আজকাল নানা উপায়ে পরিবার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে কারা কোন উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পছন্দের উপরেই নির্ভর করে। অবশ্য সবার জন্য সব উপায় উপযুক্তও নয়। কারণ প্রত্যেক উপায়েরই ভালোমন্দ দুটি দিক আছে। তাই কোনও উপায়কে মাধ্যম করার আগে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
অস্থায়ী উপায়
যতদিন আপনি সন্তান চাইবেন না, ততদিন পরিবার নিয়ন্ত্রণের কোনও একটি উপায়কে মাধ্যম করার পদ্ধতিটিকেই বলা হয় অস্থায়ী উপায়। এই উপায়ের মধ্যে রয়েছে কন্ডোম ও কপার টি-র ব্যবহার, গর্ভনিরোধক পিল সেবন, জেলির ব্যবহার প্রভৃতি। এছাড়া রয়েছে মাসের মধ্যে কয়েকটি সুরক্ষিত দিন এবং স্খলনে নিয়ন্ত্রণ।
সুরক্ষিত দিন
মহিলাদের ২৮ দিনের যে ঋতুচক্রের ধারা আছে, সেই ঋতুচক্রের মধ্যে প্রথম ১০ দিনের পর গর্ভাশয়ে ডিম্বাণু তৈরি হয়। তাই প্রথম ৯ দিন পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে, কনসিভ করার সম্ভাবনা কমে যায়। সেইসঙ্গে ২০ থেকে ২৮ দিন পর্যন্তও কনসিভ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়। অতএব ওই দিনগুলিতে আপনারা অনেকটা সুরক্ষিত। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সব মহিলার ঋতুচক্রের সময়সীমা এক থাকে না। তাই যদি ঋতুচক্রের সময়সীমার হেরফের ঘটে, তাহলে সুরক্ষিত দিনগুলির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
স্খলনে নিয়ন্ত্রণ
এই পদ্ধতিকে বলা হয় স্বনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। স্খলনের আগে পুরুষাঙ্গকে স্ত্রী অঙ্গের বাইরে নিয়ে আসার মাধ্যমেও স্খলনে নিয়ন্ত্রণ আনা যায় এবং গর্ভরোধ করা যায়। তবে অনেক সময় স্খলনের আগে নির্গত স্বচ্ছ স্রাবের মধ্যেও স্পার্ম থাকে এবং সেই স্পার্মও গর্ভসঞ্চার করতে পারে। তাই এই পদ্ধতিতে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
কন্ডোম
পুরুষের ব্যবহারযোগ্য একটি উপকরণ এটি। যৌনসম্পর্ক স্থাপনের আগে পুরুষাঙ্গে ব্যবহার করা হয় এই কন্ডোম। এর ব্যবহারে যৌনক্রিয়ার সময়, বীর্য কন্ডোমের ভিতর পড়ে এবং গর্ভাশয়ে শুক্রাণু পেৌঁছোতে পারে না। ফলে গর্ভসঞ্চারেরও সম্ভাবনা থাকে না। শুধু তাই নয়, এই কন্ডোমকে যৌনরোগের সুরক্ষা কবচও বলা হয়। যেহেতু পুরুষাঙ্গের উপর পাতলা আবরণ (কন্ডোম) থাকছে, তাই পুরুষ কিংবা স্ত্রীর কোনও যৌনরোগ থাকলে তা অন্যের দেহে সংক্রামিত হয় না। তবে একটি কন্ডোম একবারের বেশি ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ একাধিকবার একই কন্ডোম ব্যবহার করলে তা যেমন ফুটো হয়ে শুক্রাণু যোনিপথে গর্ভাশয়ে গিয়ে ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনই সংক্রমণের কারণও হতে পারে।
গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট
কেবলমাত্র মহিলারাই গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট বা পিল ব্যবহার করেন। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন নামক দু’ধরনের হরমোনের সমন্বয়ে তৈরি হয় এই গর্ভনিরোধক পিল। তাই পিল ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পিল খাওয়া উচিত। কারণ, বাজারে নানারকম পিল পাওয়া যায়। কার কোন পিল সুফল দেবে, তা একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ঠিক করে দেবেন।
সাধারণত ২৮টি করে পিল থাকে একটি প্যাকেটে। ঋতুচক্রের প্রথম চারদিন বাদ দিয়ে, পাঁচদিন থেকে প্রতিদিন, একটি করে মোট ২৮টি ট্যাবলেট খেতে হবে। এভাবে যতদিন আপনি গর্ভধারণ করতে চাইবেন না, ততদিন এই গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট ব্যবহার করে যেতে হবে। তবে এক্ষেত্রে জেনে রাখা জরুরি যে, একটানা অনেকদিন পিল ব্যবহার করার পর, গর্ভধারণের জন্য যখন পিল খাওয়া বন্ধ করবেন, সাধারণত তারপর অন্তত তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগবে কনসিভ করতে। কারণ, দীর্ঘদিন পিল সেবনের প্রভাব থেকে যেতে পারে দু’তিন মাস।
কপার-টি
কপার-টি লাগানো হয় মহিলাদের গর্ভাশয়ে। তামা দিয়ে তৈরি টি-শেপের গর্ভনিরোধক এটি। এর উপর পলিথিনের একটি আচ্ছাদন থাকে। সাধারণত ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ গর্ভনিরোধকের কাজ করে কপার-টি। তিন বছর পর্যন্ত শরীরে রাখা যেতে পারে এটি। তিন বছর পরও যদি সন্তান না চান, তাহলে পুরোনো কপার-টি ফেলে, নতুন কপার-টি লাগিয়ে নিন। তবে প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, কপার-টি ব্যবহারের ফলে অনেক মহিলার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
স্থায়ী পদ্ধতি
পরিবার পরিকল্পনার স্থায়ী পদ্ধতিও রয়েছে। একটি বা দুটি বাচ্চার পর, পুরুষ বা স্ত্রী অপারেশনের দ্বারা স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ করাতে পারেন।
ভ্যাসেকটমি
এই বন্ধাত্বকরণ পদ্ধতি পুরুষদের জন্য। অত্যন্ত সহজ শল্যচিকিৎসার পদ্ধতি এটি। এই অপারেশনে বীর্যনালিতে গিঁট দিয়ে দেওয়া হয়। এরফলে শুক্রাণু নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং কন্ডোম ছাড়াই সম্ভোগের পূর্ণ আনন্দলাভ করা যায়। এই অপারেশনের পর কোনও বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না এবং শরীর দুর্বলও হয় না। কাজকর্ম করা যায় খুব স্বাভাবিকভাবে। তবে অপারেশনের পর তিন মাস কন্ডোম ব্যবহার করে সম্ভোগ করতে হয়। কারণ ওইসময় শুক্রাণু নির্গত হওয়ার সামান্য সম্ভাবনা থাকে। তাই মাসতিনেক কন্ডোম ব্যবহার করার পর, চিকিৎসক পরীক্ষা করে যদি বোঝেন, শুক্রাণু নির্গত হচ্ছে না, তখন নিশ্চিন্তে কন্ডোম ব্যবহার বন্ধ করতে পারেন।
টিউবেকটমি
মহিলাদের জন্যই এই অপারেশন পদ্ধতি। গর্ভাশয়ে যেখানে ডিম্বাণু তৈরি হয়, সেই নালিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই অপারেশনের মাধ্যমে। এরফলে শুক্রাণু ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায় না এবং গর্ভসঞ্চার হয় না। ডেলিভারির পরই এই অপারেশন করিয়ে নেওয়া ভালো।
ল্যাপ্রোস্কোপিক শল্যক্রিয়া
এই ধরনের শল্য চিকিৎসা, প্রসবের ৪৫ দিন বাদে অথবা গর্ভপাতের পর করা হয়। পেটে ছোট্ট একটি ছিদ্র করে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এই চিকিৎসা করা হয়। এখন এই ধরনের শল্যচিকিৎসার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। কারণ অপারেশনের পর হাসপাতালে থাকতে হয় না। তিনচার ঘণ্টা বাদেই বাড়ি ফেরা যায় এবং এক-দু’দিন পর থেকেই স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যায়।
অতএব জনসংখ্যা বৃদ্ধি রুখতে এবং আপনার পরিবারকে সুখী করার জন্য, পরিবার নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতিকে আপনি বেছে নেবেন, তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে।