সকাল সাড়ে চারটেয় ফ্লাইট। বিমান বন্দরে ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল রাত বারোটা নাগাদ।

চেক-ইন সেরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে নিরালা একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম জানলার ধারে। কাচের জানলা দিয়ে দূরে শহরে যাওয়ার হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। শেষ ডিসেম্বরের রাত। হালকা কুয়াশার মধ্যে রাস্তার বাতিগুলো যে-আলো ছড়াচ্ছে, সেটাও আবছা লাগছে।

হঠাৎ মনে হল আমাদের জীবনটাই কেমন যেন আবছা। আলো ছায়া অন্ধকার মেশানো। সঙ্গে সবসময়ই একটা বই থাকে পড়ার জন্যে। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছিল না। গভীর রাতে যাত্রী সংখ্যাও বেশ কম। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন তাঁরা।

হঠাৎ একটু অস্বস্তি লাগল। ঘরের মধ্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে দেখতে চেষ্টা করলাম, কোনও এমন কিছু চোখে পড়ল না, যাতে এরকম লাগতে পারে। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে কারও নজরের মধ্যে আছি যেন।

কায়রোর এই বিমান বন্দরটি যাত্রীদের জন্যে অত্যাধুনিক সব রকম আরাম আয়েসের ব্যবস্থা করে রেখেছে। উঠে একটু পায়চারি করে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এ দিকটায় অনেকগুলো ইজিচেয়ার রয়েছে। সবগুলোতে দূরপাল্লার যাত্রীরা চাদরমুড়ি দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। নতুন কিছু নয়। বিসদৃশও নয়। আমার এখনও প্রায় ঘন্টা তিনেক বাকি ফ্লাইটে ওঠার। খালি একটা এরকম চেয়ার পেলে পিঠটাকে টান করে নেওয়া যেত।

ভাবছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, মাফ করবেন আপনি বাঙালি? উত্তরে কিছু বলার আগেই আবার তাঁর প্রশ্ন, আপনি কি খুলনার? মানে বাংলাদেশের খুলনার কথা বলছি।

কেন বলুন তো? খুলনার কাউকে আপনি খুঁজছেন?

না, ঠিক তা নয়। কিন্তু আপনাকে আমার খুব চেনা লাগছে।

আমাকে আপনি চিনবেন কেমন করে! আমি বাঙালি অবশ্যই। তবে প্রবাসী বাঙালি। বহুকাল ধরে, বলতে গেলে সারা জীবনই আমি প্রবাসে আছি।

ভদ্রলোক একটু আনমনা হলেন। খুব আস্তে করে বললেন, আমি চিনি আপনাকে।

আমি হাসলাম। হয়তো আপনার পরিচিত কারও মতো মনে হয়েছে আমাকে দেখে। আমি আপনাকে চিনি না। আমি পেছন ফিরে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সত্যিই ভদ্রলোককে আমার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। সরে এসে একটু দূরে বসে এবার সঙ্গের বইটি খুলে চোখ রাখলাম।

বাংলাদেশ বিমানের এই ফ্লাইট-এর যাত্রীদের উদ্দেশ্যে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে। প্যাসেঞ্জার্স হু আর ট্রাভেলিং বিমান বাংলাদেশ, ফ্লাইট নাম্বার ০২২১, প্লিজ গো টু গেইট নাম্বার বি ২৫। আশেপাশের থেকে অনেকেই সঙ্গের হাতব্যাগ, ট্রলি নিয়ে উঠে রওয়ানা হচ্ছেন নির্ধারিত গেটের দিকে। সামনে দিয়ে যাচ্ছেন কয়েজন একসঙ্গে।

আরে রওশন আরা খানম, নয়? এখানে আপনি? মুখ তুলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে তার শ্লেষ মিশ্রিত বাক্য, কী-ইই ম্যাডাম, চিনতে পারছেন?

হাতের বইটা বন্ধ করে উত্তর দিতেই হল, না চেনবার কারণ নেই, রায়হান সাবেহান।

বেশ বেশ। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ম্যাডাম, কেমন আছেন? এখানে কেন? বাংলাদেশে যাচ্ছেন?

যাচ্ছি তো কোথাও নিঃসন্দেহে। তবে সেটা বাংলাদেশে না-ও হতে পারে।

তা বটে, তা বটে। সৌভাগ্য আপনি আমাকে মনে রেখেছেন।

হ্যাঁ, এই যে সেজো ভাই, আসেন পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি মার্কিন মুলুকে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে বাঙালি নারী সাংবাদিক। বিখ্যাত। আমাদের মতো ছাপোষা অখ্যাত বাংলা কাগজের সাংবাদিক নন। এনার বিচরণ অন্য লোকে। তাকিয়ে দেখি আমি খুলনার কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন যিনি, সেই ভদ্রলোক!

এবার একটু থমকাবার পালা আমার। এমনিতেই রায়হান সাবেহানের মতো এঁটেল ব্যক্তির সঙ্গে হিসেব করে কথাবার্তা বলা অতীব জরুরি। তীব্র ব্যঙ্গ দিয়ে কথাবার্তা বলে, সে তার গুরুত্ব বোঝাতে খুব পারঙ্গম। তার ওপর বোঝা গেল এরা আত্মীয়। হাত তুলে সালাম দেওয়ার আগেই রায়হান সাবেহান বলল, এর আর একটা পরিচয় দেই সেজো ভাই। ইনি আমাদের শহরেরই মেয়ে।

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, অনেকক্ষণ আগে আমি দূর থেকে দেখেই ওঁকে চিনতে পেরেছি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি অবশ্য খুলনার কিনা সেটা বলতে চাইছিলেন না। অনেক দিন হয়ে গেল। প্রায় পঞ্চান্ন বছর! রায়হান সাবেহানের মতো ঘাঘু লোকও এবার বাক্যহারা বলে মনে হল। আমি নিজেও।

আপনি কি আমার বড়ো ভাই, কি মামাদের সঙ্গে পড়তেন? মানে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারছি না।

আমাকে আপনার চেনবার কথাও নয়। তবে আমি আপনাকে চিনি। আমার ডাক নাম তরু। নামটা আপনি শুনেছেন কিনা জানি না অবশ্য। হয়তো শুনে থাকতে পারেন। খুলনায় যান না আপনি কখনও?

হ্যাঁ যাই তো। তবে কম। মানে দেশেই তো আসা হয় না তেমন। তার ওপর এখন আর আমার পরিবারের প্রায় কেউ সেখানে নেই।

হ্যাঁ জানি আমি। আপনাদের সেই বড়ো বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। আমি সবই জানি। আসবেন। খুলনা এলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।

মুহুর্মুহু তাড়া আসছে মাইক্রোফোনে তখন নির্ধারিত গেটে যাওয়ার জন্যে। বিমানে যাত্রীদের তোলা শুরু হয়েছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যদি খুলনা যাওয়া হয় কোনও সময়। আপনাদের ফ্লাইটে লাস্ট কল দিচ্ছে।

রায়হান সাবেহান একেবারে চুপ। ও একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার ওই ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক নিঃশব্দে হাত তুললেন। প্রত্যুত্তরে আমিও। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে।

শুনতে পেলাম রায়হান সাবেহানের প্রশ্ন, সেজো ভাই এই তাহলে সেই, যার জন্যে আপনি… বাকি কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেল। ভদ্রলোক কিছু বললেন সেটা আর শোনা গেল না। আমিও চুপ করে বসে রইলাম। মনে হল এই তাহলে সেই তরু!

পাত্রী দেখতে এসেছে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শুনেই বললাম, যাব না সামনে। শেষ পর্যন্ত বড়ো ভাই, মা-এর চাপে যেতেই হল। বড়ো ভাই বললেন, যা শুধু গিয়ে দাঁড়াবি, আর চলে আসবি। আমি ঠিক তাই করেছিলাম। গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নীচের দিকে চোখ রেখে। তিন জোড়া পায়ে জুতো দেখেছিলাম।

ওরা বসেছিল। কে কোন জন তাও আমি দেখিনি। আমাকে বসতে বলা হল, বসলাম। একবারও মুখ তুলে তাকাইনি। কয়েক মিনিট পর ওরা বললেন ঠিক আছে, তুমি ভেতরে যাও। আমি চলে এলাম।

তখন বিয়ে সম্বন্ধ আসছে। বাবা নেই। মা অস্থির হয়ে গেলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্যে। বাড়িতে একজনকে পছন্দ করা হল। ওরা ঢাকার। খুলনার এই পাত্রটির বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার এদের বাড়ির বড়ো বউ, মা খালারা এলেন। তাদের ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গেল ঢাকাতেই।

আমার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আপনারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দিলেন, এমন একটা কথা বলেছিল এই ছেলে আমাদের বাড়ির কাউকে। আর সেটা নিয়ে বেশ হাসি তামাশাও হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।

নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার বিয়ে টিকল না। বছর দশেক টানাটানি করে সম্পর্কটা বহাল থাকল বটে কিন্তু সে বছরগুলো ছিল আমার জন্যে এবং আমার পরিবারের জন্যেও এক দুঃসহ সময়। তখন এই তরু নামটি অনেকবার উচ্চারিত হতে শুনেছি বাড়িতে।

বড়ো মামি খুব বলতেন, ছেলেটি ওকে এত পছন্দ করেছিল, ঠিক ওর দীর্ঘনিশ্বাস লেগেছে! কেন ওর সঙ্গে তোমরা বিয়েতে রাজি হলে না গো? এর ঠিক কোনও সদুত্তর ছিল না। মা তখন নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন, ভাগ্য। নাহলে ওরা এত অনুরোধ করেছিল।

একটি এনজিওতে কাজ করার সুবাদে ইউরোপে যাওয়া। তারপর জীবন গড়িয়ে গেছে। দু’-দু’বার সংসার পাতার চেষ্টা, কোনওটাই সফল হয়নি। আমিও ভাবি, ভাগ্য। আজ পড়ন্তবেলায় এভাবে এক বিমান বন্দরে দেখা হয়ে যাবে কে জানত! নামটা শুনেছিলাম বহুবার। আজ সে নামের সঙ্গে একটা চেহারা যুক্ত হল। আমার ফ্লাইটের এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। কাজেই ঢাকা বিমান বন্দরে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেটাই স্বস্তির।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...