একসময় আলাস্কার ভূমির উপর বিচরণ করত ডাইনোসর, বাইসন, ম্যামথ বিশালাকার প্রভৃতি প্রাণী। আনুমানিক বিশ হাজার বছর পূর্বে সাইবেরিয়া পার হয়ে আলাস্কায় প্রথম মানুষের পদচিহ্ন পড়ে। আরও দশ হাজার বছরেরও কিছু আগে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। সেই জনগোষ্ঠীই এখনকার আলাস্কার আদিবাসীদের পূর্বপুরুষ, এদের বলা হয় অ্যালেসিয়ান। ১৭৪১ সালে প্রথম ভারচুয়াস বেরিং নামে এক ইউরোপীয় অনুসন্ধানকারী দল, আলাস্কাকে আবিষ্কার করে। তারপর রাশিয়ানরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করে ও সিকটাতে তাদের সরকার গঠন করে। ক্রমে রাশিয়ান ব্যতীত ইংরেজ এবং স্প্যানিশরাও এখানে বসতি স্থাপন করতে উদ্যত হয়। তারপর ১৮৬৭ সালে ৩০ মার্চ ইউনাইটেড স্টেটস্ ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। অর্থের বিনিময়ে আলাস্কা, রাশিয়ার হাত থেকে ইউনাইটেড স্টেটস্-এর দখলে চলে যায়।

আলাস্কা উপসাগরে দেখা যায় তুষারপ্রাচীর, তুষার গ্লেসিয়ার আর কপালে থাকলে দেখা যায় তিমি মাছ, শিল মাছ, সি-লায়ন প্রভৃতি। সারা আলাস্কা জুড়েই তুষারমণ্ডিত শিখরের সারি, রুপোলি ঝরনার ঝরে পড়া, পাইন গাছের মনোরম সবুজ। দেখা যায় পথের ধারে মাঝে মাঝেই নীল জলের সরোবরে শুভ্র তুষার খণ্ডের অনুপম ভেসে যাওয়া, সত্যিই আলাস্কা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানি।

এই অপরূপা সুন্দরীকে দেখার সুযোগ আমার এল। একটি প্রসিদ্ধ টুর কোম্পানির সঙ্গে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে, চড়ে বসলাম দুবাইগামী উড়োজাহাজে। রাত্রি সাড়ে আটটায় প্লেন আকাশে উড়ল। দুবাই-য়ের সময় রাত্রি ১২-০৫-এ আমাদের দুবাই এয়ারপোর্টে অবতরণ। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছোলাম শেষ রাতের স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শ নিয়ে। হোটেলে এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া।

ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরেই রওনা হলাম এয়ারপোর্ট অভিমুখে। দুবাই থেকে চড়ে বসলাম সিয়াটলগামী এমিরেটস ফ্লাইট-ইকে-২৯৯-এ। আমাদের আকাশযাত্রা প্রায় ১৪ ঘন্টার মতো। কিন্তু সারা আকাশপথেই দিনের আলো রইল এবং সূর্যের প্রখর রৌদ্রের জন্য প্লেনের জানলার শাটার টেনে রাখতে হল। বেশ কয়েক ঘন্টা প্লেনের জানলা দিয়ে গ্রিনল্যান্ডের বরফ দেখা গেল। তাড়াতাড়ি সিট ছেড়ে পিছনের জানালায় এসে দাঁড়াই। ক্রমে আকাশযান গ্রিনল্যান্ড পেরিয়ে উত্তরমেরুর কাছাকাছি এসে গেছে। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে জমাট বাঁধা চাপ চাপ শ্বেতশুভ্র তুষার-ভূমি, মাঝে মাঝে জমাট চাদরের উপর ছোট্ট বাটির আকারে নীল জলের গর্ত, চক্ষু ফেরানো যাচ্ছে না। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে এই দৃশ্য চলল।

যখন সিয়াটলে অবতরণ করলাম তখন ভারতীয় সময় রাত্রি সাড়ে বারোটা, কিন্তু এখানকার সময় দুপুর একটা। তারিখের অবশ্য পরিবর্তন হল না। এয়ারপোর্টের আইনি বেড়াজাল পেরিয়ে বাসে করে হোটেলে পৌঁছোতে সাড়ে তিনটে বাজল (এখানকার সময়)।                        সকাল হতে ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে করে সিয়াটল শহর দর্শনে বেরিয়ে পড়া গেল। বাসে বসেই দেখা হল এখানকার স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, খেলার স্টেডিয়াম, আয়রন হ্যামারিং স্ট্যাচু প্রভৃতি। তারপর একটা পার্কের কাছে বাস থেকে নামা হল। এই পার্কের মাঝখানে বিশাল উঁচু একটা স্তম্ভ, নাম – স্পেস নিডিল। লিফটে করে উপরে ওঠা যায়, অবশ্য টিকিট কেটে। উপর থেকে সারা শহরের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। এই বাগানে প্রাকৃতিক গাছ ও ফুলের মাঝে মাঝে রয়েছে কাচের তৈরি গাছ ও ফুলের ঝাড়। তারপর যাওয়া হল এখানকার হারবারের কাছে। এখানেই সিয়াটলের মার্কেট প্লেস।

এরপর আমরা জাহাজ ঘাটে এসে জাহাজে ওঠার জন্য লাইন দিলাম। প্রথমে মালপত্র চেক করিয়ে জাহাজের কর্তৃপক্ষের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হল। তারপর আবার লাইন দিয়ে জাহাজের রুমে প্রবেশের কার্ড পাওয়া গেল। অনেক সময় লাগল প্রক্রিয়াটায়। জাহাজের পাঁচতলায় আমাদের ঘর। লিফটে চড়ে পাঁচতলায় ওঠা হল, তারপর ঘরে প্রবেশ। ঘরটি বড়ো না হলেও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, টিভি, ইন্টারকম সব সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। অ্যাটাচড বাথ, সেখানে সবরকম সুবন্দোবস্ত আর মাথার কাছে বেশ বড়ো জানলা দিয়ে সব সময় সমুদ্রদর্শন করা যাচ্ছে। জাহাজের নাম ‘নরওয়েইয়ান জুয়েল’। বিকেল চারটের সময় জাহাজ ভাসল আলাস্কা উপসাগরে। জেটল্যাগের জন্য আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। জিনিসপত্র গুছিয়ে বিছানার আশ্রয়ে।

ঘুম যখন ভাঙল তখন রাত্রি পৌনে আটটা কিন্তু তখনও আকাশে রোদের ঝিলিক। শুনলাম ন’টার পর সূর্যাস্ত হবে। তবে ডিনার করতে আটটার মধ্যে যেতে হবে। অতএব চোখেমুখে জল দিয়ে লিফটে করে ১২ তলায় ওঠা হল। বেশ বড়ো লাইব্রেরি হলের পাশ দিয়ে গোটা দুয়েক সুইমিং পুলকে অন্যপাশে রেখে গার্ডেন কাফেতে আমাদের খাবার ব্যবস্থা। কাফেতে ঢুকে দেখি বিশাল ব্যাপার। কি বিশাল আয়োজন, তা লিখে বোঝানো যাবে না। এক এক স্টলে এক এক রকমের খাবার। বিশাল হল, প্রচুর টেবিল-চেয়ার তাও খালি পাওয়া মুশকিল। লোক তো কম নয় ৩০০০-এরও বেশি যাত্রী আছে জাহাজে, তবে রেস্টুরেন্টও আছে ৬-৭টির বেশি। অবশ্য তার মধ্যে দুটি তিনটি রেস্টুরেন্টে টাকা দিয়ে খেতে হয়। এখানে আরও বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টে খাবার খরচ আমাদের প্যাকেজের মধ্যেই ধরা আছে। একটা পদ খাবার খেয়ে অপর পদ আনতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া প্লেট পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন প্লেটে খাবার নাও, সত্যি সার্ভিসের তুলনা নেই।

পরের দিনটা আমাদের জাহাজেই কাটল। তেরো তলা জাহাজের মধ্যে মোটামুটি একটা ছোটোখাটো শহর। কী নেই– নানারকম খেলার ব্যবস্থা ও জায়গা, গোটা দুই বড়ো সুইমিং পুল আর বাচ্চাদের জন্য ছোটো ছোটো গোটা তিনেক পুল রয়েছে। এক্সারসাইজের নানা উপকরণ এবং জাহাজের ছাদে জগিং করার ব্যবস্থা, থিয়েটার হল, ডান্সিং হল, নানা জিনিসপত্রের দোকান, জুয়েলারির দোকান, স্যুভেনিয়রের দোকান, পোশাকের দোকান, বিউটি স্যালন প্রভৃতিও রয়েছে। বিশাল লাউঞ্জ। জাহাজের আরোহী শিশুদের নিয়ে নাচ, গান, নাটক করেও দেখানো হচ্ছে। সত্যি অ্যামিউজমেন্টের শেষ নেই। জাহাজের ১৩ তলায় উপাসনা করার জন্য চার্চও রয়েছে।

এখন এখানে দিন বড়ো, রাত্রি ছোটো। আমাদের জাহাজে ওঠার থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রশান্ত সাগরের অংশ আলাস্কা উপসাগরের উপর দিয়ে আমাদের জাহাজ ভেসে চলেছে। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলাস্কার পর্বতশ্রেণীর তুষারাচ্ছাদিত রূপ। আকাশ নীল নয় ধূসর মেঘে আবৃত। রাত ৯টার সময় আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হল, তখন সূর্যাস্তের সময়। তাড়াতাড়ি জাহাজের ১৩ তলায় উঠলাম। আকাশ সম্পূর্ণ ভাবে মেঘমুক্ত নয় তবে মেঘ ভাঙা আলো আকাশকে অপরূপ করে সাজিয়েছে। প্রবল ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না, ফটো তুলেই নেমে এলাম।

পরের দিন সকাল ৭টার সময় জাহাজ নোঙর করল কেচিকানের হারবারে। ছোটো হারবার হলেও বড়ো বড়ো গোটাচারেক জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে আর আছে অসংখ্য ছোটো-বড়ো বোট। আমরা ১১টা নাগাদ জাহাজ থেকে হারবারে নামলাম তারপর ডাক টুরের গাড়িতে ওঠা হল। এই গাড়ি রাস্তাতেও চলে আবার জলেও চলে।

গাড়ি চলতে শুরু করল ছোটো শহর কেচিকানের পথ ধরে। গাড়ি দাঁড়াল একটা সরু খালের ধারে, খালের মুখে জাল পাতা রয়েছে। সমুদ্র থেকে বয়ে আসা জলের সঙ্গে স্যামন মাছ ভেসে আসে। সেগুলি ধরার জন্য এই ব্যবস্থা, একে ‘স্যামন ল্যাডার’ বলে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রচুর স্যামন মাছ জালে ধরা পড়ে। আমাদের গাইড এই মাছের চমকপ্রদ জীবনইতিহাস শোনালেন। সত্যি বড়ো অদ্ভুত স্যামন মাছ। পাহাড়ের উপর জলাশয়ে ডিম পাড়ে, তারপর ডিম ফুটে বড়ো হয়ে পার্বত্য নদীপথে সমুদ্রে চলে আসে। প্রায় বছর পাঁচেক সাগরে থাকার পর যখন তাদের আবার ডিম পাড়ার সময় হয় তখন তারা আবার নদী পথ ধরে তাদের জন্মস্থান পাহাড়ের উপর সেই জলাশয়ে ফিরে যায় এবং সেখানেই ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার পর মরে যায়। এই পাহাড়ের উপর জলাশয় থেকে নামা ও সমুদ্র থেকে উপরে ওঠার পথে স্যামন মাছ ধরা হয়, ভাল্লুকরাও নাকি বসে থাকে নদীর ধারে তাদের খাবার জন্য। আমরা জাহাজে স্যামন মাছ খেয়েছি, খুবই সুস্বাদু।

তারপর যাওয়া হল টোটেম পোল দেখতে স্যাক্সম্যান নেটিভ ভিলেজে। মানুষের মনের সংস্কারবশে দেবতা বা বংশচিহ্ন বলে গৃহীত অদ্ভুত দর্শন মানুষের মুখ, বৃক্ষ, জন্তু ইত্যাদির কাঠের তৈরি মূর্তি বানিয়ে এক জায়গায় প্রোথিত করা হয়। এইগুলিকেই টোটেম পোল বলা হয়। আমাদের দেশেও এই প্রথা আছে, একে বৃক্ষকাষ্ঠ বলা হয়। মৃত ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশে বৃক্ষকাষ্ঠ প্রোথিত করা হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের ভাবনার কত মিল। টোটেমগুলির শিল্পকার্য অসাধারণ আর রঙের বাহার চোখ কাড়ে। আবার চলা, বাসে বসেই দেখা হল সুন্দর সাজানো ছবির মতো সিটি পার্ক। দূর থেকে দেখা হল ডলিস হাউস মিউজিয়াম। এবার আমাদের গাড়ি ডাঙা ছেড়ে সমুদ্রের জলে নামল, ভেসে চলল নৌকোর মতো, বেশ মজার ব্যাপার। সমুদ্রের বুকে দেখা গেল প্রচুর ঈগল পাখি উড়ছে। অসংখ্য সামুদ্রিক যানে সমুদ্রসৈকত পূর্ণ। বেলা দুটো নাগাদ জাহাজে ফিরে লাঞ্চ খেয়ে জাহাজের থিয়েটার হলে ম্যাজিক দেখা হল।

পরের দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আবার ডাঙায় অবতরণ। গাড়ি চড়ে রওনা হলাম আলাস্কার রাজধানী জুনের পথে। ছিমছাম সুন্দর শহর। পথের দুধারে নানা বস্তুসম্ভারের দোকান– জুয়েলারি শপ, স্যুভেনির শপ, গিফট শপ, রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টগুলিতে কাঁকড়া আর লোকাল মাছের বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। গাড়ি থেকেই দেখতে পেলাম পৃথিবীখ্যাত ও বহুপ্রাচীন রেডডগ সেলুন। জুনে শহরে প্রাচীন কালে রেডডগই ছিল একমাত্র রেস্তোরাঁ ও পানশালা। দেখা হল এখানকার গভর্নর হাউস। জাহাজ ছাড়া বিমানে বা স্থলপথেও জুনেতে আসা যায়। এটি দ্বীপ নয়।

শহর ছাড়িয়ে পথ ধরা হল টনগাস ন্যাশনাল রেইন ফরেস্ট অভিমুখে, নর্থ ভ্যালি অর্থাৎ উত্তর দিকের পথ। দুধারে হেমলগ ক্রুশ ও পাইনের সবুজ চিরে চলা। যেতে যেতে দেখা গেল আলাস্কা উপসাগরে মাছ ধরা নৌকোর ছড়াছড়ি, বোট হাউসও রয়েছে। আর বহুদূরে দেখা যাচ্ছে তুষারে মোড়া পর্বতশ্রেণি। ক্রমে পৌঁছোলাম মেনডেন হল লেকের কাছে, ভিজিটর সেন্টারে। একটু এগিয়েই চমকপ্রদ মুগ্ধতায় তাকিয়ে রইলাম। সুবিশাল বরফের গ্লেসিয়ার লেকের জলে নেমে এসেছে। নানারঙের বিচ্ছুরণে গ্লেসিয়ারের মোহময়ী রূপ দেখে অপলক তাকিয়ে থাকা। সারা হ্রদের জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে শ্বেত হংসের মতো শুভ্র তুষার খণ্ড, অনবদ্য দৃশ্য। হ্রদের চারপাশে অনেক সরু সরু পায়ে চলা পথ। সেই স্নিগ্ধ মায়াময় পথ ধরে ঘুরে ঘুরে নানাদিক থেকে দেখলাম গ্লেসিয়ারের রূপ। মন ভরে গেল। এই পথ ধরেই চলে গেলাম নাগেট ফলসের কাছে, হিমশীতল জল নিয়ে প্রবল উচ্ছাসে ঝরে পড়ছে ঝরনাধারা, নিমেষ হারা সৌন্দর্য। এবার ফেরার পথ ধরা। ভিজিটর সেন্টারে ফিরে এসে, ওখানকার হলে ঢুকে দেখা হল গ্লেসিয়ার ও জুনের তুষারক্ষেত্রের উপর ফিলম শো। এরপর যাওয়া হল ডগলাস আইল্যান্ডে। সেখান থেকে দেখা হল সাগরের ধার ধরে জুনে শহরের প্যানোরামিক দৃশ্য। এইখানে একসময় খনির শ্রমিকদের বসবাস ছিল। এবার জাহাজে ফেরা।

পরের দিন জাহাজ নোঙর করল স্যাগওয়ে সিটির হারবারে। ব্রেকফাস্টের পর জাহাজ থেকে নেমে আমরা একটি ঐতিহাসিক হলুদ বর্ণের গাড়িতে উঠলাম সিটি টুরের উদ্দেশ্যে। ১৯২০ সালে জুনের ভ্রমণকারীদের জন্য এই রকম মোটরগাড়ির ব্যবস্থা ছিল এবং এই ঐতিহাসিক টুর বিশেষ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিল। ১৯২৭ সালে যে-হলুদ বর্ণের গাড়িতে করে তখনকার ভ্রমণকারীরা ভ্রমণ করতেন, এটি সেই ঐতিহাসিক গাড়ি এবং তখনকার চালকের মতো পোশাক পরিহিতা আমাদের আজকের চালিকা। শহরের চারিদিকের পাহাড়গুলি সাদা বরফের টোপর মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ভিন্টেজ টুরে আমরা শহরের বাড়িঘর, দোকানবাজার দেখতে দেখতে পৌঁছোলাম একটি হলে। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে এখানকার গোল্ড রাশের সময়কার নানা প্রাচীন বস্তু সামগ্রী। একজন ভদ্রলোক আমাদের গোল্ড রাশের ইতিহাস বললেন– আলাস্কার পাহাড়ের উপর ক্লোন ডাইক নদী, যেখানে ইউকোন নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সেইখানেই নদীর দক্ষিণ পাড় ধরে সোনার সন্ধান পাওয়া যেত। তবে ১৮৯৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম পাকাপাকি ভাবে সোনার সন্ধান মেলে। সোনার প্রথম আবিষ্কারক স্কুকুম জিম ও তাঁর ভাইপো ডাওসন চার্লি। অনুমান করা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে আগ্নেয়গিরির লাভার সঙ্গে সোনা উঠে আসে এবং নদীর খাতে জমা হয়। পরে নদীর স্রোতধারার সঙ্গে মিশে সেই সোনা নদীর ধারে ধারে আবিষ্কৃত হয়। ক্লোন ডাইক নদী এই সোনা বহন করা নদী। মনে পড়ে আমাদের দেশের সুবর্ণরেখা নদীতেও প্রাচীনকালে সোনা পাওয়া যেত।

সেই সময় আমেরিকায় খুব অর্থাভাব চলছিল, ফলে দলে দলে লোক সোনার সন্ধানে স্যাগওয়ে শহরে আসে। কারণ এই শহর থেকেই পৌঁছোনো যাবে সোনার সন্ধানে তুষারাবৃত পাহাড়ি পথে, যার নাম হোয়াইট পাস ট্রেইল। প্রায় লাখ খানেক লোক এসে পড়ল এই ছোট্ট শহরে। সোনার আশায় পাগলের মতো চড়তে লাগল বরফে মোড়া ভয়ংকর পাহাড়ি পথে, কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ পায়ে হেঁটে। পথেই মারা পড়েছিল তিনভাগ লোক। পৌঁছোতে পেরেছিল ৩০-৪০ হাজারের মতো মানুষ। তার মধ্যে আগে পৌঁছোনো ৪০০০ জনেরই হস্তগত হয়েছিল সোনা। ফলে লাগল নিজেদের মধ্যে লড়াই। মারামারি করেও মারা গেল বেশ কিছু মানুষ, ফ্র্যাংকরেইড আর সোপিস্মিথের গান ফাইট বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল এই প্রেক্ষিতে।

পরবর্তীকালে এই পথে রেললাইন বসানো হয় এবং স্বর্ণ উত্তোলনের জন্য সরকারি ব্যবস্থা চালু হয়। সাধারণ লোকেদের জন্য এই পথ বন্ধ হয়ে যায়। আধুনিক মাইনিং ব্যবস্থার দ্বারা সোনা উত্তোলন শুরু হয়। ১৯০৩-২০০৫ স্বর্ণ উত্তোলন অব্যাহত থাকে এবং ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৭০ হাজার কেজি সোনা উত্তোলন হয়। এখন অবশ্য আর সোনা পাওয়া যায় না।

তবে এখনও এই রেললাইন বর্তমান আছে। রেল লাইন ও ইঞ্জিন আমরা দেখলাম। এখন হোয়াইট পাস ট্রেইল বা হোয়াইট পাস রেলওয়ের সমান্তরাল হাইওয়ে তৈরি হয়েছে– যার দ্বারা ৩,২৯২ ফুট উপরে ওঠা যায়। পথে পড়ে বরফের গ্লেসিয়ার, বরফজলের ঝরনাধারা ইত্যাদি এবং উপরে উঠলে দেখা যায় ব্রিটিশ কলোম্বিয়া ও কানাডা ভ্যালি। কিন্তু এই পথে যাবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। এরপর যাওয়া হল বুটসহিলের উপর গোল্ড রাশের সময় যারা মারা গিয়েছিলেন তাঁদের সমাধিক্ষেত্র দেখতে। এই সমাধিক্ষেত্রে গান ফাইটার দুজনেরও সমাধি রয়েছে। স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ কাড়ে। এবার জাহাজে ফেরা।

জাহাজে ফিরে লাঞ্চ করে ঘরে বিশ্রাম করছি। হঠাৎ শুনলাম, আমাদের জাহাজ নাকি একটা বিশাল গ্লেসিয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব দৌড় দৌড়, জাহাজের উপরে উঠলাম। একদম কাছ থেকেই দেখা গেল বিশাল গ্লেসিয়ার, তার সামনে অপূর্ব নীল সমুদ্রের জল স্থির হয়ে রয়েছে। মোহমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

পরের দিন শুধুই ভেসে চলা সাগরের বুকে, চারিদিকের তুষারমুকুট পরা পাহাড় দেখতে দেখতে। তারপরের দিন আমাদের জাহাজ নোঙর করল ভিক্টোরিয়া কলোম্বিয়ার হারবারে। সিটির নাম ভিক্টোরিয়া-ক্যাপিটাল অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া। আমরা গাড়ি করে ভিক্টোরিয়া সিটির পথে বের হলাম, জাহাজ থেকে নেমে। কানাডার একেবারে দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে এই শহর। কুইনের নামে নাম রাখা হয় ভিক্টোরিয়া। এখানে ব্রিটিশরা বসতি স্থাপন করে ১৮৪৩ সালে। ভিক্টোরিয়া উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো আফিং সরবরাহ কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং এই ব্যাবসার জন্যই তখন ভিক্টোরিয়া শহরের এত রমরমা হয়। হংকং থেকে আফিং আমদানি করে এনে সমগ্র উত্তর আমেরিকায় আফিং সরবরাহ করা হতো। ভিক্টোরিয়া হারবারের সামনেই ঐতিহাসিক বিশাল হোটেল ‘এমপ্রেস’।

১৮৯৮ সালে এখানে পার্লামেন্ট গৃহের উদ্বোধন হয়। যেমন বিশাল তেমনি অপরূপ সুন্দর স্থাপত্য। পার্লামেন্টের সামনে মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্ট্যাচু রয়েছে। ওখানকার পার্লামেন্ট হাউসটিকে দেখে মনে হল কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বিশাল সংস্করণ। এবার গেলাম এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য ক্রেইডারোচ ক্যাসল। এই প্রাচীন ক্যাসেলটি এখানকার প্রধান দর্শনীয়। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৮৭-১৮৯০ সালে।

এরপর যাওয়া হল বেশ উঁচুতে মাউন্ট টলমি পার্ক দেখতে। টলমি পার্ক থেকে সারা শহরের এবং হারবারের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। আর দেখতে পেলাম বরফে মোড়া একটি অপরূপ সুন্দর পর্বতশৃঙ্গ। গাইড বললেন এটি নাকি মৃত আগ্নেয়গিরি। ভিক্টোরিয়া শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর বাগান আছে। তবে সবগুলি তো দেখা সম্ভব নয়। আমরা একটি বাগান দেখলাম। ফুল আর গাছের সবুজায়নে অপরূপ করে সাজানো। এবার জাহাজে ফেরা। পরের দিন সকালেই শেষ হল আমাদের জাহাজ যাত্রা, ফিরে এলাম সিয়াটলের বন্দরে। আলাস্কার সুন্দর দৃশ্যগুলি ধরা রইল স্মৃতির অ্যালবামে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...