী বিষ ঢেলেছে। এটা তারই ট্রেলার!’
তুলিকাদেবীর আর কোনওকিছুই বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে পুষ্প-কে তুলোধোনা করতে থাকেন তিনি। পরিস্থিতি যাতে আরও জটিল না হয়, সেই কারণে জয়, মাকে নিয়ে উপরের ঘরে চলে যায়। মা-কে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, দু-দিন শ্বশুরঘর করতে না করতেই শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া লোকের কানে গেলে, একটা হাস্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হবে। সেটা লোকসমাজে বড়োই দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়াবে। তাই জয়ের এই নীরব থাকার পন্থা অবলম্বন। তার মার প্রতি নিশার এই দূর্ব্যবহার, সুন্দরী নিশাকেও একেবারে জয়ের কাছে কদর্য করে তুলছিল।
মিনিট পাঁচেক পরেই জয় উপর থেকে নেমে আসে। রাগ সামলে নিয়ে নিশাকে আবারও বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘এভাবে কেন সিন ক্রিয়েট করছ? মার সাথে এইরকম ভাবে কথা বলাটা কি তোমার উচিত হল? দু’দিনও হয়নি তুমি এবাড়িতে এসেছ, তাতেই তুমি বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস করে নিলে। আমাদের থেকে আগে তারা আপন হল তোমার কাছে?’
বড়োবউ তো আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে সমাজের চোখে তাদের অপরাধী সাজিয়েই রেখেছে। তার উপর ছোটোবউয়ের এহেন অনভিপ্রেত আচরণে তুলিকাদেবী মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন যা ঘটার ঘটে গেছে। বাড়িতে নতুন বউ এলে সংসার আবার আনন্দে ভরে উঠবে। তাই খুব তাড়াতাড়িই ছোটোছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মেয়েও যথেষ্ট শিক্ষিত, সুন্দরী আর ছেলেও স্টেবল– নিজের বাড়ি, গাড়ি। সেই কারণেই দু-পক্ষই বিয়েতে অমত করেনি।
সব কাজই ঠিকঠাক মিটল তারপরেই যত বিপত্তি। তুলিকাদেবী স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এভাবে নতুন বউয়ের হাতে তাদের হেনস্থা হতে হবে। তিনি না হয় ছেলের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে নেবেন কিন্তু ছোটোছেলে…! তার কী হবে? বড়োছেলের ঘর তো আগেই ভেঙেছে, এবার যদি ছোটোছেলের সংসারটাও…! যেন সেরকমই কিছু অশনিসংকেতের আভাস পেতে থাকেন তুলিকাদেবী।
নিজের মাথা যতই নত হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে আবারও একবার চেষ্টা করলেন তিনি। নিশার কাছে গিয়ে তাকে কাছে ডেকে নিলেন। ‘দ্যাখো বউমা, তুমি আমার মেয়ের মতো। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝবে। সংসারে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অন্যের সংসারে আগুন লাগিয়ে আনন্দ পেতে ভালোবাসে। তাই বলছি, তুমি তো যথেষ্ট শিক্ষিত বলেই জানি বউমা! লোকের কথা শুনে ভুল না বুঝে, আমার মনে হয় সব ভুলে ক’দিন মন দিয়ে সংসার করলেই আমাদের বুঝতে পারবে। তুমিও ভালো থাকবে।’
ঠিক তখনই তুলিকাদেবীর বড়োছেলের মেয়ে, বছর তিনেকের নাতনি তিন্নি কেঁদে ওঠায়, তিনি ছেলের ঘরে চলে গেলেন।
জয়ের বড়দা নিলয় আর ছোটোমাসি, বিয়ের সমস্ত জিনিসপত্রের হিসেবনিকেশ করতে সারাদিন এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, সেভাবে কোনওদিকে কর্ণপাত করার সুযোগ ঘটেনি। তবে হ্যাঁ একেবারেই যে কিছু শোনেননি, সেটা বললেও বোধহয় ভুল হবে। সেই মুহূর্তে হয়তো চুপ থাকাটাই উচিত বলে মনে করেছেন তারা।
সন্ধেবেলা আশপাশের বেশ কয়েকজন মহিলা নিশার সঙ্গে আলাপ করার জন্য বাড়িতে আসতেই, তুলিকাদেবী তাদের আগমনবার্তা জানিয়ে বউমাকে নীচের ঘরে আসার জন্য বলে পাঠালেন। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও একটা ভয় ছিলই। এই বুঝি কেউ আবার কানভারী করার মতো কথা বলে বসে। তাই নিশা নীচের ঘরে আসতেই তিন্নিকে কোলে নিয়ে নিশার একদম পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন তুলিকাদেবী।
কিন্তু তাতেও কি আর নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করা সম্ভব? যা আশঙ্কা করছিলেন ঠিক তা-ই হল। একজন তো মা-হারা মেয়েকে দেখে বলতেই শুরু করল, ‘আহা রে এই বয়সে মাকে ছেড়ে থাকা… অনিতা কত আদরযত্নে রাখত। দিদিমার পক্ষে কি সম্ভব? সেদিন সকালেও বারান্দায় বসে গল্পগুজব করছিল। কী জানি বাপু হঠাৎ করে কীভাবে ঘরে আগুন লেগে গেল!’
পাশে বসা আর-এক মহিলা সায় দিয়ে বলে, ‘আহা গো আমি তো নিজের চোখে দেখেছি কত কষ্ট পেয়ে পুড়ে মরেছে মেয়েটা। এবার তো সংসারের হাল ধরতে হবে নিশাকেই। নিলয়ের বাচ্চাটাকেও মাতৃস্নেহে পালন করতে হবে। নিলয়ের কি আর বিয়ে করবে!’
তুলিকাদেবী এমনিতেই যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। নতুন বউয়ের সামনে পড়শিদের এহেন কথাবার্তা চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। অস্বস্তি এড়াতে দ্রুত জলখাবার খাইয়ে তাদের বিদায় করেন। তবে ততক্ষণে নতুন বউয়ের মন আরও ভারাক্রান্ত।
প্রতিবেশীরা চলে যাওয়ার পর জয় নীচে নেমে আসে। নিশাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জয়ের নিজেকে হঠাৎ দোষী মনে হয়। ভাবে কোথাও ঘুরে এলে হয়তো নিশার মনটা ভালো হবে। নিশার দিকে তাকায়, ‘চলো দুজনে কোথাও ঘুরে আসি। ভালো লাগবে।’
‘এসব আদিখ্যেতা ছাড়ো, অনেক হয়েছে, এবার কি গভর্নেস-এর ডিউটিও করতে হবে?’
‘দ্যাখো, বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য মালতী আছে, মা আছে। দাদা তো আছেই। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই, ইচ্ছা না থাকলে তিন্নি-র কোনও কিছু তুমি কোরো না। কে কী বলে গেল, আর উনি ওটাই ভেবে নিলেন।’ নিশাকে শান্ত করার চেষ্টা করে জয়।
নিশা যদিও মানতে নারাজ। গজগজ করতেই থাকে, ‘দুই ভাই-ই জল্লাদ। দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না।’
পরের দিন ফোনে দাদা-বউদিকে সব কথা জানায় নিশা। ছুটে আসেন দুজনেই। ক্ষোভ উগরে দেন জয়ের পরিবারের উপর।
তুলিকাদেবীকে সামনে পেয়েই বলেন, ‘আপনারা আপনাদের বড়ো বউকে পুড়িয়ে মারার খবর আমাদের কাছে লুকিয়েছেন।
আগে জানলে…।’
অভিযোগ শুনে ক্ষুব্ধ জয় কোনওমতে ক্রোধ সংবরণ করে, ‘থানায় গিয়ে খোঁজ নিন, সত্যিটা জানতে পারবেন। বউদির ক্যানসার ছিল। রোগের যন্ত্রণা আর মৃত্যুভয় থেকে বউদি ড্রিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। তার থেকেই সুইসাইড। আমরা যদি মারতামই, তাহলে আপনার সামনে নয় সপরিবারে জেলে থাকতাম।’ যদিও জয় বোঝাতে ব্যর্থ।
ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নিশার দাদা-বউদি। হঠাৎই পথে দেখা হয় এক আত্মীয়ের সাথে। যার মাধ্যমেই এই বিয়ের যোগাযোগ। দাদা-বউদির থেকে ক্ষোভের কথা শুনে তিনি আশ্বস্ত করেন, ‘জয়দের পরিবার যথেষ্ট ভদ্র। কেউ যদি আত্মহত্যা করে, ওদের দোষ কোথায়? পরিবারটিকে অনেকদিন ধরেই চিনি, অযথা রাগ করছিস। এক বউয়ের অবস্থা এমন হয়েছে বলে নিশার যে একই অবস্থা হবে তার কি কোনও মানে আছে? আর তোরা যে ডিভোর্সের কথা ভাবছিস, তারপর নিশার কী হবে ভেবে দেখেছিস?’
নিজেদের ভুল বুঝতে পারে নিশার দাদা-বউদি। ফিরে গিয়ে জয়ের মায়ের কাছে ভুল স্বীকার করে নেন। নিশাকেও বোঝায় দু’জনেই।
কিন্তু নিশা অনড়। মনে মনে ভাবে দাদা বোধহয় নিজের দায়িত্ব এড়াতেই ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিচ্ছে।
দাদাকে পাশে না পাওয়াটা নিশা একেবারেই মন থেকে মানতে পারে না। বড়ো একলা, নিঃসঙ্গ বোধ করে সে। মনে মনে ভাবে যদি এই দুঃসময়ে পাশে কেউ থাকত।
মনে পড়ে দিদির কথা। মেইল-এ দিদিকে সব জানায়। উত্তরে দিদি লেখে, ‘চিন্তা করিস না, আমি তোর পাশে আছি। যখনই প্রয়োজন পড়বে আমাকে ডাকবি। সতর্ক থাকিস। সে রকম সন্দেহজনক কিছু বুঝলে থানায় রিপোর্ট করবি। তোর চিঠিটা প্রমাণ হিসাবে রেখে দিলাম।’
এরপর কেটে যায় আরও বেশ কয়েকটা দিন। এরই মধ্যে নিয়মানুযায়ী অষ্টমঙ্গলা ছাড়াও বারকয়েক তারা ঘুরে এসেছে দাদার বাড়িতে। কিন্তু দুজনের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক সেইভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশা আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। জয় চেষ্টা করেছিল ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে।
কিন্তু বিধি বাম। এর মধ্যে হাজির লোন নিয়ে নতুন ঝামেলা। জয়ের বিজনেসে ঘাটতি। হঠাৎ প্রয়োজন পড়ে টাকার।
পরিচিত মহল থেকে লোন নিলে কারখানার কর্মীদের কানে খবর পৌঁছোবেই। অকারণে কর্মীরা বিব্রত হয়ে উঠবে। সেই কারণেই অন্য কোথাও থেকে ব্যবস্থা করা। সেই মুহূর্তে নিশার দাদা অমলেন্দুবাবুই এগিয়ে এসে জয়কে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তার অনেক বন্ধুবান্ধবই ব্যাংক-এর সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং লোন পেতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি অমলেন্দুবাবু। বরং বিভিন্ন অছিলায় ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছেন। বোনও কম যায় না। সে তো এমনিই কোনওদিন জয়ের ভালো চায়নি। দিবারাত্রি অকথা-কুকথা রয়েইছে। তার উপর যতদিন লোন সম্পর্কিত কথা তার কানে গেছে, নিশার মন্তব্য আরও তীক্ষ্ণ ও শাণিত হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তিক্ততা চরমে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় দুজনের কথাবার্তা। নিশা ভেবে নেয় এটা বোধহয় ঝড়ের পূর্বাভাস। তারও বোধহয় দিন ঘনিয়ে এল। তাই
দিদির কথামতো সদা চোখ-কান খোলা রাখা। একটুতেই সকলকে সন্দেহ করা…।
রাত্রিতে খাওয়াদাওয়ার পর সকলে মিলে উঠোনে বসে খানিকক্ষণ আড্ডা মারার অভ্যাসটা জয়েদের একেবারে চলেই গিয়েছিল। আজ অনেকদিন পর একসঙ্গে বসে নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প– পরিবেশটাতেই অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। হঠাৎই উঠোনে সকলকে একসঙ্গে বসে ধীরে ধীরে কথা বলতে দেখে, আতঙ্কে শিউরে ওঠে নিশা। দূর থেকে তাদের কথা শোনার নানারকম চেষ্টা করেও ‘টাকা’ ছাড়া আর একটি শব্দও বোধগম্য হয় না তার।
একটা শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে যায় নিশার শিরদাঁড়া বরাবর। মনে সন্দেহের ভাবনাটা চেপে বসতে থাকে যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গায়ে আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান বানাচ্ছে সবাই মিলে।
এর থেকে বাঁচতে হলে তাকে ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারও তো উপায় নেই। মেইন গেটে অনেকক্ষণ আগেই যে তালা পড়ে গেছে। সুতরাং বাঁচতে হলে অন্য কোনও পথ খুঁজে বের করতেই হবে। অন্যথায় আজ তার মৃত্যু অনিবার্য।
মনে মনে ভাবে পাড়াপড়শিদের চেঁচিয়ে ডাকবে, কিন্তু তাদের সঙ্গেও তো সেই অর্থে খুব একটা পরিচয় হয়ে ওঠেনি নিশার। তারা তার ডাকে সাড়া দেবে কি? নাকি যে-কোনও– উপায়ে আগে ঠিক করে তাদের কথা শুনতেই হবে। সেইমতো চুপিচুপি সবার অলক্ষ্যে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে উঠে উঠোনের দিকের কার্নিশের ধারে এগিয়ে যায় নিশা।
দোতলায় একটা ঘর আগেই ছিল। লোকজন এলে ভীষণ অসুবিধা হয়। সেকথা ভেবেই গতবছর দোতলায় আর-একটি ঘর বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিলয়। সেইমতো কাজও এগোচ্ছিল। মিস্ত্রিরা সবেমাত্র উঠোনের সাইডের কার্নিশ ভাঙা শুরু করেছে কী অনিতার টেস্ট রিপোর্ট হাতে এল। সেদিন খরচের কথা ভেবে সব কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছর গড়িয়েছে কিন্তু সেই কার্নিশ আজও মেরামত হয়নি। শুধু ইটগুলোকে থাক-থাক করে সাজিয়ে রাখা রয়েছে মাত্র।
আলো-আঁধারির মায়াজালে নিশা সামনের দিকে পা বাড়াতেই, হঠাৎই শাশুড়ির চিৎকার। নিশা তখনই বুঝতে পারে এই চিৎকারের কারণ তার পা লেগে উপর থেকে পড়া ইট। ভয় পেয়ে গিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিশা। নিজের ঘরের বিছানার চাদরের মধ্যে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। ঠিক তখনই জয় ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকে, ‘নিশা ওঠো। ছাদ থেকে কীভাবে যেন একটা ইট মায়ের মাথায় পড়েছে। আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি ঘর পাহারা দিও।’
তুলিকাদেবী বেশ গুরুতর চোটই পেয়েছিলেন। ন’টা স্টিচও পড়েছে। আপাতত হসপিটালে আবজার্ভেশনে আছেন। নিশা মনে মনে বেশ উৎফুল্ল। ভাবল, তাকে মারার প্ল্যান বানানো, ভগবান এর ফল একেবারে হাতেনাতে দিয়েছেন। মরে গেলেও ক্ষতি হতো না।
শাশুড়ি হাসপাতালে। সুতরাং সমস্ত ঘর-সংসারের দায়িত্ব এখন তারই। তৎসত্ত্বেও তার দু-ঠোঁট এক না করার কারণ বোধহয় কোথাও একটা অনুশোচনা– তার কারণেই শাশুড়ির আজ এই অবস্থা।
এরই মধ্যে একদিন দুপুরে তিন্নির জামাকাপড় বউদির আলমারিতে রাখার সময়, নিশার চোখে পড়ে একটা ফাইল। কৌতূহলবশত ফাইলটা খুলতেই নজরে আসে অনিতা বউদির আত্মহত্যা সম্বন্ধিত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং আদালতের রায় সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র। সঙ্গে বউদির একটা চিঠি। যার
বয়ান এরকম–
প্রিয় নিলয়,
আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। এটাও জানি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তুমি তোমার কর্তব্য থেকে একটুও পিছপা হবে না। কিন্তু ডাক্তারবাবু যখন আমার অন্তিম সময় বেঁধেই দিয়েছেন, তখন আমার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করে লাভ কী। অনেক তো করেছ। ধার করে আর নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলো না। তাই বিদায় নিলাম। তিন্নির খেয়াল রেখো। নিজেরও। তিন্নিকে মায়ের অভাব বুঝতে দিও না, ওর জন্য নতুন মায়ের ব্যবস্থা কোরো।
ইতি
তোমার অনিতা
চিঠিটা পড়েই নিশার মাথা ঘুরে গেল। এটা কী করেছে সে– লোকের কথা শুনে নিজের জীবনের বেশ কিছু সুখের সময় নিজের হাতেই খুন করেছে সে। অমন দেবতুল্য ভাসুরকে প্রতিটি পদে পদে অপমান করেছে। স্নেহময়ী শাশুড়িকে সুয়োগ পেলেই হেনস্থা করেছে। এমনকী জয়কে বড়ো শত্রু হিসাবে দেখে এসেছে। না পেরেছে ভালো স্ত্রী হতে, না বউমা। যারা বউকে সুস্থ করতে লোকের কাছে হাত পাততেও দ্বিধা করেনি– তাদের সঙ্গে এরকম জঘন্য ব্যবহার করেছে সে। লজ্জা আর অনুশোচনার আগুনে মাটিতে মাথা কুটে মরার মতো অবস্থা হয় নিশার।
ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে ওঠে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে উঠে ফাইলটা আলমারিতে রেখে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল নিশা। দরজা খুলতেই দেখল জয় দাঁড়িয়ে। ভীষণভাবে বিধবস্ত। কোনওমতে হাত-পা ধুয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল জয়। নিশা জয়ের দিকে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘মা কেমন আছেন?’
‘এখন একটু ভালো আছে। চোখ খুলেই তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তুমি বাড়িতে একা আছো তাই চিন্তা…। নিশাকে উত্তর দিয়েই চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই বিড়বিড় করতে থাকে, কী করে কী হবে, কে জানে, একে বিজনেসে ঘাটতি। তার উপর… কীভাবে যে কী সামলাব! বিড়বিড় করা বন্ধ করে হঠাৎই আবার নিশাকে বলে, ‘তুমিও একটু খেয়াল রেখো। কার্নিশের ধারে যেও না কিন্তু।’
চোখ বন্ধ থাকার জন্য নিশার করুণ, জলে ভেজা, ঝাপসা দৃষ্টির দিকে খেয়াল করেনি জয়। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে আলমারি থেকে একটা বাক্স বার করল নিশা। তারপর বলল, ‘জয় ওঠো, বেলা গড়িয়ে গেছে। খেয়ে নাও। তোমার খাওয়া হলে আমরা মাকে দেখতে যাব। ও হ্যাঁ এটা রাখো।’
বেশ আশ্চর্য হয় জয়, ‘এগুলো তো তোমার গয়না। আমাকে দিচ্ছ কেন?’
‘তুমি এগুলো বন্ধক রেখে নয় তো বিক্রি করে তোমার বিজনেসে লাগাও। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এগুলো তো অসময়েরই সঙ্গী বলো। শুধু শুধু ঘরে রেখে কী হবে। এই বাড়িটা তো আমারও নাকি। আমার সংসারের সুখের জন্য আমি ভাবব না তো কে ভাববে।’
হঠাৎই নিশার এই পরিবর্তনে জয় অবাক। বোকার মতো কেবল নিশার দিকে তাকিয়ে রইল। আর নিশার চোখে তখন সোনার সংসারের স্বপ্ন।