আপনি বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার কর্মীই হোন, বা বিজ্ঞাপন চিত্রের মডেল। নিজের ব্যক্তিত্বকে ঠিকঠাক উপস্থাপিত না করতে পারলে, আপনার পেশাদারী দক্ষতা ফিকে হয়ে যাবে। অ্যাটিটিউড-ই সেই মন্ত্র যা আপনাকে রঙিন করে তুলতে পারে। তবে সুন্দর অ্যাটিটিউড তৈরি করাটা রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য চাই গ্রুমিং। যা আপনার চলনবলন, আদবকায়দা, ড্রেসিং সেন্স এবং সর্বোপরি নিজেকে ক্যারি করার পদ্ধতিটা সহজতর করে দেবে। যে-কোনও পেশার জন্য, শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষাটাই যথেষ্ট নয়। যুগোপযোগী হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তই হল নিজেকে প্রেজেন্টেব্ল করে তোলা।

সফ্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট এযুগের নবতম ক্রাইটিরিয়া। তাই গ্রুমিং এক্সপার্ট বা সফ্ট স্কিল এক্সপার্ট-এর পরামর্শ নিয়ে অনেকেই নিজের ব্যক্তিত্বে যুক্ত করছেন স্মার্টনেসের পরত। একটা কথা ভুললে চলবে না যে, ‘ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইমপ্রেশন’। অর্থাৎ আপনার প্রথম প্রভাবই শেষ প্রভাব, ‘পহেলে দর্শনধারী পিছলে গুণবিচারী’। আর ঠিক এই কারণেই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে গ্রুমিং এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সঠিক গ্রুমিং না হলে, যতই যোগ্যতা থাকুক আর যতই আপনি সৌন্দর্য শ্রেষ্ঠা হোন– প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা মুশকিল। আবার পার্টিতে গেলেও সাজগোজে যতই পারফেক্ট হোন, সঠিক এটিকেট না জানলে আপনি হাস্যাস্পদ হয়ে উঠতে পারেন।

জনপ্রিয় মডেল তথা গ্রুমিং কনসালট্যান্ট জেসিকা গোমস্-এর মতে, গ্রুমিংই হল সাফল্যের চাবিকাঠি।

গ্রুমিং মূলত তিন ধরনের হয়। প্রফেশনাল, মডেল এবং সোশ্যাল গ্রুমিং।

প্রফেশনাল গ্রুমিং

ধরা যাক একটি বহুজাতিক সংস্থা থেকে আপনার কাছে ইন্টরভিউয়ের ডাক এসেছে। আপনি কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়াই আপনার সেরা ড্রেস এবং যেমন তেমন সাজগোজ করে পৌঁছে গেছেন ইন্টারভিউ দিতে। দেখা গেল প্রথম অ্যাপিয়ারেন্স-এই আপনি নাকচ হয়ে গেলেন সচেতনতার অভাবের কারণে। ঠিক এই কারণেই একটু সফ্ট স্কিল ট্রেনিং এবং গ্রুমিং-এর একটি কোর্স আপনার করে আসার প্রয়োজন ছিল। কলকাতার আর এক গ্রুমিং কনসালট্যান্ট সুচিতা রায়চৌধুরীর মতে, ইন্টারভিউয়ের আগে অনেকগুলি ধাপে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। আবেদনময়ী হয়ে ওঠার অনেকগুলি ধাপ পেরোতে হবে।

প্রফেশনাল গ্রুমিং-এর প্রথম ধাপই হল জব অ্যাপ্লিকেশন লেখা। সজাগ থাকবেন, এই দরখাস্তে যেন ব্যাকরণগত বা বানান ভুল না থাকে। নিজের প্রোফাইল অনুযায়ী অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ-সহ আবেদন করুন। সঙ্গে থাকবে সিভি। এগুলি পারফেক্ট করার শিক্ষাই দিয়ে থাকেন সফ্ট স্কিল এক্সপার্টরা।

এরপরের ধাপ হল ড্রেসিং ফেস। জেসিকার মতে ড্রেসিং এমন হওয়া উচিত, যা মুখ খোলার আগেই আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংস্থার এক্সিকিউটিভদের একটা প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেবে। অর্থাৎ নিজেকে এতটাই কনফিডেন্স-এর সঙ্গে ক্যারি করতে হবে, যা অন্যদের মনে একটি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করবে। পোশাকের রং বাছতে হলে অতিরিক্ত রংচঙে জামাকাপড়ের বদলে সোবার রঙের পোশাকই বাছুন।

তৃতীয় ধাপ হল বডি ল্যাংগুয়েজ ও প্রেজেন্টেশন। অর্থাৎ যে-বিষয়ের উপর কাজ করবেন বলে আপনাকে ডাকা হয়েছে, সেই বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করুন। আপনার বডি ল্যাংগুয়েজে যেন আত্মবিশ্বাস নজরে আসে, নার্ভাসনেস নয়। ব্যস, জীবনটাকে রঙিন করে তুলতে এই গ্রুমিংই কেল্লাফতে করবে ইন্টারভিউ বোর্ডে।

সোশ্যাল গ্রুমিং

এবার আসা যাক সোশ্যাল গ্রুমিং-এর প্রসঙ্গে। কারণ মডেল গ্রুমিং কেবল নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের পেশাদার হওয়ার জন্যই প্রয়োজন হয়। কিন্তু সোশ্যাল গ্রুমিং আধুনিক সমাজের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মডেল নয়নিকা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সোশ্যালাইজ করাটা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই অপরিহার্য। কিন্তু যেখানে পেশাদারি কারণে সোশ্যালাইজ করার প্রয়োজন হয়, সেখানে কিছু বিশেষ এটিকেট মেইনটেন করা জরুরি। এমন অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে কার্যক্ষেত্রে, এমন সব অপ্রিয় মানুষজনের সঙ্গে দেখা করতে হয়, যে সবসময় তা সুখকর হয় না। কিন্তু গ্রুমিং-এর ট্রেনিং থাকলে এই সব পরিস্থিতি অনায়াসে সামলানো যায়।

যে-কোনও পেশায় আপনার ব্যক্তিত্ব এবং অ্যাটিটিউড অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। ব্যক্তিত্ব ধরে রাখা মানে কিন্তু অযথা গম্ভীর হয়ে থাকা নয়। হাসিখুশি স্বভাব ও ভরপুর আত্মবিশ্বাস হল ব্যক্তিত্বের প্রাথমিক শর্ত। সেইসঙ্গে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ– এটাই হল আপনার সেরা প্লাস পয়েন্ট।

পোশাকে পারফেক্ট

সোশ্যাল গ্রুমিং-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল পোশাক। সুচিতা জানালেন, পোশাকের ক্ষেত্রে যেটা সবসময় মাথায় রাখা জরুরি, সেটা হল পোশাকটি কোথায়, কী অনুষ্ঠানে পরা হচ্ছে। সেটার উপরই নির্ভর করবে কী ধাঁচের এবং কোন রংয়ের পোশাক পরবেন। কিছুটা ফর্ম্যাল লুক-এও শাড়ি পরা যায় কিন্তু তার প্লিট এবং পিন দুটোই সুন্দর করে করতে হবে। ব্লাউজের সঙ্গে ব্রা-এর ফিটিংটাও যেন পারফেক্ট হয়। ঢলঢলে ব্লাউজ ও অন্তর্বাস– দুটোই অশোভন ও বিসদৃশ। যারা লম্বা, তাদের আড়ের দিকে অর্থাৎ ভার্টিকাল স্ট্রাইপ বা ডুরে পরা উচিত নয়। অনুচ্চ মহিলাদের পক্ষে আবার এটাই আদর্শ। হাইট ভালো হলে গাঢ় রঙের পোশাক স্বচ্ছন্দে পরুন। একটু ভারিক্বি চেহারা হলে জমকালো প্রিন্ট বা জংলা নকশার পোশাক এড়িয়ে চলুন। ফরসা রঙে কালো বা বেগুনি একটু বেশি লাউড লাগে। ফর্মাল ওয়্যারে এগুলি এড়িয়ে চলুন। গায়ের রং শ্যামলা হলে ফ্লুরেসেন্ট কালার্স অ্যাভয়েড করুন।

মোবাইল ম্যানার্স

নয়নিকার সাজেশন, মোবাইল দামি হওয়াটাই বড়ো কথা নয়, সেটা মেইনটেন করার কিছু এটিকেট আছে। মনে রাখবেন মোবাইল ব্যবহারের এটিকেট আপনার ব্যক্তিত্বকে শানিয়ে তুলতে পারে। মোবাইলে কথা বলার সময় বেশি চিৎকার করে কথা বলবেন না। কোনও সিনিয়র বা গুরুত্বপূর্ণ লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় কল রিসিভ করবেন না। বাড়িতে গেস্ট এলে তাদের বসিয়ে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে কথা বলে যাবেন না। পার্টি বা মিটিং-এ হয় ফোন বন্ধ রাখুন অথবা সাইলেন্ট মোডে রাখুন। যদি এমার্জেন্সি কল হয়, তাহলে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটু আলাদা জায়গায় সরে গিয়ে সংক্ষেপে কথা সারুন। প্রফেশনাল জগতের মানুষজনের ফোন রিসিভ করার সময় প্রথমেই উইশ করতে ভুলবেন না। আবার ফোন কাটার আগে ‘বাই’ বা ‘গুডনাইট’ বা ‘হ্যাভ আ নাইস ডে’ বলাটাও শিষ্টাচার। কাউকে সম্বোধন করার সময় নাম বা পদবীর আগে মিস্টার, মিস বা মিসেস সম্বোধন করাটাও প্রফেশনাল এটিকেট। ফোন রিসিভ করতে না পারলে একটা ‘সরি’ মেসেজ পাঠাতে ভুলবেন না।

টেবল ম্যানার্স

সোশ্যালাইজ করতে গেলে টেবল ম্যানার্স সঠিকভাবে জানাটাও একান্ত জরুরি। একজন সফল প্রফেশনাল এবং সার্থক সোশ্যালাইট হতে গেলে এই ট্রেনিংটাও অত্যন্ত আবশ্যক। টেবিলে বসার সময় ন্যাপকিন খুলে কোলের উপর ছড়িয়ে তবে খাওয়া শুরু। খাবার খাওয়ার সময় মুখ মোছার প্রয়োজন হলে, ন্যাপকিন বা টিশু ব্যবহার করুন। সুপ খাবার সময় সুপের বাটির খুব কাছে মুখ নামিয়ে আনবেন না। ছুরি-কাঁটা-চামচের শব্দ তথা খাবার চেবানোর শব্দ না করে খাওয়ার অভ্যাস করুন। অফিস, পার্টি, ক্লাব, গেট-টুগেদার বা ঘরোয়া পার্টি যেখানেই উপস্থিত থাকুন, সবার সঙ্গে ঘুরে ফিরে কথা বলুন। প্রত্যেক গেস্ট-এর সঙ্গে অন্যান্যদের পরিচয় করিয়ে দিন। গেস্টরা চলে যাওয়ার সময় আসার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান।

টকিং টার্মস

সফল প্রফেশনাল বা সোশ্যালাইট হওয়ার জন্য বাকপটু হওয়ার দরকার নেই। তবে যথাসম্ভব গুছিয়ে কথা বলুন। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা এড়িয়ে চলুন। উচ্চস্বরে কথা বলবেন না। অন্যের আলোচনার মধ্যে অতর্কিতে ঢুকে পড়বেন না। একজনের কথা শোনার সময় তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে মনোনিবেশ করবেন না। কথা শুনতে শুনতে ‘হ্যাঁ-না’ বলুন ও অন্যজনের বলা শেষ হলে তবেই আপনার মতামত দিন। যে-কোনও ভাষায় কথা বলার সময় সঠিক শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগ করুন। মানে না জেনে ভুল শব্দ উচ্চারণ করবেন না। নিজের অ্যাকসেন্ট ও উচ্চারণ শুধরোনোর জন্য সফ্ট স্কিল ট্রেনিং খুব জরুরি। অডিয়ো চালিয়ে সঠিক উচ্চারণের অভ্যাস করতে পারেন। হালফিল দুনিয়ার খবরাখবর রাখুন। কাগজ ম্যাগাজিন পড়ে সাম্প্রতিক সময়ের হালহকিকত জেনে রাখুন। অন্যের বলা কথা বা মতামতকে নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করবেন না। কোনও বিষয়ে অল্প জেনে অযথা নিজেকে জাহির করতে গিয়ে নিজের অজ্ঞনতাকেই প্রকাশ করে ফেলবেন না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...