অফিসে আজকে সকলের মুখে হাসি। হবেই বা না কেন? অফিসের সব কর্মচারীদের আজকে ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। একমাত্র মৌসুমির মুখে হাসি নেই। তিথি কারণ জিজ্ঞেস করতেই মৌসুমির বিস্ফোরক মন্তব্য, আমার রোজগারের উপর আমার নয়, আমার পুরো শ্বশুরবাড়ির অধিকার রয়েছে।
ইনক্রিমেন্ট মানেই বেশি কাজের দায়িত্ব, কিন্তু আমি কী পাব, কিছু না। প্রতি মাসে আমার স্বামী, বাচ্চাদের দেওয়ার মতো করে আমার হাতে চার হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করলেই বলেন, সবই তো পাচ্ছ, কী করবে পুরো টাকাটা দিয়ে বেকার খরচা করা ছাড়া।
মৌসুমি একলা নয়। সব বাড়িতেই এরকম মহিলারা রয়েছেন যারা নিজেরা রোজগার করলেও আর্থিক ভাবে স্বতন্ত্র হওযার স্বাধীনতা নেই। স্বামী এবং পরিবারের কাছে রোজগারের যন্ত্র ছাড়া তারা আর কিছু নন। তার টাকা কীভাবে খরচ করা হবে, কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মৌলিক অধিকার যেন শুধু স্বামীরই রয়েছে।
জয়িতারও অবস্থা মৌসুমির থেকে আলাদা নয়। জয়িতার স্যালারি আসতে আসতেই নানা খাতে সেটা ভাগ হয়ে যায়। বাচ্চার স্কুলের ফিজ, বাড়ির লোন-এর কিস্তি, আর বাড়ির খরচ সব জয়িতার স্যালারিতে হয়। অথচ জয়িতার স্বামী প্রদীপের রোগগারের টাকা কী হয় তা প্রদীপ ছাড়া কেউ জানে না।
প্রত্যেক ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানিং করা, আত্মীয়স্বজনদের জন্য উপহার কেনা, স্ত্রী-বাচ্চাদের জন্য জামাকাপড় সব প্রদীপই কেনে। ফলে বাড়ি এবং বাইরের লোকের কাছে প্রদীপের মতো ছেলে হয় না। অথচ জয়িতার বেলায় প্রদীপ বলে, মেয়েদের মেক-আপ, লিপস্টিকের খরচা আটকাবার একটাই উপায় হল ওদের স্যালারির উপর লোন ইত্যাদি নিয়ে নাও।
জয়িতা মাসে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করেও নিজের পছন্দের না-কিছু কিনতে পারে আর না-তো ইচ্ছেমতো কাউকে কোনও গিফট দিতে পারে। এত রোজগার করেও ও স্বামীর উপর নির্ভরশীল।
মৌসুমি এবং জয়িতা, দুজনেরই অবস্থা প্রমাণ করে যে এরা, এই যুগেও গোলামির শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। মানসিক ভাবে স্বতন্ত্র হওয়ার অধিকার দুজনেরই নেই। এরা এটাও জানে না নিজেদের রক্ত জল করা রোজগারের টাকা কীভাবে কোথায় খরচা করবে।
এটা বলাও বোধহয় ভুল হবে না যে জয়িতা, মৌসুমির মতো মহিলাদের অবস্থা, আর্থিক ভাবে যারা আত্মনির্ভর নয় তাদের থেকেও আরও খারাপ। কখনও স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় আবার কখনও ভয়ে তারা তাদের আর্থিক স্বতন্ত্রতার মূল রসদই স্বামীর হাতে তুলে দেয়। এই কাজ কখনওই ঠিক কাজ নয়।
বর্তমান যুগে আমাদের জীবনের গাড়ি তখনই সাবলীল ভাবে চলবে যখন দুজন জীবনসঙ্গীই আর্থিক ভাবে আত্মনির্ভর হতে পারবে। গাড়ির দুটো চাকা সমান না হলে যেমন গাড়ির চলা বন্ধ হয়ে যাবে ঠিক তেমনি সংসারে স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে সমতা থাকলে তবেই জীবন মসৃণ ভাবে কাটতে পারবে। এই ছোটো ছোটো কথাগুলো যদি মনে রাখেন তাহলে নিজের রোজগার পছন্দমতো খরচ করতে পারবেন।
ভালোবাসার মানে গোলামি নয় :
মহিলারা স্বাভাবিক ভাবেই কোমল এবং আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। ভালোবাসার খাতিরে নিজের রোজগার স্বামীর হাতে তুলে দিতে তাদের দ্বিধা হয় না। পুরুষ নিজের রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীয়ের রোজগারও নিজের হিসেব মতো খরচ করে। বিযের প্রথম প্রথম এই প্রথা মেয়েরা খুশিমনে মেনে নিলেও তিন-চার বছর বিয়ে হয়ে গেলে তখন মেয়েদের মনে আপশোশ জন্মায়। স্বামীর হাতে পুরো রোজগারের টাকা বা এটিএম কার্ড ধরিয়ে দেওয়া ভালোবাসা বা বিশ্বাসের নয়, গোলামির পরিচায়ক।
নিজের উপর খরচ করা আপনার মৌলিক অধিকার :
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিয়ের পর মেয়েরা নিজেদের জন্য কিছু খরচ করতে অস্বস্তি বোধ করে। তারা মনে করে নেয় সংসারের দাযিত্বই তার কাছে মুখ্য। নিজের জন্য খরচা করতে বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যেতে তারা পঞ্চাশবার ভাবে যে, সংসার বা স্বামীকে সে ঠকাচ্ছে না তো। এই মানসিকতা বদলাতে হবে। আপনার সর্বপ্রথম দায়িত্ব নিজের খেয়াল রাখা সুতরাং নিজেকে খুশি রাখা আপনার মৌলিক অধিকার।
ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করুন :
জীবন আপনার তাই জীবনের সুতোটা নিজের হাতে রাখুন। বিয়ে মানে স্বামীর ভরসায় সব ছেড়ে দিয়ে হাতে হাত রেখে বসে থাকা নয়। নিজের ভবিষ্যৎ-কে সুরক্ষিত রাখা আপনার দায়িত্ব। নিজের রোজগারের সঠিক বিনিয়োগ করে ভবিষ্যতের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করুন।
নিজের অবস্থা বুঝে দেওয়া-নেওয়া করুন :
অনেক সময দেখা যায় স্ত্রীয়ের রোজগারের জন্য স্বামী মিথ্যা স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে দামি দামি গিফট দিয়ে বসে বিয়েতে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে। আপনার উচিত স্বামীকে বাধা দেওয়া। বাপের বাড়ি হোক বা শ্বশুরবাড়ি, সবজায়গায় একইরকম গিফট দেওয়া উচিত এবং নিজের পকেট বুঝে গিফট কেনা বাঞ্ছনীয়।
বুঝেশুনে বিনিয়োগ করা উচিত :
বুঝেশুনে বিনিয়োগ করুন কারণ এটা আপনার পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ। আপনি শেয়ার কিনবেন, নাকী বন্ড কিনবেন, না প্রপার্টি-তে টাকা ঢালবেন এই নির্ণয় নেওয়ার অধিকার শুধুমাত্র আপনার। স্বামীর থেকে অবশ্যই পরামর্শ নিন কিন্তু তার উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন না।
অর্থই বলবান :
শুনতে তেতো লাগলেও এটাই সত্যি। আপনার কাছে টাকা আছে মানে শ্বশুরবাড়িতে সম্মান আছে। স্বামীও ভুল কিছু করার আগে দশবার ভাববে। কারণ তার অজানা নয় যে জীবনের লাগাম আপনার হাতেই ধরা আছে। স্বামী ভুল করলে শোধরাবার চেষ্টা করুন কিন্তু ব্যর্থ হলে দ্বিধা না করে ছেড়ে চলে যান। স্বামীরা এটুকুও খুব ভালো করেই জানে যে তার স্ত্রীয়ের সঞ্চিত অর্থ স্ত্রীয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নিজেরও বার্ধক্যের লাঠি হযে উঠবে।