‘মুর্শিদাবাদ বলতে মানুষ বোঝে হাজারদুয়ারি। এর বাইরেও যে দেখার আছে, ঐতিহ্যের দিক থেকে নবাবি ইতিহাসের চেয়ে সেসব কোনও অংশে কম নয়, সে খবর কেউ রাখে না। আপনারাও রাখেন না, আপনাদের কাগজগুলোও রাখে না। রাখলেও ছাপার কথা ভাবে না।’ কথাগুলো ক্ষোভের সঙ্গে উগরে দিলেন সুখেন কর্মকার। নৌকা তখন মাঝ নদীতে। জিয়াগঞ্জ থেকে ভাগীরথী পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি আজিমগঞ্জ– বাংলার আর এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সন্ধানে।
কলকাতা থেকে সকালে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে ঘন্টা চারেকের ব্যবধানে মুর্শিদাবাদের পরের স্টেশন জিয়াগঞ্জ। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। সুখেনদা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। স্থানীয় মানুষ তিনি, আমার পূর্বপরিচিত। আমার আসার খবর তাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। চা-জলখাবারের পর্ব শেষ করে চেপে বসলাম তার বাইকে। স্টেশন থেকে সোজা ফেরিঘাট। এপারে জিয়াগঞ্জ ওপারে আজিমগঞ্জ– মাঝে ভাগীরথী। নদী পেরিয়ে বড়োনগরের দূরত্ব মাত্র তিন কিমি।
সেকালে বড়োনগরকে বলা হতো বাংলার বারাণসী। আজকের বড়োনগরকে দেখে নবাবি আমলের সেই বাণিজ্য নগরীকে কল্পনা করা হয়তো একটু কষ্টকর হবে। তখন বহু বিদেশি বণিক পালতোলা জাহাজ নিয়ে এখানে বাণিজ্যের জন্যে আসতেন। বড়োনগরের খ্যাতি ছিল কাঁসা-পিতলের জন্যে। আজ সে নবাবি আমল নেই, বাণিজ্য কেন্দ্রও নেই। নদীর মতো সময়ও একূল ভাঙে ওকূল গড়ে। নতুন নতুন শহর-নগরের জন্ম হয়, হারিয়ে যায় অনেক প্রাচীন নগরী। বড়োনগর এমনই এক শহর। সময় তাকে যেমন গ্রাস করেছে, ভাগীরথীও কম করেনি। তবু আজও অতীতের সাক্ষী হিসাবে টিকে আছে ডজনখানেক মন্দির। বাংলার নিজস্ব শৈলী আর টেরাকোটার কাজের জন্য আজও তারা আপন বৈশিষ্টে উজ্জ্বল। আমরা সেই মন্দিররাজি দর্শন করতে যাচ্ছি।
সুখেনদা বললেন, ‘বড়োনগরের ইতিহাস জানতে হলে রানি ভবানীকে আগে জানতে হবে। রানি ভবানীর হাতেই বড়োনগরের জন্ম বলতে পারেন। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে এই বড়োনগর ছিল রানির প্রিয় বাসস্থান।’
‘রানি ভবানীর নামটা শোনা শোনা লাগছে’, আমি বললাম, ‘কোথাকার রানি ছিলেন ইনি?’
ততক্ষণে নৌকা ঘাটে লেগেছে। দু’জনে মিলে ধরাধরি করে ফেরি নৌকা থেকে বাইক নামালাম ডাঙায়। শুরু হল আমাদের বড়োনগর যাত্রা।
সুখেনদা চালাচ্ছে, আমি সওয়ার। ফেরিঘাটের জটলা কাটিয়ে একটু ফাঁকায় আসতেই পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরলেন তিনি, ‘যেকথা হচ্ছিল, রানি ভবানী… নাটোরের রানি ছিলেন।’
বুকের মধ্যে ছলাৎ করে ওঠে ভাগীরথীর জল। প্রিয় পাঠক, জানি কমবেশি আপনার অবস্থাও একই রকম। নাটোর শব্দটার সাথে জড়িয়ে আছে শিক্ষিত বাঙালির এক গোপন ভাবাবেগ। শব্দটা শুনলেই মনে পড়তে বাধ্য জীবনানন্দ দাশ, বনলতা সেন… থাকে শুধু অন্ধকার আর মুখোমুখি বসিবার… কে জানে ইনিই সেই…!
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। বলি, ‘নাটোর!’
‘আদপে এনারা ছিলেন বরিশালের জমিদার। যেহেতু বরিশালের নাটোর গ্রামের মানুষ ছিলেন, তাই নাটোরের রাজা হিসাবেই পরিচিতি ছিল রাজা রামকান্তের। ১৭৫৩ সালে রামকান্তের অকাল প্রয়াণের পর মাত্র ২৭ বছর বয়সে, মতান্তরে ৩২ বছর বয়সে বিশাল জমিদারির শাসনভার নিজে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রামকান্তের বিধবা স্ত্রী রানি ভবানী এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। রানি ভবানী ছিলেন শিক্ষিত মহিলা। বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষায় তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। জমিদারির কাজেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বামী বেঁচে থাকতে জমিদারি পরিচালনার অনেক ক্ষেত্রেই তিনি স্বামীকে সাহায্য করতেন।
দান ধ্যানের ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না। প্রজারা মাতৃরূপে দেখত। বলত, দীনজননী, সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। আর ছিল ধর্মে মতি। রানি ভবানী ছিলেন শিবের উপাসক। সধবা থাকাকালীন ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কাশীর শিব মন্দির তৈরি করে তাতে ভবানীশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা করেন। বড়োনগর ছিল নাটোররাজের দ্বিতীয় আবাসস্থল এবং রানি ভবানীর প্রিয় জায়গা। পরবর্তী কালে এই বড়োনগরকেই তিনি তার সাধনস্থল হিসাবে বেছে নেন এবং তৈরি করেন একটার পর একটা শিবমন্দির। মোট ১০৭-টি শিবমন্দির তৈরি করে তিনি বারাণসীতুল্য করে তুলতে চেয়েছিলেন বড়োনগরকে। যার
অধিকাংশই আজ কালগর্ভে নয়তো নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। টিকে আছে কয়েকটি মাত্র।’
কথা বলতে বলতে আমরা মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সামনেই একবাংলা পঞ্চানন শিবমন্দির। মন্দিরের খিলানে পোড়ামাটির কাজ। ভেতরে প্রাচীন শিবমূর্তি। এই শিব বৈশিষ্ট্যে অনন্য। মহাদেবের এখানে পাঁচটি আনন।
পাঁচমুখী শিবমন্দির দর্শন করে সামান্য উত্তরে এগোতেই বড়োনগর তথা রানি ভবানীর অনন্য কীর্তি চারবাংলা মন্দিররাজি। একটি স্বল্প পরিসর স্থানে মুখোমুখি চারটি মন্দির। প্রত্যেক মন্দিরে তিনটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ এবং প্রত্যেকটি মন্দিরে তিনটি করে শিবলিঙ্গ। প্রতিটি মন্দির টেরাকোটায় আবৃত এবং বহুলভাবে কারুকার্যমণ্ডিত। রামায়ণ, মহাভারত ছাড়াও নানা পৌরাণিক আখ্যান মূর্ত হয়েছে চারবাংলার ভাস্কর্যে। ১৭৫৫ সালে এটি তৈরি।
চারবাংলার উত্তর-পশ্চিমে অষ্টকোণিক ভবানীশ্বর শিবমন্দির। মুর্শিদাবাদের নিজস্ব শৈলীতে ১৭৫৫ সালে রানি ভবানী এটি তৈরি করান। মন্দিরে পঙ্খের কাজ অনবদ্য। ১৮মিটার উঁচু মন্দিরের ছাদের গম্বুজটি যেন উলটানো পদ্ম। পদ্মের পাপড়ি ৮-টি দিকে বিকশিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারও আটটি।
অদূরে পথের বাঁকে রানি ভবানীর কন্যা তারাসুন্দরীর তৈরি গোপাল মন্দিরটি আজ দীর্ণ। দু’পাশে আছে আরও দুটি ভগ্নপ্রায় শিবমন্দির। এদের বামপাশে রানি ভবানীর রাজরাজেশ্বরী মন্দির। মন্দিরে অধিষ্ঠান করছে দারু নির্মিত মদনগোপাল মূর্তি, জয়দুর্গা এবং মহালক্ষ্মী। কেবলমাত্র অষ্টধাতুর মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তিটি আজ অন্তর্হিত। রাজরাজেশ্বরী মন্দিরের সামান্য উত্তরে রাজবাড়িটি আজ বিধবস্ত এবং পরিত্যক্ত। এই বাড়িতেই রানি ভবানীর শেষ জীবন কাটে।১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন তিনি।
রাজবাড়ি রেখে আরও উত্তরে এগোলে বড়োনগরের নিজস্ব দেবতা অষ্টভুজ গণেশ মন্দির। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়। আরও উত্তরে মঠবাড়ির বিপরীতে জোড়বাংলা মন্দির বা গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির বাংলার টেরাকোটা শিল্পের আর এক অনন্য নিদর্শন। মোটামুটি বড়োনগর দর্শন এখানেই শেষ।
এবার আমাদের গন্তব্য ১০ কিলোমিটার দূরের কিরীটেশ্বরী মন্দির। তার আগে দুপুরের ডানহাতের কাজটা আজিমগঞ্জ থেকেই সেরে নিই। কিরীটেশ্বরী যাওয়ার পথে ৬ কিলোমিটার দূরে ডাহাপাড়ায় শ্রীজগবন্ধু ধামটাও দেখে নিই। পরম বৈষ্ণব জগদ্বন্ধু সুন্দরের জন্ম এই ডাহাপাড়ায়। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে খুব ঘটা করে প্রভুর জন্মোৎসব পালিত হয়।
ডাহাপাড়ার পর কিরীটেশ্বরী– দূরত্ব চার কিলোমিটার। কথিত আছে সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুট পড়েছিল এখানে। কিরীটেশ্বরী তাই সতীপীঠ। অতীতে নাম ছিল কিরীটকণা। রজ্জচ্টি শিবমন্দির তৈরি হয়েছিল সেকালে। রচ্ছ্রঙ্মপ্ত সালে মূল মন্দিরটি ধবংস হলেও কারুকার্যমণ্ডিত প্রস্তরবেদিটি আজও আছে। বর্তমান মন্দিরটি রজ্জ্ব শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় তৈরি করান। মন্দিরে কোনও দেবীমূর্তি নেই, ছিল দেবীর কিরীট, বর্তমানে যেটি রানি ভবানীর তৈরি গুপ্তমঠে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইতিহাস বলছে, জীবনের শেষলগ্নে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত মিরজাফর শরীর-মনের জ্বালা মেটাতে দেবী কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পান করেছিলেন। কিরীটেশ্বরী মন্দির ছাড়াও এই চত্বরে রয়েছে আরও অনেক মন্দিরের ধবংসাবশেষ। পৌষমাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে মেলা বসে এবং ভক্ত সমাগম হয়।
কিরীটেশ্বরী দর্শন শেষ করে আমরা পরবর্তী দ্রষ্টব্য সিরাজের সমাধি খোশবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। শীতের বেলা, দ্রুত আলো নিভে আসছে, ইচ্ছা ছিল এ যাত্রায় শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণটাও দেখে নেব। রাস্তায় বাইকের টায়ার পাংচার হওয়ায় সে পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। কর্ণসুবর্ণ তোলা থাকল অন্য কোনও সফরের জন্য।
খোশবাগ পৌঁছোতে পাঁচটা পেরিয়ে গেল। পাঁচটায় খোশবাগের মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা গেটের বাইরে থেকেই খোশবাগ দর্শন করে ফিরে আসি ডাহাপাড়া ফেরিঘাটে। ভাগীরথীর ওপাড়ে লালবাগ বা মুর্শিদাবাদ। ফেরিঘাট থেকে হাজারদুয়ারির দূরত্ব মাত্র আধ মাইল। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে কাল সকালে ধীরেসুস্থে বেরোব নবাবি ইতিহাসের মুর্শিদাবাদে। দেখে নেব হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, নশিপুর রাজবাড়ি, কাঠগোদাম, রাজপরিবারের সমাধিস্থল সহ আরও যা যা দ্রষ্টব্য। সব মিলে ঘন্টা দুই-তিনের সফর। তারপর বিকালের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস ধরে আবার কলকাতায়। বাঙালি মাত্রেই মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল এবং বহু চর্চিত বিষয়, তাই সে বর্ণনায় আর গেলাম না। ভবিষ্যতে যারা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে আসবেন, তাদের কাছে একটাই অনুরোধ, অতিরিক্ত একটা দিন বরাদ্দ রাখুন বড়নগরের জন্যে। সম্ভব হলে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের জন্যও একটা দিন। কথা দিচ্ছি ভাগীরথীর ওপার আপনাকে বঞ্চিত করবে না।
কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে লালগোলাগামী যে-কোনও ট্রেনে ৪-৫ ঘন্টার ব্যবধানে মুর্শিদাবাদ কিংবা জিয়াগঞ্জ। শুরুটা যে-কোনও দিক থেকেই করা যেতে পারে। সারাদিনে এ লাইনে অসংখ্য ট্রেন চলে। তবে ভালো হয় সকালের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস কিংবা বিকালের ভাগীরথী এক্সপ্রেস। লোকাল ট্রেনের তুলনায় ভাড়া দ্বিগুন হলেও এক-দেড় ঘন্টা সময় কম লাগবে।
কোথায় থাকবেন?
মুর্শিদাবাদে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের এবং দামের অসংখ্য হোটেল রয়েছে। উৎসবের সময় বাদ দিয়ে এলে বুকিং না করে এলেও চলবে।
কখন যাবেন?
বছরের যে-কোনও সময়েই আসতে পারেন।
কেনাকাটা -মুর্শিদাবাদের কাঁসা-পিতলের কাজ আজও বিখ্যাত। কিনতে পারেন সংসারের নিত্য ব্যবহার্য কোনও জিনিস কিংবা কোনও স্মারক।