গণেশ এসেছে। এসে চেয়ারে না বসে, বসেছে চেয়ারের হাতলে। কাঠের এই চেয়ার বহু বছরের পুরোনো। শক্তপোক্ত, দু’পাশে হাতল। হাতলগুলো চওড়া। চেয়ারটাকে রাখা হয়েছে খাটের গা ঘেঁষে। যাতে ডাক্তারবাবু, আত্মীয়স্বজন, বাড়ির লোকজন রোগীর কাছে বসতে পারে। গত চার মাস, না চার মাস নয়, গত চার মাস এগারো দিন এই ব্যবস্থা চলেছে। প্রথম প্রথম এঘর, ওঘর থেকে মোড়া, চেয়ার, এমন কী টুল পর্যন্ত টেনে আনা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সিচুয়েশনের অবনতি হচ্ছে। ঘরে ডাক্তার, ভিজিটর বসবার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা রাখতে হবে। বারান্দায় রাখা চেয়ারটাকে মুছে-টুছে ঘরে আনা হল। আজ থেকে আর এই চেয়ারের দরকার হবে না।
গণেশ যখন এল তখনও আলো ফোটেনি। ফুটব ফুটব করছে। দূরে একটা দুটো কাক ডেকে উঠল। আড়মোড়া ভাঙা ডাক। রাস্তা দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ করে চলে গেল দুধের গাড়ি। রমাকান্তবাবু পাশ ফিরতে গেলেন। একটু পারলেন, বেশিটা পারলেন না। পাশ ফেরবার শক্তি মানুষটার আর নেই। শ্বাস নিতেও কেমন যেন অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ নব ঘুরিয়ে ঘরের বাতাসের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খানিক আগে বুকের ভিতরে একধরনের চাপা ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। শরীর জানান দিয়ে দিচ্ছে, সময় ফুরিয়ে গেল… সময় ফুরিয়ে গেল…। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয়, আজই কিছু একটা হয়ে যাবে। কখন হবে? বেলাবেলি? নাকি দুপুরের পর? দুপুরের পর হলে ভালো। বাড়ির সবার খাওয়া-টাওয়া হয়ে যাবে। নইলে রাত পর্যন্ত আটকে থাকা। মরা বাড়িতে হাজার ফ্যাঁকড়া। এইটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না।
মাধবীর আলসারের সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ কিছু না খেলে পেটে ব্যথা হয়। তারও তো বয়স কম হল না। স্বামীর মৃত্যুর পর আলসারে কাবু স্ত্রীদের জন্য কি কোনও ছাড় আছে? হালকা কিছু খেতে পারে? পারা উচিত। যাই হোক, সবথেকে ভালো হয় ঘটনা বিকেলের দিকে ঘটলে। তবে সে তো আর কারও হাতে নেই যে সকলকে স্নানটান করিয়ে, মাছের ঝোল ভাত, কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে, ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিয়ে তবে ঘটবে। মৃত্যু কখন আসে কেউ বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু খুবই অনির্দিষ্ট একটা বিষয়। তারা স্বেচ্ছাচারী। নিজের খুশি মতো চলতে পছন্দ করে।
রমাকান্তবাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসতে চেষ্টা করলেন। একটু পারলেন, একটু পারলেন না। আর কোনও কিছুই সবটা পারবার সময় নেই।
মুক্তি… মুক্তি। রোগ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। মুক্তি দীর্ঘ জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিশ্রম আর ক্লান্তি থেকে। মুক্তি বেঁচে থাকবার যাবতীয় গ্লানি, অবহেলা থেকে। আহ্! রমাকান্তবাবু আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। মুক্তির হাসি।
মুক্তি শুধু নিজের নয়, মুক্তি বাড়ির লোকেদেরও। তারাও এবার যবনিকাপতন চায়। নিজের মধ্যে একথা বলাবলিও করছে। পরশু রাতেই বড়ো ছেলে শুভ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তার বউকে চাপা গলায় বলছিল। শুভ ভেবেছিল, বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনতে পাচ্ছে না। রমাকান্তবাবু সবই শুনেছেন, জেগে ছিলেন। শুনতে ভালোই লেগেছে। এখন আর স্ত্রী ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইরা কী বলল সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল, এখনও তারা কাছে আছে। তাদের চোখে দেখা যায়, গলা শোনা যায়, ছোঁয়া পাওয়া যায়। কয়েকমাস ধরেই এই অনুভূতিটা হচ্ছে। বারবার মনে হয়েছে, বেশিদিন নয়, এবার দূরে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। কতদূরে তাও ঠিক মতো জানা নেই। হাজার চেষ্টা করলেও ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, গলা শোনা যাবে না। বিগত কটাদিন বেশিরভাগ সময়ে রমাকান্তবাবু আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে কাটিয়েছেন। চোখ বুজে পড়ে থেকেছেন। সবাই ভেবেছে, রোগী ঘুমোচ্ছে। শরীর বোধহয় খানিকটা ভালো। রমাকান্তবাবু ভুল ভাঙাননি। ভাঙাতে গেলেও বিশ্বাস করবে না। ভাববে, অসুস্থ মানুষ ভুল বকে। ঘুমোলেও বলে ‘জেগে ছিলাম’। তার থেকে চুপ করে থাকাই ভালো।
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। কে বুঝবে একথা? এ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সবাইকে বলবার মতোও নয়। বোঝানো তো যায়ই না। আর দরকারই বা কি? সেদিনও রমাকান্তবাবু তাই ছিলেন। বড়োছেলে আর তার বউয়ের কথা কানে এসেছে সব।
শুভ তার বউকে বলেছিল, ‘উফ্ আর কতদিন বলো তো? এ তো আর টানা যাচ্ছে না। টাকার পর টাকা গলে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তেমনি। আরে বাবা, যদি চান্স না থাকে তাহলে এত দামি দামি মেডিসিন দেবার মানে কী? আর কতদিন বলো তো?’
বউমা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে বলছ কেন? বাবা তোমার, কবে মরবে, কবে বাঁচবে তুমিই জানো। আমি কী করে বলব?’
বড়োছেলে মুখে ‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘এমন ভাবে বলছ ঝুমা, যেন তোমার বাবার মৃত্যুর ডেট তুমি জেনেশুনে বসে আছো। বাবা হলেই সব জানা যায়?’
ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমার বাবার কথা আসছে কোথা থেকে? আমার বাবাকে টানছ কেন? বালাই-ষাট সে মরবে কীসের জন্য? সে তো আর শ্বশুরমশাইয়ের মতো চার মাস বিছানায় কেতরে নেই। ডাক্তার, বদ্যির পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও খসাচ্ছে না, ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইদের ছুটিয়েও মারছে না। সে আছে নিজের মতো।’
বড়োছেলে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বাবা হলেন বিরাট পরোপকারী। আমার বলাটাই ভুল হয়েছে। আই অ্যাম সরি।’
ঝুমা গজগজ করে বলল, ‘কথায় কথায় আমার বাবাকে টানবে না। নিজের বাবাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছ, যা বলবার তাকে বলো।’
‘কী বলব?’
ঝুমা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কী আবার বলবে, অনেক সমস্যা করেছেন এবার শেষ করুন।’
শুভ অবাক গলায় বলল, ‘বাবাকে বলব, শেষ করুন! মানে তুমি মরে যাও! এসব কী বলছ ঝুমা!’
ঝুমা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, ‘মরে যাও বলবে কেন? বলবে… বলবে, এবার ভালো হয়ে ওঠো। তোমার সেবাযত্ন করতে করতে তো বাড়িশুদ্ধ সবার নাজেহাল অবস্থা। টাকাপয়সাও তো জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। এত বয়স হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না?’
বড়োছেলে চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলে, ‘অ্যাই ঝুমা, ঝুমা, অ্যাই ঝুমা…’
‘ধেড়ে বয়েসে বারবার বউয়ের নাম বলে আহ্লাদ করছ কেন? কী বলবার বলে ফেল।’
বড়োছেলে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা কাজ করো না।’
ঝুমা সন্দেহ ভরা গলায় বলল, ‘কী কাজ? শ্বশুরমশাইকে বিষ খাওয়াব?’
শুভ বলল, ‘উফ্ তোমার মুখে কিছু আটকায় না। তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবে?’
ঝুমা বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করব?’
শুভ কিছু একটা বলল। রমাকান্তবাবু শুনতে পেলেন না। যদিও গত চার মাস ধরে কান খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে। প্রকৃতির কি এটাই মজা? শরীরের সব অঙ্গ কাহিল করে দিয়ে একটাকে তরতাজা করে রাখে? তার বেলায় যেমন শ্রবণ ক্ষমতাকে রেখেছে? মনে হচ্ছে, যুবক বয়েসের কান ফিরে পেয়েছেন। দূরের কথাও শুনতে সমস্যা নেই।
ঝুমা খানিকটা জোর গলায় বলল, ‘একথা তুমি জিজ্ঞেস করতে পারছ না? ডাক্তারবাবুকে ফোন করে জিজ্ঞসা করো।’
শুভ ‘শ্শ্শ্’ আওয়াজ করে বলল, ‘এই আস্তে, বাবা শুনতে পাবে।’
‘শুনতে পাবে না। অনেকক্ষণ থেকে ঘুমোচ্ছে। আজকাল তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়েই থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম হয় না। তুমি বরং এখনই ডক্টর রায়কে ফোন করো।’
শুভ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার বলাটা কি ঠিক হবে ঝুমা?’
ঝুমা অবাক গলায় বলল, ‘কেন? হবে না কেন? তুমি তার ছেলে। তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো। তাছাড়া তুমি তো আর মরবার কথা বলছ না। বলবে, দেখুন ডাক্তারবাবু আমাদের তো একটা প্ল্যানিং করতে হবে। উনি আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবেন যদি জানতে পারি সুবিধে হয়… এত টাকাপয়সা খরচ… জোগাড়ও তো করতে হবে। তার থেকে বড়ো কথা… আমরা এই কষ্ট চোখে দেখতে পারছি না। আমার স্ত্রী তো… আমার স্ত্রী তো রোজ কান্নাকাটি করে।’
‘তুমি আমার মরণাপন্ন বাবার জন্য কান্নাকাটি করো? এতবড়ো একটা মিথ্যে কথা বলা কি ঠিক হবে ঝুমা?’
ঝুমা চাপা গলায় স্বামীকে ধময় দেয়।
‘চুপ করো। বেশি ঢঙ দেখিও না। তোমার মা কী বলছেন?’
শুভ বলল, ‘কী বলেছেন?’
রমাকান্তবাবু কান খাড়া করলেন। মাধবী বলেছে! সে আবার কী বলল!
ঝুমা বলল, ‘কাল বিকেলে ঘরে ডেকে আমাকে বলল, বউমা তোমার শ্বশুরমশাইয়ের হাগামোতার কাপড় আমি আর ধুতে পারব না। এক-দুদিন হলে হয়, মাসের পর মাস হলে হয় না। খোকাকে বলো, লোক রাখতে। সে বড়ো হয়েছে, রোজগারপাতি করে। বাবার হাগামোতার পিছনে পয়সা খরচ করতে পারবে না এমন নয়। সংসারে অনেক ঝি-গিরি করেছি, আর নয়। তোমার শ্বশুরমশাই চলে গেলে, নিজের মতো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব। নিজের স্ত্রী-ই তো এসব বলছে। আমি কেন কাঁদতে যাব?’
শুভ বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, চুপ করো। আর মায়ের নিন্দে করতে হবে না। আমি দেখছি।’
শুধু স্ত্রী, বড়োছেলে-বউমা নয়, রমাকান্তবাবুর মেয়ে জামাইও খুব অসুবিধেতে রয়েছে। কাজকর্ম ফেলে তাদের ছুটে ছুটে আসতে হচ্ছে। তার ওপর টাকাপয়সা নিয়েও একটা টেনশন আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। শুভ যে-কোনও সময় তার দিদির কাছে হাত পাততে পারে। বলা যায় না, হয়তো আয়া রাখবার টাকাটাই চেয়ে বসতে পারে। এই ক’দিনে রমাকান্তবাবুকে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। সেদিন তো পাশের ঘরে দুজনে খুব একচোট চ্যাঁচামেচি করল। করবারই কথা। একজন যদি চার মাস ধরে ‘মরছি মরব’ করে শুয়ে থাকে তাহলে সকলেরই সমস্যা। তার ওপর রমাকান্তবাবুর জামাই কোনও হাবিজাবি লোক নয়। সে নামকরা মানুষ। তার একটা পরিচয় আছে। কলেজে পড়ায়। সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল তাকে প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়। আলোচনায় চান্স পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িত, মানুষের জন্য গলা ফাটায়। কখনও সরকারের বিরুদ্ধে, কখনও বিরোধীদের বিরুদ্ধে। যে- চ্যানেল যার কথা বলতে বলে সেই চ্যানেলে গিয়ে তাই বলে। যাওয়ার আগে দাড়ি, চুল শ্যাম্পু করে ফুরফুরে করে নেয়। রঙচঙে জামা পরে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝগড়া করে। রমাকান্তবাবু যখন সুস্থ ছিলেন, মুগ্ধ হয়ে জামাইয়ের প্রোগ্রাম দেখতেন। গিন্নি ঝামেলা করত। রিমোট টিপে সিরিয়াল দেখতে চলে যেত।
‘আহা করো কী, শ্যামলের কথা শুনছি।’
গিন্নি ধাতিয়ে উঠত, ‘রাখও তোমার জামাইয়ের কথা। খালি বকবক আর বকবক। কে আমার বক্তিতে দেওয়ার লোক এল রে! ওর লেকচার কেন শুনতে যাব? দেশের জন্য কোন কম্মটা করেছে তোমার জামাই? এমন ভাবে দাড়ি নেড়ে কথা বলে মনে হয়, টেগার্ট সাহেবকে বোম মারবে।’
‘মেয়ে কিন্তু রাগ করবে। সে রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, তার বরের কথা শুনেছি কিনা।’
গিন্নি আরও রেগে যেত।
‘বনির আশকারাতেই তো জামাইটা গোল্লায় গেল। ঘরের কাজ করে না, কলেজে যায় না, খালি ক্যামেরায় মুখ দেখানোর জন্য ছোকছোকানি। ছিছি। এই সব ছেলেকে মারতে হয় চড়।’
সেদিন মেয়ে জামাইয়ের ঝগড়া পুরোটা না হলেও, কিছু কথা ভেসে আসছিল। আজকাল কেমন শীত শীত করে। রক্তের জোর কমে গেছে। সেদিন শীত ভাবটা বেশি ছিল। চাদর গায়ে দিয়ে গুটিয়ে শুয়েছিলেন রমাকান্তবাবু। সেই অবস্থাতেই শুনলেন, জামাই বনির ওপর চ্যাঁচাচ্ছে।
‘কী মনে করছ কী? আমার কোনও কাজ নেই? কলেজ, সেমিনার, ছাত্রছাত্রী, টিভি সব ফেলে এখানে এসে তোমার বাবার নাড়ি ধরে থাকব আর আহা উহু করব?’
বনি বলল, ‘রোজ কোথায় আসছ? সপ্তাহে তো মোটে একদিন আসো। বড়োজোর দু’বার। তাতেই এত বিরক্ত! দাদা তো সব সময় রয়েছে। সবকিছু সামলাচ্ছে।’
জামাই রাগি গলায় বলল, ‘তোমার দাদার কাজটা কী? দশটা পাঁচটার অফিস করেই খালাস। তাও মাথার কোনও কাজ নেই। মাথা থাকলে তো কাজ থাকবে। মাছি-মারা কেরানি।’
বনি বলল, ‘ইস্ আমার দাদার মাথা নেই, আর ওনার বিরাট মাথা।’
জামাই বলল, ‘তাছাড়া তোমার দাদা রমাকান্ত রায়ের ডাইরেক্ট পুত্র। পুত্র, পিতার রোগশয্যার পাশে সর্বদা থাকবে এটা আর নতুন কথা কী?’
বনি তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘এখন পুত্রই সব করবে, আর সেদিন যে বড়ো বলছিলে, অ্যালার্ট থেকো বনি। তোমার বাবা মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই। যে-কোনও সময় ফুটুস হবেন, এরপরেই কিন্তু সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল লাগবে। তোমার মায়ের পোরশনটা বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু তুমি আর তোমার দাদা ফিফটি ফিফটি। কই তখন তো ডাইরেক্ট পুত্র বলে দাদাকে পুরো সম্পত্তি দেওয়ার কথা বলোনি। বলেছিলে?’
জামাইয়ের সব কথা কানে এল না। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শুনতে পেলেন।
‘আমি তো আইনের কথা বলেছি বনি… নারীর সমঅধিকারের কথা… তুমি মেয়ে বলে তোমাকে বঞ্চনা আমি সমর্থন করব না… কোনও নারীর ওপর অন্যায় আমি মানি না… শুধু তুমি নও… টিভির অনুষ্ঠানে কি আমি মুখ দেখাতে যাই?… যাই বলো?… ন্যায়ের কথা বলতে যাই…।’
বনি দাবড়ে ওঠে, ‘বাজে কথা বন্ধ করো। বাবাকে নিয়ে আর পারছি না। খুব জ্বালাতনে পড়লাম। তুমি দাদাকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। হাসপাতালে সেজেগুজে দেখতে যাব। না গেলেও কিছু নয়।’
‘খেপেছ? হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেই তোমার দাদা টাকা চেয়ে বসবে। আমার কাছে টাকা কোথায়? তোমাদের ফিফটি আগে পাই তারপর…।’
অন্য সময় হলে এসব কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে যেত। ইচ্ছে করত, পিছনে একটা লাথি মেরে জামাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। যাবার সময় মেয়েকেও গলাধাক্বা লাগাই। জীবনের এই পর্যায়ে কোনও কথাতেই আর রাগ হয় না। এখন আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষের গালমন্দও ভালো লাগে। মনে হয়, সবই মায়া।
বাইরে আলো ফুটছে। ঘরেও আলো এসেছে। পায়ের কাছে জানালাটা খুলে দিতে পারলে ভালো হতো। ঠান্ডা হাওয়া ঢুকত। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। শুধু কাক নয়, আরও নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় একটা ঘুঘু ডাকছে না? এত সকালে কি ঘুঘু ডাকে? নাকি ভুল শুনছেন? মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে ভুল শোনাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। ডান হাতটা খাট থেকে ঝুলে পড়েছে। রমাকান্তবাবু হাতটা তুলতে গেলেন। ঝিনঝিন করে উঠল। ভারী লাগছে। মৃত্যুকালে শরীরের ওজন কি বেড়ে যায়? হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। যে-পেশি দিয়ে নিজের হাতটাকে তুলবেন তার শক্তিও তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইস্, কেউ হাতটা তুলে দিতে পারলে ভালো হতো।
এমন সময় গণেশের দিকে আবার নজর পড়ল রমাকান্তবাবুর।
গণেশটা কী করছে? মিটিমিটি হাসছে কেন? এসে হাতটা তুলে দিতে পারে তো? বেটা চেয়ারের হাতলেই বা বসেছে কেন? হারামজাদার বদভ্যাসটা গেল না। কখনও ভদ্র সভ্য হয়নি। স্কুলে এসে বেঞ্চের মাথায় বসত। বাইরে গেলে পাঁচিলের টঙে উঠে পা দোলাত। একবার গাছে বসে পেয়ারা খেতে গিয়ে পড়ে গেল। পা ভাঙল। কোন ক্লাসে যেন? সিক্স? নাকি সেভেন? বকাঝকা কম খায়নি। তাও শিক্ষা হয় না ছেলেটার।
‘কী রে রমা, কেমন আছিস?’
রমাকান্তবাবু একথার জবাব দিলেন না। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘চেয়ারের হাতলে বসেছিস কেন? নেমে বস। কেউ দেখলে কী ভাববে।’
গণেশ ফিচ্ করে হেসে বলল, ‘হাতলে বসলেই তো মজা। কেউ দেখলে বয়েই গেছে।’
রমাকান্তবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘মারব, একটা চড়। এটা তোর নলিনীবালা হাই স্কুলের ক্লাসঘর নয় যে বেঞ্চের মাথায় থাকবি। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।’
গণেশ মাথা কাত করে চোখ পিটপিট করে বলল, ‘ভদ্রলোকটা কে?’
রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কেন! তোর কি আমাদের ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে না?’
গণেশ হাতল থেকে নেমে খাটের পাশে এসে বসল। রমাকান্তবাবু হাঁই হাঁই করে উঠলেন, ‘অ্যাই করিস কী! করিস কী! জুতো পরে রোগীর বিছানায় বসছিস! কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! জুতো খোল, আগে জুতো খোল। মাধবী যদি দেখে…।’
গণেশ থমকে গিয়ে বলল, ‘উফ্ বড্ড জ্বালাস।’
গণেশ জুতো খুলে খাটের তলায় রাখল। ছোটো মাপের স্কুলের জুতো। ধুলো মাখা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে তাপ্পি। গণেশটা বিরাট পাজি। শুধু স্কুলের জুতো নয়, স্কুল ড্রেসও পরে এসেছে। খাকি রঙের হাফপ্যান্ট, নীল রঙের জামা। তার কি অন্য কোনও পোশাক নেই? এত বছর পর বন্ধুর বাড়ি এলি, একটু সেজেগুজে, চুল আঁচড়ে আসতে অসুবিধে কোথায়? বদের ধাড়ি একটা। বেটা খাটে পা গুটিয়ে আরাম করে বসেছে দ্যাখো, যেন একটু পরেই ক্যারাম খেলা শুরু হবে।
রমাকান্তবাবুর গায়ে হাত রেখে নরম গলায় গণেশ বলল, ‘বললি না তো আছিস কেমন?’
রমাকান্তবাবুর রাগ হচ্ছে। এই ছেলে তো মহা ঝামেলা পাকাচ্ছে। একটু পরেই মাধবী ঘরে আসবে। সে এসে যদি দেখে রোগীর বিছানায় কেউ বসে আছে, রাগারাগি করবে। গত মাস পর্যন্ত মাধবী এ ঘরেতেই ক্যাম্প খাট পেতে শুত। ঘুমের অসুবিধে হয় বলে নিজের ঘরে চলে গেছে। ঠিকই করেছে। চার মাস ধরে রাতে রোগীর ঘরে শুয়ে থাকা অসম্ভব। স্বামী হলেও অসম্ভব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠো রে, জল দাও রে, গায়ের চাদর ঠিক করো রে, বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দাও রে, ইউরিন পট ধরো রে, ওষুধ খাওয়াও রে। তাহলে ঘুমোবে কখন? শুভ বলেছিল, ‘এক কাজ করা যাক। মা যখন শুচ্ছে না, আমি একজন নার্সকে বলি। রাতে এসে বাবার ঘরে থাকবে। যদি তোমরা রাজি হও বলতে পারি।’
নার্স মেয়েটি এসেছিল। কম বয়েস এবং দেখতে শুনতে ভালো। ঝুমা তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে। স্বামীকে সে বিশ্বাস করে না।
তারপর থেকে রাত একাই কাটান রমাকান্ত। ভালোই লাগে। একা থাকলে, নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যায়।
গণেশ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কেমন আছিস বলবি না?’
রমাকান্তবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন?’
গণেশ হেসে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস।’
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘অবশ্যই ভালো আছি। একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই যা।’
গণেশ বলল, ‘ও কিছু নয়, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যখন জলে ডুবে যাচ্ছিলাম তখনও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে ঠিক হয়ে গেল।’
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘বুঝলাম। এবার আমার হাতটা তুলে দে দেখি।’
গণেশ হেসে বলল, ‘থাক। খাট থেকে হাত ঝুলিয়ে মরলে একটা নাটক নাটক ভাব হবে।’
রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি করবি না গণেশ। ফাজলামির জন্য তোর সঙ্গে কতবার মারপিট করেছি মনে পড়ে? ক্লাস এইটে একবার আমার পেনসিল নিয়ে পালিয়েছিলি। তোকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তোর মাথা ফুলে আলু হয়ে গেল। মনে পড়ছে?’
গণেশ হেসে বলল, ‘না, মনে পড়ছে না। আমি তো আর তোর মতো মরতে বসিনি, যে পুরোনো কথা মনে পড়বে।’
ঘরের আলো আরও বেড়ে গেছে। আজ বোধহয় খুব রোদ উঠবে। এও একটা মুশকিল। সবাইকে গরমে বেরোতে হবে। শুভটার আবার অ্যালার্জির ধাত। বেশি গরমে গায়ে অ্যালার্জি বেরোয়। অবশ্য এখন তো ডেডবডি ঘাড়ে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যাপার নেই। কাচে ঢাকা গাড়ি আছে। তাও একটা ছোটাছুটি তো থাকে। ঘর বার করতে হয়।
‘আমার অসুখের খবর তোকে কে দিল গণেশ?’
‘বাবলুদা।’
‘বাবলুদা! হার্ট অ্যাটাকে যে মারা গেছে সেই বাবলুদা?’
গণেশ একটা হাই তুলে বলল, ‘হ্যাঁ। রঞ্জনাও বলল। রঞ্জনাকে মনে আছে? বিষ খেয়েছিল।’
রমাকান্তবাবু একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘মনে আছে।’
গণেশ ফিচ করে হেসে বলল, ‘তোর সঙ্গে প্রেম ছিল না? বিয়ে করলি না কেন? বেচারি এভাবে মরত না।’
রমাকান্তবাবু গণেশের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রঞ্জনা তোকে কিছু বলে?’
গণেশ নাক টেনে বলল, ‘বলে না। তবে বুঝি তোর ওপর খুব অভিমান। পাগলি একটা। সেই কবে কলেজের প্রেম…। এখনও জিইয়ে রেখেছে।’
রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ওরা সব আছে কেমন?’
গণেশ বলল, ‘ভালো আছে।’
রমাকান্তবাবু আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুই কেন এসেছিস?’
গণেশ সহজ ভাবে বলল, ‘তোকে নিতে এসেছি। অনেকটা পথ। দুজনে গল্প করতে করতে চলে যাব।’
‘তুই কি আমাকে বিকেল পর্যন্ত সময় দিবি গণেশ? বাড়ির সবাই খেয়ে-টেয়ে নিত… সারাদিন ধকল যাবে… বিকেল বিকেল হলে রোদটাও কম হতো…।’
গণেশ বলল, ‘না, মৃত্যু সময় দেয় না। আমাকেও দেয়নি।’
মাধবী ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। কেমন একটা গন্ধ না?
রমাকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘এসো মাধবী। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার স্কুলের বন্ধু গণেশ। খুব পাজি। বেটা ক্লাস এইটে পড়বার সময় জলে ডুবে ফট করে মরে গেল। সাঁতার জানত তবু মরল। ডাক্তারবাবু বললেন, গণেশ নাকি সাঁতার দেবার সুযোগই পায়নি। মাঝপুকুরে পেৌঁছোতেই হার্টফেল করে। বেঁচে থাকা কী কঠিন বলো মাধবী। সব আয়োজন, প্রস্তুতি নিয়েও বাঁচা যায় না।’ কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠলেন রমাকান্ত। বললেন, ‘যাবার আগে ওকে একটা জোর ধমক দাও তো মাধবী। রোগীর বিছানায় ওঠবার জন্য ওর ধমক খাওয়া উচিত।’
মাধবী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই বুঝতে পেরেছেন, রমাকান্তবাবু মারা গেছেন। ঘরে মৃত্যুর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেছেন।
পরদিন সকালে রমাকান্তবাবুর খাটের তলা থেকে এক জোড়া জুতো পাওয়া গেল। ছোটো জুতো। ধুলোমাখা, ডানপায়ে তাপ্পি।